এরশাদের দিনযাপন by বেলায়েত হোসাইন
রাজধানীর
বারিধারার দূতাবাস রোডের মাঝামাঝিতে অবস্থিত বিলাসবহুল ভবন প্রেসিডেন্ট
পার্ক। ভবনের পঞ্চম তলায় বাস করেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ও জাতীয় পার্টির
চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ভবনজুড়ে এরশাদের নিকটজন বলতে থাকেন শুধু
সন্তান এরিক। সঙ্গে থাকেন আরও কয়েকজন কর্মচারী। এরিকের দেখাশোনার জন্য দুজন
ও রান্নার জন্য দুজনসহ মোট কর্মচারীর সংখ্যা ১৫-এর অধিক। এরশাদের বাড়িটি
ঘুরে ও তার ঘনিষ্ঠজনদের কাছ থেকে জানা যায়, পঞ্চম তলার পুরোটাই নিজের জন্য
সাজিয়েছেন তিনি। ষষ্ঠ তলায় রয়েছে এরশাদের জিমাগার। পঞ্চম তলার প্রধান দরজা
দিয়ে ঢুকলেই হাতের ডানে একটি অফিস রুম। বই-পুস্তকেসমৃদ্ধ এ রুমটিকেই
ব্যক্তিগত অফিস হিসেবে ব্যবহার করেন তিনি। কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ ও
আলাপ-আলোচনা করেন এখানেই বসে। আরেকটু সামনে গেলে একটি বিশাল ড্রইংরুম।
পাশেই রয়েছে সুসজ্জিত ডাইনিং। সন্তান এরিকের জন্য রয়েছে আলাদা বিশাল
বেডরুম। নিজের জন্য তো আছেই। রাজনীতিতে নানা ও নাটকীয়তার জন্ম দিলেও
ব্যক্তিগত জীবনে এরশাদ খুব সময়নিষ্ঠ। ভোর ৫টা বাজেই শয্যা ত্যাগ করেন সাবেক
এই প্রেসিডেন্ট। ফজরের নামাজ পড়েই রওনা হন মর্নিং ওয়ার্কে। সেই সঙ্গে
নিয়মিত খেলেন গলফ। এসব শেষে বাসায় ফিরেন সাড়ে ৯টার মধ্যেই। তার পর গোসল
করেই নাশতা খেতে বসেন। জানা যায়, নাশতা হিসেবে এরশাদের প্রিয় খাবার ডালিমের
জুস। দুধের সঙ্গে মধু খেতেও পছন্দ করেন তিনি। এ ছাড়া বাদামের প্রতি রয়েছে
তার আলাদা আকর্ষণ। নাশতার পরেই নিজের রিডিংরুমে বসেন। খবরের কাগজ ও বিভিন্ন
বই অধ্যয়ন করেন। বেলা ১১টা পর্যন্ত বাসাতেই থাকেন সাধারণত। এ সময়ের মধ্যেই
প্রেসিডেন্ট পার্কে উপস্থিত হয়ে যান প্রেস সচিব সুনীল শুভরায় ও ব্যক্তিগত
সচিব মেজর (অব.) খালিদ আক্তার। কোন কোন দিন আসেন দলের মহাসচিবও। দলের
গুরুত্বপূর্ণ নেতারাও এ সময়ের মধ্যে সাক্ষাৎ পান তার। তবে ঢালাওভাবে দলীয়
নেতাকর্মীদের সঙ্গে বাসায় দেখা করেন না তিনি। এর জন্য রয়েছে তার বনানীর
রাজনৈতিক কার্যালয়। তিন তলাবিশিষ্ট ভবনটির নিচতলায় মহাসচিব ও দোতলায় রয়েছে
এরশাদের কার্যালয়। বেলা সাড়ে ১১টার মধ্যে পৌঁছে যান সেখানে। একের পর এক
নেতাকর্মীরা আসতে থাকেন। দেশের বিভিন্ন জেলার নেতাকর্মীরাও আসেন এখানে।
অনেকেই সাক্ষাৎ পান। আবার সাক্ষাৎ ছাড়াও ফিরে যান অনেকে। দুপুর গড়াতেই আবার
প্রেসিডেন্ট পার্কে ফিরেন এরশাদ। ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ। তার পর ব্যক্তিগত কাজে
মন দেন। কখনও কখনও দুপুরের পরে কিছু সময়ের জন্য ঘুমান এরশাদ। জানা গেছে,
মাঝেমধ্যেই বিকালবেলা তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও
কূটনৈতিকরা। কখনও আবার অন্য সময়েও আসেন। ড্রইংরুমে বসেই এসব ব্যক্তির সঙ্গে
সৌজন্য সাক্ষাৎ ও বৈঠক করেন তিনি। তবে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকেই
এরশাদের বাসায় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও ভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের
উপস্থিতি খুব একটা উল্লেখযোগ্য নয়। রাত ১০টার আগেই সেরে ফেলেন ডিনার। এর
মধ্যেই ছেলে এরিকের সঙ্গে কিছু সময় ব্যয় করেন। এরিকের কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত
শুনেন। এজন্য বাসায় রয়েছে গানের সব যন্ত্রপাতি। নিজের সব কাজকর্ম সেরে
১১টার মধ্যেই বিছানায় চলে যান এরশাদ। এরপর কিছুক্ষণ টিভি দেখেন। তারপর
ঘুমিয়ে পড়েন। এই হলো এরশাদের ২৪ ঘণ্টার নিয়মিত রুটিন। যদিও ব্যক্তি জীবনের
বাইরে এরশাদের রয়েছে ভিন্ন কয়েকটি পরিচয়। বিশেষ করে সংসদ সদস্য ও
প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। তা ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যও আছে। আর তাই এরশাদের
রুটিনে গরমিল হয়ে যায় প্রায়ই। সকাল সাড়ে ৯টার পর থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এ
সময়ের মধ্যেই এরশাদের রুটিন বিপর্যয় ঘটে। মাঝেমধ্যেই রাজধানীর বিভিন্ন
স্থানে দলের সভা-সমাবেশে যোগ দেন তিনি। এ ছাড়া সংসদে যাওয়ার কথা থাকলে
সময়মতোই পৌঁছে যান এরশাদ। জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার কার্যালয় বরাবরের
ঠিক নিচেই প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের কার্যালয়। সংসদে গেলেই এ অফিসেও
কিছুটা সময় ব্যয় করেন তিনি। সেখানে একজন উপসচিবসহ তার বেশ কিছু
কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও সংসদের ব্যস্ততা থাকলে
সেদিন আর দলীয় কার্যালয়ে যান না তিনি। সার্বক্ষণিক এরশাদের সঙ্গী হিসেবে
থাকেন সুনীল শুভরায়, মেজর (অব.) খালিদ ও দেহরক্ষী বাদশা মিয়া। এ ছাড়া
প্রায়ই নিজ জেলা রংপুরে ছুটে যান এরশাদ। আবার প্রতি মাসের কোন না কোন দিনে
থাকে ঢাকার বাইরে দলীয় সফর। ঢাকার বাইরে যাওয়ার মাধ্যম হিসেবে এরশাদের
পছন্দ বিমান। এ ছাড়া বিদেশ সফর তো আছেই। সিঙ্গাপুরে তিনি হার্টের ডাক্তার
দেখান বলে জানা গেছে। ঢাকায় থাকলে এরশাদ আরও দুটি জায়গায় সময় ব্যয় করেন।
সেগুলো হলো- গুলশান ক্লাব ও ডিওএইচএস ক্লাব। এ ছাড়া সপ্তাহে একদিন স্ত্রী
রওশনের সঙ্গে ডিনার অথবা লাঞ্চে মিলিত হন তিনি। আগে নিয়মিত জিম করলেও এখন
আর সেভাবে পারেন না এরশাদ। উল্লেখ্য, বেশ কিছু বছর আগ থেকেই এরশাদ এবং রওশন
আলাদা বাসায় থাকেন। জাপা নেতাদের মতে, এর প্রধান কারণই দাম্পত্য কলহ। পরে
যা রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে রূপ নেয় একাধিকবার।
No comments