সৃজনশীল প্রশ্ন: তত্ত্ব ও প্রয়োগ by গোলাম ফারুক
এ
দেশে সাধারণভাবে মনে করা হয়, যে ব্যক্তি লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তিনি
জীবন-জগতের বাস্তবতার বেশি কিছু বোঝেন না। এই সমস্যা দূর করার জন্য
শিক্ষার্থীদের মুখস্থনির্ভরতা থেকে মুক্ত করার আশায় চালু হয়েছে ‘সৃজনশীল’
পদ্ধতি। কিন্তু পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত কিছু নিবন্ধ বা শিক্ষক-অভিভাবকদের
ক্ষোভ বিবেচনায় নিলে বলতেই হবে, সমস্যাটা দূর হয়নি, বরং হয়তো আরও গভীর
হয়েছে।
তাহলে ‘সৃজনশীল’ চালু করা কি ভুল হয়েছে?
না, ভুল হয়নি। শিক্ষা–বিষয়ক মনোবিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ব্লুম যে ছয়টি চিন্তাস্তর চিহ্নিত করেছিলেন, আমাদের আগের পদ্ধতিতে ছাত্রছাত্রীরা কেবল তাদের সর্বনিম্ন (জ্ঞান) এবং তার পরের স্তরটির (অনুধাবন) কিছুটা চর্চা করত। বর্তমান পদ্ধতিতে তাদের এর ওপরের আরও চারটি স্তরে চিন্তা করার সুযোগ পাওয়ার কথা। কিন্তু আমার ধারণা, তারা তা যথাযথভাবে পাচ্ছে না। উপরন্তু, আগের মতো, অন্যের (সু)লিখিত বড় বড় নোট মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় লিখে আসার সুযোগটাও আর নেই। সম্ভবত এই একূল-ওকূল দুকূল হারানোর বেদনাই জনমনে উদ্ভূত ক্ষোভের কারণ।
‘সৃজনশীল’ হোঁচট খাচ্ছে একে সৃজনশীলভাবে ব্যবহার না করার কারণে। ‘সৃজনশীল’-এর ব্যর্থতা নিশ্চয়ই এর তাত্ত্বিক কাঠামোতে নেই, থাকলে তা দুনিয়াজুড়ে গৃহীত হতো না। আমরা জানি, এর তাত্ত্বিক ভিত্তি হচ্ছে ব্লুম চিহ্নিত ছয়টি চিন্তাস্তর এবং তাদের কাঠামো। ১৯৫৬ সালে ব্লুম যে হাতবইটি প্রকাশ করেন, সে অনুযায়ী নিম্নতর চিন্তার তিনটি স্তর হচ্ছে ‘জ্ঞান’, ‘অনুধাবন’ ও ‘প্রয়োগ’। আর উচ্চতর চিন্তার তিনটি স্তর হচ্ছে ‘বিশ্লেষণ’, ‘সংশ্লেষণ’ ও ‘মূল্যায়ন’। চিন্তার এই কাঠামো শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে যখন ২০০১ সালে ব্লুমের ছাত্র লরিন এন্ডারসনের নেতৃত্বে একদল বিশেষজ্ঞ একে ঢেলে সাজান। তাঁরা চিন্তার স্তরগুলোর নামবাচক নামগুলোকে ক্রিয়াবাচক করে দেন। ব্লুম যেটাকে ‘জ্ঞান’ বলেছেন, তাঁরা সেটাকে ‘মনে করা’ বলে আখ্যায়িত করেন। ‘অনুধাবন’ হয় ‘বুঝতে পারা’, ‘প্রয়োগ’ হয়ে যায় ‘প্রয়োগ করা’, ‘বিশ্লেষণ’ হয় ‘বিশ্লেষণ করা’, ‘সংশ্লেষণের’ জায়গায় আসে ‘মূল্যায়ন করা’ আর ‘মূল্যায়নের’ জায়গায় তাঁরা প্রায় নতুন একটি ক্রিয়াপদ বসান—‘সৃষ্টি করা’।
ভাবনার এই ছয়টি প্রক্রিয়া আবার পরস্পর-বিচ্ছিন্ন নয়। এদের একটির ওপর আরেকটি পিরামিড বা সিঁড়ির মতো করে সাজিয়ে কল্পনা করা যেতে পারে। পিরামিডের মতো সাজানোর অর্থ হচ্ছে এটা বোঝানো যে সব সময় নিচের স্তরটি তার ওপরের স্তরের চেয়ে আকারে বড় হয়। যেমন: আমরা যত তথ্য মনে রাখতে পারি, তার সবটুকু বুঝি না, আবার যতটুকু বুঝি, তার সবটুকু প্রয়োগ করতে পারি না। একইভাবে, যা প্রয়োগ করি, তার সব বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা আমাদের থাকে না। আবার যতটুকু বিশ্লেষণ করি, তার পুরো মূল্যায়ন করতে পারি না, আর সৃষ্টি করার ক্ষমতা তো তার চেয়েও কম। অন্যদিকে, চিন্তাস্তরগুলোকে কখনো সিঁড়ির মতো কল্পনা করা হয় এ কারণে যে প্রথম ধাপটি না পেরোলে দ্বিতীয় ধাপটিতে পা রাখা যায় না। একইভাবে, দ্বিতীয় ধাপে উঠতে পারলেই কেবল তৃতীয়টিতে উত্তরণ সম্ভব। অর্থাৎ, সর্বশেষ ধাপে পৌঁছাতে হলে আগের সব কটি ধাপ অতিক্রম করতে হবে।
ব্লুম ও এন্ডারসনে ছয়টি স্তর থাকলেও আমাদের ‘সৃজনশীল পদ্ধতিতে’ চারটি স্তর আছে। নিচ থেকে ওপরের সেগুলো হচ্ছে ‘জ্ঞান’, ‘অনুধাবন’, ‘প্রয়োগ’ ও ‘উচ্চতর দক্ষতা’। এটা স্পষ্ট, এই পদ্ধতির সর্বনিম্ন তিনটি স্তর ব্লুমের ট্যাক্সোনমি থেকে নেওয়া। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এন্ডারসনদের নামগুলো আরও জুতসই হতো। ব্লুমের অনুকরণে সৃজনশীল প্রশ্নে যাকে ‘জ্ঞান’ নাম দেওয়া হয়েছে, তা আসলে ছাত্রছাত্রীর জ্ঞান যাচাই করে না, বরং পাঠ্যবইয়ের কী কী সে মনে করতে পারে, তা পরীক্ষা করে। আমরা যেভাবে ‘মুখস্থ’ শব্দটা ব্যবহার করি, সেই অর্থে মুখস্থ না করেও কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা পাঠ্যবইয়ের অনেক বিষয় মনে রেখে সৃজনশীল পরীক্ষার ‘জ্ঞান’-বিষয়ক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। এন্ডারসন বলেছেন, মানুষ নানাভাবে ‘মনে করে’। যেমন দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতিভান্ডার থেকে কোনো কিছু তুলে আনে, সেখানকার কোনো কিছু আবার নতুন করে দেখতে পেয়ে তাকে চিনতে পারে বা অনেক সময় অবচেতন মনে ঘুমিয়ে থাকা অনেক পুরোনো বিষয় নতুন অভিজ্ঞতার সংস্পর্শে এসে জেগে ওঠে। এভাবে প্রতিটি স্তর কীভাবে কাজ করে, এন্ডারসন সেই ব্যাপারে বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন।
যা-ই হোক, আসল মুশকিলটা হয় ‘উচ্চতর দক্ষতা’ নিয়ে। এটা স্পষ্ট যে এটা দিয়ে ওপরের তিনটি চিন্তাস্তরকে বোঝানো হচ্ছে। কিন্তু সেগুলো ব্লুমের, না এন্ডারসনের? এখানে কি তিনটির সব কটি অন্তর্ভুক্ত, নাকি দুটি, না কেবল একটি? বিষয়টি প্রশ্নকর্তা, শিক্ষক, পরীক্ষক, ছাত্রছাত্রী, কারও কাছেই পরিষ্কার নয়। উপরন্তু, এই ‘উচ্চতর দক্ষতা’ এবং ‘প্রয়োগের’ জন্য যে উদ্দীপক ব্যবহার করা হয়, বাংলাদেশে সেই উদ্দীপক তৈরিতে সক্ষম প্রশ্নকর্তার সংখ্যা খুব কম।
‘উচ্চতর দক্ষতা’ সম্পর্কে ধারণার অভাব, ধারণা থাকলেও একই প্রশ্নের মধ্যে চিন্তার সর্বোচ্চ তিনটি স্তরকে অন্তর্ভুক্ত করার দুরূহতা শেখা, শেখানো, প্রশ্ন তৈরি ও মূল্যায়নকে কঠিন এবং ক্ষেত্রবিশেষে অসম্ভব করে তোলে। অন্যদিকে, যথাযথ প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতার অভাবের কারণে অধিকাংশ শিক্ষকের কাছে ‘উদ্দীপক’ তৈরি করা একটি আতঙ্ক। অনেকে খেটেখুটে যাও–বা তৈরি করেন, তা প্রায়ই উদ্ভট, অপ্রাসঙ্গিক, কিংবা নোট বা পাঠ্যবইয়ের অনুকরণ হয়ে যায়।
সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতিকে সফল করে তুলতে হলে এই দুই সমস্যার সমাধান করতে হবে। তিনটি উচ্চতর চিন্তাস্তরের জন্য একটির বদলে তিনটি প্রশ্ন করা যায়, যাদের নাম হতে পারে¦ ‘বিশ্লেষণ’, ‘মূল্যায়ন’ ও ‘সৃজন’। তাতে শিক্ষকেরা বুঝবেন কী পড়াতে হবে, প্রশ্নকর্তারা পরিষ্কার ধারণা নিয়ে প্রশ্ন করতে পারবেন, শিক্ষার্থীরা জানবে উত্তরে কী লিখতে হবে আর পরীক্ষকেরাও সঠিকভাবে তা মূল্যায়ন করতে পারবেন।
এবার আসা যাক উদ্দীপকের কথায়। উদ্দীপক লেখার ক্ষেত্রে প্রশ্নকর্তাকে স্বাধীনতা দিলে এই সমস্যার কিঞ্চিৎ সমাধান হতে পারে। সবচেয়ে ভালো হয় প্রশ্নকর্তা যদি উদ্দীপক রাখা বা না রাখার স্বাধীনতা পান। ছাত্রছাত্রীর চিন্তাস্তর পরীক্ষার জন্য সব সময় যে উদ্দীপক ব্যবহার করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। এন্ডারসন ও আরও অনেকে কোন ধরনের চিন্তাস্তরের জন্য কী প্রশ্ন করতে হবে এবং সেখানে কী ধরনের ক্রিয়াপদ ব্যবহার করা যায়, তার সুনির্দিষ্ট নমুনা তৈরি করে দিয়েছেন। সেখানে কোথাও উদ্দীপকের কথা বলা হয়নি।
নিজেরা একটু বুদ্ধি খাটালে এন্ডারসনদেরও দরকার হয় না। আমাদের পুরোনো পদ্ধতির প্রশ্ন দিয়েও ছাত্রছাত্রীদের চিন্তাক্ষমতা যাচাই করা যায়। যেমন পুরোনো একটি প্রশ্ন¦ ‘হৈমন্তীর চরিত্র বিশ্লেষণ করো’¦ অনায়াসে ছাত্রছাত্রীদের বিশ্লেষণ স্তরের চিন্তা যাচাই করতে পারে। কিন্তু আমরা জানি, এ ধরনের প্রশ্ন বারবার আসায় পরীক্ষার্থীরা সত্যিকার অর্থে আর বিশ্লেষণ করে না, কোনো তৈরি নোট মুখস্থ করে নেয়। এই পুনরাবৃত্তি এড়াতে প্রশ্নটি একটু ঘুরিয়ে অনেকভাবে করা যায়। যেমন: ‘হৈমন্তীর সঙ্গে তোমার দেখা ওই বয়সী কোনো নারীর মিল-অমিল আলোচনা করো’, কিংবা ‘হৈমন্তীর জায়গায় এই যুগের কোনো শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নারী থাকলে কী করত বলে তোমার ধারণা। আলোচনা করো’। তাহলে ছাত্রছাত্রীরা আর মুখস্থ করার দিকে ঝুঁকবে না। বরং বেশি লেখার সুযোগ পেয়ে নিজেদের সৃজনশীলতার প্রমাণ দিতে পারবে, যা তারা উদ্দীপকভিত্তিক প্রশ্নের কারণে পাচ্ছে না। উদ্দীপকবিহীন প্রশ্ন প্রণয়নে প্রশ্নকর্তারা এবং উত্তর পরীক্ষণে পরীক্ষকেরা অনেক সহজ বোধ করবেন। উদ্ভট উদ্দীপক লিখে কিংবা নোটবইয়ের প্রশ্ন নকল করে বা বেশি বেশি নম্বর দিয়ে আর দায়সারাভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে না।
অজ্ঞানতাপ্রসূত প্রশংসাও ‘সৃজনশীল’কে দুর্বল করে দেয়। এই পদ্ধতি যে খুব ভালো, তার প্রমাণ দিতে গিয়ে আমরা বলি যে এখানে মুখস্থবিদ্যাকে নির্বাসন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ওপরের পিরামিডগুলো লক্ষ করলে দেখা যাবে নিচের ‘জ্ঞান’-এর স্তরটিই সবচেয়ে বড়। আমাদের প্রশ্নকাঠামোতেও এই স্তরের জন্য সবচেয়ে বেশি নম্বর বরাদ্দ থাকে। যদিও ১০ নম্বরের একটি প্রশ্নে আপাতদৃষ্টিতে ‘জ্ঞানে’ ১, ‘অনুধাবনে’ ২, ‘প্রয়োগে’ ৩ এবং ‘উচ্চতর দক্ষতায়’ ৪ থাকে; ভালো করে লক্ষ করলে বোঝা যাবে, এখানে আসলে ‘জ্ঞানে’ ৪, ‘অনুধাবনে’ ৩, ‘প্রয়োগে’ ২ এবং ‘উচ্চতর দক্ষতায়’ ১ আছে। কারণ, আমরা আগেই আলোচনা করেছি, প্রতিটি স্তরে তার নিচের স্তরগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকে। যেমন: ‘প্রয়োগে-৩-এর ভেতর ১ হলো ‘জ্ঞান’ এবং ১ ‘অনুধাবন’-এর জন্য। তার মানে ভালো নম্বর পাওয়ার জন্য মুখস্থ করে বা যেভাবেই হোক পাঠ্যবইয়ের তথ্যগুলো খুব ভালোভােব মনে রাখতে হবে।
যা-ই হোক, ‘সৃজনশীল’ পদ্ধতি কোথায় কোথায় হোঁচট খাবে, শুরুতে তা জানা না থাকলেও এখন তো তা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। পথের এই বন্ধুরতাকে বিবেচনায় নিলে পদ্ধতিটি অনেক সাবলীলভাবে এগিয়ে যাবে, ছাত্রছাত্রীরা উপকৃত হবে, শঙ্কিত নাগরিকেরাও দুশ্চিন্তামুক্ত হবেন।
গোলাম ফারুক: ফলিত ভাষাতত্ত্ববিদ, গবেষক, অধ্যাপক।
faruk.golam@yahoo.com
তাহলে ‘সৃজনশীল’ চালু করা কি ভুল হয়েছে?
না, ভুল হয়নি। শিক্ষা–বিষয়ক মনোবিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ব্লুম যে ছয়টি চিন্তাস্তর চিহ্নিত করেছিলেন, আমাদের আগের পদ্ধতিতে ছাত্রছাত্রীরা কেবল তাদের সর্বনিম্ন (জ্ঞান) এবং তার পরের স্তরটির (অনুধাবন) কিছুটা চর্চা করত। বর্তমান পদ্ধতিতে তাদের এর ওপরের আরও চারটি স্তরে চিন্তা করার সুযোগ পাওয়ার কথা। কিন্তু আমার ধারণা, তারা তা যথাযথভাবে পাচ্ছে না। উপরন্তু, আগের মতো, অন্যের (সু)লিখিত বড় বড় নোট মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় লিখে আসার সুযোগটাও আর নেই। সম্ভবত এই একূল-ওকূল দুকূল হারানোর বেদনাই জনমনে উদ্ভূত ক্ষোভের কারণ।
‘সৃজনশীল’ হোঁচট খাচ্ছে একে সৃজনশীলভাবে ব্যবহার না করার কারণে। ‘সৃজনশীল’-এর ব্যর্থতা নিশ্চয়ই এর তাত্ত্বিক কাঠামোতে নেই, থাকলে তা দুনিয়াজুড়ে গৃহীত হতো না। আমরা জানি, এর তাত্ত্বিক ভিত্তি হচ্ছে ব্লুম চিহ্নিত ছয়টি চিন্তাস্তর এবং তাদের কাঠামো। ১৯৫৬ সালে ব্লুম যে হাতবইটি প্রকাশ করেন, সে অনুযায়ী নিম্নতর চিন্তার তিনটি স্তর হচ্ছে ‘জ্ঞান’, ‘অনুধাবন’ ও ‘প্রয়োগ’। আর উচ্চতর চিন্তার তিনটি স্তর হচ্ছে ‘বিশ্লেষণ’, ‘সংশ্লেষণ’ ও ‘মূল্যায়ন’। চিন্তার এই কাঠামো শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে যখন ২০০১ সালে ব্লুমের ছাত্র লরিন এন্ডারসনের নেতৃত্বে একদল বিশেষজ্ঞ একে ঢেলে সাজান। তাঁরা চিন্তার স্তরগুলোর নামবাচক নামগুলোকে ক্রিয়াবাচক করে দেন। ব্লুম যেটাকে ‘জ্ঞান’ বলেছেন, তাঁরা সেটাকে ‘মনে করা’ বলে আখ্যায়িত করেন। ‘অনুধাবন’ হয় ‘বুঝতে পারা’, ‘প্রয়োগ’ হয়ে যায় ‘প্রয়োগ করা’, ‘বিশ্লেষণ’ হয় ‘বিশ্লেষণ করা’, ‘সংশ্লেষণের’ জায়গায় আসে ‘মূল্যায়ন করা’ আর ‘মূল্যায়নের’ জায়গায় তাঁরা প্রায় নতুন একটি ক্রিয়াপদ বসান—‘সৃষ্টি করা’।
ভাবনার এই ছয়টি প্রক্রিয়া আবার পরস্পর-বিচ্ছিন্ন নয়। এদের একটির ওপর আরেকটি পিরামিড বা সিঁড়ির মতো করে সাজিয়ে কল্পনা করা যেতে পারে। পিরামিডের মতো সাজানোর অর্থ হচ্ছে এটা বোঝানো যে সব সময় নিচের স্তরটি তার ওপরের স্তরের চেয়ে আকারে বড় হয়। যেমন: আমরা যত তথ্য মনে রাখতে পারি, তার সবটুকু বুঝি না, আবার যতটুকু বুঝি, তার সবটুকু প্রয়োগ করতে পারি না। একইভাবে, যা প্রয়োগ করি, তার সব বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা আমাদের থাকে না। আবার যতটুকু বিশ্লেষণ করি, তার পুরো মূল্যায়ন করতে পারি না, আর সৃষ্টি করার ক্ষমতা তো তার চেয়েও কম। অন্যদিকে, চিন্তাস্তরগুলোকে কখনো সিঁড়ির মতো কল্পনা করা হয় এ কারণে যে প্রথম ধাপটি না পেরোলে দ্বিতীয় ধাপটিতে পা রাখা যায় না। একইভাবে, দ্বিতীয় ধাপে উঠতে পারলেই কেবল তৃতীয়টিতে উত্তরণ সম্ভব। অর্থাৎ, সর্বশেষ ধাপে পৌঁছাতে হলে আগের সব কটি ধাপ অতিক্রম করতে হবে।
ব্লুম ও এন্ডারসনে ছয়টি স্তর থাকলেও আমাদের ‘সৃজনশীল পদ্ধতিতে’ চারটি স্তর আছে। নিচ থেকে ওপরের সেগুলো হচ্ছে ‘জ্ঞান’, ‘অনুধাবন’, ‘প্রয়োগ’ ও ‘উচ্চতর দক্ষতা’। এটা স্পষ্ট, এই পদ্ধতির সর্বনিম্ন তিনটি স্তর ব্লুমের ট্যাক্সোনমি থেকে নেওয়া। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এন্ডারসনদের নামগুলো আরও জুতসই হতো। ব্লুমের অনুকরণে সৃজনশীল প্রশ্নে যাকে ‘জ্ঞান’ নাম দেওয়া হয়েছে, তা আসলে ছাত্রছাত্রীর জ্ঞান যাচাই করে না, বরং পাঠ্যবইয়ের কী কী সে মনে করতে পারে, তা পরীক্ষা করে। আমরা যেভাবে ‘মুখস্থ’ শব্দটা ব্যবহার করি, সেই অর্থে মুখস্থ না করেও কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা পাঠ্যবইয়ের অনেক বিষয় মনে রেখে সৃজনশীল পরীক্ষার ‘জ্ঞান’-বিষয়ক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। এন্ডারসন বলেছেন, মানুষ নানাভাবে ‘মনে করে’। যেমন দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতিভান্ডার থেকে কোনো কিছু তুলে আনে, সেখানকার কোনো কিছু আবার নতুন করে দেখতে পেয়ে তাকে চিনতে পারে বা অনেক সময় অবচেতন মনে ঘুমিয়ে থাকা অনেক পুরোনো বিষয় নতুন অভিজ্ঞতার সংস্পর্শে এসে জেগে ওঠে। এভাবে প্রতিটি স্তর কীভাবে কাজ করে, এন্ডারসন সেই ব্যাপারে বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন।
যা-ই হোক, আসল মুশকিলটা হয় ‘উচ্চতর দক্ষতা’ নিয়ে। এটা স্পষ্ট যে এটা দিয়ে ওপরের তিনটি চিন্তাস্তরকে বোঝানো হচ্ছে। কিন্তু সেগুলো ব্লুমের, না এন্ডারসনের? এখানে কি তিনটির সব কটি অন্তর্ভুক্ত, নাকি দুটি, না কেবল একটি? বিষয়টি প্রশ্নকর্তা, শিক্ষক, পরীক্ষক, ছাত্রছাত্রী, কারও কাছেই পরিষ্কার নয়। উপরন্তু, এই ‘উচ্চতর দক্ষতা’ এবং ‘প্রয়োগের’ জন্য যে উদ্দীপক ব্যবহার করা হয়, বাংলাদেশে সেই উদ্দীপক তৈরিতে সক্ষম প্রশ্নকর্তার সংখ্যা খুব কম।
‘উচ্চতর দক্ষতা’ সম্পর্কে ধারণার অভাব, ধারণা থাকলেও একই প্রশ্নের মধ্যে চিন্তার সর্বোচ্চ তিনটি স্তরকে অন্তর্ভুক্ত করার দুরূহতা শেখা, শেখানো, প্রশ্ন তৈরি ও মূল্যায়নকে কঠিন এবং ক্ষেত্রবিশেষে অসম্ভব করে তোলে। অন্যদিকে, যথাযথ প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতার অভাবের কারণে অধিকাংশ শিক্ষকের কাছে ‘উদ্দীপক’ তৈরি করা একটি আতঙ্ক। অনেকে খেটেখুটে যাও–বা তৈরি করেন, তা প্রায়ই উদ্ভট, অপ্রাসঙ্গিক, কিংবা নোট বা পাঠ্যবইয়ের অনুকরণ হয়ে যায়।
সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতিকে সফল করে তুলতে হলে এই দুই সমস্যার সমাধান করতে হবে। তিনটি উচ্চতর চিন্তাস্তরের জন্য একটির বদলে তিনটি প্রশ্ন করা যায়, যাদের নাম হতে পারে¦ ‘বিশ্লেষণ’, ‘মূল্যায়ন’ ও ‘সৃজন’। তাতে শিক্ষকেরা বুঝবেন কী পড়াতে হবে, প্রশ্নকর্তারা পরিষ্কার ধারণা নিয়ে প্রশ্ন করতে পারবেন, শিক্ষার্থীরা জানবে উত্তরে কী লিখতে হবে আর পরীক্ষকেরাও সঠিকভাবে তা মূল্যায়ন করতে পারবেন।
এবার আসা যাক উদ্দীপকের কথায়। উদ্দীপক লেখার ক্ষেত্রে প্রশ্নকর্তাকে স্বাধীনতা দিলে এই সমস্যার কিঞ্চিৎ সমাধান হতে পারে। সবচেয়ে ভালো হয় প্রশ্নকর্তা যদি উদ্দীপক রাখা বা না রাখার স্বাধীনতা পান। ছাত্রছাত্রীর চিন্তাস্তর পরীক্ষার জন্য সব সময় যে উদ্দীপক ব্যবহার করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। এন্ডারসন ও আরও অনেকে কোন ধরনের চিন্তাস্তরের জন্য কী প্রশ্ন করতে হবে এবং সেখানে কী ধরনের ক্রিয়াপদ ব্যবহার করা যায়, তার সুনির্দিষ্ট নমুনা তৈরি করে দিয়েছেন। সেখানে কোথাও উদ্দীপকের কথা বলা হয়নি।
নিজেরা একটু বুদ্ধি খাটালে এন্ডারসনদেরও দরকার হয় না। আমাদের পুরোনো পদ্ধতির প্রশ্ন দিয়েও ছাত্রছাত্রীদের চিন্তাক্ষমতা যাচাই করা যায়। যেমন পুরোনো একটি প্রশ্ন¦ ‘হৈমন্তীর চরিত্র বিশ্লেষণ করো’¦ অনায়াসে ছাত্রছাত্রীদের বিশ্লেষণ স্তরের চিন্তা যাচাই করতে পারে। কিন্তু আমরা জানি, এ ধরনের প্রশ্ন বারবার আসায় পরীক্ষার্থীরা সত্যিকার অর্থে আর বিশ্লেষণ করে না, কোনো তৈরি নোট মুখস্থ করে নেয়। এই পুনরাবৃত্তি এড়াতে প্রশ্নটি একটু ঘুরিয়ে অনেকভাবে করা যায়। যেমন: ‘হৈমন্তীর সঙ্গে তোমার দেখা ওই বয়সী কোনো নারীর মিল-অমিল আলোচনা করো’, কিংবা ‘হৈমন্তীর জায়গায় এই যুগের কোনো শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নারী থাকলে কী করত বলে তোমার ধারণা। আলোচনা করো’। তাহলে ছাত্রছাত্রীরা আর মুখস্থ করার দিকে ঝুঁকবে না। বরং বেশি লেখার সুযোগ পেয়ে নিজেদের সৃজনশীলতার প্রমাণ দিতে পারবে, যা তারা উদ্দীপকভিত্তিক প্রশ্নের কারণে পাচ্ছে না। উদ্দীপকবিহীন প্রশ্ন প্রণয়নে প্রশ্নকর্তারা এবং উত্তর পরীক্ষণে পরীক্ষকেরা অনেক সহজ বোধ করবেন। উদ্ভট উদ্দীপক লিখে কিংবা নোটবইয়ের প্রশ্ন নকল করে বা বেশি বেশি নম্বর দিয়ে আর দায়সারাভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে না।
অজ্ঞানতাপ্রসূত প্রশংসাও ‘সৃজনশীল’কে দুর্বল করে দেয়। এই পদ্ধতি যে খুব ভালো, তার প্রমাণ দিতে গিয়ে আমরা বলি যে এখানে মুখস্থবিদ্যাকে নির্বাসন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ওপরের পিরামিডগুলো লক্ষ করলে দেখা যাবে নিচের ‘জ্ঞান’-এর স্তরটিই সবচেয়ে বড়। আমাদের প্রশ্নকাঠামোতেও এই স্তরের জন্য সবচেয়ে বেশি নম্বর বরাদ্দ থাকে। যদিও ১০ নম্বরের একটি প্রশ্নে আপাতদৃষ্টিতে ‘জ্ঞানে’ ১, ‘অনুধাবনে’ ২, ‘প্রয়োগে’ ৩ এবং ‘উচ্চতর দক্ষতায়’ ৪ থাকে; ভালো করে লক্ষ করলে বোঝা যাবে, এখানে আসলে ‘জ্ঞানে’ ৪, ‘অনুধাবনে’ ৩, ‘প্রয়োগে’ ২ এবং ‘উচ্চতর দক্ষতায়’ ১ আছে। কারণ, আমরা আগেই আলোচনা করেছি, প্রতিটি স্তরে তার নিচের স্তরগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকে। যেমন: ‘প্রয়োগে-৩-এর ভেতর ১ হলো ‘জ্ঞান’ এবং ১ ‘অনুধাবন’-এর জন্য। তার মানে ভালো নম্বর পাওয়ার জন্য মুখস্থ করে বা যেভাবেই হোক পাঠ্যবইয়ের তথ্যগুলো খুব ভালোভােব মনে রাখতে হবে।
যা-ই হোক, ‘সৃজনশীল’ পদ্ধতি কোথায় কোথায় হোঁচট খাবে, শুরুতে তা জানা না থাকলেও এখন তো তা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। পথের এই বন্ধুরতাকে বিবেচনায় নিলে পদ্ধতিটি অনেক সাবলীলভাবে এগিয়ে যাবে, ছাত্রছাত্রীরা উপকৃত হবে, শঙ্কিত নাগরিকেরাও দুশ্চিন্তামুক্ত হবেন।
গোলাম ফারুক: ফলিত ভাষাতত্ত্ববিদ, গবেষক, অধ্যাপক।
faruk.golam@yahoo.com
No comments