আততায়ী, কর্তৃপক্ষ ও রাষ্ট্রকে খুঁজছি by ফারুক ওয়াসিফ
দেশে
অনেক শিশু হত্যার শিকার হচ্ছে এবং অনেক বন্দুকযুদ্ধও হচ্ছে। হত্যাকারীরা
খালি হাতে বা লাঠি বা দা দিয়ে শিশুদের হত্যা করে লুকিয়ে রাখে। যেমন ঘটেছিল
ঢাকার কেরানীগঞ্জে ও সিলেটের বাহুবলে। তারপর সেই সন্দেহভাজন হত্যাকারীদের
কেউ কেউ পালাতে গিয়ে র্যা বের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারাও পড়ে। যেমনটা ঘটেছে
কেরানীগঞ্জ ও বাহুবলের শিশুহত্যার সন্দেহভাজনদের বেলায়। সর্বশেষ, বাহুবলের
চার শিশু হত্যার আসামিদের একজন বাচ্চু মিয়া (৩৩) র্যা বের সঙ্গে
‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন।
যা-ই হোক, খবরগুলো পড়ার পর থেকে নারায়ণগঞ্জের নিহত কিশোর ত্বকী ও তার বাবার কথা ভাবছি। ত্বকীকে নিষ্ঠুর কায়দায় হত্যা করে নারায়ণগঞ্জেরই শীতলক্ষ্যা নদীর সোঁতায় ফেলে রাখা হয়েছিল। সেই থেকে ত্বকীর বাবা রাফিউর রাব্বী বিচারের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন। রাফিউর রাব্বী সেই শহরের একজন ব্যবসায়ী ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পরিচিত নেতা। তাঁর কিংবা ত্বকীর মায়ের শোকের পরিমাপ করা সম্ভব নয় আমাদের পক্ষে। কিন্তু এই তিন বছরে কখনো তাঁদের বলতে শুনিনি, তাঁরা প্রিয়তম পুত্রের হত্যাকারীদের ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যু চান। তাঁরা বরং বিচার চেয়ে এসেছেন। বিচার বলতে বুঝিয়েছেন আদালতের সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে আইনিভাবে খুনি অথবা খুনিদের শাস্তির ব্যবস্থা করা। বিচারের মাধ্যমে শাস্তি আর বন্দুকযুদ্ধে হত্যার মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রতিটি বিচারের ঘটনায় সমাজে আইনের শাসন শক্তিশালী হয়, আততায়ীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র সজাগ—এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়, জনগণের মধ্যে নিরাপত্তার ভরসা নবায়িত হয় এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষের শক্তি নিজেদের জোরদার করার সুযোগ পায়।
গত বছরের আলোচিত ঘটনাগুলোর অন্যতম ছিল শিশু রাজন ও সামিউলকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা। শিশু দুটির পরিবারও বিচার চেয়েছিল এবং আদালতের মাধ্যমে সেই বিচার নিশ্চিত করা হয়েছিল। তা দেখে অনেকের মতো আমরাও আশাবাদী হয়েছিলাম যে পুলিশ সঠিক তদন্ত করলে, ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ বাধা না দিলে অল্প সময়ের মধ্যে ন্যায্য বিচার করা সম্ভব। এই দুটি ঘটনায় দেশজোড়া আলোড়নের চাপে পুলিশ ও কর্তৃপক্ষ যা করা উচিত, সেটাই করেছিল। আসামিদের একজনকে সৌদি আরব থেকে ধরে এনে কাঠগড়ায় তোলা হয়েছিল। ত্বকীর খুনের ঘটনায় কেন এ ধননের তৎপরতা দেখা গেল না?
শিশুহত্যার ঘটনায় আমরা তিন ধরনের ‘বিচার’ দেখতে পেলাম: আদালতের মাধ্যমে দ্রুত বিচার (সামিউল ও রাজনের বেলায়), বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ‘বিচার’ (সাম্প্রতিক কেরানীগঞ্জ ও বাহুবলের শিশু হত্যার বেলায়) এবং করব করব করেও বিচার না করার অবিচার (ত্বকী হত্যার মতো ঘটনায়)!
কারও বেলায় অতিবিচার হয় আর কারও বেলায় হয় এর উল্টো। ২০০৪ সালে নাটোরের বিএনপি নেতা গামা হত্যাকারীদের ২০ জনই ফাঁসির দণ্ডাদেশ থেকে ২০১০ সালে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পান। ২০১১ সালে নাটোরেরই বড়াইগ্রাম উপজেলার চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা সানাউল্লাহ নূর হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া ১১ আসামির সবাই জামিনে মুক্তি পেয়ে এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। সরকার ও পুলিশ যখন এ রকম এক চোখে দুরবিন আর আরেক চোখে ঠুলি পরে থাকে, তখন সমাজে নৈরাজ্য উপস্থিত হয়। নৈরাজ্য মানে নাগরিকের অধিকার ও নিরাপত্তা যখন নাজুক, যখন যা হওয়ার কথা নয়, তা-ই হয় এবং যা হওয়া খুবই প্রয়োজন, তা হয় না। শিশুহত্যার এমন ব্যাপকতা কোনোভাবেই হওয়া উচিত ছিল না। কিন্তু হচ্ছে। পুলিশ ওয়েবসাইটের হিসাব দেখায়, ২০১৫ সালে থানায় নথিবদ্ধ হওয়া খুনের সংখ্যা ৪ হাজার ১৫। শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, একই বছরে ২৯২ শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। এদিকে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানিয়েছে, ওই বছর বাংলাদেশে ১৮৩ জন ব্যক্তি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এই সংখ্যা আগের বছরের চেয়ে ৫৫ জন বেশি। বাস্তবত, সব ঘটনা থানায় নথিবদ্ধ হয় না, সব খবর পত্রিকা পর্যন্ত আসে না। তারপরও এ পরিসংখ্যান অকাট্যভাবে প্রমাণ করে, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও অপরাধমূলক হত্যা একসঙ্গেই বাড়ছে বাংলাদেশে।
আমাদের প্রশ্নটা বরং অন্য জায়গায়। একটা দেশে কেন ও কখন এত হত্যা-প্রতিহিংসা বেড়ে যায়? দেশ মানে সমাজ। আমরা ইংরেজ আমল থেকে কেবলই রাষ্ট্র রাষ্ট্র করছি। রাষ্ট্রকে কার্যকর করা, রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করা, রাষ্ট্রকে মানবিক করার কথা আমরা বলে থাকি। কিন্তু সমাজের কী হবে? সিরিয়াল কিলার ও ধর্ষক রসু খাঁ তৈরি হয় সমাজে, মা-বাবাকে হত্যাকারী ঐশীও বেড়ে ওঠে সমাজে-পরিবারে। শিশুর ঘাতকেরাও এই সমাজেরই আরও কারও বাবা-স্বামী-ভাই হয়েই আছে। ঐশীর বেলায় আদালত দৃশ্যত খুনের বিচার করেছে, কিন্তু যে পরিবেশ খুনি বানিয়ে তোলে, সেটাকে শায়েস্তা করা হবে কোন কায়দায়? সব দায়ের বিচার তো ফৌজদারি বিধিতে হওয়ার কথাও নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান বার্নার্দিনোতে নির্বিচার গুলিতে ১৪ জন নিহত হওয়ার পরে সিএনএন শিরোনাম দিয়েছিল ‘সোশ্যাল কিলিং!’ সামাজিক ক্রসফায়ারই বলি আর বলি সোশ্যাল কিলিং, এগুলোর কি প্রতিকার নেই? সরাসরি যে খুনি, তার শাস্তি দিলেই এসব ঘটনা ঘটা বন্ধ হয় না। বিভিন্ন জায়গায় নোটিশ টাঙানো থাকে, কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়। এসব ক্ষেত্রে কি কর্তৃপক্ষের দায় নেই? সাধারণ মানুষের দ্বারা সাধারণ মানুষের খুন, বড়দের ওপর রাগের জন্য নিরীহ নিষ্পাপ ছোটদের হত্যা করা আসল অসুখ নয়, এগুলো রোগলক্ষণ বা সিম্পটম। আমাদের সমাজ যে ভয়ানকভাবে হিংসাত্মক হয়ে উঠছে, এগুলো তারই প্রকাশ।
অপরাধের ঘটনায় দারোগা খুঁজবে অপরাধীকে, রাজনীতিবিদেরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয় দায় এড়াবেন, অথবা প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর ফন্দি করবেন। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানীকে খুঁজতে হবে সমাজের গভীর অসুখের কারণ। কোনো সমাজে বড়সংখ্যক মানুষের মনে কেন নিষ্ঠুরতা ও হিংসা-প্রতিহিংসা দানা বাঁধে, তার কার্যকারণ জানতে না পারলে এই সামাজিক বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না। সারানো সম্ভব হবে না সমাজের এই ব্যাধি।
ইংরেজ আমল থেকে আমরা মোটামুটি তিনটি রাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। রাষ্ট্র বদলেছে, সমাজও বদলেছে। কিন্তু সমাজকে সবার জন্য নিরাপদ করার বা সংস্কারের ডাক কি কখনো জোরেশোরে দেওয়া হয়েছে? বড় রাজনীতিবিদদের কথা বলে লাভ নেই। বিদ্যাচর্চায় জড়িত ব্যক্তি কিংবা অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও সামাজিক মনস্তত্ত্ব নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের কাছে কি আসলেই কোনো ব্যাখ্যা বা সমাধান আছে?
ছোটবেলায় পত্রিকার পাতায় মাঝেমধ্যেই ‘আততায়ীর হাতে নিহত’, ‘কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কিছু জানে না’ কিংবা ‘রাষ্ট্র নির্বিকার’ কথাগুলো পড়ে ভাবতাম, আততায়ী, কর্তৃপক্ষ ও রাষ্ট্র বোধ হয় কোনো ব্যক্তির নাম। ভয়ে ভয়ে আততায়ী নামক খারাপ লোকটাকে খুঁজতাম, কর্তৃপক্ষ নামক মানুষটা কেন এত চুপ, সেটা ভাবতাম আর রাষ্ট্র কোথায় থাকে, সেই প্রশ্নে পেরেশান হয়ে যেতাম। আজকের করুণ, কঠিন বাস্তবতার সামনে সে রকমই পেরেশান লাগে, যখন ‘আততায়ী’র সঠিক বিচার হয় না বা তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না এবং ‘কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়’ মনোভাব নিয়ে চলে এবং রাষ্ট্রকে পাষাণের মতো নির্বিকার থাকতে দেখি।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com
যা-ই হোক, খবরগুলো পড়ার পর থেকে নারায়ণগঞ্জের নিহত কিশোর ত্বকী ও তার বাবার কথা ভাবছি। ত্বকীকে নিষ্ঠুর কায়দায় হত্যা করে নারায়ণগঞ্জেরই শীতলক্ষ্যা নদীর সোঁতায় ফেলে রাখা হয়েছিল। সেই থেকে ত্বকীর বাবা রাফিউর রাব্বী বিচারের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন। রাফিউর রাব্বী সেই শহরের একজন ব্যবসায়ী ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পরিচিত নেতা। তাঁর কিংবা ত্বকীর মায়ের শোকের পরিমাপ করা সম্ভব নয় আমাদের পক্ষে। কিন্তু এই তিন বছরে কখনো তাঁদের বলতে শুনিনি, তাঁরা প্রিয়তম পুত্রের হত্যাকারীদের ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যু চান। তাঁরা বরং বিচার চেয়ে এসেছেন। বিচার বলতে বুঝিয়েছেন আদালতের সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে আইনিভাবে খুনি অথবা খুনিদের শাস্তির ব্যবস্থা করা। বিচারের মাধ্যমে শাস্তি আর বন্দুকযুদ্ধে হত্যার মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রতিটি বিচারের ঘটনায় সমাজে আইনের শাসন শক্তিশালী হয়, আততায়ীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র সজাগ—এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়, জনগণের মধ্যে নিরাপত্তার ভরসা নবায়িত হয় এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষের শক্তি নিজেদের জোরদার করার সুযোগ পায়।
গত বছরের আলোচিত ঘটনাগুলোর অন্যতম ছিল শিশু রাজন ও সামিউলকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা। শিশু দুটির পরিবারও বিচার চেয়েছিল এবং আদালতের মাধ্যমে সেই বিচার নিশ্চিত করা হয়েছিল। তা দেখে অনেকের মতো আমরাও আশাবাদী হয়েছিলাম যে পুলিশ সঠিক তদন্ত করলে, ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ বাধা না দিলে অল্প সময়ের মধ্যে ন্যায্য বিচার করা সম্ভব। এই দুটি ঘটনায় দেশজোড়া আলোড়নের চাপে পুলিশ ও কর্তৃপক্ষ যা করা উচিত, সেটাই করেছিল। আসামিদের একজনকে সৌদি আরব থেকে ধরে এনে কাঠগড়ায় তোলা হয়েছিল। ত্বকীর খুনের ঘটনায় কেন এ ধননের তৎপরতা দেখা গেল না?
শিশুহত্যার ঘটনায় আমরা তিন ধরনের ‘বিচার’ দেখতে পেলাম: আদালতের মাধ্যমে দ্রুত বিচার (সামিউল ও রাজনের বেলায়), বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ‘বিচার’ (সাম্প্রতিক কেরানীগঞ্জ ও বাহুবলের শিশু হত্যার বেলায়) এবং করব করব করেও বিচার না করার অবিচার (ত্বকী হত্যার মতো ঘটনায়)!
কারও বেলায় অতিবিচার হয় আর কারও বেলায় হয় এর উল্টো। ২০০৪ সালে নাটোরের বিএনপি নেতা গামা হত্যাকারীদের ২০ জনই ফাঁসির দণ্ডাদেশ থেকে ২০১০ সালে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পান। ২০১১ সালে নাটোরেরই বড়াইগ্রাম উপজেলার চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা সানাউল্লাহ নূর হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া ১১ আসামির সবাই জামিনে মুক্তি পেয়ে এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। সরকার ও পুলিশ যখন এ রকম এক চোখে দুরবিন আর আরেক চোখে ঠুলি পরে থাকে, তখন সমাজে নৈরাজ্য উপস্থিত হয়। নৈরাজ্য মানে নাগরিকের অধিকার ও নিরাপত্তা যখন নাজুক, যখন যা হওয়ার কথা নয়, তা-ই হয় এবং যা হওয়া খুবই প্রয়োজন, তা হয় না। শিশুহত্যার এমন ব্যাপকতা কোনোভাবেই হওয়া উচিত ছিল না। কিন্তু হচ্ছে। পুলিশ ওয়েবসাইটের হিসাব দেখায়, ২০১৫ সালে থানায় নথিবদ্ধ হওয়া খুনের সংখ্যা ৪ হাজার ১৫। শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, একই বছরে ২৯২ শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। এদিকে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানিয়েছে, ওই বছর বাংলাদেশে ১৮৩ জন ব্যক্তি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এই সংখ্যা আগের বছরের চেয়ে ৫৫ জন বেশি। বাস্তবত, সব ঘটনা থানায় নথিবদ্ধ হয় না, সব খবর পত্রিকা পর্যন্ত আসে না। তারপরও এ পরিসংখ্যান অকাট্যভাবে প্রমাণ করে, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও অপরাধমূলক হত্যা একসঙ্গেই বাড়ছে বাংলাদেশে।
আমাদের প্রশ্নটা বরং অন্য জায়গায়। একটা দেশে কেন ও কখন এত হত্যা-প্রতিহিংসা বেড়ে যায়? দেশ মানে সমাজ। আমরা ইংরেজ আমল থেকে কেবলই রাষ্ট্র রাষ্ট্র করছি। রাষ্ট্রকে কার্যকর করা, রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করা, রাষ্ট্রকে মানবিক করার কথা আমরা বলে থাকি। কিন্তু সমাজের কী হবে? সিরিয়াল কিলার ও ধর্ষক রসু খাঁ তৈরি হয় সমাজে, মা-বাবাকে হত্যাকারী ঐশীও বেড়ে ওঠে সমাজে-পরিবারে। শিশুর ঘাতকেরাও এই সমাজেরই আরও কারও বাবা-স্বামী-ভাই হয়েই আছে। ঐশীর বেলায় আদালত দৃশ্যত খুনের বিচার করেছে, কিন্তু যে পরিবেশ খুনি বানিয়ে তোলে, সেটাকে শায়েস্তা করা হবে কোন কায়দায়? সব দায়ের বিচার তো ফৌজদারি বিধিতে হওয়ার কথাও নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান বার্নার্দিনোতে নির্বিচার গুলিতে ১৪ জন নিহত হওয়ার পরে সিএনএন শিরোনাম দিয়েছিল ‘সোশ্যাল কিলিং!’ সামাজিক ক্রসফায়ারই বলি আর বলি সোশ্যাল কিলিং, এগুলোর কি প্রতিকার নেই? সরাসরি যে খুনি, তার শাস্তি দিলেই এসব ঘটনা ঘটা বন্ধ হয় না। বিভিন্ন জায়গায় নোটিশ টাঙানো থাকে, কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়। এসব ক্ষেত্রে কি কর্তৃপক্ষের দায় নেই? সাধারণ মানুষের দ্বারা সাধারণ মানুষের খুন, বড়দের ওপর রাগের জন্য নিরীহ নিষ্পাপ ছোটদের হত্যা করা আসল অসুখ নয়, এগুলো রোগলক্ষণ বা সিম্পটম। আমাদের সমাজ যে ভয়ানকভাবে হিংসাত্মক হয়ে উঠছে, এগুলো তারই প্রকাশ।
অপরাধের ঘটনায় দারোগা খুঁজবে অপরাধীকে, রাজনীতিবিদেরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয় দায় এড়াবেন, অথবা প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর ফন্দি করবেন। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানীকে খুঁজতে হবে সমাজের গভীর অসুখের কারণ। কোনো সমাজে বড়সংখ্যক মানুষের মনে কেন নিষ্ঠুরতা ও হিংসা-প্রতিহিংসা দানা বাঁধে, তার কার্যকারণ জানতে না পারলে এই সামাজিক বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না। সারানো সম্ভব হবে না সমাজের এই ব্যাধি।
ইংরেজ আমল থেকে আমরা মোটামুটি তিনটি রাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। রাষ্ট্র বদলেছে, সমাজও বদলেছে। কিন্তু সমাজকে সবার জন্য নিরাপদ করার বা সংস্কারের ডাক কি কখনো জোরেশোরে দেওয়া হয়েছে? বড় রাজনীতিবিদদের কথা বলে লাভ নেই। বিদ্যাচর্চায় জড়িত ব্যক্তি কিংবা অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও সামাজিক মনস্তত্ত্ব নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের কাছে কি আসলেই কোনো ব্যাখ্যা বা সমাধান আছে?
ছোটবেলায় পত্রিকার পাতায় মাঝেমধ্যেই ‘আততায়ীর হাতে নিহত’, ‘কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কিছু জানে না’ কিংবা ‘রাষ্ট্র নির্বিকার’ কথাগুলো পড়ে ভাবতাম, আততায়ী, কর্তৃপক্ষ ও রাষ্ট্র বোধ হয় কোনো ব্যক্তির নাম। ভয়ে ভয়ে আততায়ী নামক খারাপ লোকটাকে খুঁজতাম, কর্তৃপক্ষ নামক মানুষটা কেন এত চুপ, সেটা ভাবতাম আর রাষ্ট্র কোথায় থাকে, সেই প্রশ্নে পেরেশান হয়ে যেতাম। আজকের করুণ, কঠিন বাস্তবতার সামনে সে রকমই পেরেশান লাগে, যখন ‘আততায়ী’র সঠিক বিচার হয় না বা তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না এবং ‘কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়’ মনোভাব নিয়ে চলে এবং রাষ্ট্রকে পাষাণের মতো নির্বিকার থাকতে দেখি।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com
No comments