গর্ভের সন্তান নষ্টের রায়ের পর তরুণীর আত্মহত্যা
সালিশ বৈঠকে গর্ভের সন্তান নষ্ট ও ৪০ হাজার টাকায় বিয়ে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত দেয়ায় অপমান-ক্ষোভে আত্মহত্যা করলেন ফেনীর ছাগলনাইয়ার তরুণী ময়না আক্তার ফেন্সি (১৮)। এ ঘটনায় ময়নার মা বাদী হয়ে আওয়ামী লীগ নেতাসহ ৮-১০ জনকে আসামি করে মামলা করেছে। লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ফেনী হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। সাত আট মাস ধরে পাশের বাড়ির একাধিক মামলার আসামি হানিফের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে ময়নার। গর্ভবতী হয়ে পড়লে তারা দু’জনে ফেনীর বদলগাজী এলাকার কাজী অফিসে গিয়ে গত ২২ মে গোপনে বিয়ে করে। বিয়ের কথা জানাজানি হলে হানিফ পিছু হটে এবং ময়নার সঙ্গে বিয়ে অস্বীকার করে বসে। শুরু হয় স্থানীয়দের মেয়েকে দোষারোপের পালা। তাকে দুশ্চরিত্রা হিসেবে আখ্যায়িত করে। এর সঙ্গে সুর মেলাতে থাকে আবদুল বারেকের ছেলে ও ময়নার স্বামী বোমা হানিফও। শেষ পর্যন্ত ময়নার মা মনোয়ারা বেগম মাহামায় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সাহাজান মিনুর দ্বারস্থ হয়। গত মঙ্গলবার রাতে মিনু দল বল নিয়ে ময়নার দাদুর বাড়িতে গিয়ে সালিশ বৈঠক বসান। বৈঠকে উল্টো ময়নাকে দায়ী করে গর্ভের সন্তান নষ্ট করার পরামর্শ দেয়ার পাশাপাশি ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে বিয়ে বিচ্ছেদের জন্য মেয়ের পরিবারকে শাসানো হয়। কিন্তু ময়নার পরিবার বিয়ের সামাজিক স্বীকৃতির দাবি জানালেও কেউ তাতে সায় দেয়নি। এতে ক্ষোভে অপমান সইতে না পেরে মঙ্গলবার গভীর রাতে ময়না ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। কথা হয় মায়নার মা মনোয়ারা বেগমের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে জানান, বিপদে পড়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি সাহাজান মিনুর কাছে ছুটে যাই। মঙ্গলবার রাতে হঠাৎ মিনু, মাটিয়াগোদা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সম্পাদক মীর কাইয়ুম, মিজি আলম, কাইয়ুম মেম্বার, আবদুল, সিরাজসহ গ্রামের কয়েকজন মাতব্বর ময়নার দাদুর বাড়িতে বৈঠক বসান। কিন্তু তারা আমাদের কোনো কথা শোনেনি। শুরুতেই তারা সাদা কাগজে আমার সই নেন। কাবিন ফেরত দিয়ে ৪০ হাজার টাকা ছেলের কাছ থেকে বুঝে নেয়ার রায় দেন। আমি তাদের বলেছি, ‘আমরা গরিব মানুষ। ইজ্জতটুকু আমাদের সম্বল। আপনারা আমাদের ইজ্জতের দাম দিন। আমার মেয়ে ক’মাস পর সন্তানের মা হবে। আপনারা দয়া করে আমার মেয়েকে হানিফের বউ হিসেবে স্বীকৃতি দেন। তারা আমার কথা আমলেই নেননি। তিনি বলেন, ‘রাত ১টার দিকে সালিশ বৈঠক শেষ হয়। সিদ্ধান্ত শুনে ময়না আমার গলা ধরে ভীষণ কান্না করে। এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুম থেকে উঠে দেখি আড়ার সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে ময়না ঝুলে আছে।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন এএসপি সার্কেল আবদুল মালেক মিয়া, ওসি আবু জাফর মোহাম্মদ ছালেহ্, ওসি (তদন্ত) আবুল খায়ের শেখ, এস আই আনোয়ার হোসেন এবং এসআই মাহবুব আলম সরকার। পরে মায়নার মা বাদী হয়ে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি সাহাজান মিনুসহ ৮-১০ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেছে। মামলায় বোমা হানিফসহ সালিশে উপস্থিত সবাইকে আসামি করা হয়েছে। তবে বুধবার বিকাল পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। পুলিশ জানায়, বোমা হানিফ চিহ্নিত সন্ত্রাসী। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। ওসি আবু জাফর মোহাম্মদ ছালেহ্ জানান, আত্মহত্যায় প্ররোচনার জন্য ৮-১০ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে। আমরা নাম বলতে চাই না। নাম বললেই তারা পালিয়ে যাবে। স্থানীয় মাটিয়াগোদা গ্রামের ইউপি সদস্য জমির উদ্দিন বাবু বলেন, সালিশ বৈঠকে অংশ নেয়া ব্যক্তিরা নিজেদের সমাজের মোড়ল দাবি করেন। তাদের রায় ময়না মেনে নিতে পারেননি। তারা বোমা হানিফের পক্ষ নিয়ে একতরফা রায় দিয়েছে। রাগে-ক্ষোভে-অপমানে মেয়েটি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। সালিশের সিদ্ধান্তের কারণে মেয়েটির মৃত্যু হয়েছে। ’ ইউপি চেয়ারম্যান গরিব শাহ হোসেন বাদশা বলেন, যা শুনেছি দেড় মাসের অন্তঃসত্ত্বা মেয়েকে এভাবে সালিশে অন্যায়ভাবে রায় দিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হল। বোমা হানিফ এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী। তার পক্ষ নিয়ে এলাকার সালিশদাররা কীজন্য এ অপকর্ম করল তা আমার বোধগম্য নয়।’ মহামায়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি সাহাজান মিনু বলেন, আমরা ফেন্সির মায়ের অনুরোধে রাতে তাদের বাড়িতে যাই। বিয়ের কাবিন হাতে পাওয়ার পর সামাজিকভাবে সিদ্ধান্ত দেয়া হবে বলে আমরা ওই বাড়ি থেকে চলে আসি। রাতে মেয়ে কি আত্মহত্যা করল, নাকি মেরে ফেলা হল তাকে, কিছু বুঝতে পারছি না। এলাকার কোন্দলের কারণে প্রতিপক্ষ ফাঁসাতে আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। আমরা ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করে বিয়ে বিচ্ছেদের রায়ে দেয়ার প্রশ্নই আসে না।’
No comments