ইরানি সিনেমা মুহাম্মদ (স.)- ক্যামেরার পেছনের কথা by সিরাজুল ইসলাম
ইরানি
সিনেমা মুহাম্মদ (সা.) নিয়ে সারা বিশ্বে নানা আগ্রহ ও কৌতূহলের সৃষ্টি
হয়েছে। এরইমধ্যে ছবিটি সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার দেশ ইরানে ৫৫০ কোটি
তুমানের (ইরানি মুদ্রা) ব্যবসা করেছে যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ১৪ কোটি
টাকা। আশার দিক হচ্ছে- ছবিটি দেখার জন্য দিন দিন ইরানের সিনেমা হলগুলোতে
ভিড় বাড়ছে। প্রথমদিকে কোন কোন হলে আসন খালি থাকলেও এখন তা থাকছে না। শুধু
তাই নয়, শো শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরেক শো শুরু হচ্ছে। ছবির দর্শক হিসেবে
আসছে সব বয়সের মানুষ। এ সিনেমার দর্শক হিসেবে বয়স্ক নারী-পুরুষ এবং
শিশুদেরও দেখা যাচ্ছে। জনপ্রিয়তার দিক থেকে এরইমধ্যে ইরানি ফার্সি বছরে
মুক্তি পাওয়া ছবিগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে মুহাম্মদ (সা.)।
ফার্সি বছর শেষ হতে আরও ছয় মাস রয়েছে। সে কারণে এ ছবি যে চলতি বছরে ইরানি
সিনেমার জনপ্রিয়তার তালিকায় এক নম্বরে উঠে আসবে তা নিয়ে জোরালোভাবে
আশাবাদী ছবির পরিচালক ও কলাকুশলীরা।
প্রথমদিকে ইরানের ১৪৩টি হলে মুহাম্মদ (সা.) সিনেমাটি দেখানো শুরু হয় এবং আগামী ১৮ই সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার থেকে আরও ৪৬টি হলে ছবিটি দেখানো শুরু হবে। রাজধানী তেহরানের ১৭টি হলে চলছে এ সিনেমা। ছবিটি দেখানোর ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত কিছু সমস্যা রয়েছে যে কারণে সব সিনেমা হলে এ ছবি দেখানো সম্ভব হচ্ছে। এ সিনেমা তৈরিতে ডি-এইট প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে যার কারণে সব সিনেমা হলে এ প্রযুক্তি লাগসই হচ্ছে না। এ কারণে সিনেমাটি নিয়ে যেভাবে মানুষের আগ্রহ রয়েছে সে পরিমাণে এই সময়ের মধ্যে টিকিট বিক্রি থেকে অর্থ উঠে আসেনি। অবশ্য, কানাডার মন্ট্রিলে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র প্রদর্শনীতে আশাব্যঞ্জক ব্যবসা হয়েছে। সেখানে একদিনেই ৬০ হাজার ডলারের টিকিট বিক্রি হয়েছে। তবে ছবিটি যেহেতু ‘বিগ বাজেটের’ এবং এ ছবি নিয়ে মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে সে কারণে ছবিটি বহুদিন ধরে ইরানের ভেতরে দেখানো হবে এবং ব্যবসায়িক দিক দিয়ে সফল হবে।
ক্যামেরার পেছনের কথা: সিনেমাটি পর্দায় আসার আগ পর্যন্ত পরিচালক মাজিদ মাজিদি সর্বোচ্চ গোপনীয়তা বজায় রাখেন। ছবির বিষয়ে তিনি কোন সংবাদ কভার করার সুযোগ দেন নি, কোন সাংবাদিককে ছবি শুটিংয়ের লোকেশন ভিজিটেরও অনুমতি দেন নি। এমনকি, তিনি এ সিনেমার অভিনেতা- অভিনেত্রীদের সঙ্গেও সামনাসামনি তেমন কোন কথা বলতেন না। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের যা বলার প্রয়োজন হতো তার বেশির ভাগই বলতে হতো পরিচালকের সহকারীদের কাছে। এ কারণে রাসুলের জীবনভিত্তিক এ সিনেমা নিয়ে আগেভাগে তেমন কিছু জানা যায় নি।
কোথায় প্রতিষ্ঠা করা হয় মক্কা-মদিনা: মুহাম্মদ (সা.) সিনেমার চিত্র ধারণের কাজ শেষ হয় ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে। ছবিতে কাজ করেছেন ৫০০ মানুষ। ছবিটি নির্মাণের জন্য ইরানের রাজধানী তেহরানের ৫০ কিলোমিটার দূরে কোম শহরের কাছে নির্মাণ করা হয় বিশাল সেট। এখানেই তৈরি করা হয় মক্কা ও মদিনার ডামি শহর। মজার তথ্য হলো- এ ছবির অংশবিশেষ ভারতে শুটিংয়ের পরিকল্পনা থাকলেও সে অনুমতি না পাওয়ায় পরে দক্ষিণ আফ্রিকাকে বেছে নেয়া হয়। তার আগে অবশ্য, সৌদি সরকার ছবিটির শুটিংয়ের জন্য অনুমতি দিতে অস্বীকার করে।
স্ক্রিপ্টের প্রথম খসড়া লেখার কাজ শেষ হওয়ার পর ইরানের বিখ্যাত থিয়েটার পরিচালক, লেখক ও গবেষক হামিদ আমজাদ অন্যতম স্ক্রিনরাইটার হিসেবে যোগ দেন। এ টিমে যোগ দিয়েই তিনি প্রধানত সংলাপ লেখার কাজে মন দেন। মুহাম্মদ (সা.) সিনেমার সংলাপ লিখতে লাগে দেড় বছর। ২০১০ সালের জুন মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে সিনেমার প্রি- প্রোডাকশনের কাজ শুরু হয়। আর ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে শেষ হয় সেট নির্মাণের কাজ।
প্রথম পর্যায়ে ১০০ হেক্টর জমির ওপর নির্মাণ করা হয় সেট; কিন্তু সিনেমার কাজ যতই এগুতে থাকে ততই এর আয়তন বাড়ানোর প্রয়োজন দেখা দেয়। পরে শেষ পর্যন্ত সিনেমার সেট নির্মাণের জন্য আয়তন বেড়ে ২২০ হেক্টরে পৌঁছায়। এখানে বানানো হয় ষষ্ঠ শতাব্দীর পুরনো মক্কা ও মদিনা শহরের ডামি। নির্মাণশৈলীতে ফুটে ওঠে নবীজির বাল্যবেলার সময়কার মক্কা-মদিনার বাস্তব চিত্র। সিনেমাটি দেখলে মনে হবে- এ যেন রাসুলের ছোটবেলার সেই মক্কা ও মদিনা। ডামি এই মক্কা ও মদিনা শহরে মুহাম্মদ (সা.) সিনেমার শতকরা ৭০ ভাগ শুটিংয়ের কাজ হয়েছে। বাকি কাজ হয়েছে ইরানের কেরমান ও বুশেহর প্রদেশের আসালুয়েহ শহরে।
শুটিংয়ের অনুমতি দেয় নি ভারত: মুহাম্মদ (সা.) ছবির কাহিনী অনুযায়ী, আবিসিনিয়ার বাদশাহ আবরাহা কাবাঘরে হামলা চালায়। শুধুমাত্র বাদশাহ আবরাহার হস্তিবাহিনীর আগ্রাসন এবং তাদের ওপর আবাবিল পাখির পাথর বর্ষণের ঘটনা দেখানোর জন্য ভারতে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু ভারতীয় কর্মকর্তারা ছবির শুটিংয়ের বিষয়ে অনুমতি না দিলে পরে তা দক্ষিণ আফ্রিকার বেলা-বেলা শহরে শুটিং করা হয়েছে।
সেট পরিদর্শনে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা: মুহাম্মদ (সা.) সিনেমা যেহেতু শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর জীবনভিত্তিক এবং তা অনেক সংবেদনশীল বিষয় সে কারণে এই সংবেদনশীলতার বিষয়টি সবসময় মাথায় রেখে কাজ করতে হয়েছে পরিচালক মাজিদ মাজিদিকে। সিনেমার নির্মাণকাজ চলার এক পর্যায়ে ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনী সেট তথা মক্কা ও মদিনার ডামি শহর পরিদর্শন করেন। সিনেমা নির্মাণের ক্ষেত্রে এটি ছিল অনন্য সাধারণ ঘটনা এবং একে পরিচালক মাজিদ মাজিদি তার জন্য বিশেষ আশীর্বাদ বলে গ্রহণ করেন। পরে তিনি সংবাদ সম্মেলনে সে কথা বলতেও ভুল করেন নি। মাজিদি জানান, ক্যামেরার বাইরে সর্বোচ্চ নেতা সেদিন নবীজির জীবনচরিত নিয়ে অতি মূল্যবান কিছু বক্তব্য রাখেন যার কিছু অংশ পরে স্ক্রিপ্টে যোগ করা হয়। মজার বিষয় হলো- ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এই প্রথম কোন সিনেমা প্রকল্প পরিদর্শন করেন এবং সেখানে বক্তৃতা রাখেন। যদিও এর আগে তিনি ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় সিরিয়াল ‘মারিয়াম মুকাদ্দাস’ নির্মাণের আগে তার সেট পরিদর্শন করেছিলেন।
হাত কেঁপেছিল ক্যালিগ্রাফি তৈরিতে: মুহাম্মদ (সা.) সিনেমার লোগো তৈরির জন্য পরিচালক মাজিদ মাজিদি একটি ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। সেখানে বিচারক হিসেবে ইরানের বিখ্যাত সব ক্যালিগ্রাফারকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। প্রতিযোগিতায় ১,৬০০ ক্যালিগ্রাফি জমা পড়ে এবং তার মধ্য থেকে একটিকে শ্রেষ্ঠ বলে বাছাই করা হয়। এছাড়া প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয়টিকে পুরস্কৃত করা হয়। কিন্তু মন ভরে না পরিচালক মাজিদির। পরে তিনি প্রতিযোগিতার অন্যতম বিচারক ও বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার জালিল রাসুলিকে বলেন, “আপনি নিজেই একটি ক্যালিগ্রাফি তৈরি করুন।”
পরে এক সংবাদ সম্মেলনে মুহাম্মদ (সা.) সিনেমার লোগো তৈরির গল্প শোনান জালিল রাসুলি। তিনি জানান, “আমি ৫০ বছর ধরে ক্যালিগ্রাফি লিখছি এবং এ শিল্পের খুঁটিনাটি সব আমার জানা। কিন্তু রাসুলের নাম লেখা ছিল আমার জন্য বেশ কঠিন একটি কাজ। অনেকগুলো স্কেচ আমি তৈরি করি এবং অনেকগুলোর ডিজাইনও করি। কিন্তু কোনটিতে আমি সন্তুষ্ট হতে পারছিলাম না। পরে আমি রাসুল (সা.)-এর কাছে আবেদন করি এবং এই কাজটিতে তাঁরই সাহায্য চাই। একদিন বাদামি রঙের কালি নিয়ে আমি রাসুলের নাম লেখার কাজ শুরু করি। এবার আমি আমার হাত দিয়ে লেখা শুরু করি এবং দেখি যে, আমার সমস্ত শরীর কাঁপছে। আমার সারা জীবনে ক্যালিগ্রাফি লিখতে গিয়ে এমন ঘটনা কখনো ঘটে নি।” রাসুলি এ ঘটনাকে ব্যাখ্যা করে বলেন, “এটাই ছিল তার ইঙ্গিত যা আমি চাইছিলাম।”
সিনেমার বাজেট নিয়ে যত কথা: মুহাম্মদ (সা.) সিনেমা ইরানের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাজেটের ছবি। সে কারণে এ নিয়ে নানা জল্পনা আর গল্প ছড়িয়ে পড়েছে। তবে, বিশেষ করে পশ্চিমা গণমাধ্যম সিনেমার বাজেট নিয়ে মিথ্যা ও বিচিত্র সব কথা ছড়াচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- হলিউড রিপোর্টার দাবি করেছেন মাজিদ মাজিদি এ সিনেমা তৈরি করতে তিন কোটি ডলার ব্যয় করেছেন। এ প্রেক্ষাপটে সিনেমা প্রকল্পের সামগ্রিক ব্যয় তুলে ধরেছেন নুর তাবান ফিল্ম কোম্পানির প্রধান সাদেকিয়ান।
সাদেকিয়ানের তথ্য অনুসারে মক্কা শহরের ডামি তৈরিতে খরচ হয়েছে ৫০ লাখ ডলার, মদিনার ডামিতে খরচ ১০ লাখ ডলার এবং অফিস ভবন তৈরিতে খরচ গেছে প্রায় চার লাখ ডলার। ছবির স্ক্রিপ্ট তৈরিতে গেছে এক লাখ ডলার, দুই লাখ ডলার ব্যয় হয়েছে গবেষণার কাজে আর ৫৪ লাখ ডলার ব্যয় হয়েছে প্রি- প্রোডাকশন কাজে। এক কোটি ১০ লাখ ডলার খরচ হয়েছে প্রডাকশনের কাজে এবং পোস্ট-প্রডাকশনে খরচ গেছে ৫৩ লাখ ডলার। এসব হিসাব অনুযায়ী মুহাম্মদ (সা.) ছবি নির্মাণে খরচ হয়েছে প্রায় দুই কোটি ২০ লাখ ডলার।
ছবির নির্মাণশৈলী এবং গুণগতমানের কারণে ইরানের ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য একাডেমির প্রধান গোলাম আলী হাদ্দাদ আদেল পরিচালক মাজিদ মাজিদিকে চলতি ইরানি বছরের সেরা পরিচালক ঘোষণা করেছেন।
যেভাবে মনোনীত হয়েছেন কাস্ট অ্যান্ড ক্রু: এ সিনেমায় যারা অভিনয় করেছেন তাদেরকে মনোনীত করেছেন স্বয়ং পরিচালক মাজিদ মাজিদি এবং ইতালির মেকআপ আর্টিস্ট গিয়ানেত্তো ডি রোসি। তিনবার একাডেমি অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী ইতালির সিনেমাটোগ্রাফার ভিত্তোরিয়ো স্তোরারো-ও এ কাজে অবদান রাখেন। কাস্ট অ্যান্ড ক্রু নির্বাচনের জন্য তিনি আলাদাভাবে ইরান সফর করেন।
মুহাম্মদ (সা.) চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনটি শিশু। ছয় বছর বয়সে অভিনয় করেছেন আলী রেজা জালিলি, আট বছর বয়সে হোসেইন জালালি এবং ১৩ বছর বয়সে অভিনয় করেছেন আমির হায়দারি। এছাড়া, মা আমিনার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন মিনা সাদাতি, দাদা আব্দুল মুত্তালিব-আলী রেজা সুজা নুরি, চাচা আবু তালিব- মাহদি পাকদেল, আবু লাহাব- মোহাম্মদ আসগরী, আবু লাহাবের স্ত্রী জামিলা- রানা আজাদিভার এবং হামজা চরিত্রে অভিনয় করেছেন হামিদ রেজা দৌলতি। এছাড়া, হালিমা চরিত্রে অভিনয় করেছেন সালেহ বাইয়াত। ইহুদি ধনকুবের স্যামুয়েল চরিত্রে অভিনয় করেছেন মোহসেন তানাবান্দেহ, আবু সুফিয়ানের চরিত্রে দারিউশ ফারহাং (নবীজির ঘোরবিরোধী) এবং খ্রিস্টান পাদ্রি বুহাইরা চরিত্রে অভিনয় করেছেন সাদেক হাতাফি।
রাসুলের মায়ের ভূমিকায় (আমিনা) অভিনয়কারী মিনা সাদাতির অভিনয়কে দর্শকরা অনন্য সাধারণ বলেছেন। ইরানের অন্যতম স্বনামধন্য অভিনেত্রী তিনি। মিনা সাদাতি বেশ কয়েকটি নামকরা সিনেমা করেছেন এবং জাতীয় পর্যায়ে ২০১৩ ও ২০১৪ সালে পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৮১ সালের নভেম্বর মাসে ইরানের কাশান শহরে এই গুণীশিল্পী জন্মগ্রহণ করেন এবং গত বছর তিনি সিনেমা জগতে শ্রেষ্ঠ নারী শিল্পী হিসেবে পুরস্কার পান।
প্রথমদিকে ইরানের ১৪৩টি হলে মুহাম্মদ (সা.) সিনেমাটি দেখানো শুরু হয় এবং আগামী ১৮ই সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার থেকে আরও ৪৬টি হলে ছবিটি দেখানো শুরু হবে। রাজধানী তেহরানের ১৭টি হলে চলছে এ সিনেমা। ছবিটি দেখানোর ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত কিছু সমস্যা রয়েছে যে কারণে সব সিনেমা হলে এ ছবি দেখানো সম্ভব হচ্ছে। এ সিনেমা তৈরিতে ডি-এইট প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে যার কারণে সব সিনেমা হলে এ প্রযুক্তি লাগসই হচ্ছে না। এ কারণে সিনেমাটি নিয়ে যেভাবে মানুষের আগ্রহ রয়েছে সে পরিমাণে এই সময়ের মধ্যে টিকিট বিক্রি থেকে অর্থ উঠে আসেনি। অবশ্য, কানাডার মন্ট্রিলে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র প্রদর্শনীতে আশাব্যঞ্জক ব্যবসা হয়েছে। সেখানে একদিনেই ৬০ হাজার ডলারের টিকিট বিক্রি হয়েছে। তবে ছবিটি যেহেতু ‘বিগ বাজেটের’ এবং এ ছবি নিয়ে মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে সে কারণে ছবিটি বহুদিন ধরে ইরানের ভেতরে দেখানো হবে এবং ব্যবসায়িক দিক দিয়ে সফল হবে।
ক্যামেরার পেছনের কথা: সিনেমাটি পর্দায় আসার আগ পর্যন্ত পরিচালক মাজিদ মাজিদি সর্বোচ্চ গোপনীয়তা বজায় রাখেন। ছবির বিষয়ে তিনি কোন সংবাদ কভার করার সুযোগ দেন নি, কোন সাংবাদিককে ছবি শুটিংয়ের লোকেশন ভিজিটেরও অনুমতি দেন নি। এমনকি, তিনি এ সিনেমার অভিনেতা- অভিনেত্রীদের সঙ্গেও সামনাসামনি তেমন কোন কথা বলতেন না। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের যা বলার প্রয়োজন হতো তার বেশির ভাগই বলতে হতো পরিচালকের সহকারীদের কাছে। এ কারণে রাসুলের জীবনভিত্তিক এ সিনেমা নিয়ে আগেভাগে তেমন কিছু জানা যায় নি।
কোথায় প্রতিষ্ঠা করা হয় মক্কা-মদিনা: মুহাম্মদ (সা.) সিনেমার চিত্র ধারণের কাজ শেষ হয় ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে। ছবিতে কাজ করেছেন ৫০০ মানুষ। ছবিটি নির্মাণের জন্য ইরানের রাজধানী তেহরানের ৫০ কিলোমিটার দূরে কোম শহরের কাছে নির্মাণ করা হয় বিশাল সেট। এখানেই তৈরি করা হয় মক্কা ও মদিনার ডামি শহর। মজার তথ্য হলো- এ ছবির অংশবিশেষ ভারতে শুটিংয়ের পরিকল্পনা থাকলেও সে অনুমতি না পাওয়ায় পরে দক্ষিণ আফ্রিকাকে বেছে নেয়া হয়। তার আগে অবশ্য, সৌদি সরকার ছবিটির শুটিংয়ের জন্য অনুমতি দিতে অস্বীকার করে।
স্ক্রিপ্টের প্রথম খসড়া লেখার কাজ শেষ হওয়ার পর ইরানের বিখ্যাত থিয়েটার পরিচালক, লেখক ও গবেষক হামিদ আমজাদ অন্যতম স্ক্রিনরাইটার হিসেবে যোগ দেন। এ টিমে যোগ দিয়েই তিনি প্রধানত সংলাপ লেখার কাজে মন দেন। মুহাম্মদ (সা.) সিনেমার সংলাপ লিখতে লাগে দেড় বছর। ২০১০ সালের জুন মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে সিনেমার প্রি- প্রোডাকশনের কাজ শুরু হয়। আর ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে শেষ হয় সেট নির্মাণের কাজ।
প্রথম পর্যায়ে ১০০ হেক্টর জমির ওপর নির্মাণ করা হয় সেট; কিন্তু সিনেমার কাজ যতই এগুতে থাকে ততই এর আয়তন বাড়ানোর প্রয়োজন দেখা দেয়। পরে শেষ পর্যন্ত সিনেমার সেট নির্মাণের জন্য আয়তন বেড়ে ২২০ হেক্টরে পৌঁছায়। এখানে বানানো হয় ষষ্ঠ শতাব্দীর পুরনো মক্কা ও মদিনা শহরের ডামি। নির্মাণশৈলীতে ফুটে ওঠে নবীজির বাল্যবেলার সময়কার মক্কা-মদিনার বাস্তব চিত্র। সিনেমাটি দেখলে মনে হবে- এ যেন রাসুলের ছোটবেলার সেই মক্কা ও মদিনা। ডামি এই মক্কা ও মদিনা শহরে মুহাম্মদ (সা.) সিনেমার শতকরা ৭০ ভাগ শুটিংয়ের কাজ হয়েছে। বাকি কাজ হয়েছে ইরানের কেরমান ও বুশেহর প্রদেশের আসালুয়েহ শহরে।
শুটিংয়ের অনুমতি দেয় নি ভারত: মুহাম্মদ (সা.) ছবির কাহিনী অনুযায়ী, আবিসিনিয়ার বাদশাহ আবরাহা কাবাঘরে হামলা চালায়। শুধুমাত্র বাদশাহ আবরাহার হস্তিবাহিনীর আগ্রাসন এবং তাদের ওপর আবাবিল পাখির পাথর বর্ষণের ঘটনা দেখানোর জন্য ভারতে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু ভারতীয় কর্মকর্তারা ছবির শুটিংয়ের বিষয়ে অনুমতি না দিলে পরে তা দক্ষিণ আফ্রিকার বেলা-বেলা শহরে শুটিং করা হয়েছে।
সেট পরিদর্শনে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা: মুহাম্মদ (সা.) সিনেমা যেহেতু শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর জীবনভিত্তিক এবং তা অনেক সংবেদনশীল বিষয় সে কারণে এই সংবেদনশীলতার বিষয়টি সবসময় মাথায় রেখে কাজ করতে হয়েছে পরিচালক মাজিদ মাজিদিকে। সিনেমার নির্মাণকাজ চলার এক পর্যায়ে ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনী সেট তথা মক্কা ও মদিনার ডামি শহর পরিদর্শন করেন। সিনেমা নির্মাণের ক্ষেত্রে এটি ছিল অনন্য সাধারণ ঘটনা এবং একে পরিচালক মাজিদ মাজিদি তার জন্য বিশেষ আশীর্বাদ বলে গ্রহণ করেন। পরে তিনি সংবাদ সম্মেলনে সে কথা বলতেও ভুল করেন নি। মাজিদি জানান, ক্যামেরার বাইরে সর্বোচ্চ নেতা সেদিন নবীজির জীবনচরিত নিয়ে অতি মূল্যবান কিছু বক্তব্য রাখেন যার কিছু অংশ পরে স্ক্রিপ্টে যোগ করা হয়। মজার বিষয় হলো- ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এই প্রথম কোন সিনেমা প্রকল্প পরিদর্শন করেন এবং সেখানে বক্তৃতা রাখেন। যদিও এর আগে তিনি ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় সিরিয়াল ‘মারিয়াম মুকাদ্দাস’ নির্মাণের আগে তার সেট পরিদর্শন করেছিলেন।
হাত কেঁপেছিল ক্যালিগ্রাফি তৈরিতে: মুহাম্মদ (সা.) সিনেমার লোগো তৈরির জন্য পরিচালক মাজিদ মাজিদি একটি ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। সেখানে বিচারক হিসেবে ইরানের বিখ্যাত সব ক্যালিগ্রাফারকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। প্রতিযোগিতায় ১,৬০০ ক্যালিগ্রাফি জমা পড়ে এবং তার মধ্য থেকে একটিকে শ্রেষ্ঠ বলে বাছাই করা হয়। এছাড়া প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয়টিকে পুরস্কৃত করা হয়। কিন্তু মন ভরে না পরিচালক মাজিদির। পরে তিনি প্রতিযোগিতার অন্যতম বিচারক ও বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার জালিল রাসুলিকে বলেন, “আপনি নিজেই একটি ক্যালিগ্রাফি তৈরি করুন।”
পরে এক সংবাদ সম্মেলনে মুহাম্মদ (সা.) সিনেমার লোগো তৈরির গল্প শোনান জালিল রাসুলি। তিনি জানান, “আমি ৫০ বছর ধরে ক্যালিগ্রাফি লিখছি এবং এ শিল্পের খুঁটিনাটি সব আমার জানা। কিন্তু রাসুলের নাম লেখা ছিল আমার জন্য বেশ কঠিন একটি কাজ। অনেকগুলো স্কেচ আমি তৈরি করি এবং অনেকগুলোর ডিজাইনও করি। কিন্তু কোনটিতে আমি সন্তুষ্ট হতে পারছিলাম না। পরে আমি রাসুল (সা.)-এর কাছে আবেদন করি এবং এই কাজটিতে তাঁরই সাহায্য চাই। একদিন বাদামি রঙের কালি নিয়ে আমি রাসুলের নাম লেখার কাজ শুরু করি। এবার আমি আমার হাত দিয়ে লেখা শুরু করি এবং দেখি যে, আমার সমস্ত শরীর কাঁপছে। আমার সারা জীবনে ক্যালিগ্রাফি লিখতে গিয়ে এমন ঘটনা কখনো ঘটে নি।” রাসুলি এ ঘটনাকে ব্যাখ্যা করে বলেন, “এটাই ছিল তার ইঙ্গিত যা আমি চাইছিলাম।”
সিনেমার বাজেট নিয়ে যত কথা: মুহাম্মদ (সা.) সিনেমা ইরানের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাজেটের ছবি। সে কারণে এ নিয়ে নানা জল্পনা আর গল্প ছড়িয়ে পড়েছে। তবে, বিশেষ করে পশ্চিমা গণমাধ্যম সিনেমার বাজেট নিয়ে মিথ্যা ও বিচিত্র সব কথা ছড়াচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- হলিউড রিপোর্টার দাবি করেছেন মাজিদ মাজিদি এ সিনেমা তৈরি করতে তিন কোটি ডলার ব্যয় করেছেন। এ প্রেক্ষাপটে সিনেমা প্রকল্পের সামগ্রিক ব্যয় তুলে ধরেছেন নুর তাবান ফিল্ম কোম্পানির প্রধান সাদেকিয়ান।
সাদেকিয়ানের তথ্য অনুসারে মক্কা শহরের ডামি তৈরিতে খরচ হয়েছে ৫০ লাখ ডলার, মদিনার ডামিতে খরচ ১০ লাখ ডলার এবং অফিস ভবন তৈরিতে খরচ গেছে প্রায় চার লাখ ডলার। ছবির স্ক্রিপ্ট তৈরিতে গেছে এক লাখ ডলার, দুই লাখ ডলার ব্যয় হয়েছে গবেষণার কাজে আর ৫৪ লাখ ডলার ব্যয় হয়েছে প্রি- প্রোডাকশন কাজে। এক কোটি ১০ লাখ ডলার খরচ হয়েছে প্রডাকশনের কাজে এবং পোস্ট-প্রডাকশনে খরচ গেছে ৫৩ লাখ ডলার। এসব হিসাব অনুযায়ী মুহাম্মদ (সা.) ছবি নির্মাণে খরচ হয়েছে প্রায় দুই কোটি ২০ লাখ ডলার।
ছবির নির্মাণশৈলী এবং গুণগতমানের কারণে ইরানের ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য একাডেমির প্রধান গোলাম আলী হাদ্দাদ আদেল পরিচালক মাজিদ মাজিদিকে চলতি ইরানি বছরের সেরা পরিচালক ঘোষণা করেছেন।
যেভাবে মনোনীত হয়েছেন কাস্ট অ্যান্ড ক্রু: এ সিনেমায় যারা অভিনয় করেছেন তাদেরকে মনোনীত করেছেন স্বয়ং পরিচালক মাজিদ মাজিদি এবং ইতালির মেকআপ আর্টিস্ট গিয়ানেত্তো ডি রোসি। তিনবার একাডেমি অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী ইতালির সিনেমাটোগ্রাফার ভিত্তোরিয়ো স্তোরারো-ও এ কাজে অবদান রাখেন। কাস্ট অ্যান্ড ক্রু নির্বাচনের জন্য তিনি আলাদাভাবে ইরান সফর করেন।
মুহাম্মদ (সা.) চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনটি শিশু। ছয় বছর বয়সে অভিনয় করেছেন আলী রেজা জালিলি, আট বছর বয়সে হোসেইন জালালি এবং ১৩ বছর বয়সে অভিনয় করেছেন আমির হায়দারি। এছাড়া, মা আমিনার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন মিনা সাদাতি, দাদা আব্দুল মুত্তালিব-আলী রেজা সুজা নুরি, চাচা আবু তালিব- মাহদি পাকদেল, আবু লাহাব- মোহাম্মদ আসগরী, আবু লাহাবের স্ত্রী জামিলা- রানা আজাদিভার এবং হামজা চরিত্রে অভিনয় করেছেন হামিদ রেজা দৌলতি। এছাড়া, হালিমা চরিত্রে অভিনয় করেছেন সালেহ বাইয়াত। ইহুদি ধনকুবের স্যামুয়েল চরিত্রে অভিনয় করেছেন মোহসেন তানাবান্দেহ, আবু সুফিয়ানের চরিত্রে দারিউশ ফারহাং (নবীজির ঘোরবিরোধী) এবং খ্রিস্টান পাদ্রি বুহাইরা চরিত্রে অভিনয় করেছেন সাদেক হাতাফি।
রাসুলের মায়ের ভূমিকায় (আমিনা) অভিনয়কারী মিনা সাদাতির অভিনয়কে দর্শকরা অনন্য সাধারণ বলেছেন। ইরানের অন্যতম স্বনামধন্য অভিনেত্রী তিনি। মিনা সাদাতি বেশ কয়েকটি নামকরা সিনেমা করেছেন এবং জাতীয় পর্যায়ে ২০১৩ ও ২০১৪ সালে পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৮১ সালের নভেম্বর মাসে ইরানের কাশান শহরে এই গুণীশিল্পী জন্মগ্রহণ করেন এবং গত বছর তিনি সিনেমা জগতে শ্রেষ্ঠ নারী শিল্পী হিসেবে পুরস্কার পান।
No comments