এবিএম মূসা: কালের আয়নায় by সোহরাব হাসান
নিকট
অতীতে যে কজন পুরোধা পুরুষ বাংলাদেশের সংবাদপত্রজগৎকে আলোকিত ও আলোড়িত
করেছেন, এবিএম মূসা তাঁদের অন্যতম। দীর্ঘ ৬০ বছরেরও বেশি সময় তিনি এই পেশায়
নিয়োজিত ছিলেন। আমরা কখনো তাঁকে পেয়েছি চৌকস রিপোর্টার হিসেবে, কখনো
ধীমান বার্তা সম্পাদকরূপে, আবার কখনো নন্দিত কলাম লেখক হিসেবে।
সাংবাদিকতার বাইরেও নানা ক্ষেত্রে তিনি ভূমিকা রেখেছেন। বাংলাদেশের প্রথম
জাতীয় সংসদের সদস্য হয়েছিলেন। যুক্ত ছিলেন নানা সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে।
কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে তাঁর সাংবাদিক সত্তাই বড় হয়ে উঠেছিল।
এবিএম মূসার জন্ম ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩১; বর্তমান ফেনী জেলার দক্ষিণ ধর্মপুরে। মৃত্যু ৯ এপ্রিল ২০১৪, ঢাকায়। বাবার চাকরিসূত্রে তাঁর শৈশব ও কৈশোরের বেশির ভাগ সময় কেটেছে চট্টগ্রামে। এরপর কুমিল্লা হয়ে ঢাকায়। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করার পরই এবিএম মূসা সাংবাদিকতা শুরু করেন তৎকালীন পাকিস্তান অবজারভার-এ। প্রথমে ক্রীড়া প্রতিবেদক, পরে বার্তা সম্পাদক। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুস সালাম। পাকিস্তান আমলে পত্রিকাটির বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা ও আকর্ষণীয় উপস্থাপনা পাঠকের মনোযোগ কেড়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এবিএম মূসা লন্ডন হয়ে কলকাতা যান। বিবিসি, সানডে টাইমস ও লন্ডন টাইমস-এর সংবাদদাতা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ও বিজয়ের বার্তা পরিবেশন করেন। সে সময়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন: অদ্ভুত এক সহমর্মিতা ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রতি প্রতিটি বিদেশি সাংবাদিকের। ব্যক্তিগত সমর্থন ছিল মুক্তিযুদ্ধে। তাই বাংলাদেশের এক কোটি শরণার্থীর দুর্দশার বিবরণ পাঠিয়ে, তথা নিজেদের পত্রিকা ও বেতার সংস্থার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তুলেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতার বিবরণ পাঠাতেন। [আমার বেলা যে যায়, পৃষ্ঠা ২০৫]
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছায় এবিএম মূসা বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক হন, সেখান থেকে সরকারি পত্রিকা মর্নিং নিউজ-এর সম্পাদক। কিন্তু সেখানেও তাঁর বেশি দিন থাকা হয়নি। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে ফেনী থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং জয়ী হন। আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, ‘শেখ সাহেবের দোহাই দিয়ে নৌকায় চড়ে সাংসদ হলাম। তবে হওয়াটাই সার, সংসদীয় কাজকর্ম কিছুই বুঝি না। অথচ এমপি হয়েই মহাফ্যাসাদে পড়ে গেলাম। মনে হলো এলাকাবাসী রাস্তা আর পুল চায় না। তারা যা চায়, তা অনেকটাই অদ্ভুত মনে হতো। ছেলের চাকরি, মেয়ের বিয়ের খরচ, বউ তালাকের সালিস আর আকাম-কুকামের জন্য জেলে যাওয়া কর্মীর জামিন।’ (আমার বেলা যে যায়, পৃষ্ঠা ২২৬)
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপালিত একদল ঘাতকের হাতে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হলে ক্ষমতায় আসে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র। এবিএম মূসা লন্ডনে ফিরে গিয়ে ফের সাংবাদিকতা শুরু করেন। এরপর ব্যাংককে ইউনেপ-এর তথ্য কর্মকর্তা পদে যোগ দেন। সেখানেই পরিচয় হয় সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের সঙ্গে। আলাপ প্রসঙ্গে জিয়া তাঁকে বলেন, ‘বিদেশে পড়ে আছেন কেন? দেশে আপনাদের মতো মানুষের প্রয়োজন আছে।’ এরপর দেশে ফিরে এবিএম মূসা বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক পদে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে তিনি সরকারি বার্তা সংস্থা বাসসের প্রধান সম্পাদক হয়েছিলেন। তিনি যেখানেই থাকুন না কেন নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে সচেষ্ট থেকেছেন। তিনি নিজেকে মুজিবের অনুসারী হিসেবে পরিচয় দিতে ভালোবাসতেন। বলতেন, ‘আমি আওয়ামী লীগ করি না, মুজিব লীগ করি।’
তরুণ বয়সে এবিএম মূসা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেন। এ জন্য তাঁকে জেলও খাটতে হয়েছিল। তিনি যুক্ত হয়েছিলেন রেভল্যুশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টির সঙ্গে; আরও পরে যোগ দেন গণতান্ত্রিক যুবলীগে। দুটোতেই বামপন্থী তরুণদের সমাবেশ ঘটেছিল। পরবর্তীকালে এবিএম মূসা যে বামপন্থার বিরোধী ছিলেন, সেটি স্পষ্ট হয় তাঁর লেখা ও কথায়। তাঁর ভাষা আন্দোলনে যোগদান নিছক আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। এ কারণেই তাঁকে দেখি পরবর্তীকালে সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনে অগ্রণী ভূমিকায়। তাঁর ভাষায়, ‘সরকারিভাবে প্রথম বাংলা চালু হয়েছে গাড়ির নম্বর প্লেটে। এই চালু হওয়ারও একটি ইতিহাস আছে। ১৯৬০ সালে আমরা তিনজন—সাঁতারু ব্রজেন দাস, অবসরপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট ও ক্রীড়াঙ্গনে সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব এফ কাসিম ও আমি একসঙ্গে অথবা আগে-পরে গাড়ি কিনলাম। ...তিনজনই বাংলায় লেখা নম্বর প্লেট লাগালাম। এই তিনটি গাড়ি রাস্তায় নামার পর কয়েক জায়গায় ট্রাফিক পুলিশ ধরল। তারপর পাঁচ আইনে। এই ধরাধরির খবর নিয়ে পত্রপত্রিকায় উঠল শোরগোল, চারদিকে বিবৃতির ছড়াছড়ি। প্রাদেশিক সরকার ভড়কে গেল। পরিষদ সেক্টর আইনানুগ অ্যাক্ট সংশোধন করে বাংলায় নম্বর প্লেট লেখা শুধু বৈধ নয়, বাধ্য করা হলো।’ (আমার বেলা যে যায়)
এবিএম মূসার চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি দলমত-নির্বিশেষে সবার সঙ্গে মিশতে পারতেন। তিনি ব্যক্তিগত সম্পর্ককে রাজনীতি তথা সব মত ও পথের ঊর্ধ্বে স্থান দিতেন। সাংবাদিক ইউনিয়ন ভাগ হয়ে যাওয়ার পর জাতীয় প্রেসক্লাবের সাংবাদিকদের টেবিলগুলোও ভাগ হয়ে যায়। এবিএম মূসা একটি ফোরামের নেতৃত্ব দিলেও সবার সঙ্গে সদ্ভাব রাখতেন। বয়সের দাবিতে অনেককে হুকুমও করতেন, স্নেহ-ভালোবাসা মিশ্রিত সেই হুকুম কেউ উপেক্ষা করতে পারতেন না।
এবিএম মূসার জন্ম ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩১; বর্তমান ফেনী জেলার দক্ষিণ ধর্মপুরে। মৃত্যু ৯ এপ্রিল ২০১৪, ঢাকায়। বাবার চাকরিসূত্রে তাঁর শৈশব ও কৈশোরের বেশির ভাগ সময় কেটেছে চট্টগ্রামে। এরপর কুমিল্লা হয়ে ঢাকায়। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করার পরই এবিএম মূসা সাংবাদিকতা শুরু করেন তৎকালীন পাকিস্তান অবজারভার-এ। প্রথমে ক্রীড়া প্রতিবেদক, পরে বার্তা সম্পাদক। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুস সালাম। পাকিস্তান আমলে পত্রিকাটির বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা ও আকর্ষণীয় উপস্থাপনা পাঠকের মনোযোগ কেড়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এবিএম মূসা লন্ডন হয়ে কলকাতা যান। বিবিসি, সানডে টাইমস ও লন্ডন টাইমস-এর সংবাদদাতা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ও বিজয়ের বার্তা পরিবেশন করেন। সে সময়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন: অদ্ভুত এক সহমর্মিতা ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রতি প্রতিটি বিদেশি সাংবাদিকের। ব্যক্তিগত সমর্থন ছিল মুক্তিযুদ্ধে। তাই বাংলাদেশের এক কোটি শরণার্থীর দুর্দশার বিবরণ পাঠিয়ে, তথা নিজেদের পত্রিকা ও বেতার সংস্থার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তুলেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতার বিবরণ পাঠাতেন। [আমার বেলা যে যায়, পৃষ্ঠা ২০৫]
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছায় এবিএম মূসা বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক হন, সেখান থেকে সরকারি পত্রিকা মর্নিং নিউজ-এর সম্পাদক। কিন্তু সেখানেও তাঁর বেশি দিন থাকা হয়নি। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে ফেনী থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং জয়ী হন। আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, ‘শেখ সাহেবের দোহাই দিয়ে নৌকায় চড়ে সাংসদ হলাম। তবে হওয়াটাই সার, সংসদীয় কাজকর্ম কিছুই বুঝি না। অথচ এমপি হয়েই মহাফ্যাসাদে পড়ে গেলাম। মনে হলো এলাকাবাসী রাস্তা আর পুল চায় না। তারা যা চায়, তা অনেকটাই অদ্ভুত মনে হতো। ছেলের চাকরি, মেয়ের বিয়ের খরচ, বউ তালাকের সালিস আর আকাম-কুকামের জন্য জেলে যাওয়া কর্মীর জামিন।’ (আমার বেলা যে যায়, পৃষ্ঠা ২২৬)
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপালিত একদল ঘাতকের হাতে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হলে ক্ষমতায় আসে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র। এবিএম মূসা লন্ডনে ফিরে গিয়ে ফের সাংবাদিকতা শুরু করেন। এরপর ব্যাংককে ইউনেপ-এর তথ্য কর্মকর্তা পদে যোগ দেন। সেখানেই পরিচয় হয় সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের সঙ্গে। আলাপ প্রসঙ্গে জিয়া তাঁকে বলেন, ‘বিদেশে পড়ে আছেন কেন? দেশে আপনাদের মতো মানুষের প্রয়োজন আছে।’ এরপর দেশে ফিরে এবিএম মূসা বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক পদে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে তিনি সরকারি বার্তা সংস্থা বাসসের প্রধান সম্পাদক হয়েছিলেন। তিনি যেখানেই থাকুন না কেন নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে সচেষ্ট থেকেছেন। তিনি নিজেকে মুজিবের অনুসারী হিসেবে পরিচয় দিতে ভালোবাসতেন। বলতেন, ‘আমি আওয়ামী লীগ করি না, মুজিব লীগ করি।’
তরুণ বয়সে এবিএম মূসা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেন। এ জন্য তাঁকে জেলও খাটতে হয়েছিল। তিনি যুক্ত হয়েছিলেন রেভল্যুশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টির সঙ্গে; আরও পরে যোগ দেন গণতান্ত্রিক যুবলীগে। দুটোতেই বামপন্থী তরুণদের সমাবেশ ঘটেছিল। পরবর্তীকালে এবিএম মূসা যে বামপন্থার বিরোধী ছিলেন, সেটি স্পষ্ট হয় তাঁর লেখা ও কথায়। তাঁর ভাষা আন্দোলনে যোগদান নিছক আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। এ কারণেই তাঁকে দেখি পরবর্তীকালে সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনে অগ্রণী ভূমিকায়। তাঁর ভাষায়, ‘সরকারিভাবে প্রথম বাংলা চালু হয়েছে গাড়ির নম্বর প্লেটে। এই চালু হওয়ারও একটি ইতিহাস আছে। ১৯৬০ সালে আমরা তিনজন—সাঁতারু ব্রজেন দাস, অবসরপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট ও ক্রীড়াঙ্গনে সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব এফ কাসিম ও আমি একসঙ্গে অথবা আগে-পরে গাড়ি কিনলাম। ...তিনজনই বাংলায় লেখা নম্বর প্লেট লাগালাম। এই তিনটি গাড়ি রাস্তায় নামার পর কয়েক জায়গায় ট্রাফিক পুলিশ ধরল। তারপর পাঁচ আইনে। এই ধরাধরির খবর নিয়ে পত্রপত্রিকায় উঠল শোরগোল, চারদিকে বিবৃতির ছড়াছড়ি। প্রাদেশিক সরকার ভড়কে গেল। পরিষদ সেক্টর আইনানুগ অ্যাক্ট সংশোধন করে বাংলায় নম্বর প্লেট লেখা শুধু বৈধ নয়, বাধ্য করা হলো।’ (আমার বেলা যে যায়)
এবিএম মূসার চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি দলমত-নির্বিশেষে সবার সঙ্গে মিশতে পারতেন। তিনি ব্যক্তিগত সম্পর্ককে রাজনীতি তথা সব মত ও পথের ঊর্ধ্বে স্থান দিতেন। সাংবাদিক ইউনিয়ন ভাগ হয়ে যাওয়ার পর জাতীয় প্রেসক্লাবের সাংবাদিকদের টেবিলগুলোও ভাগ হয়ে যায়। এবিএম মূসা একটি ফোরামের নেতৃত্ব দিলেও সবার সঙ্গে সদ্ভাব রাখতেন। বয়সের দাবিতে অনেককে হুকুমও করতেন, স্নেহ-ভালোবাসা মিশ্রিত সেই হুকুম কেউ উপেক্ষা করতে পারতেন না।
প্রয়াত অগ্রজের প্রতি জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com
No comments