প্রযুক্তিনির্ভর তদন্তই পুলিশের শেষ ভরসা by ওয়েছ খছরু
সিলেটের
ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ খুনের রহস্য উদঘাটনে প্রযুক্তিনির্ভর তদন্তের দিকেই
এগোচ্ছে পুলিশ। সূত্র খোঁজা হচ্ছে ঢাকার অভিজিৎ হত্যাসহ কয়েকটি
হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে। স্থানীয় কিংবা পারিবারিক কারণে অনন্ত বিজয় দাশ খুন
হয়েছেন সেটির কোন সত্যতা গতকাল পর্যন্ত মিলেনি। ব্যক্তিগতভাবে কিংবা
পারিবারিকভাবে অনন্ত বিজয়ের সঙ্গে কারও কোন বিরোধ ছিল না। তবে, সাইবার
দুনিয়ায় ব্লগার অন্তত বিজয়ের পরিধি ছিল বিস্তৃত। ব্লগ, ফেসবুক, পেজ সবখানেই
বন্ধুদের সঙ্গে সরব ছিলেন তারা। এ কারলে স্বাধীনচেতা মানুষ ও ব্লগার
হিসেবে অনন্ত বিজয়ের পরিচিতি ছিল সাইবার দুনিয়ায় ব্যাপকভাবে। ইতিমধ্যে
প্রযুক্তিনির্ভর অনুসন্ধান চালিয়ে পুলিশ এসব তথ্য পেয়েছে। আর এ কারণেই
অনন্ত বিজয়ের খুনের রহস্য উদঘাটে পুলিশসহ তদন্তকারী সংস্থাগুলো প্রযুক্তির
আশ্রয় নিয়েছে। ব্লগার অনন্ত বিজয় খুন হয়েছেন গেলো মঙ্গলবার সকালে। প্রকাশ্য
দিবালোকে তাকে কুপিয়ে খুন করে ঘাতকরা। এলাকার মানুষের সামনে তারা
নির্মমভাবে কুপিয়ে খুন করে চলে যায়। প্রকাশ্য এ খুনের ঘটনার পর এ দিন
বিকালেই আনসারুল্লাহ বাংলাটিম-৮ ঘটনার দায় স্বীকার করে টুইটারে বার্তা দেয়।
ঠিক যেমনি ঢাকায় অভিজিৎকে খুনের পর একইভাবে দায় স্বীকার করেছিল। তবে,
সিলেটের পুলিশসহ তদন্ত সংস্থাগুলো খুনের ঘটনাটিকে হালকাভাবে নেয়নি। স্থানীয়
প্রত্যক্ষদর্শীর জবানীর সূত্র ধরে পুলিশ সিলেটের লিংক খুঁজে বের করতে
ব্যস্ত হয়ে উঠে। প্রাথমিক পর্যায়ে চলে ম্যানুয়ালি তদন্ত। এ তদন্তে ছিল
অনন্ত বিজয়ের সঙ্গে ব্যক্তিগত বিরোধ, পারিবারিক বিরোধ কিংবা কর্মস্থলের
বিরোধ। ইতিমধ্যে পুলিশসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে ব্যাপক খোঁজখবর
নেয়া হয়েছে। কিন্তু তদন্ত আটকে দেয়ার মতো কোনো ঘটনা খুঁজে পায়নি পুলিশ।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের একাধিক সিনিয়র কর্মকর্তা অনন্ত বিজয় দাশ খুনের
ঘটনার তদন্ত মনিটরিং শুরু করেন। এমনকি কখনও কখনও তারা মাঠ পর্যায়ে গিয়ে
তদন্তে অংশ নেন। গতকাল তারা মানবজমিনকে জানিয়েছেন, নিহত অনন্ত বিজয় দাশ
খুনের সঙ্গে ঢাকায় ব্লগার খুনের চমৎকার মিল রয়েছে। কারন অভিজিৎদের মতোই
পেছন থেকে কুপিয়ে খুন করা হয়েছে অনন্তকে। আর ঘটনাকালীন অন্তত বিজয়
সুবিদবাজার পয়েন্টেই এসেই যখন হামলার শিকার হতে যাচ্ছিলেন তখন তিনি প্রাণ
বাঁচাতেই বাড়ি অভিমুখে দৌড় দেন। পথিমধ্যেই নির্জন স্থানে তাকে খুন করা হয়।
তারা বলেন, ব্লগার অনন্ত দাশ মুক্ত চিন্তার মানুষ। বাহ্যিকভাবে তার পরিধি
তেমন বড় নয়। পারিবারিক বলয়ের বাইরে মুক্তচিন্তার মানুষদের নিয়েই তার বিচরণ।
তবে, গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক ছিল অনন্ত দাশের। সিলেটের শহীদ
মিনার প্রজন্ম চত্বরের সামনে যতদিন গণজাগরণ মঞ্চের কর্মসূচি পালন করা হয়েছে
ততদিন সেখানে সরব ছিলেন অনন্ত। একজন সংগঠক হিসেবে তিনি সব সময় নেতৃত্ব
দিয়েছেন। পাশাপাশি উগ্রবাদীদের বিরুদ্ধেও রাজপথে ছিলেন সোচ্চার। ব্লগার
আসিফ মুহিউদ্দিনের ওপর হামলা, কিংবা অভিজিতের উপর হামলার ঘটনার পর যে
কয়েকজন সিলেটে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন তাদের মধ্যে অনন্ত ছিল অন্যতম।
এসব ঘটনার নিন্দা কিংবা কর্মসূচি পালনে তিনি ছিলেন সোচ্চার। পুলিশের ওই
কর্মকর্তারা জানান, সাইবার দুনিয়ায় নিহত অনন্ত দাশের পরিধি বিস্তৃত থাকার
কারণেই তাকে খুন করা হতে পারে বলে অনেকটা নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে, সেটি এখই
জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। এ কারণ সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছে আধুনিক
তদন্ত পদ্ধতির তেমন যন্ত্রপাতি নেই। এ কারণে ঘটনার পরপরই এ ব্যাপারে ঢাকা
মেট্রোপলিটন কিংবা কেন্দ্রীয় পুলিশের সহায়তা চাওয়া হয়। সিলেট থেকে আলামত
সংগ্রহসহ নানা বিষয় ইতিমধ্যে পুলিশের আধুনিক তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছে দেয়া
হয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে যাচাই বাছাই করা হচ্ছে। আজ-কালের মধ্যে পুলিশ ডিজিটাল
তদন্তের এক দিকনির্দেশনা পেতে পারে। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি
মিডিয়া মো. রহমতুল্লাহ জানিয়েছেন, ঢাকার পুলিশ ডিজিটাল তদন্তের সব রকম
সাপোর্ট পাচ্ছে। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ তেমনটি পাচ্ছে না। এ কারণে
প্রযুক্তিগত তদন্তের জন্য ঢাকা পুলিশের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। ঘটনার পর থেকে
পুলিশ প্রযুক্তিগত তদন্ত শুরু করেছে। প্রযুক্তিগত তদন্তের মধ্যে মোবাইল
ফোন, কম্পিউটার, ব্লগ, ফেসবুকসহ সবকিছুই অনুসন্ধান করা হচ্ছে। অনন্ত খুনের
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সিলেটের এয়ারপোর্ট থানার ওসি তদন্ত নুরুল আলম
জানিয়েছেন, পারিবারিক বিষয়, কর্মকস্থলসহ অনেক বিষয় নিয়ে ইতিমধ্যে তদন্ত
চলছে। তবে, এখনও কোন তথ্য মিলেনি। পুলিশ এ কারণে প্রযুক্তিগত তদন্তের দিকেও
জোর দিচ্ছে। ওদিকে, অনন্ত দাশের পারিবারিক সূত্র জানিয়েছেন, অনন্ত বিজয়
দাশ খুনের আগে তাদের বাসা কিংবা এলাকায় কিছু অচেনা লোকের আনাগোনা ছিল।
অনন্ত যখন বাসায় থাকতো না তখন মাঝে মধ্যে কিছু অচেনা যুবক তার বাসায় যেত।
খোঁজ করত অনন্ত আছে কিনা। কখনও কখনও তারা পরিবারের লোকদের কাছে পাওনাদার
বলে দাবি করতো। কেউ কেউ বলতো বন্ধুও। ফেসবুকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া:
মুক্তমনা ব্লগার এবং মুক্তমনা লেখক অনন্ত বিজয় দাশের হত্যাকাণ্ডের
প্রতিবাদে সরব হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক। ফেসবুকে অনন্ত
বিজয় দাশের অ্যাকাউন্টে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন তার সহকর্মী,
বন্ধু, স্বজনরা। সপ্তর্ষী দাস নামের একজন লিখেছেন, ‘দাদা, তুমি পরাজিত
হওনি, পরাজিত আমরা, পরাজিত খুনিরা।’ রাজেশ পাল নামক একজন লিখেছেন, ‘তোমাকেও
বাঁচতে দিল না বন্ধু!’ ‘অনন্ত দা, মাফ করবেন আমাদেরকে’ লিখেছেন জি এম অপু
নামক একজন। উৎসব এইচ পাটোওয়ারী নামের একজন লিখেছেন, ‘মানুষের জীবনের মূল্য
এতটাই কম? ন্যূনতম বেঁচে থাকার অধিকারটাও আমরা পাব না!!’ জাবেদ আহমদ
লিখেছেন, ‘দাদা তোমার জন্য কিছুই করতে পারলাম না। এ জন্তুতে পরিপূর্ণ জনপদে
তোমার মতো লোক মানায় না। এখানে বাস করতে হলে জন্তু হওয়া লাগে।’ সংহতি
সমাবেশ : ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশের খুনিদের গ্রেপ্তার দাবিতে সংহতি সমাবেশ
করেছে গণজাগরণ মঞ্চ। গতকাল বিকালে সিলেটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় এ
সংহতি সমাবেশে আয়োজন করা হয়। এ সময় আয়োজিত সমাবেশে বক্তারা বলেন, অনন্ত
খুনের ঘটনাকারী গ্রেপ্তার না হলে সিলেটের ব্লগার ও প্রগতিশীলরা নিরাপদ
থাকবে না। একের পর এক ঘটনা ঘটতেই থাকবে। সরকারের উদাসীনতায় খুনিরা ধরা পড়ছে
না দাবি করে বক্তারা বলেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে খুনিরা সরকারের চেয়ে
শক্তিশালী। সংহতি সমাবেশে সিলেট সিটি করপোরেশনের কাছে দাবি উপস্থাপন করে
বলা হয়, যে স্থানে ব্লগার অনন্ত বিজয়কে খুন করা হয়েছে সেখানে তার স্মৃতিফলক
নির্মাণ করা হোক। পাশাপাশি খুনিদের গ্রেপ্তারের জন্য সোমবার সিলেটের জেলা
প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি পেশ করার সিদ্ধান্ত
গ্রহণ করা হয়। সংহতি সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন সিলেট গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র
দেবাশীষ দেবু। বক্তব্য রাখেন, উদীচীর সভাপতি ব্যারিস্টার আরশ আলী,
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি
প্রফেসর ড. ইউনূস, প্রফেসর ড. আবদুল গনি, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ভবতোষ রায়
বর্মন, আবদুল খালিক, সৈয়দ মনির হেলাল, এনামুল মুনির, রতন দেবন, রাজিব
রাসেল, রজত কান্তি গুপ্ত, শহিদুজ্জামান পাপলু ও পাপ্পু দে প্রমুখ।
No comments