তাজউদ্দীন আহমদ: জন্মদিনের অভিবাদন by শারমিন আহমদ
শীতলক্ষ্যার
কূলঘেঁষা, শাল-গজারির বনে ঘেরা, লাল মাটিতে পথ আঁকা, নিটোল সবুজ গ্রাম
দরদরিয়ায় ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই বৃহস্পতিবার তাজউদ্দীন আহমদ জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি বেঁচে থাকলে আজ নব্বই বছরে পদার্পণ করতেন। কিন্তু মাত্র অর্ধশত বছরের
জীবনেই তিনি সম্পন্ন করেছেন শত বছরের যুগান্তকারী কর্ম। বাংলাদেশ নামের এক
স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ে ও নবজাত রাষ্ট্র গঠনে তিনি যে অনন্য অবদান
রেখেছেন, তা যুগ যুগ ধরেই বিশ্বের স্বাধীনতাকামী জাতির জন্য হতে পারে
দিগ্দর্শন ও অপার সম্ভাবনার বাতিঘর। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রেরণা ও প্রতীক। পাকিস্তানের কারাগারে
বন্দী বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তাজউদ্দীন আহমদ এক নির্মোহ সাধকের অধ্যবসায়
নিয়ে সেই প্রেরণাকে এক সাফল্যমণ্ডিত মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার মধ্য দিয়ে
বাস্তবায়িত করেন।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে যদি এক বাক্যে সংজ্ঞায়িত করতে হয়, তাহলে বলা যায় যে তিনি ছিলেন এক ন্যায়নিষ্ঠ, নির্ভীক, দূরদর্শী ও স্বাধীনচেতা মানুষ। নিজেকে আড়ালে রেখেও কোনো কৃতিত্ব দাবি না করে বিশাল মাপের কাজগুলো অসাধারণ দক্ষতা, বিচক্ষণতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে যেমন করে সম্পন্ন করতেন, তার জুড়ি মেলা ভার। তাঁর চরিত্রের ওই বিরল গুণাবলিরই সার্থক বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৭১ সালের চরম প্রতিকূল সময়ের আবর্তে—মুক্তিযুদ্ধের যজ্ঞপীঠে। তাজউদ্দীন আহমদকে না জানলে তাই বাংলাদেশের জন্মকথা—মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাও হবে অসম্পূর্ণ।
১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ, শ্রান্ত, অনাহারে ক্লিষ্ট তাজউদ্দীন আহমদ ও তাঁর দুর্গম যাত্রাপথের সঙ্গী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে কুষ্টিয়ার সীমান্ত থেকে ভারতে স্বাগত জানিয়েছিলেন ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান আইজি গোলক মজুমদার। তাজউদ্দীন আহমদ ওই শঙ্কাকুল অবস্থায়ও নিজ দেশের মর্যাদার প্রসঙ্গে ছিলেন সজাগ ও অবিচল। তিনি ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম গোলক মজুমদারকে বলেছিলেন, এক স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরূপে তাঁদের যোগ্য মর্যাদায় গ্রহণ করলে পরেই তাঁরা ভারতে আশ্রয় নেওয়ার কথা ভাবতে পারেন। গোলক মজুমদার সেই কথা রেখেছিলেন। তিনি তাঁর ঊর্ধ্বতন সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রধান রুস্তমজির মাধ্যমে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা (৪ এপ্রিল, ১৯৭১) করিয়ে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ সরকার গঠনে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করেছিলেন।
তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে গিয়ে তিনি ও তাঁর মতো অনেকেই আবিষ্কার করেছিলেন এক বিশ্বমাপের নেতাকে; প্রথম বাংলাদেশ সরকারের রূপকার ও সংগঠক, মুক্তিযুদ্ধের পরিচালক এবং প্রধানমন্ত্রীর পদবি ও পদের চেয়েও আকাশছোঁয়া মানবিক চেতনা ও আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন এক বিনম্র মানুষকে; সাধারণের ভিড়ে এক অসাধারণকে।
তাজউদ্দীন আহমদ গোলক মজুমদারকে বলেছিলেন, ভারত যদি সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়, তিনি রিফিউজি ক্যাম্পে চলে যাবেন এবং সেখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করবেন। ইন্দিরা গান্ধীকে বলেছিলেন, স্বীকৃতি ছাড়া সার্বভৌমত্বের বন্ধুত্ব হয় না। তাঁরা যৌথ চুক্তি করেছিলেন যে স্বীকৃতির পরেই ভারতীয় সহায়ক বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে বাংলাদেশে প্রবেশ করবে এবং যেদিন বাংলাদেশ সরকার মনে করবে সহায়ক বাহিনীর দেশে থাকার প্রয়োজন নেই, সেদিনই ভারতীয় বাহিনী প্রত্যাহার হবে। ১৯৭১ সালের ওই চুক্তি অনুসারেই ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করা হয়। ভিন্ন রাষ্ট্রে আশ্রয় ও তার সহযোগিতা গ্রহণের পরেও প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের মর্যাদা ও স্বাধীনতা রক্ষায় তাজউদ্দীন আহমদের দূরদর্শী পদক্ষেপ ও বিচক্ষণতা বাংলাদেশের ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। যুদ্ধবিধ্বস্ত নবজাত বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী হিসেবেও তিনি প্রতিনিয়ত লড়েছেন বাংলাদেশকে পরনির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত করে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও বৈষম্যমুক্তরূপে গড়ে তুলতে।
ভিন্ন রাষ্ট্রে আশ্রয় ও তার সহযোগিতা গ্রহণের পরেও প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের মর্যাদা ও স্বাধীনতা রক্ষায় তাজউদ্দীন আহমদের দূরদর্শী পদক্ষেপ ও বিচক্ষণতা বাংলাদেশের ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।
তাজউদ্দীন আহমদেরই সমবয়সী গোলক মজুমদার (জন্ম ৮ জুলাই, ১৯২৫), যিনি নিজেও ছিলেন এক অসাধারণ গুণী, বিনম্র, ইতিহাসচিহ্নিত ব্যক্তিত্ব এবং বাংলাদেশের দুঃসময়ের বন্ধু। এ বছরই তাঁর নব্বইতম জন্মবার্ষিকীর মাত্র দুই দিন আগে, ৬ জুলাই চলে গেলেন অমর্ত্যলোকে। তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতায়। সে সময় তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা বইটির জন্য ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তিনি আমাকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছিলেন। বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি এটি পড়ে তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে তাঁর স্মৃতিচারণা ও অভিব্যক্তি নিজ হাতে লিখে তাঁর মেয়ের মাধ্যমে আমাকে পাঠিয়েছিলেন, যা ছিল ব্যক্তিগত ও ঐতিহাসিক আঙ্গিকে এক পরম পাওয়া। তাঁর লেখা থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া হলো:
‘তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় একাত্তরের সেই রক্তঝরা মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে। স্থিরচিত্ত ও স্বল্পভাষী এই মানুষটির ব্যক্তিত্ব ছিল অসাধারণ! তাঁর সত্যনিষ্ঠা ও স্বার্থ ত্যাগ সব রকম ষড়যন্ত্র ও প্রতিকূলতা কাটিয়ে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা সম্ভব করেছিল—যার নাম বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর আস্থা ও আনুগত্য ছিল অকপট ও অবিচল...। বইটিতে কোনো অত্যুক্তি নেই, নেই কোনো উচ্ছ্বাস। প্রতিটি ছত্রে তাজউদ্দীন সাহেবের উজ্জ্বল উপস্থিতি অনুভব করি।’
১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের পরদিন ২২ বছরের তরুণ রাজনৈতিক কর্মী ও শিক্ষার্থী শোকাহত তাজউদ্দীন দিনলিপির পাতায় লিখেছিলেন, ‘সূর্য অস্তমিত হলো। এবং অস্তমিত হলো মানবতার পথের দিশারি আলোকবর্তিকা। তাহলে কি অন্ধকার নেমে এল? আলো এবং অন্ধকার। অন্ধকার এবং আলো। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। তারপরে তো সূর্যের কিরণ। ক্ষীণতনু নতুন চন্দ্র। কিন্তু তারপরে তো আনন্দময় পূর্ণচন্দ্রের আবির্ভাব। হতাশার শেষ তো আশাতে।...যে মানুষটির শোকে আজ আমরা মুহ্যমান, সেই মানুষটি তো অন্ধকারের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে আলোতে পৌঁছেছিলেন। তাঁকেও তো অন্ধকারে আলোর অন্বেষণে উদ্বিগ্ন হতে হয়েছে। অথচ কী বিস্ময়! তিনি নিজেই তো ছিলেন একটি আলোকবর্তিকা। আলোককে কি তুমি ধ্বংস করতে পারো? আলোর কণিকা আমাদের কাছ থেকে বহু দূরে অবস্থিত হতে পারে। কিন্তু তাতে কী? ধ্রুবতারার দূরত্ব অকল্পনীয়। কিন্তু বিজন মেরুতে অভিযানকারীর সে–ই তো একমাত্র দিকনির্ধারক। যুগ থেকে যুগে।’
দিনলিপিটি লেখার সময় তরুণ তাজউদ্দীন জানতেন না যে একদিন তাঁর কাঁধে ন্যস্ত হবে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব। ঘাতকের গুলিতে প্রাণ দান করে তিনিও অমরত্ব লাভ করবেন। রূপান্তরিত হবেন পথনির্ধারক আলোকবর্তিকায়।
আমার সুগভীর বিশ্বাসের কথাটি আবারও উল্লেখ করি। বাংলাদেশ একদিন তার নিজস্ব প্রয়োজনেই খুঁজে নেবে তাজউদ্দীনকে। তাঁর জ্যোতির্ময় জীবনধারার অনির্বাণ আলোয় শিশুরা খুঁজে পাবে মুক্তির পথ।
তাজউদ্দীন আহমদের ৯০তম জন্মবার্ষিকীতে অজস্র শুভেচ্ছা। লাখো তারার দীপ্তিময় অভিবাদন।
সহায়ক গ্রন্থ
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে যদি এক বাক্যে সংজ্ঞায়িত করতে হয়, তাহলে বলা যায় যে তিনি ছিলেন এক ন্যায়নিষ্ঠ, নির্ভীক, দূরদর্শী ও স্বাধীনচেতা মানুষ। নিজেকে আড়ালে রেখেও কোনো কৃতিত্ব দাবি না করে বিশাল মাপের কাজগুলো অসাধারণ দক্ষতা, বিচক্ষণতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে যেমন করে সম্পন্ন করতেন, তার জুড়ি মেলা ভার। তাঁর চরিত্রের ওই বিরল গুণাবলিরই সার্থক বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৭১ সালের চরম প্রতিকূল সময়ের আবর্তে—মুক্তিযুদ্ধের যজ্ঞপীঠে। তাজউদ্দীন আহমদকে না জানলে তাই বাংলাদেশের জন্মকথা—মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাও হবে অসম্পূর্ণ।
১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ, শ্রান্ত, অনাহারে ক্লিষ্ট তাজউদ্দীন আহমদ ও তাঁর দুর্গম যাত্রাপথের সঙ্গী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে কুষ্টিয়ার সীমান্ত থেকে ভারতে স্বাগত জানিয়েছিলেন ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান আইজি গোলক মজুমদার। তাজউদ্দীন আহমদ ওই শঙ্কাকুল অবস্থায়ও নিজ দেশের মর্যাদার প্রসঙ্গে ছিলেন সজাগ ও অবিচল। তিনি ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম গোলক মজুমদারকে বলেছিলেন, এক স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরূপে তাঁদের যোগ্য মর্যাদায় গ্রহণ করলে পরেই তাঁরা ভারতে আশ্রয় নেওয়ার কথা ভাবতে পারেন। গোলক মজুমদার সেই কথা রেখেছিলেন। তিনি তাঁর ঊর্ধ্বতন সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রধান রুস্তমজির মাধ্যমে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা (৪ এপ্রিল, ১৯৭১) করিয়ে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ সরকার গঠনে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করেছিলেন।
তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে গিয়ে তিনি ও তাঁর মতো অনেকেই আবিষ্কার করেছিলেন এক বিশ্বমাপের নেতাকে; প্রথম বাংলাদেশ সরকারের রূপকার ও সংগঠক, মুক্তিযুদ্ধের পরিচালক এবং প্রধানমন্ত্রীর পদবি ও পদের চেয়েও আকাশছোঁয়া মানবিক চেতনা ও আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন এক বিনম্র মানুষকে; সাধারণের ভিড়ে এক অসাধারণকে।
তাজউদ্দীন আহমদ গোলক মজুমদারকে বলেছিলেন, ভারত যদি সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়, তিনি রিফিউজি ক্যাম্পে চলে যাবেন এবং সেখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করবেন। ইন্দিরা গান্ধীকে বলেছিলেন, স্বীকৃতি ছাড়া সার্বভৌমত্বের বন্ধুত্ব হয় না। তাঁরা যৌথ চুক্তি করেছিলেন যে স্বীকৃতির পরেই ভারতীয় সহায়ক বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে বাংলাদেশে প্রবেশ করবে এবং যেদিন বাংলাদেশ সরকার মনে করবে সহায়ক বাহিনীর দেশে থাকার প্রয়োজন নেই, সেদিনই ভারতীয় বাহিনী প্রত্যাহার হবে। ১৯৭১ সালের ওই চুক্তি অনুসারেই ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করা হয়। ভিন্ন রাষ্ট্রে আশ্রয় ও তার সহযোগিতা গ্রহণের পরেও প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের মর্যাদা ও স্বাধীনতা রক্ষায় তাজউদ্দীন আহমদের দূরদর্শী পদক্ষেপ ও বিচক্ষণতা বাংলাদেশের ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। যুদ্ধবিধ্বস্ত নবজাত বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী হিসেবেও তিনি প্রতিনিয়ত লড়েছেন বাংলাদেশকে পরনির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত করে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও বৈষম্যমুক্তরূপে গড়ে তুলতে।
ভিন্ন রাষ্ট্রে আশ্রয় ও তার সহযোগিতা গ্রহণের পরেও প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের মর্যাদা ও স্বাধীনতা রক্ষায় তাজউদ্দীন আহমদের দূরদর্শী পদক্ষেপ ও বিচক্ষণতা বাংলাদেশের ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।
তাজউদ্দীন আহমদেরই সমবয়সী গোলক মজুমদার (জন্ম ৮ জুলাই, ১৯২৫), যিনি নিজেও ছিলেন এক অসাধারণ গুণী, বিনম্র, ইতিহাসচিহ্নিত ব্যক্তিত্ব এবং বাংলাদেশের দুঃসময়ের বন্ধু। এ বছরই তাঁর নব্বইতম জন্মবার্ষিকীর মাত্র দুই দিন আগে, ৬ জুলাই চলে গেলেন অমর্ত্যলোকে। তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতায়। সে সময় তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা বইটির জন্য ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তিনি আমাকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছিলেন। বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি এটি পড়ে তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে তাঁর স্মৃতিচারণা ও অভিব্যক্তি নিজ হাতে লিখে তাঁর মেয়ের মাধ্যমে আমাকে পাঠিয়েছিলেন, যা ছিল ব্যক্তিগত ও ঐতিহাসিক আঙ্গিকে এক পরম পাওয়া। তাঁর লেখা থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া হলো:
‘তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় একাত্তরের সেই রক্তঝরা মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে। স্থিরচিত্ত ও স্বল্পভাষী এই মানুষটির ব্যক্তিত্ব ছিল অসাধারণ! তাঁর সত্যনিষ্ঠা ও স্বার্থ ত্যাগ সব রকম ষড়যন্ত্র ও প্রতিকূলতা কাটিয়ে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা সম্ভব করেছিল—যার নাম বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর আস্থা ও আনুগত্য ছিল অকপট ও অবিচল...। বইটিতে কোনো অত্যুক্তি নেই, নেই কোনো উচ্ছ্বাস। প্রতিটি ছত্রে তাজউদ্দীন সাহেবের উজ্জ্বল উপস্থিতি অনুভব করি।’
১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের পরদিন ২২ বছরের তরুণ রাজনৈতিক কর্মী ও শিক্ষার্থী শোকাহত তাজউদ্দীন দিনলিপির পাতায় লিখেছিলেন, ‘সূর্য অস্তমিত হলো। এবং অস্তমিত হলো মানবতার পথের দিশারি আলোকবর্তিকা। তাহলে কি অন্ধকার নেমে এল? আলো এবং অন্ধকার। অন্ধকার এবং আলো। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। তারপরে তো সূর্যের কিরণ। ক্ষীণতনু নতুন চন্দ্র। কিন্তু তারপরে তো আনন্দময় পূর্ণচন্দ্রের আবির্ভাব। হতাশার শেষ তো আশাতে।...যে মানুষটির শোকে আজ আমরা মুহ্যমান, সেই মানুষটি তো অন্ধকারের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে আলোতে পৌঁছেছিলেন। তাঁকেও তো অন্ধকারে আলোর অন্বেষণে উদ্বিগ্ন হতে হয়েছে। অথচ কী বিস্ময়! তিনি নিজেই তো ছিলেন একটি আলোকবর্তিকা। আলোককে কি তুমি ধ্বংস করতে পারো? আলোর কণিকা আমাদের কাছ থেকে বহু দূরে অবস্থিত হতে পারে। কিন্তু তাতে কী? ধ্রুবতারার দূরত্ব অকল্পনীয়। কিন্তু বিজন মেরুতে অভিযানকারীর সে–ই তো একমাত্র দিকনির্ধারক। যুগ থেকে যুগে।’
দিনলিপিটি লেখার সময় তরুণ তাজউদ্দীন জানতেন না যে একদিন তাঁর কাঁধে ন্যস্ত হবে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব। ঘাতকের গুলিতে প্রাণ দান করে তিনিও অমরত্ব লাভ করবেন। রূপান্তরিত হবেন পথনির্ধারক আলোকবর্তিকায়।
আমার সুগভীর বিশ্বাসের কথাটি আবারও উল্লেখ করি। বাংলাদেশ একদিন তার নিজস্ব প্রয়োজনেই খুঁজে নেবে তাজউদ্দীনকে। তাঁর জ্যোতির্ময় জীবনধারার অনির্বাণ আলোয় শিশুরা খুঁজে পাবে মুক্তির পথ।
তাজউদ্দীন আহমদের ৯০তম জন্মবার্ষিকীতে অজস্র শুভেচ্ছা। লাখো তারার দীপ্তিময় অভিবাদন।
সহায়ক গ্রন্থ
শারমিন আহমদ: তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা |
সিমিন হোসেন রিমি সম্পাদিত তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি ১৯৪৭-৪৮। প্রতিভাস প্রকাশনা।
সিমিন হোসেন রিমি সম্পাদিত তাজউদ্দীন আহমদ: ইতিহাসের পাতা থেকে। প্রতিভাস প্রকাশনা।
তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা, লেখক: শারমিন আহমদ। ঐতিহ্য প্রকাশনা।
আদ্দিস আবাবা, ইথিওপিয়া
শারমিন আহমদ: তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা।
সিমিন হোসেন রিমি সম্পাদিত তাজউদ্দীন আহমদ: ইতিহাসের পাতা থেকে। প্রতিভাস প্রকাশনা।
তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা, লেখক: শারমিন আহমদ। ঐতিহ্য প্রকাশনা।
আদ্দিস আবাবা, ইথিওপিয়া
শারমিন আহমদ: তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা।
No comments