কয়লা নিয়ে ‘রামপাল রাজনীতি’ by মহিউদ্দিন আহমদ
বাংলাদেশ
‘রামসার’ কনভেনশনে স্বাক্ষরদাতা দেশগুলোর একটি এবং সংকটাপন্ন প্রতিবেশ
অঞ্চলগুলোর সুরক্ষার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দেশে এ রকম সংকটাপন্ন
এলাকা আছে সাতটি। উপকূলীয় অঞ্চলে আছে বেশ কয়েকটি, যেমন: সুন্দরবন,
সোনাদিয়া ও সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। সুন্দরবনের কাছাকাছি রামপালে এবং
সোনাদিয়ার নাকের ডগায় মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে কয়লাভিত্তিক
তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হচ্ছে। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, বিতর্কের
ঝড় উঠেছে। অনেকেই বলছেন, সংকটাপন্ন প্রতিবেশ এলাকাগুলো আরও ঝুঁকির মধ্যে
পড়বে।
একটা পেশাগত অভিজ্ঞতা কিন্তু খুবই প্রাসঙ্গিক উদাহরণের উল্লেখ না করে পারছি না। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি প্রকল্পের আওতায় ‘নিঝুম দ্বীপ ক্রস ড্যাম’-এর সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছিল। আমি ছিলাম এর সমন্বয়কারী। দলের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন মুখলেসুজ্জামান (পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক মহাপরিচালক) ও আলী আকবর হায়দার (নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক)। সম্ভাব্যতা যাচাই করে আমরা দেখেছিলাম ক্রস ড্যামটি হবে লাভজনক। নেদারল্যান্ডস সরকারের অনুদানে স্টাডিটি হয়েছিল। মূল প্রকল্প, অর্থাৎ ড্যাম তৈরি ও ভূমি উন্নয়নের জন্য নেদারল্যান্ডস সরকার ৩০ মিলিয়ন গিল্ডার (প্রায় ১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) বরাদ্দ রেখেছিল। কিন্তু নেদারল্যান্ডস সরকার প্রকল্পটি অনুমোদন করলেও টাকা ছাড় করেনি। তাদের যুক্তি ছিল, হাতিয়া ও নিঝুম দ্বীপের মধ্যে প্রবাহিত চ্যানেলটি ইলিশের প্রজননক্ষেত্র কি না এবং ক্রস ড্যাম তৈরি হলে ইলিশের ডিম পাড়ার জায়গাটি নষ্ট হয়ে যাবে কি না, সে বিষয়ে আগে নিশ্চিত হওয়া দরকার।
তারা সুপারিশ করেছিল, বাংলাদেশ সরকারের মৎস্য বিভাগের উচিত হবে এ বিষয়ে একটি সমীক্ষা চালিয়ে দেখা। সেই সমীক্ষা আজও হয়নি। কথাটা এ জন্য বললাম, উপকূলের কোল ঘেঁষে পায়রা বন্দরের কাছে বামনাবাদে আরেকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হবে। বরগুনা, পটুয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ঘেঁষে সাগরের যে অগভীর অংশ, সেটা ইলিশ মাছের সম্ভাব্য প্রজননক্ষেত্র। ওখানে বন্দর কিংবা বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে তার অভিঘাতে ইলিশ মাছের ডিম পাড়ার জায়গাটি তছনছ হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের জনজীবনে ও অর্থনীতিতে ইলিশের গুরুত্ব খাটো করে দেখার উপায় নেই। আমাদের দেশে যে পরিমাণ মাছ উৎপাদন ও ধরা হয়, তার ১১ শতাংশ হলো রুপালি ইলিশ; আর সামুদ্রিক মাছের মোট সংগ্রহের ৪০ শতাংশের বেশি হচ্ছে এই ইলিশ (সূত্র: ফিসারিজ ইয়ার বুক অব বাংলাদেশ)। যাঁরা বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বন্দর তৈরি করছেন, তাঁদের এ বিষয়টি আমলে নেওয়া দরকার।
মধ্য আয়ের দেশ হওয়া নিয়ে বাংলাদেশে রীতিমতো মাতম শুরু হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য যে বিষয়গুলো সবচেয়ে বেশি জরুরি, তার একটি হলো বিদ্যুৎ। লেনিন বলেছিলেন, মার্ক্সবাদ + বিদ্যুৎ = বিপ্লব। বিজলি না হলে ঘরে আলো জ্বলে না, কলের চাকা ঘোরে না। সুতরাং আমাদের বিদ্যুতের উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়াতেই হবে। কিন্তু কীভাবে?
বাংলাদেশে মাথাপিছু বিদ্যুতের প্রাপ্তি মাত্র ২৮ ওয়াট। বলা হচ্ছে, দেশের ৭০ শতাংশ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। সংখ্যাতত্ত্বে ফাঁকি আছে। প্রশ্ন হলো, বিদ্যুতের সংযোগ হয়তো গেছে, খাম্বাও বসেছে অনেক, কিন্তু কতজনের ঘরে দিনে কত ঘণ্টা, কত ওয়াট বিদ্যুৎ যায়? আমরা এ ক্ষেত্রে ভালো আছি যখন বলি, তখন আমরা আমাদের চেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করি, যেমন: সোমালিয়া, হাইতি, সিয়েরা লিওন, বুরুন্ডি কিংবা নেপাল। শ্রীলংকার মানুষ মাথাপিছু বিদ্যুৎ পায় ৫২ ওয়াট, ভারতে ৯০ ওয়াট, ভিয়েতনামে ১২৭ ওয়াট, চীনে ৪৫৮ ওয়াট, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১০৩৮ ওয়াট, অস্ট্রেলিয়ায় ১১১৪ ওয়াট, যুক্তরাষ্ট্রে ১৬৮৩ ওয়াট, ইউরোপীয় ইউনিয়নে গড়ে ৬৮৮ ওয়াট। এসব দেশের অনেকেই বিদ্যুৎ তৈরির জন্য কয়লা ব্যবহার করে। কয়লা থেকে বিদ্যুতের জোগান আসে দক্ষিণ আফ্রিকায় ৯৪ শতাংশ, চীনে ৭৯ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়ায় ৬৯ শতাংশ, ভারতে ৬৮ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ৪৩ শতাংশ, জার্মানিতে ৪৫ শতাংশ এবং যুক্তরাজ্যে ৩০ শতাংশ। (সূত্র: সিআইএ ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টস বুক)
বাংলাদেশে ১৫ জুলাই সন্ধ্যায় সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ৭,৩০৪ মেগাওয়াট। এর মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন মাত্র ২ শতাংশ। অর্থাৎ পৃথিবীর তাবৎ শিল্পোন্নত দেশ কয়লা ব্যবহার করে দ্রুত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে যাচ্ছে কিংবা ওই সমৃদ্ধি বজায় রাখছে। অন্যদিকে, সারা দুনিয়ার পরিবেশ রক্ষার দায় যেন নিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশ।
বর্তমানে বাংলাদেশে অনেকগুলো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা হয়েছে কিংবা বাস্তবায়নের পথে আছে। এর মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলে বাগেরহাটের রামপাল, পটুয়াখালীর পায়রা ও মহেশখালীর মাতারবাড়ী উল্লেখযোগ্য। পায়রায় এলএনজির জন্য টার্মিনালও তৈরি হবে। সেই সঙ্গে চলছে বন্দর তৈরির আয়োজন। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরির পরিকল্পনা আছে।
রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করা নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে। কয়েকটি পরিবেশবাদী সংগঠন এর বিরোধিতা করছে। তাদের মতে, এর ফলে সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে। বিদেশিদের টাকা নিয়ে যারা এ দেশে পরিবেশ আন্দোলন করে, আমি তাদের নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না। কারণ, টাকা দেওয়া বন্ধ হলে তাদের আন্দোলনও বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু দু-একটি দেশি সংগঠন, যাদের সদস্যরা নিজেদের শ্রম ও অর্থ দিয়ে পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন করছেন, তাঁদের বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত। তাঁদের আন্তরিকতা ও সততা নিয়ে আমার প্রশ্ন নেই। আমার প্রশ্ন হলো, তাঁরা শুধু রামপালের বিরুদ্ধে সোচ্চার। কিন্তু পায়রা ও মহেশখালী নিয়ে তেমন কথা বলছেন না কেন? সমস্যা তো রামপাল নয়; সমস্যা যদি থেকেই থাকে, তা হলো কয়লায়। অর্থাৎ বলা দরকার, ‘আমরা কয়লাভিত্তিক কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র চাই না। কেননা, কয়লায় দূষণ হয় অনেক বেশি।’ কিন্তু তাঁরা শুধু রামপালেই আটকে আছেন। কেন?
তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই যে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে না, তাহলেই কি সমস্যা মিটে যাবে? ওই অঞ্চলে দূষণের জন্য প্রধানত দায়ী হলো মংলা বন্দর। পশুর নদ দিয়ে যেসব জাহাজ আসা-যাওয়া করে, তাতে বায়ু ও পানিদূষণ হয় প্রচুর। নদীটি একেবারে সুন্দরবনের ভেতর দিয়েই গেছে। নেপাল-ভুটানে ট্রানজিট কার্যকর হলে মংলা বন্দরের ব্যবহার অনেক গুণ বেড়ে যাবে। অনেক বেশি জাহাজ আসা-যাওয়া করবে। ফলে দূষণ আরও বাড়বে। তাহলে আমরা কি মংলা বন্দর বন্ধ করে দেওয়ার দাবি তুলব?
প্রস্তাবিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে রামপালেরটি অপেক্ষাকৃত ছোট, ৬৬০ মেগাওয়াটের দুটি প্ল্যান্ট থেকে মোট ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরি হবে। পায়রাতেও ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিকল্পনা হয়েছে। মাতারবাড়ীতে কয়লা থেকে আসবে ৬০০০ মেগাওয়াট, এলএনজিভিত্তিক কম্বাইন্ড সাইকেল, বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আসবে আরও ৩০০০ মেগাওয়াট, জমি অধিগ্রহণ করা হবে পাঁচ হাজার একর।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে দূষণের মাত্রা হবে একেবারেই কম, যা সুন্দরবনের ক্ষতি করবে না। এ জন্য ২৭৫ মিটার উঁচু চিমনি বসানো হবে, ব্যবহার করা হবে উন্নত মানের কয়লা এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। পরিবেশবাদীরা সরকারের এই ‘স্তোকবাক্যে’ আস্থা রাখতে পারছেন না।
সম্প্রতি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া রামপাল থেকে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎকেন্দ্রটি অন্য কোথাও সরিয়ে নিতে বলেছেন। জিয়াউর রহমানের আমলে চকরিয়া সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন সাফ করে বিশ্বব্যাংকের ঋণে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের চিংড়িঘের করার জন্য জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এখন খালেদা জিয়ার কথায় মনে হতে পারে, পরিবেশ ধ্বংসের কাজটি তাঁর স্বামী মারা যাওয়ার পরই শুরু হয়েছে।
এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে রামপালে অর্থের জোগান অংশত আসবে ভারত থেকে, পায়রায় আসবে চীন থেকে এবং মাতারবাড়ীতে আসবে জাপান থেকে। সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠতে পারে, অভিযোগটা কি কয়লার বিরুদ্ধে, না রামপালে ভারতের সংশ্লিষ্টতার বিরুদ্ধে। কই, চীন ও জাপানের অর্থায়নে অন্য দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে তো অভিযোগ দেখছি না। আমি এ নিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁদের ভাষ্য হলো, ভারত একটি ‘অবিশ্বস্ত প্রতিবেশী’। সুতরাং তারা যেখানে আছে, তা মেনে নেওয়া যায় না।
আমি আগেই বলেছি, স্বেচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সংগঠনের অনেক সদস্যের সততা নিয়ে আমার কোনো প্রশ্ন নেই। শেখ হাসিনা নিজে বলেছেন, সুন্দরবনের ক্ষতি হবে না। আমি এটা বিশ্বাস করি না যে শেখ হাসিনার দেশপ্রেম নেই এবং তিনি সুন্দরবন ধ্বংস করতে চান। তাঁর অনেক ব্যাপারে আমার প্রশ্ন আছে। কিন্তু জেনেশুনে সুন্দরবন উজাড় করে দেবেন, এটা আমার মনে হয় না। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?
জনগণের ক্ষতি হলে তাঁরা তা মেনে নেন না। এর আগে কানসাট ও ফুলবাড়ীতে আমরা তার প্রমাণ পেয়েছি। স্থানীয় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের স্বরূপ আমরা দেখেছি, রামপালে তেমনটি হয়নি। সাধারণ মানুষ কিছুই বোঝেন না আর পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো সবজান্তা—এটাও মনে করার কোনো কারণ নেই।
আমার পরামর্শ হলো, সরকারের উচিত হবে একটা জাতীয় সংলাপের মাধ্যমে তার অবস্থান পরিষ্কার করে তুলে ধরা এবং যে প্রযুক্তি রামপালে ব্যবহার করা হবে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা। কয়েক দিন পর পর ঢাকার কোনো হোটেলে কিংবা কনভেনশন সেন্টারে পেশাজীবীদের গোলটেবিলের নামে মুখচেনা কিছু দলীয় লোক যে রকম গৎবাঁধা কথা বলে যান, সে রকম নয়। সচেতন নাগরিকদের সঙ্গে সরকারের যে মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে, একটা উপযুক্ত সংলাপের মাধ্যমে তার মীমাংসা হতে পারে। এ নিয়ে অযথা হইচই করার দরকার নেই।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক-গবেষক।
mohi2005@gmail.com
একটা পেশাগত অভিজ্ঞতা কিন্তু খুবই প্রাসঙ্গিক উদাহরণের উল্লেখ না করে পারছি না। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি প্রকল্পের আওতায় ‘নিঝুম দ্বীপ ক্রস ড্যাম’-এর সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছিল। আমি ছিলাম এর সমন্বয়কারী। দলের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন মুখলেসুজ্জামান (পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক মহাপরিচালক) ও আলী আকবর হায়দার (নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক)। সম্ভাব্যতা যাচাই করে আমরা দেখেছিলাম ক্রস ড্যামটি হবে লাভজনক। নেদারল্যান্ডস সরকারের অনুদানে স্টাডিটি হয়েছিল। মূল প্রকল্প, অর্থাৎ ড্যাম তৈরি ও ভূমি উন্নয়নের জন্য নেদারল্যান্ডস সরকার ৩০ মিলিয়ন গিল্ডার (প্রায় ১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) বরাদ্দ রেখেছিল। কিন্তু নেদারল্যান্ডস সরকার প্রকল্পটি অনুমোদন করলেও টাকা ছাড় করেনি। তাদের যুক্তি ছিল, হাতিয়া ও নিঝুম দ্বীপের মধ্যে প্রবাহিত চ্যানেলটি ইলিশের প্রজননক্ষেত্র কি না এবং ক্রস ড্যাম তৈরি হলে ইলিশের ডিম পাড়ার জায়গাটি নষ্ট হয়ে যাবে কি না, সে বিষয়ে আগে নিশ্চিত হওয়া দরকার।
তারা সুপারিশ করেছিল, বাংলাদেশ সরকারের মৎস্য বিভাগের উচিত হবে এ বিষয়ে একটি সমীক্ষা চালিয়ে দেখা। সেই সমীক্ষা আজও হয়নি। কথাটা এ জন্য বললাম, উপকূলের কোল ঘেঁষে পায়রা বন্দরের কাছে বামনাবাদে আরেকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হবে। বরগুনা, পটুয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ঘেঁষে সাগরের যে অগভীর অংশ, সেটা ইলিশ মাছের সম্ভাব্য প্রজননক্ষেত্র। ওখানে বন্দর কিংবা বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে তার অভিঘাতে ইলিশ মাছের ডিম পাড়ার জায়গাটি তছনছ হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের জনজীবনে ও অর্থনীতিতে ইলিশের গুরুত্ব খাটো করে দেখার উপায় নেই। আমাদের দেশে যে পরিমাণ মাছ উৎপাদন ও ধরা হয়, তার ১১ শতাংশ হলো রুপালি ইলিশ; আর সামুদ্রিক মাছের মোট সংগ্রহের ৪০ শতাংশের বেশি হচ্ছে এই ইলিশ (সূত্র: ফিসারিজ ইয়ার বুক অব বাংলাদেশ)। যাঁরা বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বন্দর তৈরি করছেন, তাঁদের এ বিষয়টি আমলে নেওয়া দরকার।
মধ্য আয়ের দেশ হওয়া নিয়ে বাংলাদেশে রীতিমতো মাতম শুরু হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য যে বিষয়গুলো সবচেয়ে বেশি জরুরি, তার একটি হলো বিদ্যুৎ। লেনিন বলেছিলেন, মার্ক্সবাদ + বিদ্যুৎ = বিপ্লব। বিজলি না হলে ঘরে আলো জ্বলে না, কলের চাকা ঘোরে না। সুতরাং আমাদের বিদ্যুতের উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়াতেই হবে। কিন্তু কীভাবে?
বাংলাদেশে মাথাপিছু বিদ্যুতের প্রাপ্তি মাত্র ২৮ ওয়াট। বলা হচ্ছে, দেশের ৭০ শতাংশ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। সংখ্যাতত্ত্বে ফাঁকি আছে। প্রশ্ন হলো, বিদ্যুতের সংযোগ হয়তো গেছে, খাম্বাও বসেছে অনেক, কিন্তু কতজনের ঘরে দিনে কত ঘণ্টা, কত ওয়াট বিদ্যুৎ যায়? আমরা এ ক্ষেত্রে ভালো আছি যখন বলি, তখন আমরা আমাদের চেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করি, যেমন: সোমালিয়া, হাইতি, সিয়েরা লিওন, বুরুন্ডি কিংবা নেপাল। শ্রীলংকার মানুষ মাথাপিছু বিদ্যুৎ পায় ৫২ ওয়াট, ভারতে ৯০ ওয়াট, ভিয়েতনামে ১২৭ ওয়াট, চীনে ৪৫৮ ওয়াট, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১০৩৮ ওয়াট, অস্ট্রেলিয়ায় ১১১৪ ওয়াট, যুক্তরাষ্ট্রে ১৬৮৩ ওয়াট, ইউরোপীয় ইউনিয়নে গড়ে ৬৮৮ ওয়াট। এসব দেশের অনেকেই বিদ্যুৎ তৈরির জন্য কয়লা ব্যবহার করে। কয়লা থেকে বিদ্যুতের জোগান আসে দক্ষিণ আফ্রিকায় ৯৪ শতাংশ, চীনে ৭৯ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়ায় ৬৯ শতাংশ, ভারতে ৬৮ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ৪৩ শতাংশ, জার্মানিতে ৪৫ শতাংশ এবং যুক্তরাজ্যে ৩০ শতাংশ। (সূত্র: সিআইএ ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টস বুক)
বাংলাদেশে ১৫ জুলাই সন্ধ্যায় সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ৭,৩০৪ মেগাওয়াট। এর মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন মাত্র ২ শতাংশ। অর্থাৎ পৃথিবীর তাবৎ শিল্পোন্নত দেশ কয়লা ব্যবহার করে দ্রুত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে যাচ্ছে কিংবা ওই সমৃদ্ধি বজায় রাখছে। অন্যদিকে, সারা দুনিয়ার পরিবেশ রক্ষার দায় যেন নিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশ।
বর্তমানে বাংলাদেশে অনেকগুলো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা হয়েছে কিংবা বাস্তবায়নের পথে আছে। এর মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলে বাগেরহাটের রামপাল, পটুয়াখালীর পায়রা ও মহেশখালীর মাতারবাড়ী উল্লেখযোগ্য। পায়রায় এলএনজির জন্য টার্মিনালও তৈরি হবে। সেই সঙ্গে চলছে বন্দর তৈরির আয়োজন। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরির পরিকল্পনা আছে।
রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করা নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে। কয়েকটি পরিবেশবাদী সংগঠন এর বিরোধিতা করছে। তাদের মতে, এর ফলে সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে। বিদেশিদের টাকা নিয়ে যারা এ দেশে পরিবেশ আন্দোলন করে, আমি তাদের নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না। কারণ, টাকা দেওয়া বন্ধ হলে তাদের আন্দোলনও বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু দু-একটি দেশি সংগঠন, যাদের সদস্যরা নিজেদের শ্রম ও অর্থ দিয়ে পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন করছেন, তাঁদের বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত। তাঁদের আন্তরিকতা ও সততা নিয়ে আমার প্রশ্ন নেই। আমার প্রশ্ন হলো, তাঁরা শুধু রামপালের বিরুদ্ধে সোচ্চার। কিন্তু পায়রা ও মহেশখালী নিয়ে তেমন কথা বলছেন না কেন? সমস্যা তো রামপাল নয়; সমস্যা যদি থেকেই থাকে, তা হলো কয়লায়। অর্থাৎ বলা দরকার, ‘আমরা কয়লাভিত্তিক কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র চাই না। কেননা, কয়লায় দূষণ হয় অনেক বেশি।’ কিন্তু তাঁরা শুধু রামপালেই আটকে আছেন। কেন?
তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই যে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে না, তাহলেই কি সমস্যা মিটে যাবে? ওই অঞ্চলে দূষণের জন্য প্রধানত দায়ী হলো মংলা বন্দর। পশুর নদ দিয়ে যেসব জাহাজ আসা-যাওয়া করে, তাতে বায়ু ও পানিদূষণ হয় প্রচুর। নদীটি একেবারে সুন্দরবনের ভেতর দিয়েই গেছে। নেপাল-ভুটানে ট্রানজিট কার্যকর হলে মংলা বন্দরের ব্যবহার অনেক গুণ বেড়ে যাবে। অনেক বেশি জাহাজ আসা-যাওয়া করবে। ফলে দূষণ আরও বাড়বে। তাহলে আমরা কি মংলা বন্দর বন্ধ করে দেওয়ার দাবি তুলব?
প্রস্তাবিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে রামপালেরটি অপেক্ষাকৃত ছোট, ৬৬০ মেগাওয়াটের দুটি প্ল্যান্ট থেকে মোট ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরি হবে। পায়রাতেও ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিকল্পনা হয়েছে। মাতারবাড়ীতে কয়লা থেকে আসবে ৬০০০ মেগাওয়াট, এলএনজিভিত্তিক কম্বাইন্ড সাইকেল, বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আসবে আরও ৩০০০ মেগাওয়াট, জমি অধিগ্রহণ করা হবে পাঁচ হাজার একর।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে দূষণের মাত্রা হবে একেবারেই কম, যা সুন্দরবনের ক্ষতি করবে না। এ জন্য ২৭৫ মিটার উঁচু চিমনি বসানো হবে, ব্যবহার করা হবে উন্নত মানের কয়লা এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। পরিবেশবাদীরা সরকারের এই ‘স্তোকবাক্যে’ আস্থা রাখতে পারছেন না।
সম্প্রতি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া রামপাল থেকে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎকেন্দ্রটি অন্য কোথাও সরিয়ে নিতে বলেছেন। জিয়াউর রহমানের আমলে চকরিয়া সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন সাফ করে বিশ্বব্যাংকের ঋণে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের চিংড়িঘের করার জন্য জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এখন খালেদা জিয়ার কথায় মনে হতে পারে, পরিবেশ ধ্বংসের কাজটি তাঁর স্বামী মারা যাওয়ার পরই শুরু হয়েছে।
এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে রামপালে অর্থের জোগান অংশত আসবে ভারত থেকে, পায়রায় আসবে চীন থেকে এবং মাতারবাড়ীতে আসবে জাপান থেকে। সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠতে পারে, অভিযোগটা কি কয়লার বিরুদ্ধে, না রামপালে ভারতের সংশ্লিষ্টতার বিরুদ্ধে। কই, চীন ও জাপানের অর্থায়নে অন্য দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে তো অভিযোগ দেখছি না। আমি এ নিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁদের ভাষ্য হলো, ভারত একটি ‘অবিশ্বস্ত প্রতিবেশী’। সুতরাং তারা যেখানে আছে, তা মেনে নেওয়া যায় না।
আমি আগেই বলেছি, স্বেচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সংগঠনের অনেক সদস্যের সততা নিয়ে আমার কোনো প্রশ্ন নেই। শেখ হাসিনা নিজে বলেছেন, সুন্দরবনের ক্ষতি হবে না। আমি এটা বিশ্বাস করি না যে শেখ হাসিনার দেশপ্রেম নেই এবং তিনি সুন্দরবন ধ্বংস করতে চান। তাঁর অনেক ব্যাপারে আমার প্রশ্ন আছে। কিন্তু জেনেশুনে সুন্দরবন উজাড় করে দেবেন, এটা আমার মনে হয় না। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?
জনগণের ক্ষতি হলে তাঁরা তা মেনে নেন না। এর আগে কানসাট ও ফুলবাড়ীতে আমরা তার প্রমাণ পেয়েছি। স্থানীয় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের স্বরূপ আমরা দেখেছি, রামপালে তেমনটি হয়নি। সাধারণ মানুষ কিছুই বোঝেন না আর পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো সবজান্তা—এটাও মনে করার কোনো কারণ নেই।
আমার পরামর্শ হলো, সরকারের উচিত হবে একটা জাতীয় সংলাপের মাধ্যমে তার অবস্থান পরিষ্কার করে তুলে ধরা এবং যে প্রযুক্তি রামপালে ব্যবহার করা হবে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা। কয়েক দিন পর পর ঢাকার কোনো হোটেলে কিংবা কনভেনশন সেন্টারে পেশাজীবীদের গোলটেবিলের নামে মুখচেনা কিছু দলীয় লোক যে রকম গৎবাঁধা কথা বলে যান, সে রকম নয়। সচেতন নাগরিকদের সঙ্গে সরকারের যে মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে, একটা উপযুক্ত সংলাপের মাধ্যমে তার মীমাংসা হতে পারে। এ নিয়ে অযথা হইচই করার দরকার নেই।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক-গবেষক।
mohi2005@gmail.com
No comments