‘রাজন রাজন আর্তনাদ’ বাইয়ারপাড়ে মানুষের ঢল by ওয়েছ খছরু
ঈদের
আগের দিন অর্থমন্ত্রী গেলেন রাজনদের বাড়িতে। বললেন, ‘খুনিরা মানুষ নয়,
জানোয়ার।’ আর ঈদের দিন দলে দলে লোকজনও গেলেন পরিবারকে সান্ত্বনা জানাতে।
কিন্তু কোন সান্ত্বনাই মা লুবনার শোকাহত মনকে স্বস্তি দিতে পারেনি। আর বাবা
আজিজুর রহমানও যেন পাগলপ্রায়। শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন। কোন ভাষা নেই মুখে।
বুক ফেটে যে আর্তনাদটি বের হচ্ছে সেটি কেবল- ‘রাজন, রাজন।’ চোখের সামনেই
রাজনের কবর। দুয়ার খুললেই চোখে পড়ে কবর। ঈদের দিন সকাল হতেই দুই হাত উপরে
তুলে কবরের দিকে তাকিয়ে উঠোনে দাঁড়িয়ে আর্তনাদ শুরু করেন মা লুবনা। তার
আর্তনাদে ঘুম ভাঙে বাইয়ারপাড়ের মানুষের। ছেলের কবরের দিকে তাকিয়ে আর্তনাদ
করতে থাকেন। বুক চাপড়ে বলেন, ‘রাজন উঠে আয়।’ হাতে থাকা জামা কাপড় দেখিয়ে
বলেন, ‘ওই কাপড় পরে নামাজে যা। আমি ফিরনি সেমাই রান্না করবো। জামাত থেকে
এসে খাবে।’ তার এই আর্তনাদের দৃশ্য দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না
গ্রামবাসী। মাকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা যেন হারিয়ে ফেলেছেন সবাই। আর্তনাদ
করে করে কাদামাখা উঠোনে শুয়ে পড়লেন মা। আর বাবা আজিজুর রহমান ছেলের কবরের
দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারলেন না। শুয়ে পড়লেন মাটিতে। ঈদের সকালে দুখিনী মা
ও বাবার মুখে ছিলো রাজনের জন্য আর্তনাদ, হাহাকার। বলতে লাগলেন, ‘রাজন কবরে
শুয়ে আছে। এতো কষ্টে ওর মৃত্যু হয়েছে। এই মৃত্যু দেখার আগে কেন আল্লাহ
আমাদের দুনিয়া থেকে তুলে নিয়ে গেলেন না।’ মা লুবনা প্রতিবেশীকে বললেন,
‘রাজন ওখানে কেমন আছে। কি করছে। খেতে আসবে না। মা বলে জড়িয়ে ধরবে না।’
রাজনের চাচারা ঈদের দিন দুপুরে মানবজমিনকে জানালেন, ‘ঈদের সকালে সকল শোক
নেমে এসেছিলো আমাদের বাড়িতে। আমরাই বুক ধরাতে পারিনি। ওর মা বাবা কিভাবে
বুক ধরাবে।’ ঈদের সকালে মাতমে পুরোপুরি অসুস্থ হয়ে পড়েন মা লুবনা ও পিতা
আজিজুর রহমান। এ জন্য গ্রামের লোকজন তাদের দুই জনকে দুই ঘরে রেখে সান্ত্বনা
দেয়ার চেষ্টা করেন। এদিকে, সকাল হতেই রাজনদের বাড়িতে ঢল নামে সাধারণ
মানুষের। প্রথমে গ্রামে নারী-পুরুষরা দলে দলে গিয়ে হাজির হন রাজনদের
বাড়িতে। পুরুষরা দল বেঁধে রাজনের কবর জিয়ারত করেন আর অঝোরে কাঁদেন। দুপুর
হতেই সিলেট শহর থেকে দলে দলে মানুষ যান রাজনের বাড়িতে। দুপুরের দিকে শ’ শ’
মানুষের উপস্থিতিতে শোকাবহ পরিবেশ বিরাজ করে রাজনের বাড়িতে। আওয়ামী লীগ,
বিএনপি, জাতীয় পার্টি সহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতারা রাজনদের বাড়িতে
গিয়ে তার শোকাহত মা ও বাবাকে সান্ত্বনা জানান। এ কারণে গোটা দিনই রাজনের
জন্য হাহাকার চলে রাজনের বাড়িতে। বিএনপি নেতা আব্দুল মোক্তাদির, কয়েস লোদি
সহ অন্যরা রাজনের বাড়িতে শোক জানাতে গিয়ে চোখের জল সংবরণ করতে পারেননি।
তারা খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন। ঈদের আগের দিন রাজনের
বাড়িতে যান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এ সময় অর্থমন্ত্রী বলেন,
‘শিশু রাজনকে পৈশাচিকভাবে নির্যাতনে যারা হত্যা করেছে তারা মানুষ না,
জানোয়ার। তাদের বিচার নিশ্চিত করা হবে।’ তিনি বলেন, ‘রাজন হত্যার আসামি
(কামরুল ইসলাম) সৌদি আরবে পালাতে সহায়তাকারী বদমায়েশদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা
নেয়া হবে।’ তিনি বলেন, ‘ঘটনার দিন এলাকাবাসী সোচ্চার হলে রাজনকে বাঁচানো
সম্ভব হতো।’ তিনি এলাকাবাসী ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের উদ্দেশে খুনিদের
বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়ার আহ্বান জানান। অর্থমন্ত্রী রাজনের ভাই সাজনের
ভবিষ্যতের জন্য ৫ লাখ টাকার ফান্ড গঠনের ঘোষণা দেন। এ সময় আওয়ামী লীগের
কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, সিলেট সদর উপজেলা
পরিষদ চেয়ারম্যান আশফাক আহমেদ সহ সিনিয়র নেতারা উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে,
নিহত রাজনের নাম ভাঙ্গিয়ে চাঁদাবাজির সময় সিলেট শহর থেকে দুইজনকে
গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নগরীর তালতলাস্থ কে এস এন্টারপ্রাইজ নামের একটি
প্রতিষ্ঠান লটারি বিক্রি করছিল। কিন্তু কোন ধরনের অনুমতি না ছাড়াই লটারি
বিক্রি করায় শুক্রবার রাতে দুইজনকে আটক করে পুলিশ। আটককৃতরা হলেন- নগরীর
কুয়ারপাড় ৭৭ নং বাসার বাসিন্দা মৃত নেছার আহমদের ছেলে মামুন (২৪) ও মতিয়ার
(২৫)। বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির এসআই নজরুল ইসলাম জানান, রাতে নগরীর
তালতলাস্থ কে এস এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান নির্মমভাবে খুন হওয়া
রাজনের নাম ভাঙিয়ে ২টি রিকশা দিয়ে লটারি বিক্রি করছিল। প্রতি টিকিটের মূল্য
নিচ্ছিল ২০ টাকা করে। লটারি বিজয়ীদের মধ্যে ৫ জনকে পুরস্কৃত করা হবে বলে
তারা ঘোষণা দিচ্ছিল। এর মধ্যে প্রথম পুরস্কার রয়েছে ১টি মোটরসাইকেল, ২য়
পুরস্কার ১৪ ইঞ্চি একটি টিভি, তৃতীয় পুরস্কার ১টি বাইসাইকেল, ৪র্থ পুরস্কার
১০টি মোবাইল ও পঞ্চম পুরস্কার একটি ফিল্টার। তিনি আরও জানান, রাজনের নামে
লটারি বিক্রির কোন অনুমতি না থাকায় কে এস এন্টারপ্রাইজের পরিচালক মামুন ও
মতিয়ার নামের আরো একজনকে আটক করা হয়েছে। এছাড়াও রিকশা দুটি জব্ধ করা হয়েছে
বলেও জানিয়েছেন নজরুল। নিহত রাজনের নাম ভাঙ্গিয়ে লটারি বিক্রির কথা জানতে
পেয়ে তার বাবা আজিজুর রহমান বলেন, ‘আমার ছেলের নাম ভাঙ্গিয়ে যে বা যারা
টাকা তুলছে তাদের আমি চিনি না।’ এটা একটি প্রতারণা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এ
ধরনের প্রতারকদের আটক করতে হবে। কারণ আমি কোন টাকা চাই না। আমি আমার ছেলে
হত্যার বিচার চাই।’ রাজন খুনের নির্মম ঘটনা ভুলতে পারছে না সিলেটবাসী।
এলাকার মানুষ একের পর এক খুনিদের ধরে পুলিশে দিয়েছে। আর প্রতিবারই তারা
উল্লাস করেছে। ক্ষোভ ঝেড়েছে পুলিশের দিকেও। ওদিকে, খুনিদের গ্রেপ্তার ও
ফাঁসির দাবিতে হচ্ছে মানববন্ধনও। ঈদের আগের দিন নগরীর তালতলায় ব্যবসায়ীরা
বিশাল মানববন্ধন করেছেন। আর গতকাল বিক্ষোভ করেছে স্বপ্ন পূরণ সমাজ কল্যাণ
সংঘ ও বৃহত্তর বাগবাড়ী পশ্চিম কাজলশাহবাসী। এ সময় নগরীর নরসিংটিলা এলাকায়
বিশাল মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। হাজী মখন মিয়ার সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক
রকিব খান এবং মিসবাহ উজ্জামানের যৌথ পরিচালনায় প্রধান অতিথির বক্তব্য
রাখেন, ৩ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আমজাদ হোসেন এবং বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন
এলাকার বিশিষ্ট মুরব্বি তৈয়বুর রহমান।
No comments