বিএনপির কালো দিবস -সোহরাব হাসান
প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপি অনেক বেশি ভাগ্যবান। ৬০ বছর বয়সী আওয়ামী লীগ সাকুল্যে সাড়ে নয় বছর দেশ শাসন করেছে। আর বিএনপি ক্ষমতাসীন হয়েছে ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই। তাদের ক্ষমতার মেয়াদ ১৫ বছরেরও বেশি। রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি প্রচলিত কথা আছে, আওয়ামী লীগ পরিবারে জন্ম না নিলে কেউ খাঁটি আওয়ামী লীগার হতে পারেন না—ন্যাপের মহিউদ্দিন থেকে যান। কিন্তু বিএনপিতে ওসব শুচিবাই নেই। সেখানে নকশাল-বাকশাল, দালাল-যুদ্ধাপরাধী, তোষামোদি-উদারপন্থী— সব একাকার হয়ে যায়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপির সাফল্য আশাতীত। তারা চার-চার বার সরকার গঠন করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করে আবার তার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ শুধু ক্ষমতাচ্যুত হয়নি, দলটিও কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল। অন্যদিকে ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পরও ১০ মাস বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। পরে এরশাদ যাঁদের নিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ এখন বিএনপিতে আছেন।
বিএনপির এত সাফল্য-কৃতিত্ব সত্ত্বেও একটি অপূর্ণতা ছিল—তা হলো, তাদের কোনো কালো বা কৃষ্ণ দিবস নেই। ছিল না। আওয়ামী লীগের কালো দিবস বেশুমার। ১৫ আগস্ট। ৩ নভেম্বর। ৭ নভেম্বরও আওয়ামী লীগের জন্য কালো দিবস। অন্যদিকে বিএনপি এসব কালো দিবসের আলো নিয়েছে শুধু। সুবিধা আদায় করেছে।
আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি নিজেকে আপসহীন দাবি করলেও, তাতে আওয়ামী লীগ ও বাম দলগুলোর নেতা-কর্মীরাই বেশি জীবন দিয়েছেন। ময়েজউদ্দীন আহমদ ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা। তাজুল ইসলাম ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা। সেলিম, দেলোয়ার, বসুনিয়া ছাত্রলীগের কর্মী। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর নূর হোসেন নামের যে তরুণ বুকে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ স্লোগান এঁটে জীবন দিয়েছিলেন, তিনিও ছিলেন যুবলীগের কর্মী। অতএব, এসব দিবসের মালিকও বিএনপি নয়।
খালেদা জিয়ার পয়লা জমানাটি মোটামুটি চলে গেলেও দ্বিতীয় মেয়াদে এসে তারা একটার পর একটা কালো দিবস সৃষ্টি করতে থাকে এবং প্রতিটির লক্ষ্য ছিল, আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী সংগঠনগুলো। ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলা, ২৭ জানুয়ারি শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা, ২৭ ফেব্রুয়ারি হুমায়ুন আজাদ হত্যাচেষ্টা, ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী বোমা হামলা, ৭ নভেম্বর শ্রমিকনেতা আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যা ইত্যাদি। এসব কৃষ্ণ দিবসেও বিএনপির হক নেই। বরং কোনো কোনো সন্ত্রাসী ঘটনায় তাদের নেতা-কর্মীদের জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ বেরিয়ে আসছে।
কৃষ্ণ দিবসবিহীন বিএনপি এত বড় বঞ্চনা ও বৈষম্য মেনে নেয় কীভাবে? অতএব, তাদেরও একটি কৃষ্ণ দিবস থাকা জরুরি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কল্যাণে তারা সেটি পেয়েও গেল। ১১ জানুয়ারি সাড়ম্বরে বিএনপি কালো দিবস পালনও করল। নেতারা বিচার দাবি করলেন এক-এগারোর কুশীলবদের। কিন্তু কেন এবং কাদের জন্য ১১ জানুয়ারির অঘটন ঘটল, সে সম্পর্কে বিএনপি নেতারা টুঁ-শব্দটি করলেন না। ১১ জানুয়ারির কুশীলবদের বিরুদ্ধে তাঁদের অভিযোগ কী? তত্ত্বাবধায়ক সরকার অন্যায়ভাবে দুই বছর ক্ষমতায় ছিল। সংবিধান তাদের মেয়াদ তিন মাস নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। জরুরি আইন জারি করে জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করেছিল। বিএনপি নেতাদের কাছে জানতে চাই, ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করে তাঁরা কার স্বার্থ রক্ষা করেছিলেন? মরহুম জিয়াউর রহমান কোন সংবিধানবলে ক্ষমতায় এসেছিলেন? তাঁর মেয়াদ কত দিন নির্দিষ্ট ছিল? কোন আইনবলে তিনি সেনাপ্রধানের পদে বহাল থেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেছিলেন?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সব কাজ ভালো ছিল, আমরা তা বলি না। তাদের দুই নেত্রীবিয়োগ কৌশল জনগণ মেনে নেয়নি। দুর্নীতি দমনের নামে লোকজনকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন চালানোর ঘটনাও নিন্দনীয়। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার জনগণকে দেওয়া একটি কথা তো অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। বিলম্বে হলেও তারা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে বিদায় নিয়েছে। এ রকম স্বেচ্ছায় ও সানন্দে ক্ষমতা ত্যাগের নজির অন্তত রাজনীতিকদের মধ্যে নেই। বিএনপির নেতারা কষ্ট করে ইতিহাস না ঘাঁটলেও অনুগ্রহ করে জনগণের মনের ভাষাটি পড়ে দেখতে পারেন। তাঁরা যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সবকিছু নাকচ করে দিচ্ছেন, তখন নিরপেক্ষ জরিপে দেখা যায়, ৬৫ শতাংশ মানুষ তাঁদের (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) কাজ সঠিক ছিল বলে মত দিয়েছেন।
কালো দিবস সব সময় কালো নয়। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো যদি ভুল স্বীকার করে আত্মশুদ্ধির চেষ্টা চালায়, তাহলে জনগণকে বারবার দুর্ভোগ আর দুঃশাসনের শিকার হতে হয় না। আর যদি তারা একের পর এক ভুল করতে থাকে এবং সবকিছুতে মহা ষড়যন্ত্র খোঁজে, তাহলে একই বৃত্তে আমাদের রাজনীতি ঘুরপাক খাবে এবং এক-এগারোর পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকবে। বিএনপি সম্ভবত দ্বিতীয় পথটিই বেছে নিয়েছে।
সোহরাব হাসান: সাংবাদিক।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপির সাফল্য আশাতীত। তারা চার-চার বার সরকার গঠন করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করে আবার তার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ শুধু ক্ষমতাচ্যুত হয়নি, দলটিও কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল। অন্যদিকে ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পরও ১০ মাস বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। পরে এরশাদ যাঁদের নিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ এখন বিএনপিতে আছেন।
বিএনপির এত সাফল্য-কৃতিত্ব সত্ত্বেও একটি অপূর্ণতা ছিল—তা হলো, তাদের কোনো কালো বা কৃষ্ণ দিবস নেই। ছিল না। আওয়ামী লীগের কালো দিবস বেশুমার। ১৫ আগস্ট। ৩ নভেম্বর। ৭ নভেম্বরও আওয়ামী লীগের জন্য কালো দিবস। অন্যদিকে বিএনপি এসব কালো দিবসের আলো নিয়েছে শুধু। সুবিধা আদায় করেছে।
আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি নিজেকে আপসহীন দাবি করলেও, তাতে আওয়ামী লীগ ও বাম দলগুলোর নেতা-কর্মীরাই বেশি জীবন দিয়েছেন। ময়েজউদ্দীন আহমদ ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা। তাজুল ইসলাম ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা। সেলিম, দেলোয়ার, বসুনিয়া ছাত্রলীগের কর্মী। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর নূর হোসেন নামের যে তরুণ বুকে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ স্লোগান এঁটে জীবন দিয়েছিলেন, তিনিও ছিলেন যুবলীগের কর্মী। অতএব, এসব দিবসের মালিকও বিএনপি নয়।
খালেদা জিয়ার পয়লা জমানাটি মোটামুটি চলে গেলেও দ্বিতীয় মেয়াদে এসে তারা একটার পর একটা কালো দিবস সৃষ্টি করতে থাকে এবং প্রতিটির লক্ষ্য ছিল, আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী সংগঠনগুলো। ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলা, ২৭ জানুয়ারি শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা, ২৭ ফেব্রুয়ারি হুমায়ুন আজাদ হত্যাচেষ্টা, ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী বোমা হামলা, ৭ নভেম্বর শ্রমিকনেতা আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যা ইত্যাদি। এসব কৃষ্ণ দিবসেও বিএনপির হক নেই। বরং কোনো কোনো সন্ত্রাসী ঘটনায় তাদের নেতা-কর্মীদের জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ বেরিয়ে আসছে।
কৃষ্ণ দিবসবিহীন বিএনপি এত বড় বঞ্চনা ও বৈষম্য মেনে নেয় কীভাবে? অতএব, তাদেরও একটি কৃষ্ণ দিবস থাকা জরুরি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কল্যাণে তারা সেটি পেয়েও গেল। ১১ জানুয়ারি সাড়ম্বরে বিএনপি কালো দিবস পালনও করল। নেতারা বিচার দাবি করলেন এক-এগারোর কুশীলবদের। কিন্তু কেন এবং কাদের জন্য ১১ জানুয়ারির অঘটন ঘটল, সে সম্পর্কে বিএনপি নেতারা টুঁ-শব্দটি করলেন না। ১১ জানুয়ারির কুশীলবদের বিরুদ্ধে তাঁদের অভিযোগ কী? তত্ত্বাবধায়ক সরকার অন্যায়ভাবে দুই বছর ক্ষমতায় ছিল। সংবিধান তাদের মেয়াদ তিন মাস নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। জরুরি আইন জারি করে জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করেছিল। বিএনপি নেতাদের কাছে জানতে চাই, ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করে তাঁরা কার স্বার্থ রক্ষা করেছিলেন? মরহুম জিয়াউর রহমান কোন সংবিধানবলে ক্ষমতায় এসেছিলেন? তাঁর মেয়াদ কত দিন নির্দিষ্ট ছিল? কোন আইনবলে তিনি সেনাপ্রধানের পদে বহাল থেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেছিলেন?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সব কাজ ভালো ছিল, আমরা তা বলি না। তাদের দুই নেত্রীবিয়োগ কৌশল জনগণ মেনে নেয়নি। দুর্নীতি দমনের নামে লোকজনকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন চালানোর ঘটনাও নিন্দনীয়। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার জনগণকে দেওয়া একটি কথা তো অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। বিলম্বে হলেও তারা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে বিদায় নিয়েছে। এ রকম স্বেচ্ছায় ও সানন্দে ক্ষমতা ত্যাগের নজির অন্তত রাজনীতিকদের মধ্যে নেই। বিএনপির নেতারা কষ্ট করে ইতিহাস না ঘাঁটলেও অনুগ্রহ করে জনগণের মনের ভাষাটি পড়ে দেখতে পারেন। তাঁরা যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সবকিছু নাকচ করে দিচ্ছেন, তখন নিরপেক্ষ জরিপে দেখা যায়, ৬৫ শতাংশ মানুষ তাঁদের (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) কাজ সঠিক ছিল বলে মত দিয়েছেন।
কালো দিবস সব সময় কালো নয়। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো যদি ভুল স্বীকার করে আত্মশুদ্ধির চেষ্টা চালায়, তাহলে জনগণকে বারবার দুর্ভোগ আর দুঃশাসনের শিকার হতে হয় না। আর যদি তারা একের পর এক ভুল করতে থাকে এবং সবকিছুতে মহা ষড়যন্ত্র খোঁজে, তাহলে একই বৃত্তে আমাদের রাজনীতি ঘুরপাক খাবে এবং এক-এগারোর পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকবে। বিএনপি সম্ভবত দ্বিতীয় পথটিই বেছে নিয়েছে।
সোহরাব হাসান: সাংবাদিক।
No comments