সম্ভাবনার ২০১৬ by মাহবুব হাসান
লাখ লাখ শিশু শিক্ষার্থীর নির্মল হাসি আনন্দে আলোকিত বছরের শেষ দিন।
জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষায় বিশাল সাফল্যে খুশির জোয়ারে ভাসছে ওরা। ওদের
সঙ্গে পুরো দেশই হাসতে হাসতেই বিদায় দিয়েছে পুরনো বছরকে। এই উচ্ছ্বাসই
রাঙিয়ে দেবে আগামী বছর। এমন আশা-উদ্দীপনা-সম্ভাবনায় শুরু হচ্ছে আরও একটি
বছর। সেই লাখো নিষ্পাপ শিশুর হাসিতেই নতুন বছর ২০১৬-কে স্বাগতম।
বছরের শেষ দিন আশা জাগিয়েছে ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যার বিচার। এর আগের দিন অনুষ্ঠিত পৌর নির্বাচনও অনেক সম্ভাবনারই ইঙ্গিত দিয়ে গেছে। এত প্রাপ্তি, সম্ভাবনা আর হাসি দিয়ে শেষ করা বছরটি কিন্তু শুরু হয়েছিল দারুণ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়। ২০১৫ সালের প্রথম সপ্তাহেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি। চোরাগোপ্তা হামলা, অগ্নিসংযোগ, দগ্ধ মানুষের আহাজারি, স্বজন হারানো পরিবারগুলোর হাহাকারে ভারি ছিল চারদিক। দীর্ঘ তিন মাস চলে এ অবস্থা। এরপর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসে সবকিছু। বছরের মাঝামাঝি শুরু হয় বিদেশী নাগরিক হত্যা, লেখক-ব্লগারদের ওপর হামলা, ধর্মযাজক, মসজিদ-মন্দির এবং সংখ্যালঘু ও সাম্প্রদায়িক হামলায় ব্যাপ্তি পায়। এসব ঘটনাসহ নানা ধরনের স্মৃতি নিয়ে মানুষ বরণ করে নিল নতুন বছর। কিন্তু কেমন কাটবে ২০১৬? দেশের বিশিষ্ট নাগরিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও শিক্ষক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ড. এমাজউদ্দীন আহমদ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান, এফবিসিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট মাতলুব আহমাদ এবং মানবাধিকার কর্মী খুশী কবীরের সঙ্গে কথা বলে যুগান্তর এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চেয়েছে।
তাদের প্রত্যেকের মতেই ভালোমন্দ মিলিয়েই কেটেছে গেল বছর। দেশ এগিয়েছে। হয়েছে সামগ্রিক উন্নয়ন। সব সূচকেই এগিয়ে বিশ্বে প্রশংসিত হচ্ছে বাংলাদেশ। এসবের ধারাবাহিকতা কামনার পাশাপাশি অনেক শংকাও ব্যক্ত করেছেন তারা। নতুন বছরে শান্তি, সমঝোতা আর সংঘাতমুক্ত পরিস্থিতির স্বার্থে সব পক্ষের শুভবুদ্ধির উদয় হবে বলে প্রত্যাশা তাদের সবার। তাদের কামনা রাজনীতিতে সহনশীলতা, মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা, জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস এবং অপরাধ দমন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে সত্যিকারের শোষণ, বঞ্চনাহীন, অসাম্প্রদায়িক-প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে উঠুক। তাদের প্রত্যাশা, ২০১৫-তে বিনিয়োগে আশানুরূপ সাড়া না থাকলেও ২০১৬ হয়ে উঠবে শিল্পের স্বর্ণ বছর। আর সবকিছুর মূলে অতীতে যে সুশাসনের অভাব ছিল সেটা এ বছর ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। কেননা সুশাসনই রাষ্ট্রকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাবে, জনগণকে করবে স্বাধীন ও নির্ভার।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বিদায়ী বছরে রাজনীতিসহ সব ক্ষেত্রেই সহনশীলতার অভাব ছিল। তিনি সহনশীলতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নতুন বছরে বৈষম্য দূর এবং উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়ানোর ওপর জোর দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। গেল বছরে সাম্প্রদায়িক হামলা ও বিদেশী হত্যার অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, যারা এসব ঘটাচ্ছে তারা হতাশা থেকে ঘটিয়েছে, বেকারত্ব থেকে ঘটিয়েছে। এর পেছনে বিদেশী শক্তির ইন্ধন ও অর্থ দুটোই ছিল। কেননা এরা সেই শক্তি যারা বাংলাদেশে বিভিন্ন স্বার্থ কায়েম করতে চায়। এসব শক্তির প্রসার ও ব্যাপ্তি দুটোই বাড়ছে উল্লেখ করে এই শিক্ষক বলেন, এদের মোকাবেলাই হবে ২০১৬-তে একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ। দেশপ্রেমের শক্তিতে এদের রুখে দিয়ে দেশের ভেতরে যারা ভ্রান্ত পথে গিয়ে এসব ঘটিয়েছে তাদের সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারলে নতুন বছর অনেক শান্তিময় হবে বলে তিনি আশা করেন। আর তারুণ্য তাকে এখনও আশাবাদী করে। তিনি বলেন, আজকের তরুণরা প্রতিবাদ করছে, আন্দোলন করছে, লেখাপড়া করছে, নিজের ক্যারিয়ার নিজেই গড়ছে, সঠিক ইতিহাস চর্চার আগ্রহ দেখাচ্ছে, এসব খুব ইতিবাচক দিক। তাই নিজেদের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে আগ্রহী তারুণ্যেই আস্থা তার।
অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ : অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, তার প্রত্যাশা আগামী বছর হোক শান্তির বছর। ২০১৫ সালে গণতান্ত্রিক রীতি ও মূল্যবোধের যে নাজুক অবস্থা ছিল, তার শুভ পরিবর্তন হোক নতুন বছরে। একটি বিষয় বুঝতে হবে, এ দেশটি আর শিশুরাষ্ট্র নয়। এটি পরিণত রাষ্ট্র। এ কারণে মানবিক মূল্যবোধ, গণতান্ত্রিক রীতি, শিষ্টাচার, পরমত সহিষ্ণুতার ব্যাপারে অনেক বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে সবাইকে। বিশেষ করে যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, তাদের এ বিষয়ে বেশি সচেতন থাকা দরকার। তিনি বলেন, রাজনীতিতে অস্থিরতা-উৎকণ্ঠা কেন, এটা কারও অজানা নয়। যে বিষয় সবাই জানে, তার সমাধানও কঠিন হওয়ার কথা নয়। সমস্যা হচ্ছে শ্রদ্ধাবোধ, আস্থা এবং পরমত সহিষ্ণুতার অভাব। এই অভাবগুলোর আবর্তেই রাজনীতি ঘুরপাক খাচ্ছে। আশা করা যায়, নতুন বছরে সবার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হবে, আস্থা ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হবে; সমঝোতার পরিবেশ তৈরি হবে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর অর্থনীতির গতি-প্রকৃতিও নির্ভর করে। রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন হলে অর্থনীতিও ভালো থাকবে। কারণ, স্থিতিশীল পরিস্থিতি থাকলে নতুন বিনিয়োগ হবে, মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে সামাজিক নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হয়। বিশেষ করে, গেল বছরে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বেশি উৎকণ্ঠা ছিল। রাজনৈতিক সহিংসতার পাশাপাশি গুম-খুনের মতো মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। প্রত্যাশা থাকবে, নতুন বছরে আর একজন ব্যক্তিও মানবাধিকার লংঘনের শিকার হবে না। মানুষের বিভিন্ন পর্যায়ে যে কষ্ট আছে, তা মোচনেই রাষ্ট্র-সরকার উদ্যোগী হবে। ড. এমাজউদ্দীন বলেন, “আমি লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘ইকোনমিস্ট’ পত্রিকার ভাষায় বলতে চাই, দেশে এখন ‘টক্সিক’ রাজনীতি চলছে।” সরকার রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে যথেচ্ছা ব্যবহার করছে, ফলে এসব প্রতিষ্ঠান বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। যেমন নির্বাচন কমিশন যে আচরণ করছে তাতে সুশাসন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। আর তাতেই গণতন্ত্র মূল্যহীন হয়ে পড়ছে। সুশাসনের পথে উঠতে হয় গণতন্ত্র দিয়ে, গণতন্ত্রে উঠতে হয় সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে। যেখানে নির্বাচনী ব্যবস্থাটাই নষ্ট করে ফেলা হয়েছে, জনগণকে তাদের পছন্দের প্রতিনিধিকে দায়িত্বে বসাতে দেয়া হচ্ছে না। যে কারণে দেশ এগোচ্ছে এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। তিনি আইনশৃংখলা বাহিনীর উদ্দেশে বলেন, তাদের বলব, আইনশৃংখলা রক্ষাই তাদের কাজ। এর নামে নির্যাতন করা নয়, অথচ যা হচ্ছে তা আইনশৃংখলা রক্ষার নামে নির্যাতন। এ প্রসঙ্গে তিনি নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের ঘটনায় র্যাবের সংশ্লিষ্টতা উল্লেখ করেন।
এম হাফিজ উদ্দিন খান : অনেকটাই হতাশাব্যঞ্জক মন্তব্য হাফিজ উদ্দিন খানের। তিনি বলেন, নতুন বছর নতুন কোনো বার্তা বয়ে নিয়ে আসবে বলে মনে হচ্ছে না। গত পুরো বছরে শাসন দিন দিন কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছে, ২০১৬-তে তা আরও বেশি জেঁকে বসবে। রাজনীতিতে কোনো সমঝোতার লক্ষণ নেই মন্তব্য করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এই উপদেষ্টা এক্ষেত্রে সহনশীলতার অভাব তুলে ধরেন। তবে, দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে এবং আগামী বছরেও সেটা বিরাজ থাকলে জনগণের জীবনমানও উন্নত হবে বলে মনে করেন তিনি। আর এজন্য সব ক্ষেত্রেই জবাবদিহিতা এবং অপরাধ দমনের পাশাপাশি শান্তিময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি কামনা করেন তিনি।
মাতলুব আহমাদ : বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মাতলুব আহমাদ অবশ্য হতাশার বিপরীতে আশার কথাই শুনিয়েছেন। তিনি বলেন, গত বছর ব্যাংক সেক্টরে অনেক সাফল্য, উন্নয়ন ও অগ্রগতি আছে। বাংলাদেশ ক্রমশ বিনিয়োগের জন্য উত্তম জায়গা হয়ে উঠছে, বিভিন্ন জায়গা থেকে এমন কথা শুনেছি। বাংলাদেশ নিয়ে জাতিসংঘ থেকেও বিভিন্ন বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব লক্ষ্য করেছি। যে কারণে আমরা আশা করছি, ২০১৬ সাল শিল্পের জন্য হয়ে উঠবে স্বর্ণ বছর। তবে, গ্যাসের চাহিদা উত্তরোত্তর বাড়ায় এবং গ্যাসের কোনো বিকল্প সংকুলান না থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি। তাছাড়া গার্মেন্ট সেক্টরে অস্থিরতা বারবার নিরসন হলেও এখানে কোনো অপশক্তি কাজ করছে বলে আশংকা তার। সে কারণে এ সেক্টরে সতর্ক দৃষ্টি কামনা করেন তিনি।
খুশী কবির : খুশী কবির বলেন, বিদায়ী বছর যেভাবে শেষ হয়েছে নতুন বছরটাও সেভাবে গেলে সেটা ভালো হবে না। কেননা ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সূচকের অগ্রগতিসহ আমাদের অনেক অর্জন থাকলেও মানুষ পুরো বছরই জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত ছিল। বেড়েছে নারীদের নিরাপত্তাহীনতাও। ভিন্ন মত পোষণকারী, ভিন্ন আদর্শ ধারণকারী, ভিন্ন জীবন-যাপনকারীদের ওপর খক্ষ ছিল নিয়মিতই। এসব বিষয়ে সরকার যদি আন্তরিক হয় নতুন বছরে সেটা হবে অনেক খুশির খবর। খুশী কবির বলেন, সরকারে যারা আছেন, তাদেরও সমালোচনা সহ্য করতে হবে। সহিংসতার কারণগুলো চিহ্নিত করে তা বন্ধ করতে হবে। গণতন্ত্রের কথা শুধু মুখে নয়, কর্মকাণ্ডেও তার প্রতিফলন করতে হবে। জবাবদিহিতার জায়গা স্পষ্ট করতে হবে, সত্যিকারের অপরাধীদের সাজা নিশ্চিত করতে হবে। জঙ্গিদের জামিন নিয়ে আদালত-পুলিশের টানাটানি উল্লেখ করে তিনি বলেন, জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িক হামলা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ দেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। এই মানবাধিকার কর্মী একটি শক্তিশালী বিরোধী পক্ষের অভাব পর্যবেক্ষণ করেছেন মত দিয়ে বলেন, রাজনীতিতে সহনশীলতা-সমঝোতা উন্নয়নের পূর্বশর্ত, সরকারকে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে। মত প্রকাশের সুযোগ অবারিত রাখার কথাও তুলে ধরেন তিনি।
বছরের শেষ দিন আশা জাগিয়েছে ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যার বিচার। এর আগের দিন অনুষ্ঠিত পৌর নির্বাচনও অনেক সম্ভাবনারই ইঙ্গিত দিয়ে গেছে। এত প্রাপ্তি, সম্ভাবনা আর হাসি দিয়ে শেষ করা বছরটি কিন্তু শুরু হয়েছিল দারুণ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়। ২০১৫ সালের প্রথম সপ্তাহেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি। চোরাগোপ্তা হামলা, অগ্নিসংযোগ, দগ্ধ মানুষের আহাজারি, স্বজন হারানো পরিবারগুলোর হাহাকারে ভারি ছিল চারদিক। দীর্ঘ তিন মাস চলে এ অবস্থা। এরপর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসে সবকিছু। বছরের মাঝামাঝি শুরু হয় বিদেশী নাগরিক হত্যা, লেখক-ব্লগারদের ওপর হামলা, ধর্মযাজক, মসজিদ-মন্দির এবং সংখ্যালঘু ও সাম্প্রদায়িক হামলায় ব্যাপ্তি পায়। এসব ঘটনাসহ নানা ধরনের স্মৃতি নিয়ে মানুষ বরণ করে নিল নতুন বছর। কিন্তু কেমন কাটবে ২০১৬? দেশের বিশিষ্ট নাগরিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও শিক্ষক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ড. এমাজউদ্দীন আহমদ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান, এফবিসিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট মাতলুব আহমাদ এবং মানবাধিকার কর্মী খুশী কবীরের সঙ্গে কথা বলে যুগান্তর এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চেয়েছে।
তাদের প্রত্যেকের মতেই ভালোমন্দ মিলিয়েই কেটেছে গেল বছর। দেশ এগিয়েছে। হয়েছে সামগ্রিক উন্নয়ন। সব সূচকেই এগিয়ে বিশ্বে প্রশংসিত হচ্ছে বাংলাদেশ। এসবের ধারাবাহিকতা কামনার পাশাপাশি অনেক শংকাও ব্যক্ত করেছেন তারা। নতুন বছরে শান্তি, সমঝোতা আর সংঘাতমুক্ত পরিস্থিতির স্বার্থে সব পক্ষের শুভবুদ্ধির উদয় হবে বলে প্রত্যাশা তাদের সবার। তাদের কামনা রাজনীতিতে সহনশীলতা, মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা, জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস এবং অপরাধ দমন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে সত্যিকারের শোষণ, বঞ্চনাহীন, অসাম্প্রদায়িক-প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে উঠুক। তাদের প্রত্যাশা, ২০১৫-তে বিনিয়োগে আশানুরূপ সাড়া না থাকলেও ২০১৬ হয়ে উঠবে শিল্পের স্বর্ণ বছর। আর সবকিছুর মূলে অতীতে যে সুশাসনের অভাব ছিল সেটা এ বছর ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। কেননা সুশাসনই রাষ্ট্রকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাবে, জনগণকে করবে স্বাধীন ও নির্ভার।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বিদায়ী বছরে রাজনীতিসহ সব ক্ষেত্রেই সহনশীলতার অভাব ছিল। তিনি সহনশীলতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নতুন বছরে বৈষম্য দূর এবং উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়ানোর ওপর জোর দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। গেল বছরে সাম্প্রদায়িক হামলা ও বিদেশী হত্যার অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, যারা এসব ঘটাচ্ছে তারা হতাশা থেকে ঘটিয়েছে, বেকারত্ব থেকে ঘটিয়েছে। এর পেছনে বিদেশী শক্তির ইন্ধন ও অর্থ দুটোই ছিল। কেননা এরা সেই শক্তি যারা বাংলাদেশে বিভিন্ন স্বার্থ কায়েম করতে চায়। এসব শক্তির প্রসার ও ব্যাপ্তি দুটোই বাড়ছে উল্লেখ করে এই শিক্ষক বলেন, এদের মোকাবেলাই হবে ২০১৬-তে একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ। দেশপ্রেমের শক্তিতে এদের রুখে দিয়ে দেশের ভেতরে যারা ভ্রান্ত পথে গিয়ে এসব ঘটিয়েছে তাদের সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারলে নতুন বছর অনেক শান্তিময় হবে বলে তিনি আশা করেন। আর তারুণ্য তাকে এখনও আশাবাদী করে। তিনি বলেন, আজকের তরুণরা প্রতিবাদ করছে, আন্দোলন করছে, লেখাপড়া করছে, নিজের ক্যারিয়ার নিজেই গড়ছে, সঠিক ইতিহাস চর্চার আগ্রহ দেখাচ্ছে, এসব খুব ইতিবাচক দিক। তাই নিজেদের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে আগ্রহী তারুণ্যেই আস্থা তার।
অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ : অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, তার প্রত্যাশা আগামী বছর হোক শান্তির বছর। ২০১৫ সালে গণতান্ত্রিক রীতি ও মূল্যবোধের যে নাজুক অবস্থা ছিল, তার শুভ পরিবর্তন হোক নতুন বছরে। একটি বিষয় বুঝতে হবে, এ দেশটি আর শিশুরাষ্ট্র নয়। এটি পরিণত রাষ্ট্র। এ কারণে মানবিক মূল্যবোধ, গণতান্ত্রিক রীতি, শিষ্টাচার, পরমত সহিষ্ণুতার ব্যাপারে অনেক বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে সবাইকে। বিশেষ করে যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, তাদের এ বিষয়ে বেশি সচেতন থাকা দরকার। তিনি বলেন, রাজনীতিতে অস্থিরতা-উৎকণ্ঠা কেন, এটা কারও অজানা নয়। যে বিষয় সবাই জানে, তার সমাধানও কঠিন হওয়ার কথা নয়। সমস্যা হচ্ছে শ্রদ্ধাবোধ, আস্থা এবং পরমত সহিষ্ণুতার অভাব। এই অভাবগুলোর আবর্তেই রাজনীতি ঘুরপাক খাচ্ছে। আশা করা যায়, নতুন বছরে সবার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হবে, আস্থা ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হবে; সমঝোতার পরিবেশ তৈরি হবে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর অর্থনীতির গতি-প্রকৃতিও নির্ভর করে। রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন হলে অর্থনীতিও ভালো থাকবে। কারণ, স্থিতিশীল পরিস্থিতি থাকলে নতুন বিনিয়োগ হবে, মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে সামাজিক নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হয়। বিশেষ করে, গেল বছরে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বেশি উৎকণ্ঠা ছিল। রাজনৈতিক সহিংসতার পাশাপাশি গুম-খুনের মতো মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। প্রত্যাশা থাকবে, নতুন বছরে আর একজন ব্যক্তিও মানবাধিকার লংঘনের শিকার হবে না। মানুষের বিভিন্ন পর্যায়ে যে কষ্ট আছে, তা মোচনেই রাষ্ট্র-সরকার উদ্যোগী হবে। ড. এমাজউদ্দীন বলেন, “আমি লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘ইকোনমিস্ট’ পত্রিকার ভাষায় বলতে চাই, দেশে এখন ‘টক্সিক’ রাজনীতি চলছে।” সরকার রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে যথেচ্ছা ব্যবহার করছে, ফলে এসব প্রতিষ্ঠান বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। যেমন নির্বাচন কমিশন যে আচরণ করছে তাতে সুশাসন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। আর তাতেই গণতন্ত্র মূল্যহীন হয়ে পড়ছে। সুশাসনের পথে উঠতে হয় গণতন্ত্র দিয়ে, গণতন্ত্রে উঠতে হয় সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে। যেখানে নির্বাচনী ব্যবস্থাটাই নষ্ট করে ফেলা হয়েছে, জনগণকে তাদের পছন্দের প্রতিনিধিকে দায়িত্বে বসাতে দেয়া হচ্ছে না। যে কারণে দেশ এগোচ্ছে এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। তিনি আইনশৃংখলা বাহিনীর উদ্দেশে বলেন, তাদের বলব, আইনশৃংখলা রক্ষাই তাদের কাজ। এর নামে নির্যাতন করা নয়, অথচ যা হচ্ছে তা আইনশৃংখলা রক্ষার নামে নির্যাতন। এ প্রসঙ্গে তিনি নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের ঘটনায় র্যাবের সংশ্লিষ্টতা উল্লেখ করেন।
এম হাফিজ উদ্দিন খান : অনেকটাই হতাশাব্যঞ্জক মন্তব্য হাফিজ উদ্দিন খানের। তিনি বলেন, নতুন বছর নতুন কোনো বার্তা বয়ে নিয়ে আসবে বলে মনে হচ্ছে না। গত পুরো বছরে শাসন দিন দিন কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছে, ২০১৬-তে তা আরও বেশি জেঁকে বসবে। রাজনীতিতে কোনো সমঝোতার লক্ষণ নেই মন্তব্য করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এই উপদেষ্টা এক্ষেত্রে সহনশীলতার অভাব তুলে ধরেন। তবে, দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে এবং আগামী বছরেও সেটা বিরাজ থাকলে জনগণের জীবনমানও উন্নত হবে বলে মনে করেন তিনি। আর এজন্য সব ক্ষেত্রেই জবাবদিহিতা এবং অপরাধ দমনের পাশাপাশি শান্তিময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি কামনা করেন তিনি।
মাতলুব আহমাদ : বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মাতলুব আহমাদ অবশ্য হতাশার বিপরীতে আশার কথাই শুনিয়েছেন। তিনি বলেন, গত বছর ব্যাংক সেক্টরে অনেক সাফল্য, উন্নয়ন ও অগ্রগতি আছে। বাংলাদেশ ক্রমশ বিনিয়োগের জন্য উত্তম জায়গা হয়ে উঠছে, বিভিন্ন জায়গা থেকে এমন কথা শুনেছি। বাংলাদেশ নিয়ে জাতিসংঘ থেকেও বিভিন্ন বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব লক্ষ্য করেছি। যে কারণে আমরা আশা করছি, ২০১৬ সাল শিল্পের জন্য হয়ে উঠবে স্বর্ণ বছর। তবে, গ্যাসের চাহিদা উত্তরোত্তর বাড়ায় এবং গ্যাসের কোনো বিকল্প সংকুলান না থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি। তাছাড়া গার্মেন্ট সেক্টরে অস্থিরতা বারবার নিরসন হলেও এখানে কোনো অপশক্তি কাজ করছে বলে আশংকা তার। সে কারণে এ সেক্টরে সতর্ক দৃষ্টি কামনা করেন তিনি।
খুশী কবির : খুশী কবির বলেন, বিদায়ী বছর যেভাবে শেষ হয়েছে নতুন বছরটাও সেভাবে গেলে সেটা ভালো হবে না। কেননা ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সূচকের অগ্রগতিসহ আমাদের অনেক অর্জন থাকলেও মানুষ পুরো বছরই জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত ছিল। বেড়েছে নারীদের নিরাপত্তাহীনতাও। ভিন্ন মত পোষণকারী, ভিন্ন আদর্শ ধারণকারী, ভিন্ন জীবন-যাপনকারীদের ওপর খক্ষ ছিল নিয়মিতই। এসব বিষয়ে সরকার যদি আন্তরিক হয় নতুন বছরে সেটা হবে অনেক খুশির খবর। খুশী কবির বলেন, সরকারে যারা আছেন, তাদেরও সমালোচনা সহ্য করতে হবে। সহিংসতার কারণগুলো চিহ্নিত করে তা বন্ধ করতে হবে। গণতন্ত্রের কথা শুধু মুখে নয়, কর্মকাণ্ডেও তার প্রতিফলন করতে হবে। জবাবদিহিতার জায়গা স্পষ্ট করতে হবে, সত্যিকারের অপরাধীদের সাজা নিশ্চিত করতে হবে। জঙ্গিদের জামিন নিয়ে আদালত-পুলিশের টানাটানি উল্লেখ করে তিনি বলেন, জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িক হামলা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ দেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। এই মানবাধিকার কর্মী একটি শক্তিশালী বিরোধী পক্ষের অভাব পর্যবেক্ষণ করেছেন মত দিয়ে বলেন, রাজনীতিতে সহনশীলতা-সমঝোতা উন্নয়নের পূর্বশর্ত, সরকারকে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে। মত প্রকাশের সুযোগ অবারিত রাখার কথাও তুলে ধরেন তিনি।
No comments