ওমরাহ ভিসা বন্ধ যে কারণে
শুধু
সাগরপথেই মালয়েশিয়ায় নয়, ওমরাহর নামে আকাশপথেও সৌদি আরবে করা হচ্ছে মানব
পাচার। এজন্য সৌদি সরকার বাংলাদেশ কালো তালিকাভুক্ত করেছে। দেড় মাস ধরে
বাংলাদেশের ওমরাহ ভিসা বন্ধ রেখেছে। সৌদি সরকার ব্যাপক কড়াকড়ি আরোপের পরও
ওমরাহর নামে মানব পাচার বন্ধ করতে পারেনি। বিগত ওয়ান-ইলেভেনের সময়ও
বেশিসংখ্যক ওমরাহযাত্রী অবৈধ হয়ে সৌদিতে পালিয়ে থাকার কারণে ওমরাহ ভিসা
বন্ধ করে দিয়েছিল। পরে বাংলাদেশের মাত্র ২১টি এজেন্সিকে অনুমতি দিয়ে ওমরাহ
ভিসা চালু করা হয়েছিল। এজেন্সির মালিকরা জানিয়েছেন, ওমরাহর নামে মানব পাচার
রোধ করতে উদ্যোগ নিতে হবে বাংলাদেশ সরকারকেই। নতুবা সহসাই আর ওমরাহ ভিসা
চালু হবে না। আশি কিংবা নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশীদের নিয়ে এতটা কড়াকড়ি ছিল
না সৌদি আরবে। ওই সময় খুব কমসংখ্যক বাংলাদেশী সৌদিতে কাজের সন্ধানে বসবাস
করতেন। কিন্তু পরে সৌদি আরবে কাজের সন্ধানে যাওয়া বাংলাদেশীদের সংখ্যা
আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যায়। বর্তমানে কয়েক লাখ বাংলাদেশী শ্রমিক সৌদি আরবে
বসবাস করছেন। এর মধ্যে অনেকেই ওমরাহ কিংবা হজ ভিসায় সৌদি আরবে গিয়ে রয়ে
যান। এসব বিষয় নিয়ে দফায় দফায় সৌদি আরবে বাংলাদেশের শ্রমবাজার বিতর্কের
মুখে পড়ে। পরে ওই শ্রমবাজারটি বন্ধ হয়ে পড়ে। এজেন্সির মালিকরা জানিয়েছেন,
শ্রমবাজার বন্ধ হওয়ার পর হজ ও ওমরাহ ভিসায় ব্যাপক কড়াকড়ি আরোপ করে সৌদি
সরকার। এর পরও মানব পাচারকারী গুটিকয়েক এজেন্সি ওমরাহ ও হজ ভিসায় মানব
পাচার করে। এতে ২০০৭ সালের দিকে একবার সৌদি সরকার ওমরাহ ভিসা বন্ধ করে
দিয়েছিল। প্রচুরসংখ্যক বাংলাদেশী ওমরাহর নামে সৌদি আরবে গিয়ে পলাতক থাকায়
সেটি হয়। ওই সময় সৌদি সরকার নতুন নিয়ম আরোপ করে এজেন্সি, কোম্পানি ও সরকার
পর্যায়ে চুক্তির মাধ্যমে চালু করেছিল ওমরাহ ভিসা। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের
মাত্র ২১টি এজেন্সিকে বৈধতা দিয়ে তাদের মাধ্যমে ওমরাহ চালু করে। এরপর থেকে
বাংলাদেশের এজেন্সির মালিকরাও নিজেদের ব্যবসা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার
স্বার্থে সঠিক নিয়মেই ওমরাহযাত্রীদের পাঠিয়েছিলেন। ২০১৫ সালের মার্চ মাসের
আগ পর্যন্ত সৌদি আরবে সৌদির চুক্তির নিয়ম অনুযায়ী এক ভাগের বেশি যাত্রী
ওভার স্ট্রে (অতিরিক্ত সময় অবস্থান) করেনি। এদিকে, বর্তমান সরকার চলতি বছরে
নতুন করে সৌদির শ্রমবাজার চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ থেকে
রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বল্প খচরে শ্রমিক নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু যখন
সৌদির শ্রমবাজার খুলছে তখনই ওমরাহ ভিসার নামে মানব পাচার করে সৌদি আরবে ফের
ব্ল্যাক লিস্টেট হয়ে গেল বাংলাদেশ। এজেন্সির মালিকরা জানিয়েছেন, সৌদি আরব
হচ্ছে বাংলাদেশের অন্যতম বড় শ্রমবাজার। একই সঙ্গে ওমরাহ ও হজ পালন করতে
প্রতি বছর লাখ লাখ বাংলাদেশী সৌদি আরবে যান। এজন্য সৌদির সঙ্গে বাংলাদেশের
ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে। এ অবস্থায় শুধু ওমরাহর নামে মানব পাচার করায়
বাংলাদেশের সব পর্যায়ের অর্জন ধূলিসাত হতে চলেছে। আর গুটিকয়েক এজেন্সি এই
মানব পাচারে জড়িত থেকে দেশের জন্য দুর্নাম নিয়ে এসেছে। তারা জানান, ২২শে
মার্চ বাংলাদেশের ওমরাহ ভিসা বন্ধ করে দেয়ার সময় ১২০০ থেকে ১৫০০ যাত্রী
মেয়াদের অতিরিক্ত সময় সৌদিতে অবস্থান করছিলেন। মে মাসের প্রথমদিকে এসে সেই
সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় দুই হাজারের মতো। এখন অতিরিক্ত সময়ে যারা
অবস্থান করছেন, তাদের চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। এ কারণে কবে নাগাদ ওমরাহ ভিসা
চালু হবে সেটিও নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। অনেক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন,
বাংলাদেশ সরকার থেকে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করা না হলে এবারের রমজান মাসে
বাংলাদেশ থেকেই কেউ-ই ওমরাহ পালন করতে সৌদি আরব যেতে পারবেন না। এতে চলমান
থাকা দেড় শতাধিক এজেন্সির লোকসান দাঁড়াবে অর্ধশত কোটি টাকার মতো। তারা
জানান, আবার ওমরাহ ভিসা চালু করতে হলে বাংলাদেশ সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে।
বাংলাদেশ থেকে যেসব এজেন্সি ওমরাহর নামে মানব পাচার করেছে, তাদের চিহ্নিত
করতে হবে দ্রুত। এরপর যারা অতিরিক্ত সময় সৌদিতে অবস্থান করছেন, তাদের
চিহ্নিত করা সম্ভব হবে। হজ অ্যাসোসিয়েশন এজেন্সি বাংলাদেশ-হাব সিলেটের
সভাপতি মনসুর আলী খান মানবজমিনকে জানিয়েছেন, হঠাৎ করে ওমরাহ ভিসা বন্ধ হয়ে
যাওয়ায় এজেন্সির মালিকরা কি পরিমাণ ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন, সেটি বলে
বোঝানো সম্ভব নয়। সৌদি আরবে আগে টাকা দিয়ে বাসাবাড়ি ভাড়া করে রাখতে হয়।
ওখানে বাসাভাড়া নেয়া হলেও এখন ওমরাহযাত্রী যাওয়া বন্ধ। সুতরাং পুরো টাকাই
লোকসান হচ্ছে এজেন্সির মালিকদের। তিনি বলেন, সরকার থেকে উদ্যোগ নিলে আপাতত
স্বচ্ছভাবে যারা ব্যবসা পরিচালনা করছেন, তারা কিছুটা স্বস্তি পাবেন।
সিলেটের শিপার এয়ারওয়েজের স্বত্বাধিকারী খন্দকার শিপার আহমদ জানিয়েছেন,
ওমরাহ ভিসা কবে চালু হবে সেটি অনিশ্চিত। রমজানে অনেক মানুষ ওমরাহতে যান।
এবার তারা যেতে পারবেন না। তিনি বলেন, একমাত্র মানব পাচারের কারণেই
বাংলাদেশ কালো তালিকাভুক্ত হয়েছে। অন্যদিকে, এজেন্সির মালিকরা আশঙ্কা
প্রকাশ করে বলেছেন, ওমরাহর মতো হজের বেলায় এমন ঘটনা ঘটলে কোন উপায় থাকবে
না। তারা বলেন, দুই বছর ধরে গড়ে এক লাখ করে মানুষ পবিত্র হজ পালনে সৌদি
আরবে গেছেন। কিন্তু এবার দেখা গেছে, আরও ২০ থেকে ২৫ হাজার মানুষ অতিরিক্ত
হয়ে গেছেন। এরা এখনও ডাটা এন্ট্রি করতে পারেননি। বাংলাদেশ সরকার সৌদি
সরকারের সঙ্গে আলোচনাক্রমে শেষপর্যায়ে তাদের হয়তো সুযোগ দিতে পারে। কিন্তু
হজে গিয়ে যাতে কোন ওভার স্ট্রে (অতিরিক্ত সময় অবস্থান) করতে না পারে সে
জন্য সরকারকে আগেভাগেই ব্যবস্থা করতে হবে।
No comments