‘শতভাগ সফল’ প্রকল্পে ৬৩১ কোটি টাকার ঋণ অনিয়মিত -একটি বাড়ি একটি খামার: অনুসন্ধান by শরিফুজ্জামান
একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প |
একটি
বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল গরু-ছাগল কিনে ‘অর্ধেক
তোমার অর্ধেক আমার’—এ জাতীয় ভাগাভাগির মাধ্যমে। লুটপাট বন্ধ করতে চালু করা
হয়েছিল দরিদ্রদের জন্য ক্ষুদ্র সঞ্চয়, যা প্রকৃতপক্ষে ক্ষুদ্রঋণে মোড়
নেয়। এর মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে ‘শতভাগ সফল’ দাবি করা হলেও মাঠপর্যায়ে
বিতরণ করা ৬৩১ কোটি টাকার ঋণ অনিয়মিত হয়ে পড়েছে।
এ ছাড়া ৫ মে পর্যন্ত ৯৩৭ কোটি টাকা ব্যাংকে অলস পড়ে ছিল, যা থেকে প্রমাণিত হয়, সঞ্চয়ের প্রতি সদস্যের আগ্রহ কমে গেছে। কারণ, শর্ত অনুযায়ী সদস্যরা সঞ্চয় জমা না দেওয়ায় উৎসাহ বোনাসের এই টাকা ছাড় করা যাচ্ছে না। আবার টাকা ছাড় করতে না পারায় দরিদ্র মানুষ ঋণসুবিধাও পাচ্ছে না।
প্রতিটি বাড়িতে একটি খামার গড়ে তোলার লক্ষ্যে সদস্যদের সঞ্চয়ের বিপরীতে সমান পরিমাণ উৎসাহ বোনাস এবং সমিতিকে অনুদান হিসেবে দেওয়া এ প্রকল্পের তহবিল এখন (৫ মে পর্যন্ত) ২ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। আগামী বছরের জুন পর্যন্ত সরকার এ প্রকল্পে বরাদ্দ রেখেছে ৩ হাজার ১৬২ কোটি টাকা।
প্রকল্পের হিসাব বিবরণী অনুযায়ী, এর ২ হাজার ৭৭ কোটি টাকার মধ্যে আদায় হয়েছে ৫০৬ কোটি টাকা ও অনাদায়ি ৬৩১ কোটি টাকা। এ ছাড়া ৫১০ কোটি টাকা মাঠে থাকলেও তা পরিশোধের সময় হয়নি।
প্রায় দুই মাস ধরে পরিচালিত অনুসন্ধানে এ প্রকল্পের অনিয়ম ও দুর্নীতি, ক্রমান্বয়ে দরিদ্র মানুষের হাতে টাকা আটকে যাওয়া এবং দারিদ্র্যকে পুঁজি করে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করাসহ প্রকৃত চিত্র আড়াল করার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের কাছে শুধুই কাগজে-কলমে ইতিবাচক চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে। দারিদ্র্য বিমোচনে এটা সরকারের অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প।
প্রকল্পের মূল লক্ষ্য সঞ্চয় গড়তে উৎসাহ জোগানো, খামার গড়তে ঋণ নেওয়া ও তা সময়মতো ফেরত দেওয়া। কিন্তু মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, একদিকে সদস্যদের সঞ্চয়ের প্রবণতা কমছে, অন্যদিকে ঋণ আদায়ের হারও কমছে।
এর পরও প্রকল্প কর্তৃপক্ষ বক্তৃতা-বিবৃতিতে দাবি করছে, এটা ‘শতভাগ’ সফল একটি প্রকল্প। দেশের দারিদ্র্য কমে আসার ক্ষেত্রে এ প্রকল্পের ভূমিকাই মুখ্য বলে প্রচার করা হচ্ছে। এমনকি দেশে একজনও দরিদ্র থাকবে না, এমন স্বপ্ন দেখিয়ে আরও ৫ হাজার ১৬২ কোটি টাকা সরকারকে এই খাতে দিতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে, যা সরকারের সক্রিয় বিবেচনাধীন।
অর্থনীতিবিদ এবং পিপলস পাওয়ার পার্টিসিপেশন ট্রাস্টের (পিপিআরসি) নির্বাহী পরিচালক হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এ প্রকল্পের কারণে দারিদ্র্য বিমোচন হয়েছে, এমন দাবির কোনো ভিত্তি নেই। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিসহ সরকারের বেশ কয়েকটি জনকল্যাণমূলক প্রকল্প থাকলেও এ প্রকল্প সফল বা এর কারণে দারিদ্র্য বিমোচন হয়েছে, এমন দাবি ফাঁকা আওয়াজ ছাড়া কিছুই নয়। কোন পদ্ধতি বা সূচকের ভিত্তিতে এ কথা বলছে, তা অজ্ঞাত ও অস্পষ্ট।
ক্ষুদ্র কৃষক উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এইচ এম আবদুল্লাহ বলেন, এ প্রকল্পের কার্যক্রম গ্রামীণ জনপদে কী ধরনের প্রভাব বিস্তার করছে, তা কোনো নিরপেক্ষ সংস্থা দিয়ে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। (কার্যবিবরণী, জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটির সভা, ১৫ এপ্রিল ২০১৫)
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রকল্পের সফটওয়্যারে সব তথ্য উল্লেখ করা হলেও মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের সংখ্যা বা বকেয়া ঋণের চিত্র দেখানো হয়নি। এটাকে কৌশল আখ্যা দিয়ে প্রকল্পের একাধিক কর্মকর্তা জানান, যেকোনোভাবেই প্রকল্প সফল দেখানোর চেষ্টা চলছে। যদিও মাঠের বাস্তব চিত্র এমনটি নয়।
মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধানে জানা গেছে, মেয়াদোত্তীর্ণ বা কুঋণ হওয়ার বিষয়টি চাপা দিতে কেন্দ্র থেকে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়ার মৌখিক নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে প্রায় সব ঋণই চলমান বলে দেখানো সম্ভব হবে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, ঋণ বিতরণের বিপরীতে আদায়, সঞ্চয় ও বকেয়ার তথ্যগুলো এ প্রকল্পের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। গত মার্চে দেশের বিভিন্ন জেলার ৪০ উপজেলা থেকে প্রকল্পের প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো প্রতিবেদন সংগ্রহ করে বিশ্লেষকদের এ আশঙ্কার সত্যতা মেলে।
মাঠের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এসব উপজেলায় ওই মাসে ঋণ আদায়ের লক্ষ্য ছিল ১৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। কিন্তু আদায় হয়েছে মাত্র ২ কোটি ৮২ লাখ টাকা। অর্থাৎ আদায়ের হার ১৯ দশমিক ৫৩ এবং অনাদায়ি হার ৮০ দশমিক ৪৭।
উপজেলার প্রকল্প সমন্বয়কারীদের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলায় মার্চ মাসে ২২ লাখ ৯৯ হাজার টাকা আদায় করার কথা ছিল, আদায় হয়েছে মাত্র ৯৮ হাজার টাকা। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ৩৮ লাখ ৪৫ হাজার টাকার বিপরীতে ৬ লাখ ৯ হাজার টাকা, পাবনার সাঁথিয়ায় ২১ লাখ ১৬ হাজার টাকার বিপরীতে ৪ লাখ ৪৫ হাজার টাকা, শেরপুরের ঝিনাইগাতীতে ১২ লাখ ৪৮ হাজার টাকার বিপরীতে ৫ লাখ ১১ হাজার টাকা আদায় হয়েছে। এমন ৪০টি উপজেলার তথ্য এ প্রতিবেদকের হাতে রয়েছে।
তবে প্রকল্প পরিচালক দাবি করেন, মাঠ থেকে প্রকল্প সমন্বয়কারীদের পাঠানো এসব তথ্য বিভ্রান্তিকর। তাঁর কাছে বিকল্প উপায়ে সংগৃহীত তথ্যই সঠিক।
অনুসন্ধানে আরও পাওয়া গেছে, মাঠপর্যায়ে খেলাপি হওয়ার প্রবণতা ক্রমান্বয়ে বাড়ার কারণ বেশির ভাগ গরিব মানুষের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছে যে এটি সঞ্চয়ের বিপরীতে সরকারের অনুদান। তাই আর ফেরত দিতে হবে না।
সমিতিগুলোর হালচাল: প্রথম আলোর পক্ষ থেকে কমপক্ষে ৩০টি সমিতির ব্যবস্থাপক ও প্রকল্পের মাঠকর্মীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য এবং প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া একটি বাড়ি একটি খামারের সাফল্যের ঢোল যেভাবে পেটানো হচ্ছে, তা বাস্তবসম্মত নয়। ৬০ জনের বেশির ভাগ সমিতিতে ৪০ থেকে ৪৫ জন সদস্য রয়েছেন এবং নিষ্ক্রিয় সদস্যের সংখ্যা প্রায় অর্ধেক।
পঞ্চগড়ের শালবাহান লোহাকাচি গ্রাম উন্নয়ন সমিতিতে ৬০ সদস্যের মধ্যে নিয়মিত আছেন ৫১ জন, ঋণ নিয়েছেন ৪৮ জন, এঁদের মধ্যে খেলাপি ১৭ জন। অর্থাৎ ৬০ জনের মধ্যে সক্রিয় আছেন ৩১ জন। একই জেলার আটোয়ারী ছেপড়াঝাড়া গ্রাম উন্নয়ন সমিতির ৬০ জনের ১৪ জনই সঞ্চয় জমা দেন না। ৩৮ জন ঋণ নিলেও নিয়মিত শোধ করছেন ১০ জন, ২৮ জনই অনিয়মিত।
আবার ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ভেলাজান সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমিতির ৬০ জনের সবাই ঋণ নিয়েছেন, কোনো খেলাপি নেই। এমন সমিতি ৩০টির মধ্যে একটি পাওয়া গেছে।
একই জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় একজন মাঠকর্মীর আওতায় নয়টি সমিতির ৫৪০ জন সদস্য রয়েছেন। সেখানে প্রায় ৬০ শতাংশ সদস্যই ঋণখেলাপি। মাঠকর্মী নির্মল চন্দ্র সিংহ জানান, গত বছরের জানুয়ারিতে যোগ দেওয়ার পর তিনি আস্তে আস্তে ঋণ আদায়ের চেষ্টা করছেন। গমের মৌসুমে ঋণ শোধ করার অঙ্গীকার করেছেন প্রায় সবাই।
সমিতি, সদস্য ও সংকট: ২০০৯ সালের ১ জুলাই প্রকল্পের শুরু। এর দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় ২০১৩ সালের জুলাইয়ে। প্রকাশ্যে না হলেও আড়ালে-আবডালে বলা হচ্ছিল, গ্রামীণ ব্যাংকের বিকল্প হিসেবে এ প্রকল্প সারা দেশে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ করে দারিদ্র্য বিমোচন করবে।
প্রকল্পের নিয়ম অনুযায়ী, ৬০ জন সদস্যের প্রত্যেকে মাসে ২০০ টাকা হিসাবে দুই বছরে ৪ হাজার ৮০০ টাকা সঞ্চয় করবেন। সরকার তাঁদের আরও ৪ হাজার ৮০০ টাকা দেবে। দুই বছরে ৬০ সদস্যের জমা হবে ৫ লাখ ৭৬ হাজার টাকা, এর সঙ্গে বছরে দেড় লাখ টাকা হিসাবে দুই বছরে ওই সমিতিকে সরকার মোট ৩ লাখ টাকা দেবে আবর্তক তহবিল হিসেবে। সব মিলিয়ে দুই বছরে একটি সমিতির সর্বোচ্চ ৯ লাখ টাকা সঞ্চয় হওয়ার কথা।
মোট ৪০ হাজার ১২১টি সমিতির মধ্যে (প্রতি সমিতির সদস্য ৬০ জন) পুরোনো সমিতি ১৭ হাজার ৩০০ এবং নতুন সমিতি ২২ হাজার ৮২১। মোট সদস্যসংখ্যা ২৪ লাখ ৭ হাজার ২৬০ জন। পুরোনো সমিতির অধিকাংশই এখন খেলাপি বা অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
দারিদ্র্যমুক্ত করার স্বপ্ন দেখিয়ে আরও ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের চেষ্টা
এ অবস্থা স্বীকার করে প্রকল্প পরিচালক প্রশান্ত কুমার রায় প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ৭০ ভাগ সমিতি ভালো চলছে। তাঁর মতে, নতুন ২৩ হাজার সমিতি পুরোনোগুলোর তুলনায় ভালো চলছে।
রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রকল্প: দেশজুড়ে এত বড় এবং এত টাকার প্রকল্প চললেও সরকারি বা বেসরকারি কোনো পর্যায়ে এর সর্বশেষ মূল্যায়ন হয়নি। এমনকি পরীক্ষা-নিরীক্ষা (পাইলটিং) ছাড়াই এত বড় কাজ শুরু হয়ে যায়।
পিপিআরসির নির্বাহী পরিচালক হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের অনেকগুলো সফল প্রকল্পের মধ্যে এটি স্থূল রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের শুরুটাই ছিল ত্রুটিপূর্ণ এবং পাইলটিং ছাড়া বড় বাজেটের এই বিশাল প্রকল্প নেওয়াটাই অন্যায় হয়েছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা বলেন, সুচিন্তিত ও পরিকল্পিত না হওয়ায় এ প্রকল্পের গতি বারবার পরিবর্তন করতে হয়েছে। এর উদ্দেশ্য সুস্পষ্টকরণে চরম দুর্বলতা লক্ষ করা যায়। ফলে গরু-ছাগল দেওয়া শুরু করে তা ক্ষুদ্রঋণে মোড় নেয়, এরপর তা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়লে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের মাধ্যমে কাঠামোবদ্ধ করার চেষ্টা হচ্ছে, যদিও ব্যাংকটি কাজই শুরু করতে পারছে না।
আর শতভাগ সফল বলতে চান না: শতভাগ সফল দাবি করা প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক বলেন, এটা আর বলা ঠিক নয়। শতভাগ সফল হতে চাইলে সমিতির সব সদস্য, প্রকল্পের কর্মী, মাঠ প্রশাসন এবং স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সর্বাত্মক সহযোগিতা দরকার।
এ প্রকল্পের কারণে দারিদ্র্য কমেছে এবং ভবিষ্যতে আরও কমবে—কোনো গবেষণা, মূল্যায়ন বা জরিপ ছাড়া এটা কিসের ভিত্তিতে বলছেন, জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক বলেন, সম্প্রতি কোনো মূল্যায়ন হয়নি, তবে আইএমইডি এটা করার কথা বলেছে।
প্রকল্পের মাঠকর্মীদের বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রশান্ত কুমার বলেন, ওদের নিজের ইউনিয়নে চাকরি দেওয়া হয়েছে, ১০ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হয়। তার পরও ওদের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। এ জন্য ঋণ আদায়ের সক্ষমতার সঙ্গে বেতনের বিষয়টি যুক্ত করে দেওয়া হবে।
এ ছাড়া ৫ মে পর্যন্ত ৯৩৭ কোটি টাকা ব্যাংকে অলস পড়ে ছিল, যা থেকে প্রমাণিত হয়, সঞ্চয়ের প্রতি সদস্যের আগ্রহ কমে গেছে। কারণ, শর্ত অনুযায়ী সদস্যরা সঞ্চয় জমা না দেওয়ায় উৎসাহ বোনাসের এই টাকা ছাড় করা যাচ্ছে না। আবার টাকা ছাড় করতে না পারায় দরিদ্র মানুষ ঋণসুবিধাও পাচ্ছে না।
প্রতিটি বাড়িতে একটি খামার গড়ে তোলার লক্ষ্যে সদস্যদের সঞ্চয়ের বিপরীতে সমান পরিমাণ উৎসাহ বোনাস এবং সমিতিকে অনুদান হিসেবে দেওয়া এ প্রকল্পের তহবিল এখন (৫ মে পর্যন্ত) ২ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। আগামী বছরের জুন পর্যন্ত সরকার এ প্রকল্পে বরাদ্দ রেখেছে ৩ হাজার ১৬২ কোটি টাকা।
প্রকল্পের হিসাব বিবরণী অনুযায়ী, এর ২ হাজার ৭৭ কোটি টাকার মধ্যে আদায় হয়েছে ৫০৬ কোটি টাকা ও অনাদায়ি ৬৩১ কোটি টাকা। এ ছাড়া ৫১০ কোটি টাকা মাঠে থাকলেও তা পরিশোধের সময় হয়নি।
প্রায় দুই মাস ধরে পরিচালিত অনুসন্ধানে এ প্রকল্পের অনিয়ম ও দুর্নীতি, ক্রমান্বয়ে দরিদ্র মানুষের হাতে টাকা আটকে যাওয়া এবং দারিদ্র্যকে পুঁজি করে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করাসহ প্রকৃত চিত্র আড়াল করার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের কাছে শুধুই কাগজে-কলমে ইতিবাচক চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে। দারিদ্র্য বিমোচনে এটা সরকারের অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প।
প্রকল্পের মূল লক্ষ্য সঞ্চয় গড়তে উৎসাহ জোগানো, খামার গড়তে ঋণ নেওয়া ও তা সময়মতো ফেরত দেওয়া। কিন্তু মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, একদিকে সদস্যদের সঞ্চয়ের প্রবণতা কমছে, অন্যদিকে ঋণ আদায়ের হারও কমছে।
এর পরও প্রকল্প কর্তৃপক্ষ বক্তৃতা-বিবৃতিতে দাবি করছে, এটা ‘শতভাগ’ সফল একটি প্রকল্প। দেশের দারিদ্র্য কমে আসার ক্ষেত্রে এ প্রকল্পের ভূমিকাই মুখ্য বলে প্রচার করা হচ্ছে। এমনকি দেশে একজনও দরিদ্র থাকবে না, এমন স্বপ্ন দেখিয়ে আরও ৫ হাজার ১৬২ কোটি টাকা সরকারকে এই খাতে দিতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে, যা সরকারের সক্রিয় বিবেচনাধীন।
অর্থনীতিবিদ এবং পিপলস পাওয়ার পার্টিসিপেশন ট্রাস্টের (পিপিআরসি) নির্বাহী পরিচালক হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এ প্রকল্পের কারণে দারিদ্র্য বিমোচন হয়েছে, এমন দাবির কোনো ভিত্তি নেই। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিসহ সরকারের বেশ কয়েকটি জনকল্যাণমূলক প্রকল্প থাকলেও এ প্রকল্প সফল বা এর কারণে দারিদ্র্য বিমোচন হয়েছে, এমন দাবি ফাঁকা আওয়াজ ছাড়া কিছুই নয়। কোন পদ্ধতি বা সূচকের ভিত্তিতে এ কথা বলছে, তা অজ্ঞাত ও অস্পষ্ট।
ক্ষুদ্র কৃষক উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এইচ এম আবদুল্লাহ বলেন, এ প্রকল্পের কার্যক্রম গ্রামীণ জনপদে কী ধরনের প্রভাব বিস্তার করছে, তা কোনো নিরপেক্ষ সংস্থা দিয়ে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। (কার্যবিবরণী, জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটির সভা, ১৫ এপ্রিল ২০১৫)
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রকল্পের সফটওয়্যারে সব তথ্য উল্লেখ করা হলেও মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের সংখ্যা বা বকেয়া ঋণের চিত্র দেখানো হয়নি। এটাকে কৌশল আখ্যা দিয়ে প্রকল্পের একাধিক কর্মকর্তা জানান, যেকোনোভাবেই প্রকল্প সফল দেখানোর চেষ্টা চলছে। যদিও মাঠের বাস্তব চিত্র এমনটি নয়।
মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধানে জানা গেছে, মেয়াদোত্তীর্ণ বা কুঋণ হওয়ার বিষয়টি চাপা দিতে কেন্দ্র থেকে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়ার মৌখিক নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে প্রায় সব ঋণই চলমান বলে দেখানো সম্ভব হবে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, ঋণ বিতরণের বিপরীতে আদায়, সঞ্চয় ও বকেয়ার তথ্যগুলো এ প্রকল্পের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। গত মার্চে দেশের বিভিন্ন জেলার ৪০ উপজেলা থেকে প্রকল্পের প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো প্রতিবেদন সংগ্রহ করে বিশ্লেষকদের এ আশঙ্কার সত্যতা মেলে।
মাঠের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এসব উপজেলায় ওই মাসে ঋণ আদায়ের লক্ষ্য ছিল ১৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। কিন্তু আদায় হয়েছে মাত্র ২ কোটি ৮২ লাখ টাকা। অর্থাৎ আদায়ের হার ১৯ দশমিক ৫৩ এবং অনাদায়ি হার ৮০ দশমিক ৪৭।
উপজেলার প্রকল্প সমন্বয়কারীদের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলায় মার্চ মাসে ২২ লাখ ৯৯ হাজার টাকা আদায় করার কথা ছিল, আদায় হয়েছে মাত্র ৯৮ হাজার টাকা। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ৩৮ লাখ ৪৫ হাজার টাকার বিপরীতে ৬ লাখ ৯ হাজার টাকা, পাবনার সাঁথিয়ায় ২১ লাখ ১৬ হাজার টাকার বিপরীতে ৪ লাখ ৪৫ হাজার টাকা, শেরপুরের ঝিনাইগাতীতে ১২ লাখ ৪৮ হাজার টাকার বিপরীতে ৫ লাখ ১১ হাজার টাকা আদায় হয়েছে। এমন ৪০টি উপজেলার তথ্য এ প্রতিবেদকের হাতে রয়েছে।
তবে প্রকল্প পরিচালক দাবি করেন, মাঠ থেকে প্রকল্প সমন্বয়কারীদের পাঠানো এসব তথ্য বিভ্রান্তিকর। তাঁর কাছে বিকল্প উপায়ে সংগৃহীত তথ্যই সঠিক।
অনুসন্ধানে আরও পাওয়া গেছে, মাঠপর্যায়ে খেলাপি হওয়ার প্রবণতা ক্রমান্বয়ে বাড়ার কারণ বেশির ভাগ গরিব মানুষের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছে যে এটি সঞ্চয়ের বিপরীতে সরকারের অনুদান। তাই আর ফেরত দিতে হবে না।
সমিতিগুলোর হালচাল: প্রথম আলোর পক্ষ থেকে কমপক্ষে ৩০টি সমিতির ব্যবস্থাপক ও প্রকল্পের মাঠকর্মীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য এবং প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া একটি বাড়ি একটি খামারের সাফল্যের ঢোল যেভাবে পেটানো হচ্ছে, তা বাস্তবসম্মত নয়। ৬০ জনের বেশির ভাগ সমিতিতে ৪০ থেকে ৪৫ জন সদস্য রয়েছেন এবং নিষ্ক্রিয় সদস্যের সংখ্যা প্রায় অর্ধেক।
পঞ্চগড়ের শালবাহান লোহাকাচি গ্রাম উন্নয়ন সমিতিতে ৬০ সদস্যের মধ্যে নিয়মিত আছেন ৫১ জন, ঋণ নিয়েছেন ৪৮ জন, এঁদের মধ্যে খেলাপি ১৭ জন। অর্থাৎ ৬০ জনের মধ্যে সক্রিয় আছেন ৩১ জন। একই জেলার আটোয়ারী ছেপড়াঝাড়া গ্রাম উন্নয়ন সমিতির ৬০ জনের ১৪ জনই সঞ্চয় জমা দেন না। ৩৮ জন ঋণ নিলেও নিয়মিত শোধ করছেন ১০ জন, ২৮ জনই অনিয়মিত।
আবার ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ভেলাজান সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমিতির ৬০ জনের সবাই ঋণ নিয়েছেন, কোনো খেলাপি নেই। এমন সমিতি ৩০টির মধ্যে একটি পাওয়া গেছে।
একই জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় একজন মাঠকর্মীর আওতায় নয়টি সমিতির ৫৪০ জন সদস্য রয়েছেন। সেখানে প্রায় ৬০ শতাংশ সদস্যই ঋণখেলাপি। মাঠকর্মী নির্মল চন্দ্র সিংহ জানান, গত বছরের জানুয়ারিতে যোগ দেওয়ার পর তিনি আস্তে আস্তে ঋণ আদায়ের চেষ্টা করছেন। গমের মৌসুমে ঋণ শোধ করার অঙ্গীকার করেছেন প্রায় সবাই।
সমিতি, সদস্য ও সংকট: ২০০৯ সালের ১ জুলাই প্রকল্পের শুরু। এর দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় ২০১৩ সালের জুলাইয়ে। প্রকাশ্যে না হলেও আড়ালে-আবডালে বলা হচ্ছিল, গ্রামীণ ব্যাংকের বিকল্প হিসেবে এ প্রকল্প সারা দেশে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ করে দারিদ্র্য বিমোচন করবে।
প্রকল্পের নিয়ম অনুযায়ী, ৬০ জন সদস্যের প্রত্যেকে মাসে ২০০ টাকা হিসাবে দুই বছরে ৪ হাজার ৮০০ টাকা সঞ্চয় করবেন। সরকার তাঁদের আরও ৪ হাজার ৮০০ টাকা দেবে। দুই বছরে ৬০ সদস্যের জমা হবে ৫ লাখ ৭৬ হাজার টাকা, এর সঙ্গে বছরে দেড় লাখ টাকা হিসাবে দুই বছরে ওই সমিতিকে সরকার মোট ৩ লাখ টাকা দেবে আবর্তক তহবিল হিসেবে। সব মিলিয়ে দুই বছরে একটি সমিতির সর্বোচ্চ ৯ লাখ টাকা সঞ্চয় হওয়ার কথা।
মোট ৪০ হাজার ১২১টি সমিতির মধ্যে (প্রতি সমিতির সদস্য ৬০ জন) পুরোনো সমিতি ১৭ হাজার ৩০০ এবং নতুন সমিতি ২২ হাজার ৮২১। মোট সদস্যসংখ্যা ২৪ লাখ ৭ হাজার ২৬০ জন। পুরোনো সমিতির অধিকাংশই এখন খেলাপি বা অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
দারিদ্র্যমুক্ত করার স্বপ্ন দেখিয়ে আরও ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের চেষ্টা
এ অবস্থা স্বীকার করে প্রকল্প পরিচালক প্রশান্ত কুমার রায় প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ৭০ ভাগ সমিতি ভালো চলছে। তাঁর মতে, নতুন ২৩ হাজার সমিতি পুরোনোগুলোর তুলনায় ভালো চলছে।
রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রকল্প: দেশজুড়ে এত বড় এবং এত টাকার প্রকল্প চললেও সরকারি বা বেসরকারি কোনো পর্যায়ে এর সর্বশেষ মূল্যায়ন হয়নি। এমনকি পরীক্ষা-নিরীক্ষা (পাইলটিং) ছাড়াই এত বড় কাজ শুরু হয়ে যায়।
পিপিআরসির নির্বাহী পরিচালক হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের অনেকগুলো সফল প্রকল্পের মধ্যে এটি স্থূল রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের শুরুটাই ছিল ত্রুটিপূর্ণ এবং পাইলটিং ছাড়া বড় বাজেটের এই বিশাল প্রকল্প নেওয়াটাই অন্যায় হয়েছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা বলেন, সুচিন্তিত ও পরিকল্পিত না হওয়ায় এ প্রকল্পের গতি বারবার পরিবর্তন করতে হয়েছে। এর উদ্দেশ্য সুস্পষ্টকরণে চরম দুর্বলতা লক্ষ করা যায়। ফলে গরু-ছাগল দেওয়া শুরু করে তা ক্ষুদ্রঋণে মোড় নেয়, এরপর তা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়লে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের মাধ্যমে কাঠামোবদ্ধ করার চেষ্টা হচ্ছে, যদিও ব্যাংকটি কাজই শুরু করতে পারছে না।
আর শতভাগ সফল বলতে চান না: শতভাগ সফল দাবি করা প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক বলেন, এটা আর বলা ঠিক নয়। শতভাগ সফল হতে চাইলে সমিতির সব সদস্য, প্রকল্পের কর্মী, মাঠ প্রশাসন এবং স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সর্বাত্মক সহযোগিতা দরকার।
এ প্রকল্পের কারণে দারিদ্র্য কমেছে এবং ভবিষ্যতে আরও কমবে—কোনো গবেষণা, মূল্যায়ন বা জরিপ ছাড়া এটা কিসের ভিত্তিতে বলছেন, জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক বলেন, সম্প্রতি কোনো মূল্যায়ন হয়নি, তবে আইএমইডি এটা করার কথা বলেছে।
প্রকল্পের মাঠকর্মীদের বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রশান্ত কুমার বলেন, ওদের নিজের ইউনিয়নে চাকরি দেওয়া হয়েছে, ১০ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হয়। তার পরও ওদের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। এ জন্য ঋণ আদায়ের সক্ষমতার সঙ্গে বেতনের বিষয়টি যুক্ত করে দেওয়া হবে।
No comments