বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতায় নতুন মাত্রা by আলী রীয়াজ
বাংলাদেশে
জঙ্গি তৎপরতা পরিচালনা এবং ‘সশস্ত্র জিহাদ’ সংগঠনের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে
সিঙ্গাপুর ২৬ জন বাংলাদেশিকে আটক করে ফেরত পাঠিয়েছে, এই খবর উদ্বেগজনক।
সিঙ্গাপুর যে গত বছরের শেষ নাগাদ জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার অভিযোগে কিছু লোককে
ফেরত পাঠিয়েছে, এই খবর দেশে জঙ্গিবাদ এবং নিরাপত্তা বিষয়ে যাঁরা নজর রাখেন,
তাঁরা সামান্য জ্ঞাত ছিলেন। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে প্রথম আলোতে
প্রকাশিত খবরেই জানা গিয়েছিল যে কমপক্ষে মোট ২৫ জনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে
(‘সিঙ্গাপুর থেকে ২৫ বাংলাদেশিকে ফেরত, জিজ্ঞাসাবাদ চলছে’, প্রথম আলো, ২১
ডিসেম্বর ২০১৫) এবং এদের মধ্যে ১৪ জনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা
হচ্ছে (‘সিঙ্গাপুরফেরত ১৪ বাংলাদেশি রিমান্ডে’, প্রথম আলো, ২৩ ডিসেম্বর
২০১৫)। যদিও এটাও ঠিক যে এসব সংবাদে কর্তৃপক্ষের দেওয়া কিছু তথ্য সুস্পষ্ট
ছিল না এবং এটাও বোঝা যায়নি যে সিঙ্গাপুর সরকার এসব ব্যক্তিকে কেন এবং কী
ধরনের অভিযোগে আটক করেছিল।
এখন বলা হচ্ছে যে অভিযুক্তরা আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদা ও ইরাক-সিরিয়ায় সক্রিয় জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) মতাদর্শের সমর্থক এবং তাদের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে এবং অন্যত্র জঙ্গি তৎপরতার। সিঙ্গাপুর সরকার যে এই গোষ্ঠীকে দীর্ঘ নজরদারির মধ্যে রাখা এবং তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়াকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে, সেটা বোঝা যায় যখন আমরা দেখি দেশটির প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুং এই বিষয়ে মন্তব্য করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন। এসব বিবেচনায় নিলে উদ্বেগের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ রয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে আটককৃতরা জঙ্গিসংশ্লিষ্টতায় যুক্ত আছে কি না, সেই বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন আল-কায়েদা ও আইএস উভয়ই যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু এই দুই সংগঠনের মধ্যে আদর্শিক কিছু বিষয়ে পার্থক্য রয়েছে এবং তারা পরস্পরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত। ফলে সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষের এই অভিযোগ সংশয়ের সৃষ্টি করে যে তাঁরা একই সঙ্গে দুই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত বা সমর্থক কি না। কিন্তু কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী এ ধরনের সংগঠনের আদর্শের মূল সুর দ্বারা অনুপ্রাণিত হতে পারে বলে আমরা ধরে নিতে পারি। অভিযুক্ত হওয়াই কোনো ব্যক্তিকে দোষী বলার জন্য যথেষ্ট নয়। এ ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ বিষয়ে তদন্ত হবে, তাঁরা নির্দোষ হলে সেটাও আমরা জানতে পারব। কিন্তু সিঙ্গাপুরের প্রাথমিক তদন্তের ওপর আস্থা রাখলে আমাদের এটা মেনে নিতে হবে যে বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতার ক্ষেত্রে আরও একটি নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে, তা হলো বিদেশে অবস্থান করে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে দেশে জঙ্গি তৎপরতা চালানোর ষড়যন্ত্রের চেষ্টা বা এই মর্মে অভিযোগ ওঠা। এ ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষের যে বক্তব্যটি আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে তা হলো, সিঙ্গাপুর তাদের লক্ষ্যস্থল ছিল না। অর্থাৎ তারা সিঙ্গাপুরে জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা করেনি, বাংলাদেশ তাদের লক্ষ্য।
প্রবাসীরা তাঁর নিজ দেশের সশস্ত্র সংঘাতের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন, সেটি মোটেই নতুন ঘটনা নয়। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন দেশে সেটা লক্ষ করা গেছে। র্যান্ড করপোরেশনের গবেষক ব্রুস হফম্যান এক গবেষণায় দেখিয়েছিলেন, উত্তর আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতাকামী সংগঠন আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি (আইআরএ) যখন ব্রিটেনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত, সে সময় যুক্তরাষ্ট্রে আইরিশ বংশোদ্ভূতদের মধ্যে আইআরএর প্রতি সমর্থন ছিল অভাবনীয়। আয়ারল্যান্ডে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী যেসব অস্ত্র আটক করেছিল, তার ৭০ শতাংশের বেশি এসেছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে। আইরিশ বংশোদ্ভূত মার্কিনরাই এই অস্ত্রের জোগানদার ছিল। শ্রীলঙ্কার যুদ্ধে তামিলদের পক্ষে প্রবাসী তামিলরাই সবচেয়ে বেশি অর্থ জুগিয়েছে বলে জানা যায়। কিন্তু এগুলো হচ্ছে দেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পক্ষে প্রবাসী নাগরিকদের সমর্থনের প্রমাণ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও আমরা সেটা দেখতে পেয়েছি। এসব ক্ষেত্রে যেটা স্পষ্ট তা হলো প্রবাসীরা যে দেশে থাকেন, তার ভেতরে ক্ষতি সাধন করেন না বা তার সঙ্গে যুক্ত হন না, উপরন্তু তাঁরা চান যে স্থানীয়রা তাঁদের প্রতি সহানুভূতিশীল হোক। তাঁদের আদর্শের বিষয় জাতীয়। কিন্তু গত কয়েক দশকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর বিস্তার লাভের পর আমরা দেখতে পাই যে পশ্চিমা দেশে বসবাসরত অভিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে কেউ কেউ বা ক্ষুদ্র কোনো কোনো গোষ্ঠী ওই দেশেরই ক্ষতি সাধনের চেষ্টা করে থাকে।
প্রবাসী অভিবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে এই প্রবণতা ছিল ক্ষীণ, কিন্তু তা একেবারে অনুপস্থিত ছিল না। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁরা প্রবাসে সন্ত্রাসী তৎপরতায় যুক্ত হয়েছেন। যেমন ২০০২ সালে ব্রিটেনের বার্মিংহামের আদালত ২৭ বছর বয়স্ক মইনুল আবেদিনকে সন্ত্রাসী তৎপরতার ষড়যন্ত্রের দায়ে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেন। ২০০৫ সালের নভেম্বরে আটক ২৯ বছর বয়সী নূরুর রহমানকে আদালত দোষী সাব্যস্ত করেন যে তিনি একটি ট্রান্স-আটলান্টিক বিমান ভূপাতিত করার চেষ্টা করেছিলেন। ২০১১ সালে ব্রিটিশ এয়ারলাইনসে কর্মরত আইটি বিশেষজ্ঞ রাজিব করিমকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে সাহায্য করার অভিযোগে ৩০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২০১০ সালে ২১ বছর বয়সী রোশেনারা চৌধুরী সাবেক সরকারের মন্ত্রী স্টিফেন টিমসকে হত্যার চেষ্টা করার দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পান। যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৯ সালে এহসানুল করিম সাদিক ১৭ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন, কেননা তিনি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, দক্ষিণ এশিয়ায় একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তৈরির চেষ্টা করছিলেন এবং তার মাধ্যমে সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা তাঁর ছিল বলে অভিযোগ করা হয়। রেজোয়ানুল আহসান নাফিসের কথা অনেকেরই জানা আছে। নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক উড়িয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে আটক হন এবং দোষ স্বীকারের পর তাঁকে ৩০ বছরের জেল দেওয়া হয়েছে। প্রবাসে বাংলাদেশি বা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের সংখ্যার তুলনায় এসব ঘটনা খুব কম, কিন্তু আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী তৎপরতায় যুক্ত হওয়ার এটি একটি ধরন।
দ্বিতীয় ধরনটি হচ্ছে সশরীরে সংঘাতময় দেশে উপস্থিত হয়ে যুদ্ধ করা। ১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশিদের একটি গোষ্ঠী আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। তার পরিণতি হিসেবেই বাংলাদেশে পাকিস্তানভিত্তিক সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলাম বা হুজির উত্থান। আল-কায়েদার উত্থানের পর আমরা প্রত্যক্ষভাবে আল-কায়েদায় যোগদানের কথা শুনলেও তার কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাইনি। কিন্তু আইএসের উত্থানের পর আমরা বাংলাদেশের ভেতরে থেকে এবং প্রবাসে বসবাসকারী বাংলাদেশি বা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের মধ্যে আইএসে যোগদানের ঘটনার খবর পেয়েছি। যেমন, ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে আশিকুর রহমান নামে ২১ বছর বয়সী একজন তরুণ বাংলাদেশ থেকে তুরস্ক হয়ে সিরিয়ায় আইএসে যোগ দিতে গেছেন বলে জানা গেছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী গত বছরের মে মাসে মাইরুন ফারহান নামে একজন তরুণী তুরস্কে আটক হন, যিনি আইএসে যোগ দিতে সিরিয়া যাচ্ছিলেন। তাঁকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। ২০১৩ সালে ব্রিটেন থেকে যে গোষ্ঠীটি সিরিয়া গিয়েছিল যুদ্ধ করতে, তাদের মধ্যে ছিল বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইফতেখার জামান, তিনি পরে আইএসে যোগ দিয়ে সিরিয়ায় যুদ্ধে মারা যান।
তা ছাড়া, ‘ব্রিটানি ব্রিগেড বাংলাদেশি ব্যাড বয়েজ’ বলে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত পাঁচজনের একটি দল ব্রিটেন থেকে সিরিয়ায় গিয়ে যুদ্ধ করে এবং এদের মধ্যে একমাত্র আসাদুজ্জামান ছাড়া কেউই বেঁচে নেই, আসাদুজ্জামান ব্রিটেনে ফিরে এলে তাঁকে আটক করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। একইভাবে কানাডার জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার জানামতে কানাডা থেকে চারজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তরুণ তাবিরুল হাসিব, আবদুল মালিক, নূর ও আদিব ২০১৪ সালে আইএসে যোগ দিয়েছেন। অনেকের স্মরণে থাকবে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রিটেনের সংবাদপত্রে ঝড় উঠেছিল যে তিনজন কিশোরী আইএসে যোগ দিতে ব্রিটেন ছেড়েছে। তাদের মধ্যে দুজন শামীমা বেগম (১৫) ও খাদিজা সুলতানা (১৬) বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। আমরা এ-ও জানি যে ব্রিটেনের লুটনে বসবাসকারী ১২ সদস্যের এক বাংলাদেশি পরিবার বাংলাদেশ হয়ে সিরিয়ায় পাড়ি জমায়। সম্প্রতি আমরা এ-ও জানতে পারি যে সিরিয়ায় মার্কিন বিমান হামলায় নিহত আইএসের নেতাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন বাংলাদেশি সাইফুল হক সুজন। তিনিই কেবল আইএসে যুক্ত হয়েছিলেন তা নয়, তিনি বাবা, ভাইসহ পরিবারের অন্য সদস্যদেরও একই মতবাদে উদ্বুদ্ধ করেছেন বলে খবর বেরোচ্ছে। বাংলাদেশে তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান অর্থ পাচারে ব্যবহৃত হয়েছে বলেও অভিযোগ আছে।
যদিও দ্বিতীয় ধরনের সঙ্গে দেশের ও পরিবারের সংশ্লিষ্টতা আমরা দেখতে পাই, সেখানেও উদ্দেশ্য হচ্ছে সংঘাতময় দেশে গিয়ে যুক্ত হওয়া বা আন্তর্জাতিকভাবে সন্ত্রাসী তৎপরতায় যুক্ত থাকা। বাংলাদেশে ‘সশস্ত্র জিহাদ’ পরিচালনা করা নয়। কিন্তু এখন সিঙ্গাপুরে আটক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে আমরা অবগত হই যে তাঁদের লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশে জিহাদ পরিচালনা বা তাকে সমর্থন করা। বাংলাদেশে গত কিছুদিন যাবৎ এ বিষয়ে বিতর্ক হচ্ছে দেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী, বিশেষ করে আইএস সাংগঠনিকভাবে উপস্থিত আছে কি না। সরকার অতীতে আইএসের উপস্থিতি রয়েছে এমন কথা বললেও এখন তার অবস্থান বদলেছে। গত বছরে সংঘটিত সন্ত্রাসী ঘটনায় জঙ্গিদের কর্মকাণ্ডের ধরনে পরিবর্তন লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। এখন সিঙ্গাপুরে আটকদের তৎপরতার ধরনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশে জঙ্গি এবং জঙ্গি সংগঠন বিষয়ে পুরোনো অবস্থান ও অস্বীকৃতির সংস্কৃতি দুই-ই পুনর্বিবেচনা দাবি করে।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
এখন বলা হচ্ছে যে অভিযুক্তরা আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদা ও ইরাক-সিরিয়ায় সক্রিয় জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) মতাদর্শের সমর্থক এবং তাদের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে এবং অন্যত্র জঙ্গি তৎপরতার। সিঙ্গাপুর সরকার যে এই গোষ্ঠীকে দীর্ঘ নজরদারির মধ্যে রাখা এবং তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়াকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে, সেটা বোঝা যায় যখন আমরা দেখি দেশটির প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুং এই বিষয়ে মন্তব্য করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন। এসব বিবেচনায় নিলে উদ্বেগের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ রয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে আটককৃতরা জঙ্গিসংশ্লিষ্টতায় যুক্ত আছে কি না, সেই বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন আল-কায়েদা ও আইএস উভয়ই যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু এই দুই সংগঠনের মধ্যে আদর্শিক কিছু বিষয়ে পার্থক্য রয়েছে এবং তারা পরস্পরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত। ফলে সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষের এই অভিযোগ সংশয়ের সৃষ্টি করে যে তাঁরা একই সঙ্গে দুই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত বা সমর্থক কি না। কিন্তু কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী এ ধরনের সংগঠনের আদর্শের মূল সুর দ্বারা অনুপ্রাণিত হতে পারে বলে আমরা ধরে নিতে পারি। অভিযুক্ত হওয়াই কোনো ব্যক্তিকে দোষী বলার জন্য যথেষ্ট নয়। এ ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ বিষয়ে তদন্ত হবে, তাঁরা নির্দোষ হলে সেটাও আমরা জানতে পারব। কিন্তু সিঙ্গাপুরের প্রাথমিক তদন্তের ওপর আস্থা রাখলে আমাদের এটা মেনে নিতে হবে যে বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতার ক্ষেত্রে আরও একটি নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে, তা হলো বিদেশে অবস্থান করে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে দেশে জঙ্গি তৎপরতা চালানোর ষড়যন্ত্রের চেষ্টা বা এই মর্মে অভিযোগ ওঠা। এ ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষের যে বক্তব্যটি আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে তা হলো, সিঙ্গাপুর তাদের লক্ষ্যস্থল ছিল না। অর্থাৎ তারা সিঙ্গাপুরে জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা করেনি, বাংলাদেশ তাদের লক্ষ্য।
প্রবাসীরা তাঁর নিজ দেশের সশস্ত্র সংঘাতের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন, সেটি মোটেই নতুন ঘটনা নয়। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন দেশে সেটা লক্ষ করা গেছে। র্যান্ড করপোরেশনের গবেষক ব্রুস হফম্যান এক গবেষণায় দেখিয়েছিলেন, উত্তর আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতাকামী সংগঠন আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি (আইআরএ) যখন ব্রিটেনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত, সে সময় যুক্তরাষ্ট্রে আইরিশ বংশোদ্ভূতদের মধ্যে আইআরএর প্রতি সমর্থন ছিল অভাবনীয়। আয়ারল্যান্ডে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী যেসব অস্ত্র আটক করেছিল, তার ৭০ শতাংশের বেশি এসেছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে। আইরিশ বংশোদ্ভূত মার্কিনরাই এই অস্ত্রের জোগানদার ছিল। শ্রীলঙ্কার যুদ্ধে তামিলদের পক্ষে প্রবাসী তামিলরাই সবচেয়ে বেশি অর্থ জুগিয়েছে বলে জানা যায়। কিন্তু এগুলো হচ্ছে দেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পক্ষে প্রবাসী নাগরিকদের সমর্থনের প্রমাণ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও আমরা সেটা দেখতে পেয়েছি। এসব ক্ষেত্রে যেটা স্পষ্ট তা হলো প্রবাসীরা যে দেশে থাকেন, তার ভেতরে ক্ষতি সাধন করেন না বা তার সঙ্গে যুক্ত হন না, উপরন্তু তাঁরা চান যে স্থানীয়রা তাঁদের প্রতি সহানুভূতিশীল হোক। তাঁদের আদর্শের বিষয় জাতীয়। কিন্তু গত কয়েক দশকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর বিস্তার লাভের পর আমরা দেখতে পাই যে পশ্চিমা দেশে বসবাসরত অভিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে কেউ কেউ বা ক্ষুদ্র কোনো কোনো গোষ্ঠী ওই দেশেরই ক্ষতি সাধনের চেষ্টা করে থাকে।
প্রবাসী অভিবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে এই প্রবণতা ছিল ক্ষীণ, কিন্তু তা একেবারে অনুপস্থিত ছিল না। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁরা প্রবাসে সন্ত্রাসী তৎপরতায় যুক্ত হয়েছেন। যেমন ২০০২ সালে ব্রিটেনের বার্মিংহামের আদালত ২৭ বছর বয়স্ক মইনুল আবেদিনকে সন্ত্রাসী তৎপরতার ষড়যন্ত্রের দায়ে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেন। ২০০৫ সালের নভেম্বরে আটক ২৯ বছর বয়সী নূরুর রহমানকে আদালত দোষী সাব্যস্ত করেন যে তিনি একটি ট্রান্স-আটলান্টিক বিমান ভূপাতিত করার চেষ্টা করেছিলেন। ২০১১ সালে ব্রিটিশ এয়ারলাইনসে কর্মরত আইটি বিশেষজ্ঞ রাজিব করিমকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে সাহায্য করার অভিযোগে ৩০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২০১০ সালে ২১ বছর বয়সী রোশেনারা চৌধুরী সাবেক সরকারের মন্ত্রী স্টিফেন টিমসকে হত্যার চেষ্টা করার দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পান। যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৯ সালে এহসানুল করিম সাদিক ১৭ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন, কেননা তিনি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, দক্ষিণ এশিয়ায় একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তৈরির চেষ্টা করছিলেন এবং তার মাধ্যমে সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা তাঁর ছিল বলে অভিযোগ করা হয়। রেজোয়ানুল আহসান নাফিসের কথা অনেকেরই জানা আছে। নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক উড়িয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে আটক হন এবং দোষ স্বীকারের পর তাঁকে ৩০ বছরের জেল দেওয়া হয়েছে। প্রবাসে বাংলাদেশি বা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের সংখ্যার তুলনায় এসব ঘটনা খুব কম, কিন্তু আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী তৎপরতায় যুক্ত হওয়ার এটি একটি ধরন।
দ্বিতীয় ধরনটি হচ্ছে সশরীরে সংঘাতময় দেশে উপস্থিত হয়ে যুদ্ধ করা। ১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশিদের একটি গোষ্ঠী আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। তার পরিণতি হিসেবেই বাংলাদেশে পাকিস্তানভিত্তিক সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলাম বা হুজির উত্থান। আল-কায়েদার উত্থানের পর আমরা প্রত্যক্ষভাবে আল-কায়েদায় যোগদানের কথা শুনলেও তার কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাইনি। কিন্তু আইএসের উত্থানের পর আমরা বাংলাদেশের ভেতরে থেকে এবং প্রবাসে বসবাসকারী বাংলাদেশি বা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের মধ্যে আইএসে যোগদানের ঘটনার খবর পেয়েছি। যেমন, ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে আশিকুর রহমান নামে ২১ বছর বয়সী একজন তরুণ বাংলাদেশ থেকে তুরস্ক হয়ে সিরিয়ায় আইএসে যোগ দিতে গেছেন বলে জানা গেছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী গত বছরের মে মাসে মাইরুন ফারহান নামে একজন তরুণী তুরস্কে আটক হন, যিনি আইএসে যোগ দিতে সিরিয়া যাচ্ছিলেন। তাঁকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। ২০১৩ সালে ব্রিটেন থেকে যে গোষ্ঠীটি সিরিয়া গিয়েছিল যুদ্ধ করতে, তাদের মধ্যে ছিল বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইফতেখার জামান, তিনি পরে আইএসে যোগ দিয়ে সিরিয়ায় যুদ্ধে মারা যান।
তা ছাড়া, ‘ব্রিটানি ব্রিগেড বাংলাদেশি ব্যাড বয়েজ’ বলে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত পাঁচজনের একটি দল ব্রিটেন থেকে সিরিয়ায় গিয়ে যুদ্ধ করে এবং এদের মধ্যে একমাত্র আসাদুজ্জামান ছাড়া কেউই বেঁচে নেই, আসাদুজ্জামান ব্রিটেনে ফিরে এলে তাঁকে আটক করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। একইভাবে কানাডার জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার জানামতে কানাডা থেকে চারজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তরুণ তাবিরুল হাসিব, আবদুল মালিক, নূর ও আদিব ২০১৪ সালে আইএসে যোগ দিয়েছেন। অনেকের স্মরণে থাকবে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রিটেনের সংবাদপত্রে ঝড় উঠেছিল যে তিনজন কিশোরী আইএসে যোগ দিতে ব্রিটেন ছেড়েছে। তাদের মধ্যে দুজন শামীমা বেগম (১৫) ও খাদিজা সুলতানা (১৬) বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। আমরা এ-ও জানি যে ব্রিটেনের লুটনে বসবাসকারী ১২ সদস্যের এক বাংলাদেশি পরিবার বাংলাদেশ হয়ে সিরিয়ায় পাড়ি জমায়। সম্প্রতি আমরা এ-ও জানতে পারি যে সিরিয়ায় মার্কিন বিমান হামলায় নিহত আইএসের নেতাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন বাংলাদেশি সাইফুল হক সুজন। তিনিই কেবল আইএসে যুক্ত হয়েছিলেন তা নয়, তিনি বাবা, ভাইসহ পরিবারের অন্য সদস্যদেরও একই মতবাদে উদ্বুদ্ধ করেছেন বলে খবর বেরোচ্ছে। বাংলাদেশে তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান অর্থ পাচারে ব্যবহৃত হয়েছে বলেও অভিযোগ আছে।
যদিও দ্বিতীয় ধরনের সঙ্গে দেশের ও পরিবারের সংশ্লিষ্টতা আমরা দেখতে পাই, সেখানেও উদ্দেশ্য হচ্ছে সংঘাতময় দেশে গিয়ে যুক্ত হওয়া বা আন্তর্জাতিকভাবে সন্ত্রাসী তৎপরতায় যুক্ত থাকা। বাংলাদেশে ‘সশস্ত্র জিহাদ’ পরিচালনা করা নয়। কিন্তু এখন সিঙ্গাপুরে আটক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে আমরা অবগত হই যে তাঁদের লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশে জিহাদ পরিচালনা বা তাকে সমর্থন করা। বাংলাদেশে গত কিছুদিন যাবৎ এ বিষয়ে বিতর্ক হচ্ছে দেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী, বিশেষ করে আইএস সাংগঠনিকভাবে উপস্থিত আছে কি না। সরকার অতীতে আইএসের উপস্থিতি রয়েছে এমন কথা বললেও এখন তার অবস্থান বদলেছে। গত বছরে সংঘটিত সন্ত্রাসী ঘটনায় জঙ্গিদের কর্মকাণ্ডের ধরনে পরিবর্তন লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। এখন সিঙ্গাপুরে আটকদের তৎপরতার ধরনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশে জঙ্গি এবং জঙ্গি সংগঠন বিষয়ে পুরোনো অবস্থান ও অস্বীকৃতির সংস্কৃতি দুই-ই পুনর্বিবেচনা দাবি করে।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
No comments