ঈদের আর্তনাদ by আবুল হায়াত
কাল প্রায় সারা রাত ধরে হয়েছে প্রবল বর্ষণ। সকালেও আঁধার চারদিক। যেকোনো সময় বৃষ্টি নামবে। বারান্দায় এসে দাঁড়ানোর আগে অভ্যাসবশত সদর দরজার গোড়ার দিকে চোখটা গেল। পত্রিকার আশায়। তারপরই মনে পড়ল বন্ধ আজ পত্রিকা।
বারান্দায় দাঁড়িয়েই নিয়মমাফিক চোখ পড়ল সামনের ফাঁকা জায়গাটায়, যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল আমার বন্ধু নীপবৃক্ষটি। বর্ষাকালটা দারুণ উপভোগ করতাম তার দিকে চেয়ে চেয়ে। সে যেন কথা বলত আমার সঙ্গে। তাকে কীভাবে নির্মূল করা হয়েছে, সে কাহিনি শুনিয়েছি আপনাদের এই কলামেই। জানি, সে আর ফেরার নয়। তবু মন খারাপ হয়। কষ্ট অনুভব করি।
আজ ঈদ। মন খারাপ করতে নেই। ঈদ শব্দের মানেই তো উৎসব। আজ উপবাস সমাপ্তির উৎসব। বড়ই আনন্দের উৎসব। সারা বিশ্বের মুসলিম আজ মেতে উঠবে আনন্দে। ধনী-দরিদ্র, ছোট-বড়, সুস্থ-অসুস্থ—সবাই আনন্দ করবে, এই তো ঈদ। কিন্তু—। হ্যাঁ, কদিন ধরে একটা ‘কিন্তু’ মনের মধ্যে খচখচ করছে। আজকের দিনটাতে সেটা তো থাকার কথা নয়। তবু ঢাকার আকাশের ভারী বর্ষণ মনটাকে ভারাক্রান্ত করল। কালও তো বিবিসির আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখলাম—বলছে, সপ্তাহ ধরে রোদ-বৃষ্টির খেলা চলবে। তাহলে এই আনন্দের সকালটায় আকাশ কেন গোমড়ামুখ করল। রোদ-ঝলমলে হলে কী হতো? জানি না কী হতো। তবে মন বলছে, আকাশ কাঁদছে, বেশ করছে। মনের যন্ত্রণা যখন মুখে প্রকাশ করার ক্ষমতা হারায়, চোখের পানি নিজে থেকেই উদ্গত হয়।
সেদিন আমি রাজনের খবরটা পড়তে পড়তে কেঁদেছি। অনেকক্ষণ বসে ছিলাম স্তব্ধ হয়ে। এও কী সম্ভব! মানুষ হতে পারে এত নিষ্ঠুর, এত নির্দয়? না, ভিডিও দেখতে পারিনি আমি। দু-চার সেকেন্ড দেখেই চোখ ফিরিয়ে নিয়েছি। না, দেখবও না কখনো।
আজ এখন নীপবনের অভাবটা যেমন মনটাকে মোচড় দিয়ে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে মনটা ছুটে গেল রাজনের বাড়িতে। ভেসে উঠল সিনেমার ট্রেলারের মতো কতগুলো ছবি।
আজ সবার আগে রাজন উঠেছে ঘুম থেকে। ঈদের আনন্দে বিভোর তার মন। কাজ নেই আজ। সবজি বিক্রি করতে যেতে হবে না। বাবাও যাবে না কাজে। গোটা পরিবার একসঙ্গে আনন্দে মেতে থাকবে। উদ্যাপন করবে ঈদ।
ভোরে উঠেই কাছাকাছি কোথাও থেকে ফুল সংগ্রহ করেছে, সাজিয়ে রাখছে পা-ভাঙা টেবিলে, একটা খুব পুরোনো জং ধরা ফুলদানিতে। মা ঘুম থেকে উঠে অবাক আনন্দে আপ্লুত হবে এই আশায় ফুল সাজিয়েই হইহই করে বাড়ির লোকদের ঘুম ভাঙাল সে। এই আনন্দে খেয়ালই করেনি—মা সেই রাত থাকতে উঠেই সেমাই রান্নায় ব্যস্ত। রাজন জর্দা-সেমাই পছন্দ করে তো। বাড়ির তরতাজা মোরগটা বেঁধে ফেলেছেন ভোরেই। রাজন অনেক দিন থেকেই মোরগের রান খেতে চাইছিল। আজ তার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করবেন মা।
বাবা কাল রাতেই ভালো খেপ পেয়েছিলেন, সেই টাকা দিয়ে একটি লাল টুকটুকে পাঞ্জাবি এনে লুকিয়ে রেখেছেন রাজনের জন্য। অবাক হয়ে ভাবেন এতটুকু ছেলে পড়াশোনার ফাঁকে কীভাবে আয়-রোজগার করে সংসারের হালে জোগান দিচ্ছে।
‘ওরে আমার মানিক রে।’ মা বলছেন ছেলের ফুল সাজানো দেখে। দোয়া করলেন মাথায় চুমু দিয়ে, ‘অনেক বড় হবি বাবা, মা-বাবার কষ্ট যে লাঘব করে, তার ভালো নিশ্চয় আল্লাহ করবেন।’
রাজন তো চুপচাপ থাকার ছেলে নয়। বাবার ঘুম ভাঙার আগেই তাঁর জামা-কাপড় এনে গুছিয়ে বাবার বিছানার ওপর রাখল। ছেঁড়া স্যান্ডেল জোড়া সুন্দর করে মুছে সাজাল চৌকির পাশে। কাল সবজি বেচে সামান্য লাভ থেকে আতর এনেছিল, সেটাও রাখল কাপড়ের পাশে। সঙ্গে টুপিটা। ওটাও কদিন আগে দরজিকে দিয়ে বানিয়ে রেখেছিল বাবার জন্য।
মা ছেলের এসব কাণ্ড দেখে মুখ টিপে হেসে চলে যান রান্নার চালায়। মনে মনে বলেন, ‘ছেলে মাশাল্লাহ বড় হয়ে গেছে।’
বাবা গোসল সেরে এসে এতসব আয়োজন দেখে আনন্দে জড়িয়ে ধরেন ছেলেকে বুকের মাঝে। ঝাপসা হয়ে আসে তাঁর চোখ।
‘বাবা রে, তোর ছোট্ট মনটাতে এত কিছু ভাবিস আমাদের জন্য!’ টুপ করে বাবার পা ধরে সালাম করে রাজন।
এবার খুশিতে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন বাবা। ছুটে আসেন মা। এ দৃশ্য তাঁকেও আপ্লুত করে। ছুটে আসে সবাই। খুশিতে মেতে ওঠে প্রত্যেকে। ঈদের খুশিতে। জমে ওঠে ঈদ-আনন্দ।
প্রচণ্ড হর্নের শব্দে ঘোর কাটে আমার। একটা রিকশার চাকা আটকে গেছে সামনের ডোবা রাস্তার লুকানো গর্তে। তাতেই একটি প্রাইভেট কারের চিৎকার। আমার কানে মনে হলো এ তো হর্ন নয়, রাজনের পরিবারের আর্তনাদ। সেই আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ছে যেন আকাশে-বাতাসে। সারা দেশের মানুষের অন্তরাত্মায়।
আমি কাঁদছি এখন। জানি, অনেকেই কাঁদছেন আজ রাজনের জন্য। তার পরিবারের জন্য। প্রকৃতিও কাঁদছে সবার সঙ্গে। চারদিক ঝাপসা হয়ে এল বৃষ্টির দাপটে। ‘রাজন, তুমি আমাদের কখনো ক্ষমা কোরো না। আমরা ক্ষমার অযোগ্য।’ আমার আত্মাটা আর্তনাদ করে বলে উঠল।
১৮ জুলাই, ২০১৫
আবুল হায়াত: নাট্যব্যক্তিত্ব।
বারান্দায় দাঁড়িয়েই নিয়মমাফিক চোখ পড়ল সামনের ফাঁকা জায়গাটায়, যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল আমার বন্ধু নীপবৃক্ষটি। বর্ষাকালটা দারুণ উপভোগ করতাম তার দিকে চেয়ে চেয়ে। সে যেন কথা বলত আমার সঙ্গে। তাকে কীভাবে নির্মূল করা হয়েছে, সে কাহিনি শুনিয়েছি আপনাদের এই কলামেই। জানি, সে আর ফেরার নয়। তবু মন খারাপ হয়। কষ্ট অনুভব করি।
আজ ঈদ। মন খারাপ করতে নেই। ঈদ শব্দের মানেই তো উৎসব। আজ উপবাস সমাপ্তির উৎসব। বড়ই আনন্দের উৎসব। সারা বিশ্বের মুসলিম আজ মেতে উঠবে আনন্দে। ধনী-দরিদ্র, ছোট-বড়, সুস্থ-অসুস্থ—সবাই আনন্দ করবে, এই তো ঈদ। কিন্তু—। হ্যাঁ, কদিন ধরে একটা ‘কিন্তু’ মনের মধ্যে খচখচ করছে। আজকের দিনটাতে সেটা তো থাকার কথা নয়। তবু ঢাকার আকাশের ভারী বর্ষণ মনটাকে ভারাক্রান্ত করল। কালও তো বিবিসির আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখলাম—বলছে, সপ্তাহ ধরে রোদ-বৃষ্টির খেলা চলবে। তাহলে এই আনন্দের সকালটায় আকাশ কেন গোমড়ামুখ করল। রোদ-ঝলমলে হলে কী হতো? জানি না কী হতো। তবে মন বলছে, আকাশ কাঁদছে, বেশ করছে। মনের যন্ত্রণা যখন মুখে প্রকাশ করার ক্ষমতা হারায়, চোখের পানি নিজে থেকেই উদ্গত হয়।
সেদিন আমি রাজনের খবরটা পড়তে পড়তে কেঁদেছি। অনেকক্ষণ বসে ছিলাম স্তব্ধ হয়ে। এও কী সম্ভব! মানুষ হতে পারে এত নিষ্ঠুর, এত নির্দয়? না, ভিডিও দেখতে পারিনি আমি। দু-চার সেকেন্ড দেখেই চোখ ফিরিয়ে নিয়েছি। না, দেখবও না কখনো।
আজ এখন নীপবনের অভাবটা যেমন মনটাকে মোচড় দিয়ে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে মনটা ছুটে গেল রাজনের বাড়িতে। ভেসে উঠল সিনেমার ট্রেলারের মতো কতগুলো ছবি।
আজ সবার আগে রাজন উঠেছে ঘুম থেকে। ঈদের আনন্দে বিভোর তার মন। কাজ নেই আজ। সবজি বিক্রি করতে যেতে হবে না। বাবাও যাবে না কাজে। গোটা পরিবার একসঙ্গে আনন্দে মেতে থাকবে। উদ্যাপন করবে ঈদ।
ভোরে উঠেই কাছাকাছি কোথাও থেকে ফুল সংগ্রহ করেছে, সাজিয়ে রাখছে পা-ভাঙা টেবিলে, একটা খুব পুরোনো জং ধরা ফুলদানিতে। মা ঘুম থেকে উঠে অবাক আনন্দে আপ্লুত হবে এই আশায় ফুল সাজিয়েই হইহই করে বাড়ির লোকদের ঘুম ভাঙাল সে। এই আনন্দে খেয়ালই করেনি—মা সেই রাত থাকতে উঠেই সেমাই রান্নায় ব্যস্ত। রাজন জর্দা-সেমাই পছন্দ করে তো। বাড়ির তরতাজা মোরগটা বেঁধে ফেলেছেন ভোরেই। রাজন অনেক দিন থেকেই মোরগের রান খেতে চাইছিল। আজ তার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করবেন মা।
বাবা কাল রাতেই ভালো খেপ পেয়েছিলেন, সেই টাকা দিয়ে একটি লাল টুকটুকে পাঞ্জাবি এনে লুকিয়ে রেখেছেন রাজনের জন্য। অবাক হয়ে ভাবেন এতটুকু ছেলে পড়াশোনার ফাঁকে কীভাবে আয়-রোজগার করে সংসারের হালে জোগান দিচ্ছে।
‘ওরে আমার মানিক রে।’ মা বলছেন ছেলের ফুল সাজানো দেখে। দোয়া করলেন মাথায় চুমু দিয়ে, ‘অনেক বড় হবি বাবা, মা-বাবার কষ্ট যে লাঘব করে, তার ভালো নিশ্চয় আল্লাহ করবেন।’
রাজন তো চুপচাপ থাকার ছেলে নয়। বাবার ঘুম ভাঙার আগেই তাঁর জামা-কাপড় এনে গুছিয়ে বাবার বিছানার ওপর রাখল। ছেঁড়া স্যান্ডেল জোড়া সুন্দর করে মুছে সাজাল চৌকির পাশে। কাল সবজি বেচে সামান্য লাভ থেকে আতর এনেছিল, সেটাও রাখল কাপড়ের পাশে। সঙ্গে টুপিটা। ওটাও কদিন আগে দরজিকে দিয়ে বানিয়ে রেখেছিল বাবার জন্য।
মা ছেলের এসব কাণ্ড দেখে মুখ টিপে হেসে চলে যান রান্নার চালায়। মনে মনে বলেন, ‘ছেলে মাশাল্লাহ বড় হয়ে গেছে।’
বাবা গোসল সেরে এসে এতসব আয়োজন দেখে আনন্দে জড়িয়ে ধরেন ছেলেকে বুকের মাঝে। ঝাপসা হয়ে আসে তাঁর চোখ।
‘বাবা রে, তোর ছোট্ট মনটাতে এত কিছু ভাবিস আমাদের জন্য!’ টুপ করে বাবার পা ধরে সালাম করে রাজন।
এবার খুশিতে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন বাবা। ছুটে আসেন মা। এ দৃশ্য তাঁকেও আপ্লুত করে। ছুটে আসে সবাই। খুশিতে মেতে ওঠে প্রত্যেকে। ঈদের খুশিতে। জমে ওঠে ঈদ-আনন্দ।
প্রচণ্ড হর্নের শব্দে ঘোর কাটে আমার। একটা রিকশার চাকা আটকে গেছে সামনের ডোবা রাস্তার লুকানো গর্তে। তাতেই একটি প্রাইভেট কারের চিৎকার। আমার কানে মনে হলো এ তো হর্ন নয়, রাজনের পরিবারের আর্তনাদ। সেই আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ছে যেন আকাশে-বাতাসে। সারা দেশের মানুষের অন্তরাত্মায়।
আমি কাঁদছি এখন। জানি, অনেকেই কাঁদছেন আজ রাজনের জন্য। তার পরিবারের জন্য। প্রকৃতিও কাঁদছে সবার সঙ্গে। চারদিক ঝাপসা হয়ে এল বৃষ্টির দাপটে। ‘রাজন, তুমি আমাদের কখনো ক্ষমা কোরো না। আমরা ক্ষমার অযোগ্য।’ আমার আত্মাটা আর্তনাদ করে বলে উঠল।
১৮ জুলাই, ২০১৫
আবুল হায়াত: নাট্যব্যক্তিত্ব।
No comments