সঙ্কট উত্তরণে বেগম জিয়ার নির্দেশনা by ড. আবদুল লতিফ মাসুম
দ্বন্দ্বনিরসন
তাত্ত্বিক জন ডব্লিউ বার্টন মনে করেন, সমাজ ও রাষ্ট্রে এমন কিছু
দ্বন্দ্ব-বিগ্রহ আছে যা কোনো অ্যাকাডেমিক প্রক্রিয়ায় নিরসন সম্ভব নয়।
‘অ্যাকাডেমিক প্রক্রিয়া’ বলতে তিনি জ্ঞাত সঙ্কট নিরসন কৌশলের প্রায়োগিক
বাস্তবতা বুঝিয়েছেন। তিনি বলেন, এসব ক্ষেত্রে সমঝোতা অসম্ভব। এসব
দ্বন্দ্বকে সম্ভবত ‘যুদ্ধ’ বলাই শ্রেয়। এসব দ্বন্দ্ব নিরসনে
মধ্যস্থতাকারীরা কোনোভাবেই সার্থকতা লাভ করেন না। কবির ভাষায় হয়তো এভাবে
বলা যায়, ‘যত দিন ভবে না হবে না হবে তোমার অবস্থা আমার সম, ঈষৎ হাসিবে বুঝে
না বুঝিবে দেখে না দেখিবে যাতনা মম।’ বাংলাদেশ ‘ভিলেজ পলিটিকস’-এর জন্য
বিখ্যাত। বিশ্বায়নের বদৌলতে গ্রাম যখন বিশ্বের অংশ হয়েছে, তখন বাংলাদেশে
উল্টোটি ঘটেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের ‘ন্যাশনাল পলিটিকস’ ভিলেজ পলিটিকসে পরিণত
হয়েছে। বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে বংশপরম্পরায় মামলা করে করে অনেক বংশকে
নির্বংশ হতে দেখেছি। মামলার নৃশংসতা এত দূর গড়ায় যে, নিজ সন্তানকে হত্যা
করে প্রতিপক্ষের নামে মামলা দিতেও দ্বিধা করা হয় না। মিথ্যাচার, জালিয়াতি ও
প্রতারণার মতো বিষয় খুবই স্বাভাবিক হয়ে দেখা দেয় ভিলেজ পলিটিকসে। এক পক্ষ
যতক্ষণ পর্যন্ত না নিঃশেষ হচ্ছে, ততদিন কোনো সমঝোতা নয়। এ দিকে প্রতিপক্ষের
বারোটা বাজাতে গিয়ে নিজ পক্ষ নিজেদেরই প্রায় বারোটা বাজিয়ে দেয়। এখন যে
কেউ বর্তমান রাজনীতির চালচিত্র বিশ্লেষণ করে ভিলেজ পলিটিকসের বিষয়
বৈশিষ্ট্য দেখতে পাবেন।
অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘ছোট আয়না দিয়েও দেখা যায়; বড় আয়না দিয়েও দেখা যায়।’ ভিলেজ পলিটিকসের ছোট আয়না দিয়ে আমাদের রাজনীতি দেখলাম। এখন বড় আয়নায় ন্যাশনাল পলিটিকস দেখতে চাই। দুই মাস ধরে একপক্ষীয় খুন-গুম, পঙ্গুকরণ, হামলা-মামলা, নিপীড়ন-নির্যাতনে গোটা দেশ অত্যাচারের উপত্যকায় পরিণত হয়েছে। যেখানে সরকারের পক্ষ থেকে এক লাইনের একটি ঘোষণাই সঙ্কট উত্তরণের উপায় হতে পারে, সেখানে অসংখ্য মৃত্যু, অর্থনৈতিক অচলাবস্থা এবং গণযোগাযোগের বিপর্যস্ত অবস্থা সত্ত্বেও সরকারের তরফ থেকে কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যচ্ছে না। সত্য বটে, জনসাধারণকে অবরোধ আন্দোলনের ফলে বেশ কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে। জনগণের এই কষ্টের জন্য কারা দায়ী? সরকার না বিরোধী দল? পাকিস্তানিরা গণতন্ত্রকে হত্যা করে এবং সংলাপকে ষড়যন্ত্রে পরিণত করে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে অনিবার্য করে তুলেছিল। ঠিক তদ্রুপ ক্ষমতাসীনেরা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস অবলম্বন করে সঙ্কটকে অনিবার্য করে তুলছে। অথচ এই সঙ্কটের জন্য দায়ী তারাই। তারা যেমন সঙ্কটের পটভূমি নির্মাণ করেছে, তেমনি বর্তমান আন্দোলনকে বিপজ্জনক অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে।
৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালে যদি তারা বোগাস নির্বাচনটি না করতেন, তাহলে বিরোধী দলকে জনগণের ভোটাধিকার উদ্ধারের আন্দোলনে যেতে হতো না। ‘নিয়ম রক্ষার নির্বাচন’ বলে তারা যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পাঁয়তারা করছেন, তা প্রতিহত করা নাগরিক দায়িত্বে পরিণত হয়েছে। এক বছর সময় দেয়ার পরই বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সরকারকে আলটিমেটাম দিলেন। সাত দফা কর্মসূচি পেশ করলেন। সংলাপের মাধ্যমে খুঁজলেন উত্তরণের উপায়। সমাবেশ করে নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন জোরদার করতে চাইলেন। সরকার আইনানুগ পথে বেগম জিয়াকে হাঁটতে দিলো না। সরকারি হরতাল ডেকে সমাবেশ পণ্ড করা হলো। তাতেও সাধ মিটল না। বিরোধী নেত্রীকে অবরুদ্ধ করা হলো। তার সব যোগাযোগ বন্ধ করা হলো। বিদ্যুতের লাইন কেটে দেয়া হলো। ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হলো গণতন্ত্র। এসব করে সরকারের কোনো অপরাধ হলো না। অপরাধ হলো তখনই, যখন এসব অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে বেগম জিয়া অবরোধ আন্দোলনের ডাক দিলেন। আন্দোলনকে ভায়োলেন্সে পরিণত করার জন্য সরকার তাদের চিরাচরিত শঠকৌশল অবলম্বন করেছে। পেট্রলবোমা দিয়ে আন্দেলনকে বিপথগামী করা হলো। রীতিমতো একটা মানবিক বির্পযয় ঘটল। সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই সরকার বলতে শুরু করল- এসব বিএনপি-জামায়াতের কাজ। নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করার মতো সরকার বিএনপির গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাঝে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসযুদ্ধ বা ‘ওয়ার অব টেরর’ সমকক্ষতা খুঁজে পেল। যে সরকার বন্দুকযুদ্ধের নামে গত দুই মাসে ৬৬ জনকে বিনা বিচারে হত্যা করেছে, মাহমুদুর রহমান মান্নার মতো নেতাকে গুম করার চেষ্টা করেছে এবং বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিনকে অপহরণ করা হয়েছে। তাদের কাছে সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন করা যায়, বিশ্বসন্ত্রাসের সাথে কাদের মিল রয়েছে? গোয়েবলসীয় কায়দায় মিথ্যাচারের মাধ্যমে মিথ্যাকে সত্য আর সত্যকে মিথ্যা করার প্রয়াস পাচ্ছে সরকার। গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর প্রয়াস পাচ্ছে তারা।
এই দুঃসহ সঙ্কট থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে সিভিল সোসাইটি যখন সংলাপের জন্য বারবার আহ্বান জানাল তখন শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে সব নেতা-পাতিনেতা বুদ্ধিজীবীদের গালমন্দ করলেন। বিদেশী কূটনীতিকেরা যখন শান্তির আহ্বান জানালেন, তখন সৈয়দ আশরাফের মতো উঁচু দরের নেতাও তাদের ‘তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী’ বলে উপহাস করলেন। বেগম জিয়া যতবারই সংলাপের আহ্বান জানান, ততবারই তাকে আরো অপমান, আরো অসম্মানের সম্মুখীন হতে হয়েছে। অবশেষে তাকে জেলে পুরার সব আয়োজন সম্পন্ন করে প্রকারান্তরে ‘দ্বিতীয় বাকশাল’ কায়েমের প্রান্তসীমায় উপনীত হয়েছে সরকার। সব ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং সিভিল সোসাইটির আবেদনকে অগ্রাহ্য করে সংলাপের পরিবর্তে দেশকে স্থায়ী সংঘর্ষের দিকে ধাবিত করা হচ্ছে। সংলাপ তো নয়ই, বরং আন্দোলনকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালনার জন্য সভা-সমাবেশ, মিটিং-মিছিলের অনুমতিও পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ পুলিশের ছত্রছায়ায় সরকারি দল সব ধরনের সভা-সমাবেশ করে যাচ্ছে। অপর দিকে বিএনপির সব শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তৃণমূল থেকে রাজধানী পর্যন্ত সব নেতাকর্মীকে গ্রেফতার অথবা বাড়িছাড়া করা হয়েছে। কয়েক হাজার মামলা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশকে রীতিমতো একটি পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে। ‘সব ক’টা জানালা খুলে’ না দিয়ে যে রুদ্ধদ্বার নীতি সরকার অবলম্বন করছে তা অনিবার্যভাবেই একটি ভয়ঙ্কর ঝড়ের আশঙ্কা সৃষ্টি করছে।
এর বিপরীতে, বেগম খালেদা জিয়া আন্দোলনকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে একটি যৌক্তিক পরিণতিতে পৌঁছে দেয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। গত সপ্তাহে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি সঙ্কট উত্তরণের জন্য ১৯৯৬ সালের মতো সংবিধান সংশোধন করে নতুন নির্বাচনের পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। বেগম জিয়া আরো বলেন, এখন শেখ হাসিনা যদি তার আবার নির্বাচন করার অঙ্গীকার পূরণ করেন তাহলেই দেশে শান্তি, স্বস্তি ও সমঝোতার পরিবেশ ফিরে আসবে। তিনি আন্দোলন কর্মসূচির পাশাপাশি সংলাপ-সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য তিন দফা প্রস্তাব পেশ করেছেন। ১. গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনের নামে সারা দেশে গ্রেফতারকৃত নেতাকর্মীদের অবিলম্বে মুক্তি দেয়া, গুম-খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা, পুলিশ ও যৌথবাহিনীর হয়রানি বন্ধ করা, সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা এবং বিচারবহির্ভূত প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি প্রদান। ২. সভা সমাবেশ ও মিছিলসহ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর আরোপিত সব ধরনের বিধিনিষেধ অবিলম্বে প্রত্যাহার। ৩. সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সরকারের অধীনে অবিলম্বে জাতীয় সংসদের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দ্রুত সংলাপের আয়োজন করা। বিএনপি চেয়ারপারসন স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে এবং গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা ২০ দলীয় জোটপ্রধান বেগম খালেদা জিয়ার এই বক্তব্যকে সঙ্কট উত্তরণের একটি নিয়মতান্ত্রিক ফর্মুলা বলে মনে করেন। তারা বলেন, তিনি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বল সরকারের কোর্টে ছুড়ে দিয়েছেন। দেশের শীর্ষস্থানীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ সঙ্কটের নিয়মতান্ত্রিক উত্তরণ না ঘটলে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা ব্যক্ত করেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা আরো মনে করেন, বেগম জিয়ার ওই প্রস্তাবের মধ্যে সমঝোতার আভাস রয়েছে। বিশ্লেষকেরা আরো বলেন, সমঝোতা না হলে দেশে কর্তৃত্ববাদী সরকার প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা রয়েছে। এ দিকে জাতিসঙ্ঘ আবারো সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে। অপর দিকে, প্রধানমন্ত্রী আগের মতোই অনড় থেকে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন- জঙ্গি নেত্রীর সাথে কিসের সংলাপ? তবে খালেদার অনড় অবস্থানে অওয়ামী লীগ আশাহত হয়েছে বলে সংবাদ ভাষ্যে প্রকাশ।
অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘ছোট আয়না দিয়েও দেখা যায়; বড় আয়না দিয়েও দেখা যায়।’ ভিলেজ পলিটিকসের ছোট আয়না দিয়ে আমাদের রাজনীতি দেখলাম। এখন বড় আয়নায় ন্যাশনাল পলিটিকস দেখতে চাই। দুই মাস ধরে একপক্ষীয় খুন-গুম, পঙ্গুকরণ, হামলা-মামলা, নিপীড়ন-নির্যাতনে গোটা দেশ অত্যাচারের উপত্যকায় পরিণত হয়েছে। যেখানে সরকারের পক্ষ থেকে এক লাইনের একটি ঘোষণাই সঙ্কট উত্তরণের উপায় হতে পারে, সেখানে অসংখ্য মৃত্যু, অর্থনৈতিক অচলাবস্থা এবং গণযোগাযোগের বিপর্যস্ত অবস্থা সত্ত্বেও সরকারের তরফ থেকে কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যচ্ছে না। সত্য বটে, জনসাধারণকে অবরোধ আন্দোলনের ফলে বেশ কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে। জনগণের এই কষ্টের জন্য কারা দায়ী? সরকার না বিরোধী দল? পাকিস্তানিরা গণতন্ত্রকে হত্যা করে এবং সংলাপকে ষড়যন্ত্রে পরিণত করে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে অনিবার্য করে তুলেছিল। ঠিক তদ্রুপ ক্ষমতাসীনেরা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস অবলম্বন করে সঙ্কটকে অনিবার্য করে তুলছে। অথচ এই সঙ্কটের জন্য দায়ী তারাই। তারা যেমন সঙ্কটের পটভূমি নির্মাণ করেছে, তেমনি বর্তমান আন্দোলনকে বিপজ্জনক অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে।
৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালে যদি তারা বোগাস নির্বাচনটি না করতেন, তাহলে বিরোধী দলকে জনগণের ভোটাধিকার উদ্ধারের আন্দোলনে যেতে হতো না। ‘নিয়ম রক্ষার নির্বাচন’ বলে তারা যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পাঁয়তারা করছেন, তা প্রতিহত করা নাগরিক দায়িত্বে পরিণত হয়েছে। এক বছর সময় দেয়ার পরই বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সরকারকে আলটিমেটাম দিলেন। সাত দফা কর্মসূচি পেশ করলেন। সংলাপের মাধ্যমে খুঁজলেন উত্তরণের উপায়। সমাবেশ করে নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন জোরদার করতে চাইলেন। সরকার আইনানুগ পথে বেগম জিয়াকে হাঁটতে দিলো না। সরকারি হরতাল ডেকে সমাবেশ পণ্ড করা হলো। তাতেও সাধ মিটল না। বিরোধী নেত্রীকে অবরুদ্ধ করা হলো। তার সব যোগাযোগ বন্ধ করা হলো। বিদ্যুতের লাইন কেটে দেয়া হলো। ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হলো গণতন্ত্র। এসব করে সরকারের কোনো অপরাধ হলো না। অপরাধ হলো তখনই, যখন এসব অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে বেগম জিয়া অবরোধ আন্দোলনের ডাক দিলেন। আন্দোলনকে ভায়োলেন্সে পরিণত করার জন্য সরকার তাদের চিরাচরিত শঠকৌশল অবলম্বন করেছে। পেট্রলবোমা দিয়ে আন্দেলনকে বিপথগামী করা হলো। রীতিমতো একটা মানবিক বির্পযয় ঘটল। সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই সরকার বলতে শুরু করল- এসব বিএনপি-জামায়াতের কাজ। নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করার মতো সরকার বিএনপির গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাঝে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসযুদ্ধ বা ‘ওয়ার অব টেরর’ সমকক্ষতা খুঁজে পেল। যে সরকার বন্দুকযুদ্ধের নামে গত দুই মাসে ৬৬ জনকে বিনা বিচারে হত্যা করেছে, মাহমুদুর রহমান মান্নার মতো নেতাকে গুম করার চেষ্টা করেছে এবং বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিনকে অপহরণ করা হয়েছে। তাদের কাছে সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন করা যায়, বিশ্বসন্ত্রাসের সাথে কাদের মিল রয়েছে? গোয়েবলসীয় কায়দায় মিথ্যাচারের মাধ্যমে মিথ্যাকে সত্য আর সত্যকে মিথ্যা করার প্রয়াস পাচ্ছে সরকার। গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর প্রয়াস পাচ্ছে তারা।
এই দুঃসহ সঙ্কট থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে সিভিল সোসাইটি যখন সংলাপের জন্য বারবার আহ্বান জানাল তখন শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে সব নেতা-পাতিনেতা বুদ্ধিজীবীদের গালমন্দ করলেন। বিদেশী কূটনীতিকেরা যখন শান্তির আহ্বান জানালেন, তখন সৈয়দ আশরাফের মতো উঁচু দরের নেতাও তাদের ‘তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী’ বলে উপহাস করলেন। বেগম জিয়া যতবারই সংলাপের আহ্বান জানান, ততবারই তাকে আরো অপমান, আরো অসম্মানের সম্মুখীন হতে হয়েছে। অবশেষে তাকে জেলে পুরার সব আয়োজন সম্পন্ন করে প্রকারান্তরে ‘দ্বিতীয় বাকশাল’ কায়েমের প্রান্তসীমায় উপনীত হয়েছে সরকার। সব ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং সিভিল সোসাইটির আবেদনকে অগ্রাহ্য করে সংলাপের পরিবর্তে দেশকে স্থায়ী সংঘর্ষের দিকে ধাবিত করা হচ্ছে। সংলাপ তো নয়ই, বরং আন্দোলনকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালনার জন্য সভা-সমাবেশ, মিটিং-মিছিলের অনুমতিও পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ পুলিশের ছত্রছায়ায় সরকারি দল সব ধরনের সভা-সমাবেশ করে যাচ্ছে। অপর দিকে বিএনপির সব শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তৃণমূল থেকে রাজধানী পর্যন্ত সব নেতাকর্মীকে গ্রেফতার অথবা বাড়িছাড়া করা হয়েছে। কয়েক হাজার মামলা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশকে রীতিমতো একটি পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে। ‘সব ক’টা জানালা খুলে’ না দিয়ে যে রুদ্ধদ্বার নীতি সরকার অবলম্বন করছে তা অনিবার্যভাবেই একটি ভয়ঙ্কর ঝড়ের আশঙ্কা সৃষ্টি করছে।
এর বিপরীতে, বেগম খালেদা জিয়া আন্দোলনকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে একটি যৌক্তিক পরিণতিতে পৌঁছে দেয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। গত সপ্তাহে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি সঙ্কট উত্তরণের জন্য ১৯৯৬ সালের মতো সংবিধান সংশোধন করে নতুন নির্বাচনের পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। বেগম জিয়া আরো বলেন, এখন শেখ হাসিনা যদি তার আবার নির্বাচন করার অঙ্গীকার পূরণ করেন তাহলেই দেশে শান্তি, স্বস্তি ও সমঝোতার পরিবেশ ফিরে আসবে। তিনি আন্দোলন কর্মসূচির পাশাপাশি সংলাপ-সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য তিন দফা প্রস্তাব পেশ করেছেন। ১. গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনের নামে সারা দেশে গ্রেফতারকৃত নেতাকর্মীদের অবিলম্বে মুক্তি দেয়া, গুম-খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা, পুলিশ ও যৌথবাহিনীর হয়রানি বন্ধ করা, সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা এবং বিচারবহির্ভূত প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি প্রদান। ২. সভা সমাবেশ ও মিছিলসহ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর আরোপিত সব ধরনের বিধিনিষেধ অবিলম্বে প্রত্যাহার। ৩. সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সরকারের অধীনে অবিলম্বে জাতীয় সংসদের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দ্রুত সংলাপের আয়োজন করা। বিএনপি চেয়ারপারসন স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে এবং গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা ২০ দলীয় জোটপ্রধান বেগম খালেদা জিয়ার এই বক্তব্যকে সঙ্কট উত্তরণের একটি নিয়মতান্ত্রিক ফর্মুলা বলে মনে করেন। তারা বলেন, তিনি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বল সরকারের কোর্টে ছুড়ে দিয়েছেন। দেশের শীর্ষস্থানীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ সঙ্কটের নিয়মতান্ত্রিক উত্তরণ না ঘটলে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা ব্যক্ত করেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা আরো মনে করেন, বেগম জিয়ার ওই প্রস্তাবের মধ্যে সমঝোতার আভাস রয়েছে। বিশ্লেষকেরা আরো বলেন, সমঝোতা না হলে দেশে কর্তৃত্ববাদী সরকার প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা রয়েছে। এ দিকে জাতিসঙ্ঘ আবারো সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে। অপর দিকে, প্রধানমন্ত্রী আগের মতোই অনড় থেকে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন- জঙ্গি নেত্রীর সাথে কিসের সংলাপ? তবে খালেদার অনড় অবস্থানে অওয়ামী লীগ আশাহত হয়েছে বলে সংবাদ ভাষ্যে প্রকাশ।
ড. আবদুল লতিফ মাসুম লেখক : প্রফেসর জা: বিশ্ববিদ্যালয় |
‘বিনাশকালে
বিপরীত বুদ্ধি’ বলে একটি প্রবাদ আছে। সরকার সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি
চেয়ারপারসন এবং ২০ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ব্যক্তিত্ব, মর্যাদা ও
জনপ্রিয়তার কথা জানে না এমন নয়। পক্ষকাল আগে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন,
‘খালেদা জিয়া গ্রেফতার হতে চাচ্ছেন, জনগণের সহানুভূতি পাওয়ার জন্য।’
গ্রেফতারের রাজনৈতিক তাৎপর্যই প্রধানমন্ত্রীর কথায় ফুটে উঠেছে। এ সপ্তাহে
তিনি বলেছেন, ‘ওনার (খালেদা জিয়া) বিরুদ্ধে সমন জারি হয়েছে। তিনি যেন
কোর্টে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। সেটাই ওনার কল্যাণ। নইলে সরকার কোর্টের
নির্দেশ পালনে বাধ্য হবে। ওনার স্থান ওখানেই।’ স্মরণ করা যেতে পারে,
প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেছিলেন, খালেদা জিয়া মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার মতো
অপরাধ করেছেন। তাহলে সহজেই বোঝা যায়, রাষ্ট্রযন্ত্রের সব হিংসা, ক্রোধ এবং
পাশবিকতা কার বিরুদ্ধে পরিচালিত? বাংলাদেশের রাজনীতিতে ২৫ বছর ধরে বেগম
খালেদা জিয়া অনন্য বৈশিষ্ট্য, কর্তৃত্ব এবং মহত্ত্বে¡ সমাসীন। তিনি
স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আপসহীন নেত্রী। এই রাষ্ট্র তরীর সফল
কাণ্ডারি তিনি। শহীদ জিয়ার আবেগময় উত্তরাধিকার তিনি বহন করেন। ‘টেকনাফ
থেকে তেঁতুলিয়া, খালেদা জিয়া আছেন দেশ জুড়িয়া’। এভাবে বেগম খালেদা জিয়া হয়ে
উঠেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। গণতন্তের অতন্দ্র
প্রহরী। সুতরাং তাকে স্পর্শ করা অত সহজ নয়। যেকোনো অনভিপ্রেত সিদ্ধান্ত
ক্ষমতাসীন সরকারের জন্য বুমেরাং হয়ে উঠবে। বিনাশকালে যদি সত্যি সত্যিই
‘বিপরীত বুদ্ধি’ হয়, তাহলে তা ক্ষমতাসীন সরকারেরই বিনাশ ডেকে আনতে পারে।
No comments