ডাক্তার বনাম রোগীর স্বজন
রোগী শোনে না ডাক্তারের কথা, সন্তান শোনে না পিতামাতার কথা, কর্মী শোনে না রাজনৈতিক নেতার কথা, ছাত্র শোনে না শিক্ষকের কথা, কর্মচারী শোনে না কর্মকর্তার কথা, ঠিকাদার শোনে না ইঞ্জিনিয়ারের কথা। এই যে স্বেচ্ছাচারিতা, এটা মনে হয় সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিদ্যমান। একজন চিকিৎসক হিসেবে এটা বহুদিন ধরে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। গত ১৮ মে সেন্ট্রাল হাসপাতালে যে সহিংস ঘটনাটি ঘটে গেল, সেটার অন্তর্নিহিত রহস্য কী তা উদ্ঘঘাটন হওয়ার আগেই একটি ধ্বংসলীলা ঘটে গেল। সম্পদের ধ্বংস সেটা হয়তো পূরণ করা যাবে। ব্যক্তিত্বের অপমান মুখ বুজে সহ্য করা গেলেও চরিত্রের যে ধ্বংস বা কালিমা এটা কি উদ্ধার করা যাবে? সেদিন বাংলাদেশের এক নম্বর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কিছু শিক্ষার্থী যে ঘটনাটি ঘটাল, সেটা কখনও সমাজের কাছে কাঙ্খিত নয়। সেখানে অধ্যাপক মতিউর রহমান স্যারের মতো বিজ্ঞজন শিক্ষক, সারা দেশে এক নামে পরিচিত চিকিৎসক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ এবং ওই হাসপাতালের পরিচালনা কর্তৃপক্ষসহ আমার সন্তানতুল্য কিছু সদ্য পাস করা চিকিৎসকের ওপর যে অবমাননাকর, ন্যক্কারজনক আঘাত হানা হল, এটা কোনোক্রমেই আশা করা যায় না। রাস্তার গুণ্ডা-পাণ্ডা,
বখাটে ও মাদকাসক্তদের হাতে এ রকম ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের হাতে এ ঘটনা আমরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না। চিকিৎসক সম্বন্ধে ফরাসি লেখক, ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক ভলটেয়ারের একটা উক্তি আছে- ‘Men who are occupied in the restoration of health to other men, by the joint exertion of skill and humanity, are above all the great of the earth. They even partake of divinity, since to preserve and renwe is almost as noble as to create. তাছাড়াও পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই যেখানে ডাক্তারদের সম্মানের চোখে দেখা হয় না। যদিও এর মধ্যে ডাক্তারদের সম্মান আমার চোখে সবচেয়ে বেশি ছিল তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পশ্চিম জার্মানিতে, যা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে নেই। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নে ডাক্তারদের অবস্থান ছিল ঈশ্বরের নিচে, যিশুর ওপরে। কোনো রোগী হাসপাতাল থেকে ভালো হয়ে যাওয়ার পথে চিকিৎসক বা টিমকেই শুধু ধন্যবাদ দিতেন না, যাওয়ার সময় ওই সমাজের রীতি অনুযায়ী তিনটি ফুল এবং আনুষঙ্গিক কিছু উপহার অবশ্যই দিয়ে বিদায় নিতেন। একজন বিদেশি হিসেবে, একজন সহকারী চিকিৎসক হিসেবে আমিও কিছু পেতাম। যদি কোনো রোগী মারা যেতেন, তাহলে রোগীর আত্মীয়-স্বজন শুধু চিকিৎসার জন্য কতবার এসে যে চিকিৎসক দলটিকে ধন্যবাদ দিতেন তা ভাষায় বলার নয়। বাংলাদেশে ডাক্তারদের ভেতরকার রাজনীতি চিকিৎসক সমাজের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে। অধ্যাপক এমএ কাশেম স্যারের বিএমএ এবং অধ্যাপিকা ফিরোজা বেগমের বিএমএ এখন আর নেই। এখন আছে দলীয় বিএমএ। এজন্য ডাক্তারদের প্রথম বিভাজন যিনি এনেছিলেন উঅই গঠন করে, তাকে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ক্ষমা করবে কিনা জানি না।
১৯৭০ সালের পর চিকিৎসাবিদ্যার ছাত্র হিসেবে আমি দেখেছি- তখন ডাক্তাররা পেশাজীবী ছিলেন, রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিতে আচ্ছন্ন ছিলেন না, তাদের ন্যায্য দাবির কাছে সরকারই মাথানত করতে বাধ্য হতো। এই কিছুদিন আগে ভারতের কয়েকটি রাজ্যে ডাক্তারদের ধর্মঘটের কাছে সরকার এবং জনগণ পরাজয় মেনে নিয়েছে। তাই বলে কথায় কথায় ডাক্তাররা ধর্মঘট করবেন সে কথা আমি বলছি না। তবে এ মুহূর্তে গ্রামগঞ্জে, শহরে-উপশহরে যেভাবে ডাক্তারদের লাঞ্ছনা করা হচ্ছে, তা কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। ডাক্তারদের পিঠ এখন দেয়ালে ঠেকে গেছে। এখন অবশ্যই ডাক্তারদের পেশার প্রতি সম্মান দেখিয়ে হলেও রোগীর আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু লেবাসধারী অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। ডাক্তাররা যদি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত সব রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে ভালো করতে পারতেন, তাহলে হয়তো মানুষ চিকিৎসকদের ফেরেশতা বা দেবতাদের ওপরে এবং স্রষ্টার নিচেই স্থান দিতেন; কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো সম্মান আমরা আশা করি না। কারণ সেখানে অন্য চারটি মৌলিক অধিকারের মতো চিকিৎসা ছিল সরকারের দায়িত্ব এবং চিকিৎসকরা ছিলেন নন প্র্যাকটিসিং। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা যেটুকু চাই সেটা হল, আমাদের একটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতে দিতে হবে। আমাদের সবার মনে রাখতে হবে, বর্তমান নবীন চিকিৎসকরা কিন্তু আমাদের মতো সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মায়নি। আমরা যে রকম ডাক্তারি পাস করার পরই In-service Trainee নামে একটি সরকারি চাকরিতে যোগদান করি, পঞ্চম গ্রেডের বেতনে, অতঃপর ইন্টার্নশিপ শেষ হওয়ার পর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চাকরি পেয়ে যাই, তারপর নিজেরা নিজেদের ক্যারিয়ার গড়ি- বর্তমান অবস্থাটা সেরকম নয়। আমরা কখনও বেকার ছিলাম না। জনগণ ও সরকারের ভেবে দেখা উচিত, এই মুহূর্তে বাংলাদেশে প্রতি বছর ৮ থেকে ১০ হাজার ডাক্তার তৈরি হচ্ছে। সরকার কোনো অবস্থাতেই এত ডাক্তারের চাকরি দিতে পারে না, দেয়া সম্ভবও নয় এবং দেয়ার কোনো সুযোগও নেই। আমাদের পরিকল্পিত অর্থনীতির মতো বাংলাদেশে চাহিদার তুলনায় কী সংখ্যক ডাক্তার দরকার তা নির্ণয় করতে হবে। প্রতি বছর কতজন অবসরে যাবে, কতজনকে নতুন করে চাকরি দেয়া যাবে- ঠিক সেই সংখ্যক ডাক্তারই তৈরি করা উচিত। এখন আমরা যা করছি সেটা হল প্রয়োজনের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। বাংলাদেশি ডাক্তারদের বাজার কিন্তু বহির্বিশ্বের কোথাও নেই। তাছাড়া আমাদের এই ডাক্তাররা যে দেশে বসে ইউএসএ, অস্ট্রেলিয়ান অথবা ব্রিটিশ কোয়ালিফাইং টেস্ট দিয়ে দেশের বাইরে যাবেন সে সুযোগও কিন্তু বিদ্যমান নেই।
সরকারের উচিত সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেয়া। এই নতুন পাস করা ডাক্তাররা পেটের দায়ে মা-বাবার কাছ থেকে টাকা এনে চলতে পারবেন না বলেই দু’-তিনটি ক্লিনিকে চাকরি করে মানবেতর জীবনযাপন করেন। তাদের কারও বেতনই সরকারি ডাক্তারদের প্রাপ্ত বেতনের অর্ধেকের সমান নয়। সেই ডাক্তারদের আবার বিসিএস, পোস্ট গ্রাজুয়েট পরীক্ষা দেয়ার চিন্তা থাকে। সব মিলিয়ে এমন একটি পরিস্থিতিতে তারা জনগণের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, যা পৃথিবীর কোনো দেশে কল্পনা করা যায় না। বলছিলাম প্রফেসর এবিএম আবদুল্লাহর কথা। আমি তখন বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রফেসর এবিএম আবদুল্লাহ বারবার নির্বাচিত একজন ডিন অর্থাৎ শিক্ষকদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা যেমন রোগীদের মধ্যেও ঠিক তেমনি। তারপরও ডা. আবদুল্লাহ কোনো দিন অফিসে যদি বিলম্বে আসতেন তার জন্য হয়তো আমি উপাচার্য হিসেবে কিছু বলতাম না, কারণ সবাই তাকে পেতে চাইত। এবং রাজধানীর সবচেয়ে জটিল রোগীরাই ডা. আবদুল্লাহর অধীনে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হন। আমরা চেষ্টা করেছি ডা. এবিএম আবদুল্লাহর মেধা ও চিকিৎসার সুফল যেন সবাই পায়। এ কথাও সত্য, ডা. আবদুল্লাহ যদি কোনো দিন সকালে একটু দেরিতে অফিসে আসতেন, তাহলে আড়াইটায় চলে যেতেন না। হাসপাতালের সব রোগী দেখে বিকাল চারটার পর হাসপাতাল ত্যাগ করতেন, অর্থাৎ নিয়মানুবর্তী, সুশৃঙ্খল ডাক্তারদের একজন ডা. আবদুল্লাহ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের যে ছাত্রীটিকে নিয়ে দুর্ঘটনা ঘটল, সেই ছাত্রীটি যখন সেন্ট্রাল হাসপাতালে এলো তখন তার রক্ত পরীক্ষায় যে ব্লাড পিকচার, যা লিউকেমিয়ার ক্যাটাগরিতে পড়ে, সেটা পাওয়া গেল। তার জ্বর ছিল, সে ডিহাইড্রেটেড ছিল এবং প্রায় ঝযড়পশ-এ ছিল। তাকে চিকিৎসা দেয়ার আগেই তার যখন শারীরিক অবনতি হচ্ছিল, তখন সেটাকে যে কোনো চিকিৎসকের ডেঙ্গু বা হেমোরিজিক Shock মনে হতে পারে। তাকে যখন আইসিইউতে নেয়া হল, সেখানে ইনটিউবেশন করার আগেই সে মারা গেল।
অর্থাৎ আইসিইউ কেয়ার বা চিকিৎসা শুরু হওয়ার আগেই সে মারা যায়। যেহেতু চিকিৎসাই শুরু হয়নি, তাহলে চিকিৎসকের ভুল কোথায় হল? এ ক্ষেত্রে মেয়েটিকে হাসপাতালে দেরি করে আনার জন্য তার পরিবার, সহপাঠী বা সহকর্মীদের কি কোনো দায়বদ্ধতা ছিল না? মেয়েটি এমন অবস্থায় হাসপাতালে এসেছিল যে, তার রোগের ইতিহাসও সঠিকভাবে রোগী নিজে বা অন্য কেউ দিতে পারছিল না। সব কিছু মিলে একজন চিকিৎসককে দোষারোপ করা হল। তার বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর কর্তৃক মামলা করা হল। সবই সম্ভব হয়েছে; কিন্তু এতে নির্দোষ চিকিৎসক বা প্রফেসর আবদুল্লাহর যে সম্মানহানি হল সেটা কি ফিরিয়ে আনা যাবে? দৈবক্রমে হয়তো তিনি ওই মুহূর্তে সেখানে উপস্থিত ছিলেন না, কিন্তু থাকলে তার মাথায়ও যদি এরকম একটি আঘাত হানা হতো এবং তার অকাল মৃত্যু ঘটত, তাহলে এর দায়ভার নিত কে? বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ছয় বছর উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছি। তখনও দেখেছি দু’-চারটি অপ্রীতিকর ঘটনা যা বহির্বিভাগে ঘটেছে সেগুলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্ররা নয়, ছাত্র নামধারী গুটিকয়েক অসৎ ব্যক্তি জড়িত ছিল। তারাও ওইখানে দেখাতে আসতেন। কোনো নিয়ম মানতেন না। নিয়ম না মেনে তাদের আগে দেখতে হবে। এবং দেখতে গিয়ে যদি কখনও বচসা হতো, পিয়ন বা ডাক্তার যদি বলতেন নিয়ম মেনে আসেন, তাহলেই হাতাহাতি-মারামারি হতো। একথা বলে আমি কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্রের ওপর দোষারোপ করছি না। গুটিকয়েক ছাত্রের জন্য এ কলঙ্কটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘাড়ে পড়ছে। ওই সময় সব সমস্যার সমাধান আমাদের প্রিয় ছাত্রনেতা বদিউজ্জামান সোহাগ একাই সামাল দিতেন। শুধু তাকে জানালেই হতো। প্রক্টর বলেছেন (পত্রিকায় দেখেছি), তিনি ছাত্রদের শান্ত করার জন্য মামলা করেছেন। প্রক্টর যদি অভিভাবকই হন, তার স্নেহ ও শিক্ষা যদি ছাত্ররা গ্রহণ করে থাকে, তাহলে তিনি মামলা ছাড়াও তাদের শান্ত রাখতে পারতেন। কোর্ট বিল্ডিংয়ে জামিন নিতে গিয়ে ডা. এবিএম আবদুল্লাহ যেভাবে সিঁড়িতে বসে ছিলেন, এটি দেখে প্রক্টর সাহেব লজ্জিত হয়েছেন কি? আমরা চিকিৎসক সমাজ কিন্তু লজ্জিত ও অসহায় বোধ করছি।
আজকে যদি ছাত্র সংসদ বা সত্যিকার ছাত্র নেতৃত্ব থাকত, তাহলে এটা ছাত্ররাই সামাল দিতে পারতেন, প্রক্টরের প্রয়োজন হতো না।সাম্প্রতিককালে ডাক্তারদের ওপর রোগী বা তার আত্মীয়-স্বজনদের ক্ষোভের কারণেই অনেক ক্ষেত্রে কোনো জটিল রোগের চিকিৎসা কোনো ডাক্তার দিতে সমর্থ হলেও তা না দিয়ে নামিদামি হাসপাতালে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। কারণ নিগৃহীত হওয়ার ভয়। এতে করে ক্ষতি শুধু রোগীদের হচ্ছে না, চিকিৎসকও তার দক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এবং তাদের সম্মানটুকু তারা ধরে রাখতে পারছেন না। এভাবে চললে ভবিষ্যতে জটিল রোগীদের মৃত্যু হবে কোনো হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নয়, অ্যাম্বুলেন্সে শুয়ে কোনো মহাসড়কের ওপরে। আমরা জানি, কিছুদিন আগেও ভারতে এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটত। চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগে চিকিৎসকের ওপর বাংলাদেশের মতোই আচরণ হতো, হাসপাতাল ভাংচুর হতো। কয়েকদিন আগেই বিরোলার এএমআরআই হাসপাতালটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল শুধু একজন রোগীকে কেন্দ্র করে। ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের একটি রায় ছিল, রোগীর মৃত্যুর জন্য তার আত্মীয়-স্বজনদের কোনো ডাক্তারের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে অভিযোগ দায়েরের পর আইনের খাতায় যদি তিনি দোষী সাব্যস্ত না হন, তাহলে তার ওপর অত্যাচার করলে অত্যাচারীর শাস্তি হওয়া বাঞ্ছনীয় এবং সেই শাস্তির মাত্রা বোধহয় ছিল পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা এবং তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড। কিছুদিন আগে মহারাষ্ট্রের ডাক্তাররা ৫ দিন ধর্মঘট করে রোগী ও সরকারকে বাধ্য করেছিলেন এ সংক্রান্ত আইন প্রণয়নে। আমাদের দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশ মেডিকেল কাউন্সিল এখনও একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারেনি। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তখন তারা বিএমডিসির প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন এবং বিএমডিসির কাউন্সিল মেম্বার হন ওই ক্ষমতাসীন দলের এমপি, চিকিৎসক, আইনজ্ঞ, সাংবাদিক ও অন্যান্য পেশাজীবী। বিএমডিসি শুধু রেজিস্ট্রেশন নয়, কোর্স কারিকুলাম নয়, এমনকি ডাক্তারদের অন্যায়ের জন্য শাস্তি দেয়ার অধিকার রাখে। তাই যে কোনো ধরনের ভুল চিকিৎসার জন্য ভুক্তভোগী রোগী বা তার স্বজনরা বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলে অভিযোগ করতে পারেন, এটা যৌক্তিক ও আইনসম্মত। বাংলাদেশে এমন নজিরও আছে যে,
ভুল চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করা হয়েছে আজীবনের জন্য। এটাও সত্য, ডাক্তারদেরও ভেবে দেখা উচিত এমন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা অহরহ কেন ঘটছে। কেনইবা জনগণের অসন্তোষের কারণে এত দ্বন্দ্বের ঘটনা ঘটছে। এখানে চিকিৎসাদাতা ও গ্রহীতা এ দু’য়ের মধ্যে মানসিক একটা পার্থক্য রয়েছে। তেমনি প্রাপ্তির আকাক্সক্ষা অসম্ভব উঁচু ধরনের থাকছে। প্রাপ্তি যখন আমাদের প্রত্যাশার তুলনায় একটু কম হয়ে যায়, তখন এই অশান্তির সৃষ্টি হয়। রোগীর আত্মীয়-স্বজনদেরও জানতে হবে কোন অবস্থায় তারা রোগীটিকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। তারাই বা কেন রোগীকে চিকিৎসা দেয়ার মতো অবস্থায় আনতে পারেন না। সেরিব্রো ভাসকুলার অ্যাকসিডেন্ট অথবা ব্রেইন টিউমারের মতো অনেক অসুখ আছে যেগুলো নিরাময়যোগ্য নয় অথচ এসব রোগীকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে এসে ডাক্তারদের অপারেশন করতে বলা হয়, যার কোনো অর্থ হয় না। কিন্তু রোগী মারা গেলে রোগীর আত্মীয়-স্বজন কিংবা অভিভাবকরা অসম্ভব ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। এই ক্ষিপ্ত হওয়ার কারণ দুটো। একটি হল, তারা নিকটাত্মীয়কে হারিয়েছেন। তারা ভুলে যান তারাই বাধ্য করেছিলেন চিকিৎসককে অপারেশন করার জন্য। দ্বিতীয়টি হল, ভাংচুর করলে হয়তো হাসপাতালের বিল দেয়া লাগবে না। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসককেও ভাবতে হবে তিনি কোন অবস্থায় কার গায়ে ছুরি ধরবেন। চিকিৎসক দেবদূত নন; কিন্তু অনেক দিন ধরেই সমাজে এটা প্রচলিত ছিল, রোগীরা এসে ডাক্তারকে বলতেন, উপরে আল্লাহ নিচে আপনি। কখনও বলতে শুনিনি যে উপরে আল্লাহ মাঝে লক্ষ্মী, সরস্বতী, দুর্গা আর নিচে আপনি। অর্থাৎ সরাসরি আল্লাহর পরেই ডাক্তারদের স্থান দিয়ে দেন। আমরা চিকিৎসকরাও কি সেই স্থানটিকে রক্ষা করতে পেরেছি? তবে কথায় কথায় যদি সিনিয়র ডাক্তারদের লাঞ্ছিত করা হয়, এটা কোনো অবস্থাতেই মেনে নেয়া যায় না। আমরা দেখেছি উপজেলা-জেলা পর্যায়ে, এখন খোদ রাজধানীতেও এই অত্যাচার হচ্ছে। এবং এ ঘটনাগুলোর পেছনে যে অন্তর্নিহিত কারণ বা অন্য কোনো ঘটনা থাকে, সেটা কিন্তু কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। যখনই কোনো ঘটনা ঘটেছে, ঘটনার পর মীমাংসা হয়েছে অপ্রত্যাশিতভাবে। সরকারের উচিত সুর্নিদিষ্ট আইন প্রণয়ন করা- যে আইনের মাধ্যমে চিকিৎসক, সন্ত্রাসী, ভাংচুরকারী বা রোগীর আত্মীয়-স্বজন যেই হোক না কেন, যিনি দোষী সাব্যস্ত হবেন তিনি যথোপযুক্ত সাজা পাবেন। অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত : সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
No comments