রাজনীতি ২০১৬: গণতন্ত্র ও সমৃদ্ধি দুটোই চাই! by কামাল আহমেদ
নতুন বছরে অর্থনীতি নিয়ে আছে অনেক প্রত্যাশা। কিন্তু রাজনীতিতে আছে নানা শঙ্কা। সবাই মানেন যে রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা থাকলে আরও এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। তাই নতুন বছরের আকাঙ্ক্ষা—রাজনীতির গুমোট ভাব কাটবে, অর্থনীতি আরও এগিয়ে যাবে। বাড়ুক গণতন্ত্রের চর্চা, কেটে যাক জঙ্গিবাদের হুমকি। সুস্থ রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সমৃদ্ধি বাড়ুক বাংলাদেশের।
নতুন বছর ঘিরে সবার মনেই স্বপ্ন থাকে, আশা জাগে। ব্যক্তিগত সেই চাওয়াগুলোর গুরুত্ব অনেক। কারও আশা পরীক্ষায় ভালো ফল, কারও নতুন চাকরি কিংবা ব্যবসায়িক সাফল্য, বিদেশ যাত্রা, পছন্দের জীবনসঙ্গী খুঁজে পাওয়া, ঘর বাঁধা, নতুন বাড়ি, নতুন কিছু। সোজা কথায়, নতুন এবং আরও ভালো সমৃদ্ধ জীবন। ২০১৬-তে সবার আশা পূর্ণ হোক, সেই শুভকামনা সবার জন্যই।
২০১৬ সাল আমাদের স্বাধীনতার ৪৫তম বছর। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ২০১৫ সালের বেশির ভাগ সময় আমাদের ভালো কাটেনি। একধরনের অস্থিরতা ও গুমোট রাজনৈতিক পরিবেশ স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ছন্দপতনের কারণ হয়েছে।
ফেলে আসা বছরের শুরুটা ছিল অবিশ্বাস্য রকম নৃশংস ও নিষ্ঠুরতায় ভরা। রাজপথের বিরোধী দল বিএনপির দায়িত্বহীনতা এবং হঠকারিতার খেসারত হিেসবে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে বিরোধী দল প্রায় অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু সেই আপাতশূন্যতার জায়গায় কখনো জঙ্গিবাদের মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা, আবার কখনো ক্ষমতাসীন দলের অন্তর্কলহ অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু, শঙ্কা ও উদ্বেগের জন্ম দেয়। যেমনটি কখনো শোনা যায়নি, তেমন সব নতুন নতুন নজির তৈরি হতে থাকে। ঢাকায় এবং জেলা শহরের গ্রামের রাস্তায় খুন হন বিদেশি নাগরিক। আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে গুলিবিদ্ধ হয় মায়ের গর্ভে থাকা শিশু। তবে, অসম্ভব প্রতিকূলতার মধ্যেও জীবনের জয়রথ টিকে যায়। সেই শিশু সুরাইয়ার বেঁচে থাকা ও বেড়ে ওঠাই হচ্ছে ক্ষমতার লড়াইয়ের নিষ্ঠুর আঘাতের শিকার দেশ এবং মানুষের অদম্য প্রাণশক্তির প্রতীক।
বছরের শুরুতে একদিকে ছিল আন্দোলনের নামে নৃশংস আগুনে বোমায় মানুষ পোড়ানো, অন্যদিকে নৈরাজ্য ঠেকানোর নামে গুলি ও বিরোধী কর্মীদের গুম বা হাওয়া করে দেওয়া। জানুয়ারির ২ তারিখে রাজপথের বিরোধিতা বন্ধে সরকারি ইশারায় যান চলাচল বন্ধ করে দিয়ে দেশে অঘোষিত যে অচলাবস্থা শুরু হয়, তারই ধারাবাহিকতায় বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করা হয় তাঁর অফিসে। একই সময়ে শুরু হয় দেশব্যাপী অনির্দিষ্টকালের অবরোধ। রাজনৈতিক সহিংসতা, দমন-পীড়ন এবং অবরোধের পালা চলে তিন মাসের বেশি। ভীতিকর পরিস্থিতি সত্ত্বেও বিএনপির সেই অবরোধ ভেঙে পড়ে। অবশেষে বিদেশি কূটনীতিকদের নেপথ্য দূতিয়ালিতে নজিরবিহীন এই অস্থিরতার অবসান ঘটে। তবে, রাজনীতিতে কোনো সমঝোতার আভাস মেলে না। পরপর দ্বিতীয় বছরের মতো বিএনপির রাজনীতি ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের কৌশলের কাছে পরাস্ত হয়। যার ফল হিসেবে দলটির সাংগঠনিক সক্ষমতা প্রায় লোপ পাওয়ার উপক্রম ঘটে।
যে নির্বাচনী ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা শেষ হয়ে গেছে বলে বিএনপি ও তার সহযোগীরা, তারাই মাস খানেকের ব্যবধানে ঢাকা ও চট্টগ্রামের সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে রাজনীতির মাঠে ফেরার উপায় মেনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশ নেয়। তবে, কমিশনের কথিত পক্ষপাত ও অযোগ্যতার দোষে দুষ্ট নির্বাচনের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে লড়াইয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে তারা তা বর্জনের ঘোষণা দিয়ে সরে দাঁড়ায়। সেটি ছিল এপ্রিলের কথা আর নির্বাচনটিও দলীয় প্রতীকের লড়াই ছিল না। এর ঠিক সাত মাস পর সরকার সিদ্ধান্ত নিল নৌকা ও ধানের শীষের লড়াই আয়োজনের। পৌর আইন সংশোধন করে ঘোষিত হলো দলভিত্তিক মেয়র নির্বাচনের তফসিল। পুরো বছরটিতে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ করার সুযোগ তেমন একটা না পেলেও বছর শেষে ডিসেম্বরজুড়ে বিএনপি আবারও তাদের রাজনীতির ধারাকে সংগঠিত করা ও জনগণের কাছে যাওয়ার সুযোগ পেল। এবারে ভোটের লড়াইয়ে তারা শেষ পর্যন্ত থাকার প্রত্যয় ঘোষণা করল এবং থাকার চেষ্টাও করল। যদিও নির্বাচনী সাফল্য তেমন একটা না জোটায় তারা ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে তা প্রত্যাখ্যানের কথা বলেছে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। দেশে-বিদেশে ওই নির্বাচন নিয়ে ক্লান্তিকর বিতর্ক সময়ের ব্যবধানে এখন অবশ্য কিছুটা থিতিয়েও এসেছে। কিন্তু সরকারের নানা পর্যায়ে একটা অস্বস্তি রয়েই গেছে। অস্বস্তিটা তাদের ক্ষমতায়নের পালায় গণতান্ত্রিক বোধের ঘাটতির কারণে। ইংরেজিতে যাকে বলে ডেফিশিয়েন্সি ইন ডেমোক্র্যাটিক ম্যান্ডেট। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের এই দুটি নির্বাচনের বিষয়ে সরকারের উদ্যোগ ও সিদ্ধান্তের দুটি বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। প্রথমত, একটা চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে কয়েক বছর ধরে ঝুলে থাকা ঢাকার সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ। দ্বিতীয়ত, পৌর নির্বাচনকে দলীয় ভিত্তিতে আয়োজনের সিদ্ধান্ত। এই দুই সিদ্ধান্তেই চরম সংকটে পড়া রাজনৈতিক দল বিএনপি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে আবারও ফিরে আসার সুযোগ পেয়েছে। এখন পৌর নির্বাচনে বড় ধরনের অনিয়মের অভিযোগ তুলে ফলাফল প্রত্যাখ্যানের কথা বললেও তারা এমন কোনো কর্মসূচি দেয়নি, যা আবারও সহিংসতার ঝুঁকি সৃষ্টি করে। তাহলে কি আমরা আশা করতে পারি নতুন বছরে বিএনপি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির ধারাতেই আবার সংগঠিত হবে? রাজনৈতিক সহিংসতার পুনরাবৃত্তিও আর ঘটবে না? এমনটিই তো আমরা চাই।
সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সর্বশেষ যে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছিল, তার ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে গত মাসে। কিন্তু গণতন্ত্রের অভিযাত্রা বজায় রাখতে তখন যে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার অধিকাংশই ঝাপসা হয়ে গেছে। নব্বইয়ে ক্ষমতা হারানো স্বৈরাচার এখন ক্ষমতারও অংশীদার, আবার একইসাথে সংসদীয় বিরোধী দলের আসনে আসীন। দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে গড়ে ওঠা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত ভাঙার চেষ্টা যে সফল হয়নি, তার প্রমাণ গত কয়েকটি নির্বাচন। উপজেলা, সিটি করপোরেশন কিংবা পৌরসভা—কোনো কাঠামোতেই জাতীয় পার্টি জনগণের কাছে আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয়নি। স্বৈরতান্ত্রিক ও সুবিধাবাদের রাজনীতি প্রত্যাখ্যানের এই ধারা নিঃসন্দেহে স্বস্তিদায়ক।
এ কথা সত্যি যে সংসদের বাইরের বিরোধী দল বিএনপি আর চাপ প্রয়োগ করে দাবি আদায়ের মতো অবস্থায় নেই। এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপরই এখন নির্ভর করছে ভবিষ্যৎ। তিনি চাইলে ভিন্নমত ও রাজনৈতিক বিতর্ককে উৎসাহিত করার পরিবেশ সৃষ্টিতে কিছুটা ছাড় দিলেও দিতে পারেন। কোনো ধরনের সমঝোতা (নেপথ্যে হয়ে থাকলে আলাদা কথা) অদূর ভবিষ্যতে সম্ভব, এমনটা আশা কেউ করেন বলে মনে হয় না। কিন্তু পরিস্থিতির গুমোট ভাব কাটাতে প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগী হবেন, সে আশা অনেকেই করেন। গত বছরের দুটি নির্বাচন থেকেই সেই আশাবাদের জন্ম। আগামী বছরে আরও বড় আকারের নির্বাচন—ইউনিয়ন পরিষদের ভোটের আয়োজনও হতে পারে একটি বড় মহড়া, যার সাফল্যে ভর করে আগাম জাতীয় নির্বাচন কি সত্যিই অসম্ভব? অনেকে ভাবেন বা বলেন, ২০১৬ সালে এটিই হবে একটি বড় প্রশ্ন।
২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামের সিটি নির্বাচনগুলো নিয়ে নির্বাচন কমিশন ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু পৌর নির্বাচনে তারা একেবারে নীরব দর্শকের ভূমিকা থেকে সামান্য হলেও রিঅ্যাকটিভ (প্রতিক্রিয়ামূলক ভূমিকা) হওয়ার চেষ্টা করেছে। এই সামান্য পদক্ষেপকেও অনেকে ইতিবাচক চোখে দেখেছেন। আশা করা যায়, এ থেকে কমিশন কিছুটা আস্থা ফিরে পাবে এবং ভবিষ্যতে উদ্যোগী বা প্রোঅ্যাকটিভ হবে। ২০১৭ সালে তাদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই এ বছর কমিশন কি তাহলে মেরুদণ্ড কিছুটা সোজা করে দাঁড়াবে?
কোনো গণতন্ত্রই বিরোধী দলহীন অবস্থায় চলতে পারে না। দীর্ঘ সময় তো নয়ই। বিজ্ঞান বলে, শূন্যস্থান বলে কিছু নেই। নিয়মতান্ত্রিক বিরোধী রাজনীতির জায়গাটি যে শূন্য থাকতে পারে না, সেটা বেশ ভালোই টের পাওয়া যাচ্ছে। জঙ্গিবাদের উত্থানের আশঙ্কায় তাই সবাই উদ্বিগ্ন। দুজন বিদেশি নাগরিক হত্যার পর একাধিক বিদেশি কূটনীতিক প্রকাশ্যেই বলেছেন যে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের জঙ্গি হিসেবে অভিহিত করাটা খুব সহজ কাজ, কিন্তু তাতে করে আসল জঙ্গিরাই পার পেয়ে যাবে। তেমনটি যাতে না হয়, সে জন্য জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে একটি জাতীয় ঐকমত্যের কথাও ভাবা প্রয়োজন। তবে, রাজনৈতিক অস্থিরতা কিংবা অস্বাভাবিক গুমোট পরিস্থিতি কোনোভাবেই তার সহায়ক হতে পারে না। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমকে চাপমুক্ত রাখা এবং নাগরিক সমাজ বা সিভিল সোসাইটির ভূমিকা সমাজে গণতন্ত্রের চর্চা ও জবাবদিহিতার সংস্কৃতিকে বিকশিত করে ওই অস্বস্তির অবসান ঘটাতে পারে। সুতরাং, বিরোধীদের বিনাশকে অগ্রাধিকার দেওয়ার নীতি পরিত্যাগ করে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অনুশীলনকে উৎসাহিত করাই হোক ২০১৬ সালের অন্যতম অগ্রাধিকার। গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করা রাজনীতিকদের তাই এ কথা মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে গণতন্ত্র ছাড়া কোনো রাষ্ট্র বা তার সমৃদ্ধি পূর্ণতা পায় না।
নতুন বছর ঘিরে সবার মনেই স্বপ্ন থাকে, আশা জাগে। ব্যক্তিগত সেই চাওয়াগুলোর গুরুত্ব অনেক। কারও আশা পরীক্ষায় ভালো ফল, কারও নতুন চাকরি কিংবা ব্যবসায়িক সাফল্য, বিদেশ যাত্রা, পছন্দের জীবনসঙ্গী খুঁজে পাওয়া, ঘর বাঁধা, নতুন বাড়ি, নতুন কিছু। সোজা কথায়, নতুন এবং আরও ভালো সমৃদ্ধ জীবন। ২০১৬-তে সবার আশা পূর্ণ হোক, সেই শুভকামনা সবার জন্যই।
২০১৬ সাল আমাদের স্বাধীনতার ৪৫তম বছর। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ২০১৫ সালের বেশির ভাগ সময় আমাদের ভালো কাটেনি। একধরনের অস্থিরতা ও গুমোট রাজনৈতিক পরিবেশ স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ছন্দপতনের কারণ হয়েছে।
ফেলে আসা বছরের শুরুটা ছিল অবিশ্বাস্য রকম নৃশংস ও নিষ্ঠুরতায় ভরা। রাজপথের বিরোধী দল বিএনপির দায়িত্বহীনতা এবং হঠকারিতার খেসারত হিেসবে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে বিরোধী দল প্রায় অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু সেই আপাতশূন্যতার জায়গায় কখনো জঙ্গিবাদের মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা, আবার কখনো ক্ষমতাসীন দলের অন্তর্কলহ অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু, শঙ্কা ও উদ্বেগের জন্ম দেয়। যেমনটি কখনো শোনা যায়নি, তেমন সব নতুন নতুন নজির তৈরি হতে থাকে। ঢাকায় এবং জেলা শহরের গ্রামের রাস্তায় খুন হন বিদেশি নাগরিক। আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে গুলিবিদ্ধ হয় মায়ের গর্ভে থাকা শিশু। তবে, অসম্ভব প্রতিকূলতার মধ্যেও জীবনের জয়রথ টিকে যায়। সেই শিশু সুরাইয়ার বেঁচে থাকা ও বেড়ে ওঠাই হচ্ছে ক্ষমতার লড়াইয়ের নিষ্ঠুর আঘাতের শিকার দেশ এবং মানুষের অদম্য প্রাণশক্তির প্রতীক।
বছরের শুরুতে একদিকে ছিল আন্দোলনের নামে নৃশংস আগুনে বোমায় মানুষ পোড়ানো, অন্যদিকে নৈরাজ্য ঠেকানোর নামে গুলি ও বিরোধী কর্মীদের গুম বা হাওয়া করে দেওয়া। জানুয়ারির ২ তারিখে রাজপথের বিরোধিতা বন্ধে সরকারি ইশারায় যান চলাচল বন্ধ করে দিয়ে দেশে অঘোষিত যে অচলাবস্থা শুরু হয়, তারই ধারাবাহিকতায় বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করা হয় তাঁর অফিসে। একই সময়ে শুরু হয় দেশব্যাপী অনির্দিষ্টকালের অবরোধ। রাজনৈতিক সহিংসতা, দমন-পীড়ন এবং অবরোধের পালা চলে তিন মাসের বেশি। ভীতিকর পরিস্থিতি সত্ত্বেও বিএনপির সেই অবরোধ ভেঙে পড়ে। অবশেষে বিদেশি কূটনীতিকদের নেপথ্য দূতিয়ালিতে নজিরবিহীন এই অস্থিরতার অবসান ঘটে। তবে, রাজনীতিতে কোনো সমঝোতার আভাস মেলে না। পরপর দ্বিতীয় বছরের মতো বিএনপির রাজনীতি ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের কৌশলের কাছে পরাস্ত হয়। যার ফল হিসেবে দলটির সাংগঠনিক সক্ষমতা প্রায় লোপ পাওয়ার উপক্রম ঘটে।
যে নির্বাচনী ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা শেষ হয়ে গেছে বলে বিএনপি ও তার সহযোগীরা, তারাই মাস খানেকের ব্যবধানে ঢাকা ও চট্টগ্রামের সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে রাজনীতির মাঠে ফেরার উপায় মেনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশ নেয়। তবে, কমিশনের কথিত পক্ষপাত ও অযোগ্যতার দোষে দুষ্ট নির্বাচনের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে লড়াইয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে তারা তা বর্জনের ঘোষণা দিয়ে সরে দাঁড়ায়। সেটি ছিল এপ্রিলের কথা আর নির্বাচনটিও দলীয় প্রতীকের লড়াই ছিল না। এর ঠিক সাত মাস পর সরকার সিদ্ধান্ত নিল নৌকা ও ধানের শীষের লড়াই আয়োজনের। পৌর আইন সংশোধন করে ঘোষিত হলো দলভিত্তিক মেয়র নির্বাচনের তফসিল। পুরো বছরটিতে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ করার সুযোগ তেমন একটা না পেলেও বছর শেষে ডিসেম্বরজুড়ে বিএনপি আবারও তাদের রাজনীতির ধারাকে সংগঠিত করা ও জনগণের কাছে যাওয়ার সুযোগ পেল। এবারে ভোটের লড়াইয়ে তারা শেষ পর্যন্ত থাকার প্রত্যয় ঘোষণা করল এবং থাকার চেষ্টাও করল। যদিও নির্বাচনী সাফল্য তেমন একটা না জোটায় তারা ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে তা প্রত্যাখ্যানের কথা বলেছে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। দেশে-বিদেশে ওই নির্বাচন নিয়ে ক্লান্তিকর বিতর্ক সময়ের ব্যবধানে এখন অবশ্য কিছুটা থিতিয়েও এসেছে। কিন্তু সরকারের নানা পর্যায়ে একটা অস্বস্তি রয়েই গেছে। অস্বস্তিটা তাদের ক্ষমতায়নের পালায় গণতান্ত্রিক বোধের ঘাটতির কারণে। ইংরেজিতে যাকে বলে ডেফিশিয়েন্সি ইন ডেমোক্র্যাটিক ম্যান্ডেট। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের এই দুটি নির্বাচনের বিষয়ে সরকারের উদ্যোগ ও সিদ্ধান্তের দুটি বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। প্রথমত, একটা চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে কয়েক বছর ধরে ঝুলে থাকা ঢাকার সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ। দ্বিতীয়ত, পৌর নির্বাচনকে দলীয় ভিত্তিতে আয়োজনের সিদ্ধান্ত। এই দুই সিদ্ধান্তেই চরম সংকটে পড়া রাজনৈতিক দল বিএনপি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে আবারও ফিরে আসার সুযোগ পেয়েছে। এখন পৌর নির্বাচনে বড় ধরনের অনিয়মের অভিযোগ তুলে ফলাফল প্রত্যাখ্যানের কথা বললেও তারা এমন কোনো কর্মসূচি দেয়নি, যা আবারও সহিংসতার ঝুঁকি সৃষ্টি করে। তাহলে কি আমরা আশা করতে পারি নতুন বছরে বিএনপি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির ধারাতেই আবার সংগঠিত হবে? রাজনৈতিক সহিংসতার পুনরাবৃত্তিও আর ঘটবে না? এমনটিই তো আমরা চাই।
সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সর্বশেষ যে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছিল, তার ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে গত মাসে। কিন্তু গণতন্ত্রের অভিযাত্রা বজায় রাখতে তখন যে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার অধিকাংশই ঝাপসা হয়ে গেছে। নব্বইয়ে ক্ষমতা হারানো স্বৈরাচার এখন ক্ষমতারও অংশীদার, আবার একইসাথে সংসদীয় বিরোধী দলের আসনে আসীন। দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে গড়ে ওঠা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত ভাঙার চেষ্টা যে সফল হয়নি, তার প্রমাণ গত কয়েকটি নির্বাচন। উপজেলা, সিটি করপোরেশন কিংবা পৌরসভা—কোনো কাঠামোতেই জাতীয় পার্টি জনগণের কাছে আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয়নি। স্বৈরতান্ত্রিক ও সুবিধাবাদের রাজনীতি প্রত্যাখ্যানের এই ধারা নিঃসন্দেহে স্বস্তিদায়ক।
এ কথা সত্যি যে সংসদের বাইরের বিরোধী দল বিএনপি আর চাপ প্রয়োগ করে দাবি আদায়ের মতো অবস্থায় নেই। এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপরই এখন নির্ভর করছে ভবিষ্যৎ। তিনি চাইলে ভিন্নমত ও রাজনৈতিক বিতর্ককে উৎসাহিত করার পরিবেশ সৃষ্টিতে কিছুটা ছাড় দিলেও দিতে পারেন। কোনো ধরনের সমঝোতা (নেপথ্যে হয়ে থাকলে আলাদা কথা) অদূর ভবিষ্যতে সম্ভব, এমনটা আশা কেউ করেন বলে মনে হয় না। কিন্তু পরিস্থিতির গুমোট ভাব কাটাতে প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগী হবেন, সে আশা অনেকেই করেন। গত বছরের দুটি নির্বাচন থেকেই সেই আশাবাদের জন্ম। আগামী বছরে আরও বড় আকারের নির্বাচন—ইউনিয়ন পরিষদের ভোটের আয়োজনও হতে পারে একটি বড় মহড়া, যার সাফল্যে ভর করে আগাম জাতীয় নির্বাচন কি সত্যিই অসম্ভব? অনেকে ভাবেন বা বলেন, ২০১৬ সালে এটিই হবে একটি বড় প্রশ্ন।
২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামের সিটি নির্বাচনগুলো নিয়ে নির্বাচন কমিশন ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু পৌর নির্বাচনে তারা একেবারে নীরব দর্শকের ভূমিকা থেকে সামান্য হলেও রিঅ্যাকটিভ (প্রতিক্রিয়ামূলক ভূমিকা) হওয়ার চেষ্টা করেছে। এই সামান্য পদক্ষেপকেও অনেকে ইতিবাচক চোখে দেখেছেন। আশা করা যায়, এ থেকে কমিশন কিছুটা আস্থা ফিরে পাবে এবং ভবিষ্যতে উদ্যোগী বা প্রোঅ্যাকটিভ হবে। ২০১৭ সালে তাদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই এ বছর কমিশন কি তাহলে মেরুদণ্ড কিছুটা সোজা করে দাঁড়াবে?
কোনো গণতন্ত্রই বিরোধী দলহীন অবস্থায় চলতে পারে না। দীর্ঘ সময় তো নয়ই। বিজ্ঞান বলে, শূন্যস্থান বলে কিছু নেই। নিয়মতান্ত্রিক বিরোধী রাজনীতির জায়গাটি যে শূন্য থাকতে পারে না, সেটা বেশ ভালোই টের পাওয়া যাচ্ছে। জঙ্গিবাদের উত্থানের আশঙ্কায় তাই সবাই উদ্বিগ্ন। দুজন বিদেশি নাগরিক হত্যার পর একাধিক বিদেশি কূটনীতিক প্রকাশ্যেই বলেছেন যে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের জঙ্গি হিসেবে অভিহিত করাটা খুব সহজ কাজ, কিন্তু তাতে করে আসল জঙ্গিরাই পার পেয়ে যাবে। তেমনটি যাতে না হয়, সে জন্য জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে একটি জাতীয় ঐকমত্যের কথাও ভাবা প্রয়োজন। তবে, রাজনৈতিক অস্থিরতা কিংবা অস্বাভাবিক গুমোট পরিস্থিতি কোনোভাবেই তার সহায়ক হতে পারে না। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমকে চাপমুক্ত রাখা এবং নাগরিক সমাজ বা সিভিল সোসাইটির ভূমিকা সমাজে গণতন্ত্রের চর্চা ও জবাবদিহিতার সংস্কৃতিকে বিকশিত করে ওই অস্বস্তির অবসান ঘটাতে পারে। সুতরাং, বিরোধীদের বিনাশকে অগ্রাধিকার দেওয়ার নীতি পরিত্যাগ করে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অনুশীলনকে উৎসাহিত করাই হোক ২০১৬ সালের অন্যতম অগ্রাধিকার। গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করা রাজনীতিকদের তাই এ কথা মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে গণতন্ত্র ছাড়া কোনো রাষ্ট্র বা তার সমৃদ্ধি পূর্ণতা পায় না।
No comments