বেপরোয়া অপরাধে যুক্ত সাঈদের তিন ঘাতক by ওয়েছ খছরু
‘ক্ষমতাই’
এক করেছিল সিলেটের স্কুলছাত্র আবু সাঈদের ৩ ঘাতককে। অপরাধের ঘটনাপ্রবাহে
তারা বেঁধেছিল জোট। দাপট দেখিয়েছে প্রশাসনে। সিলেটের ‘অপরাধ জোন’-এ তারা
ছিল বেপরোয়া। পুলিশ কনস্টেবল হওয়ায় এবাদুরের কোন ভয় ছিল না। র্যাব’র সোর্স
আতাউর রহমান গেদা মিয়ার দাপটের কাছে অনেকেই ছিলেন অসহায়। আর ওলামা লীগের
জেলার সাধারণ সম্পাদক রাকিব ‘রাজনৈতিক’ ছত্রছায়ায় ছিল লাগামহীন। ‘ওলামা
লীগ’ পরিচয়েই সে প্রশাসনে কর্তৃত্ব খাটাত একতরফা। আর এই তিনজনের সমন্বিত
‘অপরাধ সিন্ডিকেট’র কবলে পড়ে প্রাণ গেল নিষ্পাপ শিশু আবু সাঈদের। তাদের
প্রভাব এতোটাই প্রসারিত হয়েছিল যে, অপহরণ করে খুন করাটাই যেন তাদের কাছে
‘ডাল-ভাত’। কখনও ধরা পড়বে না, কিংবা পড়লেও কুলিয়ে নিতে পারবে- এমন মনোভাবের
কারণেই শিশু সাঈদের লাশ লুকিয়ে রেখেছিল পুলিশ কনস্টেবলের বাসার দু’তলার
চিলেকোঠায়। সিলেটের ঝর্ণারপাড়, ঝেরঝেরি পাড়ায় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, খুনের
ঘটনার পর ঘাতক পুলিশ কনস্টেবল এবাদুরের সঙ্গে দেখা হয়েছিলো স্কুলছাত্র আবু
সাঈদের মামাদের। ওই সময় এবাদুর নিজ থেকেই অপহৃত আবু সাঈদের খোঁজার ব্যাপারে
কথা বলে। পাশাপাশি সার্বিক সহায়তা করারও আশ্বাস দেয়। আর র্যাব’র কথিত
সোর্স গেদা মিয়াও খুনের ঘটনার পর নিহত আবু সাঈদের পরিবারের কাছে গিয়েছে।
নিয়েছে খোঁজ-খবর। তারা জানান, খুনের ঘটনার পরও গ্রেপ্তার হওয়া তিন ঘাতক ছিল
স্বাভাবিক। তাদের চলাফেরায় কিংবা আচার-আচরণে কখনোই অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য
করা যায়নি। পুলিশ জানিয়েছে, ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে আবু সাঈদকে। আর
খুনের ঘটনার পর কনস্টেবল এবাদুরের মোবাইল সেটে লাগানো নতুন সিম নম্বর দিয়ে
দুই লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা ছিল। এ কারণে বৃহস্পতিবার রাতেও
খুনিরা দুই লাখ টাকার জন্য স্বজনদের কাছে ফোন দিয়েছিল। পুলিশের এক
কর্মকর্তা জানান, খুনের পর লাশ গুম করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছে তিন ঘাতক।
সিলেট জেলা ওলামা লীগের সাধারণ সম্পাদক রাকিবের পুরো নাম নুরুল ইসলাম
রাকিব। তার মূল বাড়ি ওসমানীনগর থানার আনোয়ারপুর গ্রামে। তার পিতা শফিক
মিয়া। সিলেট নগরীর শাহ্পরাণ নিপবন আবাসিক এলাকার বসবাস করতো সে। আর
র্যাব’র কথিত সোর্স গেদা মিয়ার পুরো নাম আতাউর রহমান গেদা। তার মূল বাড়ি
ছাতক উপজেলার মঈনপুর গ্রামে। তার পিতা মৃত হাবিবুর রহমান। সিলেট নগরীর
ঝর্ণারপাড় আবাসিক এলাকার ৭২ নম্বর বাসার নিচ তলায় সে বসবাস করতো। পুলিশ
কনস্টেবল এবাদুরের পুরো নাম এবাদুর রহমান। সে জকিগঞ্জ উপজেলার বল্লা
গ্রামের মৃত আবদুল খালেকের পুত্র। সর্বশেষ সে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের
এয়ারপোর্ট থানার কনস্টেবল ছিল। (কং-৯৩৯)। ওদের তিনজনের বাড়ি দূরবর্তী তিন
উপজেলায়। কারও সঙ্গে কারও আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই। এরপরও অপরাধ প্রবাহে তারা
বেঁধেছিল জোট। তাদের অপরাধজালে পড়ে অনেকেই হয়েছেন হয়রানির শিকার। কিন্তু
ক্ষমতার দাপটের কারণে তিনজনের বিরুদ্ধে মুখ খুলতো না কেউ। এলাকার লোকজন
জানিয়েছেন, পুলিশ কনস্টেবল এবাদুর ও সোর্স গেদা মিয়া একই এলাকায় বসবাস
করতো। তাদের সঙ্গে এলাকায় আসতো ওলামা লীগের সাধারণ সম্পাদক রাকিবও। পুলিশি
ঝামেলা, গ্রেপ্তারের ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতো না। তবে, তিনজনের
কার্যকলাপই আড়চোখে দেখতেন এলাকার লোকজন। আতাউর রহমান গেদা মিয়া প্রথমে ছিল
ছিঁচকে ছিনতাইকারী ও পকেটমার। নগরীর সুরমা মার্কেট ও আশপাশের এলাকায় গেদা
মিয়া পরিচিত মুখ। এক সময় পকেট চুরি করে চলতো তার সংসার। এ কারণে গেদা অনেক
বছর আগে থেকেই সুরমা মার্কেট এলাকার ক্রাইমজোনের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে। এক
সময় সেও সুরমা মার্কেটের ক্রাইম সিন্ডিকেটের সঙ্গে মিশে যায়। ফলে ওই সময়
থেকে মাঠপর্যায়ের পুলিশের সঙ্গে তার সংখ্য গড়ে ওঠে। পুলিশি ঝামেলা এড়াতে সে
পুলিশের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করে। শুরু করে সোর্সগিরি। সোর্সগিরির
পাশাপাশি গেদা মিয়া কীনব্রিজ থেকে বন্দরবাজার এলাকায় ছিনতাই শুরু করে।
রিকশা ড্রাইভার, শহরে আসা গ্রামের মানুষদের ধারালো ছুরি দেখিয়ে সর্বস্ব
লুটে নিতো। এ সময় পুলিশের হাতে সে কয়েকবার আটকও হয়েছিল। ৩-৪ বছর ধরে বদলে
গেছে গেদা মিয়া। পকেটমার ও চুরি ছেড়ে দিয়ে সে পুরোপুরি পুলিশ ও র্যাব’র
সোর্স হিসেবে কাজ শুরু করে। এ কারণে বন্দরবাজার এলাকার ব্যবসায়ী ও বৃহত্তর
কুমারপাড়া এলাকার মানুষ গেদা মিয়াকে র্যাব’র সোর্স হিসেবেই চিনতো।
কখনো-কখনো গেদা মিয়া নিজেকে র্যাব’র সোর্স বলে পরিচয় দিতো। তার পরিবারের
সদস্যরাও গেদা মিয়াকে র্যাব সদস্য হিসেবে পরিচয় দিতো বলে স্থানীয় লোকজন
জানিয়েছেন। আর এ সোর্সগিরি করে সে দুই হাতে কামাই করতো টাকা। বর্তমান
সরকারের শুরুতে নগরীর জিন্দাবাজারে এক যুবলীগ নেতাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী
বাহিনীর এক সদস্যকে নিয়ে মারধর করে গেদা মিয়া। পরবর্তীতে পুলিশ গেদা মিয়াকে
আটক করেছিল। বন্দরবাজার ফাঁড়িতে নিয়ে তাকে পুলিশ মারধর করে। সন্ধ্যার পর
নগরীর বন্দরবাজার এলাকায় অবস্থান নিতো গেদা মিয়া। ওই এলাকার হেরোইন, গাঁজা,
ইয়াবা ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করতো সে। লালাবাজারের দু’টি হোটেলে ছিল তার
আস্তানা। ওখানে বসে সে মাদক ব্যবসার টাকা ভাগ-ভাটোয়ারা করতো। পুলিশ ও
র্যাব‘র সোর্স পরিচয়ে সে ওই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করলেও সব সময় ছিল ধরা-ছোঁয়ার
বাইরে। সামপ্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গেদা মিয়া ছিলো বেপরোয়া। সিলেটের
কোতোয়ালি থানা, এয়ারপোর্ট থানাসহ কয়েকটি ফাঁড়িতে ছিল তার পরিচিত কয়েকজন
পুলিশ সদস্য। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ অনেককেই আটক করে। পরবর্তীতে
টাকার বিনিময়ে তারা ছাড়া পায়। আর এই টাকার একটি ভাগও পেতো গেদা মিয়া।
গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে গেদা মিয়া কুমারপাড়া, ঝর্ণার পাড়, ঝেরঝেরিপাড়ার
কয়েকজনের কাছ থেকেও টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। পুলিশ সদস্য এবাদুর রহমান
এয়ারপোর্ট থানায় থাকলেও সে এলাকার ছিল বেশ প্রভাবশালী। স্থানীয়রা
জানিয়েছেন, পুলিশ কনস্টেবল এবাদুর রহমান সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতক। এবাদুরের
সঙ্গে নিহত হওয়া স্কুলছাত্র সাঈদের পরিবারের সম্পর্ক ছিল খুব কাছের। কোন
আত্মীয়তার সম্পর্ক না হলেও দুই বছর আগে এবাদুর স্ত্রীকে নিয়ে নিহত সাঈদদের
বাসায় সাবলেট হিসেবে থাকতো। সেই সুবাদে তাদের মধ্যে পারিবারিকভাবে সম্পর্কও
গড়ে ওঠে। ফলে এবাদুরকে অনেক আগে থেকেই চিনতো স্কুলছাত্র সাঈদ। ডাকতো মামা
বলে। এবাদুর সাবলেট থাকার সময় সোর্স গেদা মিয়া যাতায়াত করতো সাঈদদের বাসায়।
ফলে গেদা মিয়া সাঈদের পরিবারের কাছে অপরিচিত ছিল না। পুলিশ সদস্য হওয়ার
কারণে যুক্তরাজ্য প্রবাসী আনোয়ারা বেগম বাসার কেয়ারটেকার হিসেবে এবাদুরের
হাতে বাসার দায়িত্ব দিয়ে যান। পুলিশি দায়িত্ব পালনকালেও এবাদুরের কর্মকাণ্ড
ভাল নয়। আগে বন্দরবাজার এলাকার বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে এবাদুরের সম্পর্ক
ছিল। সেই সুবাদে গেদার সঙ্গে এবাদুরের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। গেদা ও এবাদুর
মিলে গ্রেপ্তার নাটক সাজিয়ে অনেকের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে
জানিয়েছেন এলাকাবাসী। ওলামা লীগে যোগ দেয়ার পর নগরীর বেশ কয়েকটি অপরাধজোনের
সঙ্গে রাকিবের সম্পর্ক ছিল ভাল। রাকিবের বাড়ি ওসমানীনগরে হলেও সে দীর্ঘদিন
বসবাস করে মৌলভীবাজারে তার নানার বাড়িতে। নানার বাড়ি থেকে সে সিলেটে পাড়ি
জমিয়েছিল বলে জানিয়েছেন ওসমানীনগর আনোয়ারপুর গ্রামের বাসিন্দারা। বিভিন্ন
সরকারি অফিস-আদালতে নিজেকে সরকারি দলের লোক বলে পরিচয় দিতো সে। সেই সুবাদে
এবং ওলামা লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে রাকিব একাংশের সাধারণ
সম্পাদকের পদটি লুফে নেয়। আর পদ লুটে নেয়ার পরপরই সে হয়ে ওঠে বেপরোয়া।
নিজেকে সরকারদলীয় লোক পরিচয় দিয়ে থানা থেকে আসামি ছাড়িয়ে আনাসহ নানা কাজে
সে ছিল পটু। সেই সুবাদে তার সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক হয় র্যাব‘র কথিত
সোর্স গেদা মিয়ার। পরবর্তীতে পুলিশ কনস্টেবল এবাদুরের সঙ্গেও ভাল সম্পর্ক।
তিনজন একসঙ্গে মিলে নিরীহ মানুষকে ধরপাকড় ও পরবর্তীতে টাকার বিনিময়ে ছাড়িয়ে
আনাসহ নানা ঘটনা ঘটিয়েছে। এই তিনজনের সিন্ডিকেটে গেদা মিয়ার আরও এক সহযোগী
ছিল। তবে, তার নাম পাওয়া যায়নি। সেও পুলিশের সোর্স বলে জানিয়েছে এলাকার
মানুষ। আর রাকিবের সঙ্গে সব সময় থাকতো ওলামা লীগের প্রচার সম্পাদক এম.
মহিবুল ইসলাম ওরফে মাহিবুল ইসলাম মাছুম। মাছুম নগরীর কুয়ারপাড় এলাকায় বসবাস
করতো বলে জানা গেছে। তার মূল বাড়ি নগরীর শিবগঞ্জ এলাকায়। স্কুলছাত্র খুনের
সঙ্গে ওলামা লীগের আরেক নেতা মাছুম সরাসরি জড়িত রয়েছে বলে পুলিশকে
জানিয়েছে রাকিব। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি মিডিয়া মো. রহমতুল্লাহ
গতকাল মানবজমিনকে জানিয়েছেন, গ্রেপ্তার হওয়া এবাদুর, রাকিব ও গেদার মধ্যে
সম্পর্ক খুবই ভাল। তারা একে-অপরকে চিনতো ভালভাবে। গ্রেপ্তারের পর তারা
পুলিশের কাছে এ বিষয়টি স্বীকার করেছে। গ্রেপ্তারের পর রাকিব ও এবাদুর রহমান
সবকিছু স্বীকার করলেও সোর্স গেদা মিয়া খুবই চালাক। সে পুলিশকে নানাভাবে
বিভ্রান্তির চেষ্টা চালায়। এ কারণে তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা
হচ্ছে। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে রাকিব ও
এবাদুরের মুখ থেকে গেদা মিয়ার জড়িত থাকার বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। কিন্তু
চালাকি করে ঘটনা থেকে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছে সোর্স গেদা। আর
পলাতকদের গ্রেপ্তারে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে বলে জানান তিনি।
No comments