দুর্গন্ধে চলা দায় by খালিদ সাইফুল্লাহ
রাজধানীতে
ময়লা আবর্জনার দুর্গন্ধে চলা দায় হয়ে পড়েছে। যে সড়ক দিয়েই যান না কেন
ময়লার কনটেইনার (ডাস্টবিন) চোখে পড়বেই। আর সেসব কনটেইনারের দুর্গন্ধযুক্ত
ময়লা আবর্জনা ছড়িয়ে পড়ছে মূল সড়কেও। রাত-দিন সব সময়ই এসব জায়গায় ময়লা পড়ে
থাকতে দেখা যায়। দীর্ঘ দিন ধরে একই জায়গায় কনটেইনারগুলো থাকার কারণে
পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা ময়লা পরিষ্কার করলেও দূষিত তরল পদার্থ থেকে যাচ্ছে ওই
জায়গাতেই। এতে কনটেইনার রাখার স্থানগুলো হয়ে যাচ্ছে নোংরা ও অপরিচ্ছন্ন।
নিয়মিত ওষুধ না ছিটানোয় এ স্থানগুলো থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে প্রতিনিয়ত।
ফলে পথ চলতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে নগরবাসীকে। এ ক্ষেত্রে দুই মেয়র
রাজধানীকে পরিচ্ছন্ন, দূষণমুক্ত ও স্বাস্থ্যকর নগরী উপহার দেয়ার
প্রতিশ্রুতি দিলেও তার কোনো লক্ষণ দৃশ্যমান নয়।
দৈনিক বাংলা মোড় থেকে মতিঝিলের দিকে একটু এগোলেই টয়েনবি সার্কুলার রোড। এ সড়কে কয়েকটি উন্নতমানের খাবার হোটেল, কম্পিউটার যন্ত্রাংশের মার্কেট, প্রকাশনা সংস্থাসহ বিভিন্ন ধরনের দোকানপাট রয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার কর্মব্যস্ত মানুষ এ সড়ক দিয়ে চলাচল করেন। কিন্তু সড়কটির প্রবেশ পথে আলীগড় হাউজের সামনে ও মেঘনা পেট্রোলিয়ামের পাশে খোলা স্থানে ময়লা ফেলার দুইটি কনটেইনার রাখা হয়েছে। সেখানে গতকাল গিয়ে দেখা যায়, পুরো এলাকাটি দুর্গন্ধময় হয়ে উঠেছে। দুপুর বেলায়ও কনটেইনারে ময়লা থাকতে দেখা যায়। কনটেইনারের নিচে ও রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ময়লা পড়ে রয়েছে। এ ছাড়া পচা দুর্গন্ধময় পানির কারণে এলাকার বাতাস দুগর্ন্ধে ভারী হয়ে উঠছে। এখানে কনটেইনারের গা ঘেঁষেই ভ্যান স্ট্যান্ড রয়েছে। মার্কেটে আসা ব্যক্তিরা প্রাইভেট গাড়ি রাখছেন মারলিন রেস্তোরাঁর সামনে। আর অবাক করার বিষয় হলো দুর্গন্ধময় পানির পাশেই ফুটপাথে পলিথিন দিয়ে ঘিরে চারটি খাবার হোটেল বসানো হয়েছে। রাকিব হোসেন নামে এক দোকান কর্মচারী বলেন, কম্পিউটার মার্কেটে চাকরি করি। এখান দিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করতে হয়। কিন্তু দুর্গন্ধের কারণে বমি বমি ভাব চলে আসে। চোখ বন্ধ করে নাকে রুমাল চেপে দ্রুত রাস্তা পার হতে হয়।
বেলা দেড়টার দিকে কালভার্ট রোডের প্রবেশ মুখে গিয়ে দেখা যায়, একটি কনটেইনার রয়েছে। কনটেইনারটি ময়লায় ভর্তি। নয়াপল্টন সমাজ উন্নয়ন সমিতির চারটি গাড়ি এখানে এনে রাস্তার ওপর ময়লা ফেলছে। এ সময় সেখানে সিটি করপোরেশনের একটি কম্পেক্টর গাড়ি দেখা যায়। সে গাড়িতেও কয়েকজন শ্রমিক ময়লা তুলছেন। এ সময় পুরো এলাকাতেই ময়লা আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায়, যা থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। আর এর পাশ দিয়েই পথচারীদের চলাচল করতে হচ্ছে।
বিজয়নগর ফকিরাপুল পানির ট্যাংকের নিচে কনটেইনার রাখা হয়েছে। এ কনটেইনারকে ঘিরে বেশ খানিকটা জায়গাজুড়ে ময়লা আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। নিচে দুর্গন্ধময় পানিতে স্যাঁতসেঁতে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এখানে প্রাইভেট কারের বিভিন্ন যন্ত্রাংশের দোকান রয়েছে। এ দুর্গন্ধকে সঙ্গী করেই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। আর রাস্তার পথচারীদের নাকে রুমাল চেপে চলতে হচ্ছে।
বাসাবো কদমতলা সংসদ পানির পাম্পের সামনে মূল সড়কের ওপর তিনটি কনটেইনার রাখা হয়েছে। ২০ গজের মতো জায়গাজুড়ে ময়লা ও কাদাপানিতে স্যাঁতসেঁতে পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। এখানে বাকি যেটুকু রাস্তা রয়েছে তাও ভাঙাচোরা। বড় বড় গর্তে পানি জমে রয়েছে। এখানে ওয়াসার পানির পাম্প থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে পানি সংগ্রহ করে থাকেন। তাদের ময়লা আবর্জনার দুর্গন্ধ সয়েই ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। কনটেইনার রাখার কারণে মাঝেমধ্যেই তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয় এ স্থানটিতে।
একইভাবে উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতাধীন নতুনবাজার মোড়ে বারিধারা এলাকার ময়লা আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। এ কারণে মূল সড়কের ওপর বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে সব সময় ময়লা আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকছে। দুর্গন্ধে মানুষকে চলাচলে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। মহাখালিতে আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালের পাশেই মূল সড়কে ভাগাড় রয়েছে। এ ভাগাড়ের কারণে পুরো এলাকা দুর্গন্ধময় হয়ে পড়েছে। মিরপুর-১০ এর মোড়, শ্যাওড়াপাড়া, মোহাম্মদপুর, রামপুরা কাঁচাবাজারসহ প্রতিটি ওয়ার্ডেই ময়লার কনটেইনার রাখা হয়েছে মূল সড়কের ওপর। যেখান থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন তার নির্বাচনী ইশতেহারে ঢাকাকে একটি পরিচ্ছন্ন, দূষণমুক্ত ও স্বাস্থ্যকর মহানগরী করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে আধুনিকায়ন করা, রাস্তাঘাট, লোকালয়ের যত্রতত্র যেন বর্জ্য পড়ে না থাকে সে লক্ষ্যে বর্জ্য সংগ্রহ এবং নির্ধারিত স্থানে তা ডাম্প করার পাশাপাশি বর্জ্য রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও জৈব সার উৎপাদন প্রকল্প গ্রহণের কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু নগরবাসীকে এ পর্যন্ত কোনো সুখবর দিতে পারেননি তিনি। মেয়র তার বাজেট বক্তৃতায় কনটেইনারগুলো মূল সড়ক থেকে সরিয়ে অলিগলিতে নিয়ে যাওয়ার কথা শুনিয়েছিলেন। কিন্তু তারও কোনো অগ্রগতি চোখে পড়ে না। স্থানীয় কাউন্সিররা দু-একটি জায়গা পরিবর্তন করলেও নতুন জায়গা থেকেও সেই একইভাবে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। শুধু প্রশস্ত সড়কই নয়, রাজধানীর অলিগলি সর্বত্রই ময়লা আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এসব আবর্জনা বৃষ্টির পানির সাথে ড্রেনে গিয়ে পড়ছে। ড্রেন বন্ধ হয়ে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতার।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন আরবান পাবলিক অ্যান্ড এনভাইরনমেন্টাল হেলথ সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (ইউপিএইচএসডিপি) গ্রহণ করা হয় ২০০৯ সালে। এ প্রকল্পের অধীনে এডিবি ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে ডিএসসিসি এলাকায় সাতটি সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন নির্মাণের কথা ছিল। এ লক্ষ্যে চীনের একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হয়। তারা পান্থকুঞ্জ, হাজারীবাগসহ কয়েকটি স্থানে কাজ করতে যায়। কিন্তু স্থানীয় জনগণের বাধার মুখে কাজ করতে পারেনি। পান্থকুঞ্জ ও হাজারীবাগের স্টেশন নিয়ে মামলাও করা হয়েছে। ফলে ওই কাজ স্থবির হয়ে পড়েছে। চীনা কোম্পানিটি এ ব্যাপারে প্রকল্পের পরিচালকসহ কর্মকর্তাদের সাথে বারবার যোগাযোগ করলেও তারা স্টেশন নির্মাণের জায়গার ব্যবস্থা করে দিতে ব্যর্থ হন। একইভাবে ওই প্রকল্পের অধীনে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট ও বরিশালে কন্ট্রোল ল্যান্ডফিল এবং খুলনায় একটি স্যানিটারি ল্যান্ডফিলের পাশাপাশি ঢাকায় মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য একটি কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু কারিগরি দক্ষতাহীন প্রকল্প পরিচালকের ব্যর্থতায় ওই প্রকল্পের ২৭৫ কোটি টাকা ফেরত যাচ্ছে। ফলে ঢাকার মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আরো আধুনিকায়নের সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে। এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশনের মেয়ররাও কোনো ভূমিকা রাখতে পারেননি।
উত্তরের মেয়র আনিসুল হক তার নির্বাচনী ইশতেহারে ঢাকাকে একটি নোংরা শহর হিসেবে উল্লেখ করে বলেছিলেন, আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে তিনি কাজ করবেন। ময়লা, আবর্জনা, দুর্গন্ধ থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দিতে পর্যায়ক্রমে সড়ক থেকে ভাগাড়গুলো (ডাস্টবিন) সরিয়ে নেয়া হবে। এর পরিবর্তে এলাকাভিত্তিক ময়লা সংরক্ষণ (ডাম্প) কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। কিন্তু গত চার মাসে তিনি তার প্রতিশ্রুতির সামান্যও বাস্তবায়ন করতে পারেননি। তিনি জানিয়েছেন, ৩৬ ওয়ার্ডে দুটি করে মোট ৭২টি সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন নির্মাণ করা প্রয়োজন। এ জন্য জায়গা বাছাই করা হচ্ছে। কিন্তু জায়গার বড় সঙ্কট। মেয়র আসার আগেই ডিএনসিসি এলাকায় ১৪টি মিনি ট্রান্সফার স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। ইউপিএইচএসডিপি প্রকল্পের অধীনে দক্ষিণ সিটির মতো উত্তরেও পাঁচটি সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন নির্মাণের কথা ছিল। কিন্তু সিটি করপোরেশন জায়গা দিতে না পারায় তা আর নির্মাণ হয়নি। ফলে আবর্জনার দূষণ থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো সুখবর নেই সিটি করপোরেশনের কাছে।
দক্ষিণের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন মো: রকিব উদ্দিন ভুঁইয়া জানিয়েছেন, দক্ষিণে প্রতিদিন দুই হাজার ৩০০ থেকে দুই হাজার ৫০০ টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এসব বর্জ্য রাখার জন্য মোট ৩২৫টি কনটেইনার রয়েছে। প্রতিদিন এসব স্থান থেকে ময়লা নিয়ে রাজধানীর বাইরে ডাম্পিং স্টেশনে (ল্যান্ডফিল) ময়লা নিতে ১২৫টি খোলা ট্রাক, ৭৩টি কনটেইনার ক্যারিয়ার এবং ১৬টি কমúেক্টর রয়েছে। পাঁচ হাজার পরিচ্ছন্ন কর্মী নিয়মিত কাজ করছেন নগর পরিচ্ছন্ন রাখতে। দিনের বেলায় ময়লা নেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগের তুলনায় এটি কমে গেছে। সকাল ৮টার মধ্যেই আমরা কনটেইনার থেকে ময়লা নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। তবে মানুষের বাসার ময়লা রাতের বেলায় কনটেইনারে ফেলার কথা থাকলেও দিনের বেলায় ফেলার কারণে মাঝে মধ্যে দিনের বেলাতেও ট্রাকে করে ময়লা নিতে হচ্ছে।
মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, ঢাকা মহানগরীকে বাসোপযোগী, সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন নগরীতে পরিণত করা আমার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। তবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা একটি জটিল কাজ। উৎপাদিত বর্জ্য অপসারণে যে পরিমাণ অর্থ, লোকবল ও যন্ত্রপাতি প্রয়োজন তার সঙ্কট রয়েছে বলেও তিনি জানান।
ডিএনসিসি এলাকায় প্রতিদিন দুই হাজার ৬০০ থেকে দুই হাজার ৮০০ টন বর্জ্য জমা হয় জানিয়ে উত্তরের মেয়র আনিসুল হক বলেন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সেবা সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে মিটিং করে ৭০টি জায়গায় আমরা ট্রান্সফার স্টেশন তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি। আগামী বছরের মধ্যে সেগুলো নির্মিত হলে রাজধানীর এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন উঠবে না। রাজধানীর ২৯টি ওয়ার্ড সরেজমিন দেখার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা সম্পর্কে মেয়র বলেন, পাঁচ লাখ দোকানদার প্রতিদিন রাস্তায় ময়লা ফেলেন। জনসচেতনতা না বাড়লে এটা বন্ধ হবে না। এ জন্য এলাকায় এলাকায় মিটিং ও লিফলেট বিতরণ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। কোরবানি ঈদের সময় নগরবাসী যাতে যত্রতত্র পশু কোরবানি না দেন, এ জন্য এবার জায়গা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান।
দৈনিক বাংলা মোড় থেকে মতিঝিলের দিকে একটু এগোলেই টয়েনবি সার্কুলার রোড। এ সড়কে কয়েকটি উন্নতমানের খাবার হোটেল, কম্পিউটার যন্ত্রাংশের মার্কেট, প্রকাশনা সংস্থাসহ বিভিন্ন ধরনের দোকানপাট রয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার কর্মব্যস্ত মানুষ এ সড়ক দিয়ে চলাচল করেন। কিন্তু সড়কটির প্রবেশ পথে আলীগড় হাউজের সামনে ও মেঘনা পেট্রোলিয়ামের পাশে খোলা স্থানে ময়লা ফেলার দুইটি কনটেইনার রাখা হয়েছে। সেখানে গতকাল গিয়ে দেখা যায়, পুরো এলাকাটি দুর্গন্ধময় হয়ে উঠেছে। দুপুর বেলায়ও কনটেইনারে ময়লা থাকতে দেখা যায়। কনটেইনারের নিচে ও রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ময়লা পড়ে রয়েছে। এ ছাড়া পচা দুর্গন্ধময় পানির কারণে এলাকার বাতাস দুগর্ন্ধে ভারী হয়ে উঠছে। এখানে কনটেইনারের গা ঘেঁষেই ভ্যান স্ট্যান্ড রয়েছে। মার্কেটে আসা ব্যক্তিরা প্রাইভেট গাড়ি রাখছেন মারলিন রেস্তোরাঁর সামনে। আর অবাক করার বিষয় হলো দুর্গন্ধময় পানির পাশেই ফুটপাথে পলিথিন দিয়ে ঘিরে চারটি খাবার হোটেল বসানো হয়েছে। রাকিব হোসেন নামে এক দোকান কর্মচারী বলেন, কম্পিউটার মার্কেটে চাকরি করি। এখান দিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করতে হয়। কিন্তু দুর্গন্ধের কারণে বমি বমি ভাব চলে আসে। চোখ বন্ধ করে নাকে রুমাল চেপে দ্রুত রাস্তা পার হতে হয়।
বেলা দেড়টার দিকে কালভার্ট রোডের প্রবেশ মুখে গিয়ে দেখা যায়, একটি কনটেইনার রয়েছে। কনটেইনারটি ময়লায় ভর্তি। নয়াপল্টন সমাজ উন্নয়ন সমিতির চারটি গাড়ি এখানে এনে রাস্তার ওপর ময়লা ফেলছে। এ সময় সেখানে সিটি করপোরেশনের একটি কম্পেক্টর গাড়ি দেখা যায়। সে গাড়িতেও কয়েকজন শ্রমিক ময়লা তুলছেন। এ সময় পুরো এলাকাতেই ময়লা আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায়, যা থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। আর এর পাশ দিয়েই পথচারীদের চলাচল করতে হচ্ছে।
বিজয়নগর ফকিরাপুল পানির ট্যাংকের নিচে কনটেইনার রাখা হয়েছে। এ কনটেইনারকে ঘিরে বেশ খানিকটা জায়গাজুড়ে ময়লা আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। নিচে দুর্গন্ধময় পানিতে স্যাঁতসেঁতে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এখানে প্রাইভেট কারের বিভিন্ন যন্ত্রাংশের দোকান রয়েছে। এ দুর্গন্ধকে সঙ্গী করেই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। আর রাস্তার পথচারীদের নাকে রুমাল চেপে চলতে হচ্ছে।
বাসাবো কদমতলা সংসদ পানির পাম্পের সামনে মূল সড়কের ওপর তিনটি কনটেইনার রাখা হয়েছে। ২০ গজের মতো জায়গাজুড়ে ময়লা ও কাদাপানিতে স্যাঁতসেঁতে পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। এখানে বাকি যেটুকু রাস্তা রয়েছে তাও ভাঙাচোরা। বড় বড় গর্তে পানি জমে রয়েছে। এখানে ওয়াসার পানির পাম্প থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে পানি সংগ্রহ করে থাকেন। তাদের ময়লা আবর্জনার দুর্গন্ধ সয়েই ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। কনটেইনার রাখার কারণে মাঝেমধ্যেই তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয় এ স্থানটিতে।
একইভাবে উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতাধীন নতুনবাজার মোড়ে বারিধারা এলাকার ময়লা আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। এ কারণে মূল সড়কের ওপর বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে সব সময় ময়লা আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকছে। দুর্গন্ধে মানুষকে চলাচলে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। মহাখালিতে আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালের পাশেই মূল সড়কে ভাগাড় রয়েছে। এ ভাগাড়ের কারণে পুরো এলাকা দুর্গন্ধময় হয়ে পড়েছে। মিরপুর-১০ এর মোড়, শ্যাওড়াপাড়া, মোহাম্মদপুর, রামপুরা কাঁচাবাজারসহ প্রতিটি ওয়ার্ডেই ময়লার কনটেইনার রাখা হয়েছে মূল সড়কের ওপর। যেখান থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন তার নির্বাচনী ইশতেহারে ঢাকাকে একটি পরিচ্ছন্ন, দূষণমুক্ত ও স্বাস্থ্যকর মহানগরী করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে আধুনিকায়ন করা, রাস্তাঘাট, লোকালয়ের যত্রতত্র যেন বর্জ্য পড়ে না থাকে সে লক্ষ্যে বর্জ্য সংগ্রহ এবং নির্ধারিত স্থানে তা ডাম্প করার পাশাপাশি বর্জ্য রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও জৈব সার উৎপাদন প্রকল্প গ্রহণের কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু নগরবাসীকে এ পর্যন্ত কোনো সুখবর দিতে পারেননি তিনি। মেয়র তার বাজেট বক্তৃতায় কনটেইনারগুলো মূল সড়ক থেকে সরিয়ে অলিগলিতে নিয়ে যাওয়ার কথা শুনিয়েছিলেন। কিন্তু তারও কোনো অগ্রগতি চোখে পড়ে না। স্থানীয় কাউন্সিররা দু-একটি জায়গা পরিবর্তন করলেও নতুন জায়গা থেকেও সেই একইভাবে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। শুধু প্রশস্ত সড়কই নয়, রাজধানীর অলিগলি সর্বত্রই ময়লা আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এসব আবর্জনা বৃষ্টির পানির সাথে ড্রেনে গিয়ে পড়ছে। ড্রেন বন্ধ হয়ে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতার।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন আরবান পাবলিক অ্যান্ড এনভাইরনমেন্টাল হেলথ সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (ইউপিএইচএসডিপি) গ্রহণ করা হয় ২০০৯ সালে। এ প্রকল্পের অধীনে এডিবি ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে ডিএসসিসি এলাকায় সাতটি সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন নির্মাণের কথা ছিল। এ লক্ষ্যে চীনের একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হয়। তারা পান্থকুঞ্জ, হাজারীবাগসহ কয়েকটি স্থানে কাজ করতে যায়। কিন্তু স্থানীয় জনগণের বাধার মুখে কাজ করতে পারেনি। পান্থকুঞ্জ ও হাজারীবাগের স্টেশন নিয়ে মামলাও করা হয়েছে। ফলে ওই কাজ স্থবির হয়ে পড়েছে। চীনা কোম্পানিটি এ ব্যাপারে প্রকল্পের পরিচালকসহ কর্মকর্তাদের সাথে বারবার যোগাযোগ করলেও তারা স্টেশন নির্মাণের জায়গার ব্যবস্থা করে দিতে ব্যর্থ হন। একইভাবে ওই প্রকল্পের অধীনে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট ও বরিশালে কন্ট্রোল ল্যান্ডফিল এবং খুলনায় একটি স্যানিটারি ল্যান্ডফিলের পাশাপাশি ঢাকায় মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য একটি কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু কারিগরি দক্ষতাহীন প্রকল্প পরিচালকের ব্যর্থতায় ওই প্রকল্পের ২৭৫ কোটি টাকা ফেরত যাচ্ছে। ফলে ঢাকার মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আরো আধুনিকায়নের সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে। এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশনের মেয়ররাও কোনো ভূমিকা রাখতে পারেননি।
উত্তরের মেয়র আনিসুল হক তার নির্বাচনী ইশতেহারে ঢাকাকে একটি নোংরা শহর হিসেবে উল্লেখ করে বলেছিলেন, আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে তিনি কাজ করবেন। ময়লা, আবর্জনা, দুর্গন্ধ থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দিতে পর্যায়ক্রমে সড়ক থেকে ভাগাড়গুলো (ডাস্টবিন) সরিয়ে নেয়া হবে। এর পরিবর্তে এলাকাভিত্তিক ময়লা সংরক্ষণ (ডাম্প) কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। কিন্তু গত চার মাসে তিনি তার প্রতিশ্রুতির সামান্যও বাস্তবায়ন করতে পারেননি। তিনি জানিয়েছেন, ৩৬ ওয়ার্ডে দুটি করে মোট ৭২টি সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন নির্মাণ করা প্রয়োজন। এ জন্য জায়গা বাছাই করা হচ্ছে। কিন্তু জায়গার বড় সঙ্কট। মেয়র আসার আগেই ডিএনসিসি এলাকায় ১৪টি মিনি ট্রান্সফার স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। ইউপিএইচএসডিপি প্রকল্পের অধীনে দক্ষিণ সিটির মতো উত্তরেও পাঁচটি সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন নির্মাণের কথা ছিল। কিন্তু সিটি করপোরেশন জায়গা দিতে না পারায় তা আর নির্মাণ হয়নি। ফলে আবর্জনার দূষণ থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো সুখবর নেই সিটি করপোরেশনের কাছে।
দক্ষিণের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন মো: রকিব উদ্দিন ভুঁইয়া জানিয়েছেন, দক্ষিণে প্রতিদিন দুই হাজার ৩০০ থেকে দুই হাজার ৫০০ টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এসব বর্জ্য রাখার জন্য মোট ৩২৫টি কনটেইনার রয়েছে। প্রতিদিন এসব স্থান থেকে ময়লা নিয়ে রাজধানীর বাইরে ডাম্পিং স্টেশনে (ল্যান্ডফিল) ময়লা নিতে ১২৫টি খোলা ট্রাক, ৭৩টি কনটেইনার ক্যারিয়ার এবং ১৬টি কমúেক্টর রয়েছে। পাঁচ হাজার পরিচ্ছন্ন কর্মী নিয়মিত কাজ করছেন নগর পরিচ্ছন্ন রাখতে। দিনের বেলায় ময়লা নেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগের তুলনায় এটি কমে গেছে। সকাল ৮টার মধ্যেই আমরা কনটেইনার থেকে ময়লা নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। তবে মানুষের বাসার ময়লা রাতের বেলায় কনটেইনারে ফেলার কথা থাকলেও দিনের বেলায় ফেলার কারণে মাঝে মধ্যে দিনের বেলাতেও ট্রাকে করে ময়লা নিতে হচ্ছে।
মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, ঢাকা মহানগরীকে বাসোপযোগী, সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন নগরীতে পরিণত করা আমার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। তবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা একটি জটিল কাজ। উৎপাদিত বর্জ্য অপসারণে যে পরিমাণ অর্থ, লোকবল ও যন্ত্রপাতি প্রয়োজন তার সঙ্কট রয়েছে বলেও তিনি জানান।
ডিএনসিসি এলাকায় প্রতিদিন দুই হাজার ৬০০ থেকে দুই হাজার ৮০০ টন বর্জ্য জমা হয় জানিয়ে উত্তরের মেয়র আনিসুল হক বলেন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সেবা সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে মিটিং করে ৭০টি জায়গায় আমরা ট্রান্সফার স্টেশন তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি। আগামী বছরের মধ্যে সেগুলো নির্মিত হলে রাজধানীর এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন উঠবে না। রাজধানীর ২৯টি ওয়ার্ড সরেজমিন দেখার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা সম্পর্কে মেয়র বলেন, পাঁচ লাখ দোকানদার প্রতিদিন রাস্তায় ময়লা ফেলেন। জনসচেতনতা না বাড়লে এটা বন্ধ হবে না। এ জন্য এলাকায় এলাকায় মিটিং ও লিফলেট বিতরণ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। কোরবানি ঈদের সময় নগরবাসী যাতে যত্রতত্র পশু কোরবানি না দেন, এ জন্য এবার জায়গা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান।
No comments