ভাটির দেশ ও আমাদের চিরায়ত সাহিত্য by নজরুল ইসলাম সৃজন
পাল রাজত্ব বা চর্যাপদের উদ্ভবকাল থেকে
শুরু করে ভাটিরাজ্যের পরিবেশ প্রকৃতি বাংলাসাহিত্যে বিশেষ গুরুত্ব লাভ
করেছে। সম্ভবত অষ্টম শতকের শুরুতেই এখানে কোচ, হাজং, গারো ও অন্যান্য
নিুবর্ণের মানুষের বসত গড়ে ওঠে। কবি অনন্তরাম দত্তের পরিচয় জ্ঞাপক শ্লোকে
এসব বসতির প্রমাণ মেলে। আমাদের প্রাচীন সাহিত্য যেন সেই অভাবতাড়িত মানুষের
কথা মনে করিয়ে দেয়। সময়ের বিবর্তনে এসব এলাকা বিরানভূমিতে পরিণত হয়। জন্ম
হয় হাওর-নদী ও খাল-বিলকে ঘিরে এক নতুন কৃষ্টির। মানুষের জীবনবোধ ও নদীর
শাশ্বত ধারায় বয়ে চলে। শুরু হয় অস্তিত্বের সংগ্রাম। এ বিচিত্র ও
সংগ্রামমুখর জীবনে চড়াও হয় জমিদার-মহাজন এবং দেওয়ানরা। তাদের প্রচণ্ড
অহংবোধ ও প্রতারণা মানুষের সেই গতি থামাতে পারে না। রাখালিয়া বাঁশি ও
মাঝি-মাল্লার ভাটিয়ালি সুর ক্ষণিকের সান্ত্বনা দেয়। হৃদয়ে জাগিয়ে তোলে এক
গভীর অনুভূতি। মূর্ত হয়ে উঠে যুবতী প্রেম আর নারী জীবনের দুঃখ-দুর্দশা,
ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সর্বস্ব সমর্পণের অপরূপ মাহিমা। তাইতো, প্রেমের আকুল
মিনতি কুমারী মেয়ের মনকে উতলা করে। এক মহিমান্বিত ত্যাগের মধ্য দিয়ে
চিরভাস্বর হয়ে তাদের প্রেমানুভূতি। সতী বেহুলা মৃত স্বামী লক্ষ্মীন্দরকে
নিয়ে নদীতে ভেলা ভাসায়। মনসার মন জয় করে ফিরিয়ে আনে মৃতের জীবন।
স্ত্রী-দেবতা মনসাকে নিয়ে কাহিনীকাব্য এখানকার মানুষের চেতনায় ঠাঁই পায়।
মনসার গানে মুগ্ধ হয় মানুষ। মনসামঙ্গলের প্রধান কবি দ্বীজবংশীদাসের জন্ম
কিশোরগঞ্জের পাটোয়ারী গ্রামে। তিনি গ্রামে গ্রামে মনসার গান গেয়ে বেড়াতেন।
মনসামঙ্গলের শ্রেষ্ঠ কবি নারায়ণ দেবের জন্ম তাড়াইল থানার বোর গ্রামে। তিনি
সংস্কৃত পুরাণের কাহিনী শুনে চাঁদ সওদাগরের উপাখ্যানাদি অবলম্বনে পদ্মপুরাণ
রচনা করেন। তার কাব্যের সুর এতই শ্রুতিমধুর হয়ে উঠে যে, লক্ষ্মীন্দরের
খেদোক্তি, বেহুলার বিলাপ, ধনাই-মনাইয়ের লালসা-লোলুপ দৃষ্টি হতে বেহুলার
আত্মরক্ষার কাহিনী শুনলে এক পাষাণ হৃদয়ও করুণায় আর্দ্র হয়ে ওঠে। শুধু মনসা
নয়, রাধাকৃষ্ণের কল্পিত কাহিনীকে ঘিরে গড়ে ওঠা পদাবলী সাহিত্যও জনমানসে
বিস্তার লাভ করেছিল। এখানকার কবি মাধবাচার্য শ্রী চৈতন্যদেবের সমসাময়িক ও
শিষ্য ছিলেন। তার রচিত প্রধান দুটি কাব্যগ্রন্থ চন্ডীকাব্য ও শ্রীকৃষ্ণ
বিজয়। ড. দীনেশ চন্দ্র সেন মাধবাচার্যপকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুকুন্দরামের
চেয়ে শ্রেষ্ঠ কবি বলে বর্ণনা করেছেন। এখানকার কবি কৃষ্ণদাস বিষ্ণুভক্তি
রতœাবলীর পদ্যানুবাদে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। কটিয়াদী থানার ভিটাদিয়া
গ্রামের বৈদ্য রঘুনাথ দাস ও কবি নিত্যানন্দ দাস শ্রী চৈতন্যদেবের সমসাময়িক
কবি। বৈদ্য রঘুনাথ দাসের বিখ্যাত গ্রন্থ স্বরূপচরিত। এ কাব্যে শ্রী
চৈতন্যদেবের কিশোরগঞ্জ জেলায় আগমনসহ প্রাচীন তত্ত্বের সন্ধান পাওয়া যায়।
এছাড়া মধ্যযুগে অনুবাদ সাহিত্য ব্যাপক গতি লাভ করেছিল। বাজিতপুর থানার সাহাপুরের কবি অনন্তরামদত্ত প্রাচীন কবিদের মধ্যে, বিশেষ করে অনুবাদ কাব্যে প্রাতঃস্মরণীয়। এ পথে এগিয়ে এসেছিলেন বাংলাসাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতী। তিনি এলাকার স্বল্প শিক্ষিত লোকের উপযোগী করে রামায়ণের অংশমাত্র রচনা করেছিলেন। কটিয়াদীর কবি রামেশ্বর নন্দী ও কবি সঞ্জয় বাংলাভাষায় মাহাভারত রচনা করেছিলেন। সঞ্জয়ের মহাভারত অধিকতর সরল ভাষায় লিখিত বলে বেশি প্রচার লাভ করেছিল। কবি গঙ্গানারায়ণের সমসাময়িকক কবি ছিলেন জগন্নাথ দাস। উভয়ের জন্মস্থান নিকলী থানার ধারিশ্বরে। সাধক জগন্নাথ দাস দুর্গাপুরাণ রচনা করেছিলেন। তবে চন্দ্রাবতীর রচনায় রামায়ণের কোনো পুঁথি পাওয়া যায়নি। মহিলা কণ্ঠ থেকে সংগৃহীত হয়েই তা আমাদের পূর্ববঙ্গ গীতিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কবি চন্দ্রাবতী বাল্যকাল থেকে কবিতা রচনায় মনোযোগী হয়ে ওঠলেও রামায়ণ রচনার উদ্দেশ্য স্বতঃস্ফূর্ত নয়। চন্দ্রাবতী পরমা সুন্দরী ছিলেন। নয়ান ঘোষের বর্ণনায়, তার রূপ ও গুণের খ্যাতি শুনে অনেক সম্ভ্রান্ত ব্যক্ত তার পানি গ্রহণে ইচ্ছুক হতো। চন্দ্রার প্রার্থেব প্রেমিক ছিলেন ছেলেবেলার সঙ্গী পার্শ্ববর্তী গ্রামের জয়ানন্দ নামক এক ব্রাহ্মণ যুবক। চন্দ্রা ও জয়ানন্দের বিবাহ প্রস্তাবে সম্মত হয়ে কবি দ্বীজবংশীদাস বিবাহের যাবতীয় আয়োজনে মন দেন। এরই মাঝে ঘটে যায় আরেক ঘটনা। জয়ানন্দ মুসলিম রমণী কমলার প্রেমে ধর্মান্তরিত হয়ে ঘর বাঁধেন। এতে চন্দ্রাবতী দারুণভাবে ভেঙে পড়েন। তিনি ফুলেশ্বরী নদীর তীরে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা ও চিরকুমারী থাকার প্রার্থনা জানালে পিতা তার দুটি ইচ্ছাই মেনে নিলেন। উপরন্তু চন্দ্রাবতী যাতে নিদারুণ আঘাতে একেবারে মুষড়ে না পড়েন সেজন্য তার মনকে অন্যদিকে নির্দিষ্ট করার লক্ষ্যে রামায়ণ রচনার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে জয়ানন্দ তার ভুল বুঝতে পেরে চন্দ্রাকে একনজর দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেন। অভিমানী চন্দ্রা তার শেষ ইচ্ছা পূরণে অসম্মতির কথা লিখে জানান। পত্র পাঠে জয়ানন্দ পাগলপারা হয়ে মন্দিরের কাছে উপস্থিত হন। চন্দ্রা তাকে শূন্য হাতে ফিরিয়ে দেন। হতভাগা জয়ানন্দ রুদ্ধদ্বার মন্দিরের আঙ্গিনায় সদ্যফোটা সন্ধ্যামালতী ফুলের রস নিংড়িয়ে কপাটের ওপর চারছত্র কবিতা লিখে যান।
শৈশবকালের সঙ্গী তুমি যৌবনকালের সাথী।
অপরাধ ক্ষমা কর তুমি চন্দ্রাবতী।
পাপিষ্ঠ জানিয়া মোরে না হইলে সম্মত
বিদায় মাগি চন্দ্রাবতী জনমের মত।
চন্দ্রাবতী এ লেখা দেখে তা ধুয়ে-মুছে ফেলার জন্য নদীর ঘাটে জল আনতে
পা বাড়ান। সেখানেও চারছত্র কবিতা তার চোখে পড়ে।
জলে গেল চন্দ্রাবতী চক্ষে বহে পানি।
হেনকালে দেখে নদী ধরিছে উজানী।
একেলা জলের ঘাটে সঙ্গে নাহি কেহ।
জলের উপরে ভাসে জয়ানন্দের দেহ।
কবি চন্দ্রাবতীর জীবনেতিহাস বড়ই করুণ ও এক বিয়োগান্ত কাহিনী বলে নয়ান ঘোষ উল্লেখ করেন। নিঃসঙ্গ কবিকে জীবনভর নিদারুণ দুঃখ-কষ্টের ভার বয়ে বেড়াতে হয়। সে কারণেই হয়তো তার হাতে রামায়ণ রচনা বেশি দূর এগোয়নি। তিনি সীতার বনবাস পর্যন্ত লিখেছিলেন। রামায়ণ ছাড়াও তিনি মৈমনসিংহ গীতিকার দস্যু কেনারাম ও মলুয়া পালাটি রচনা করেছেন। অথচ তার ব্যক্তিজীবনও চন্দ্রাবতীর পালা নামে ভাটি এলাকার বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছিল। চন্দ্রাবতী পালায় প্রেমিকের মৃত্যুর ইঙ্গিত যেন অসংখ্য আখ্যানকাব্যে মূর্ত হয়ে ওঠে। শুধু পরিণতি নয়, জলের ঘাটে সুন্দরী মেয়ের স্বাভাবিক আসা-যাওয়া প্রেমিকের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। তাইতো প্রণয়ী প্রেমিকের আকুতি-মিনতি কুমারী মেয়ের মনকে আন্দলিত করে। সে সমাজের অনেক কিছুকেই তুচ্ছ ভেবে আবেদনে সাড়া দেয়।
এমন সুন্দরী কইন্যা জলের ঘাটে আইছে নয়ন পাগল কইরাছে....॥
জলের ঘাটে বাঁশি বাজে গো কমলা আমরা জলে যাই.....॥
জলের ঘাটের প্রেম নিবেদনের এই সুরটি আজও এখানকার অসংখ্য লোক শিল্পীর কণ্ঠে শোভা পায়। ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের সম্পাদনায় প্রকাশিত চুয়াল্লিশটি গীতিকার মধ্যে ত্রিশটি গীতিকা-ই পূর্ব মৈমনসিংহ গীতিকা হতে সংগৃহীত। এসব কাহিনী বৃহত্তম ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও বি.বাড়িয়া জেলার মধ্যস্থিত বিল-হাওর ও নদ-নদী প্লাবিত বিস্তৃত ভাটি অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ প্রণয়গাথা হিসেবে সারাবিশ্বে প্রশংসিত। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দীনেশ চন্দ্র সেনকে লিখেছেন, বাংলা প্রাচীন বাংলাসাহিত্যে মঙ্গলকাব্য প্রভৃতি কাব্যগুলো ধনীদের ফরমাসে ও খরচে খনন করা পুষ্করিণী, কিন্তু ময়মনসিংহ গীতিকা বাংলা পল্লী হৃদয়ের গভীর স্তর থেকে স্বতঃউচ্ছ্বসিত উৎস, অকৃত্রিম বেদনার স্বচ্ছধারা। বাংলাসাহিত্যে এমন আত্মবিস্মৃত রস সৃষ্টি আর কখনও হয়নি। এ মাটির এ লোক ঐতিহ্য বাংলাসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। যে কেউ এখানে এলে হয়তো মনে পড়ে মৈমনসিংহ গীতিকার সেই মহুয়া, মলুয়া, চন্দ্রাবতী, কাজল রেখা বা সখিদের কথা। প্রখ্যাত গবেষক ড. আশরাফ সিদ্দিকী একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকার প্রকাশনা উৎসবে এসে এ কথাই ভেবেছিলেন। এখানকার আদিবাসীদের মনেও সেসব গীতিকার কথা দোলা দেয় যখন বছরের কোনো এক সময় অচেনা বেদে বহর পাড়াগাঁ সুর হাঁকিয়ে বেড়ায়-
আমরা সাপের খেলা দেখাই,
দাঁতের পোক ফেলাই,
মাজার বিষ নামাই।
বেদেনীর সুরে ভাসে মহুয়ার মুখ। তারপর মনে পড়ে ভাটির প্রত্যন্ত হাওরে নির্বাসিত কাজল রেখার কথা। ক্রমে ক্রমে অনেক কথা হয়তো মনে পড়ে। সাহিত্যের সেই অক্ষত ধারাকে বুকে-পিঠে লালন করেছেন এখানকার লোককবিরা। তাদের কথা ও সুুরে চিরভাস্বর হয়ে ওঠে প্রেম-সৌন্দর্য ও নিঃস্বর্গের এদেশ। এ ধারার বাইরেও অনেক স্বনামধন্য কবির আবির্ভাব হয়েছিল। তাদের মধ্যে গচিহাটার কবি রামকুমার নন্দী, জঙ্গলবাড়ির কবি পূর্ণচন্দ্র রায় ও বাজিতপুর থানার বালিগাঁও-এর কবি অপূর্ব কৃষ্ণ ঘোষ অন্যতম। কিন্তু মৈমনসিংহ গীতিকার কাহিনীগুলো বাস্তব ও মর্মস্পর্শী বলে এর আবেদন সর্বাধিক। চরিত্রগুলো একান্তই ভাটির নদ-নদী, হাওর-বাঁওড় ও খাল-বিল প্রভৃতি প্রাকৃতিক সত্তাকেজুড়ে রয়েছে। লোকসাহিত্যের প্রখ্যাত গবেষক ড. আশুতোষ ভট্টাচার্যের বাড়ি এ মাটিরই বকজোড়কান্দি গ্রামে। ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য মনে করেন, পূর্ব মৈমনসিংহ গীতিকাগুলো প্রধানত পরিণত বয়স্কা কুমারীর স্বাধীন প্রেমের অধিকার ও ব্যক্তিগত হৃদয় বেদনা লইয়াই রচিত। এসব গীতিকায় নারীরা এক প্রেম শক্তির অধিকারিণী। তারা প্রেম, নারীত্ব, সতীধর্মে অবিচল। কাহিনীর এ ধারা আমাদের লোককবিদের হাতে মাধুর্য লাভ করেছে।
১৯৪৬-৪৮ সালে বাংলাসাহিত্যের অমর কথাশিল্পী অদ্বৈত মল্লবর্মণের লেখা আখ্যানকাব্যে সেভাব নবরূপে ফুটে উঠে। এ কাব্যে তিনি ভাটির নিভৃতে মানুষের একান্ত ভাষাকে শিল্পমণ্ডিত করে নিবিড়ভাব সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। তার জন্ম ভাটিরাজ্যের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার গোকর্ণঘাট। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি নিুবর্ণের মালো বা জেলে পরিবারের একজন জেলে-নমঃশূদ্র। চরম অবহেলা ও দুঃখ-কষ্টের ভেতর দিয়ে বেড়ে ওঠা কবির জীবন বিয়োগের পর তার বিখ্যাত উপন্যাস তিতাস একটি নদীর নাম সিনেমা পর্দায় দেখে, দেশ-বিদেশের সাহিত্যসেবীরা থমকে দাঁড়ায়। প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিমলমিত্র লিখেছেন, অদ্বৈত বাবু হয়তো চলে গেলেন, কিন্তু বাংলাসাহিত্যের একটি অক্ষয় স্বাক্ষর রেখে গেলেন তার তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর লোক হিসেবে তিনি নিরীহ ও বিপন্ন মানুষের জীবনবোধকে স্বচক্ষে অবলোকন করেছেন। চরিত্র নির্মাণে তার হৃদয়ের অকৃত্রিম দরদ সিক্ত হয়ে উঠেছে। তাই অদ্বৈতের লেখা যেমন নিুবর্ণের হিন্দুদের সাহিত্যসেবার গৌরব অর্জন করল, তেমনিভাবে তাদের জীবনবোধও বাংলাসাহিত্যে ঠাঁই করে নিল। স্বভাবতই অদ্বৈতের লেখা এখানকার পরিবেশ-প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় হয়ে উঠেছে। তিনি মাসিক মোহাম্মদীর ১৩ বর্ষ, ৮ম সংখ্যায় হীরামতিনামক আখ্যানকাব্যটি ছদ্মনামে প্রকাশ করেন। গীতিকাগুলোর মধ্যে মহুয়া পালাটিতে মৈমনসিংহ গীতিকার চমৎকার বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। এক অপরূপ সুন্দরী বেদের মেয়ে মহুয়ার সঙ্গে বামনকান্দার ব্রাহ্মণ জামিদার নদের চাঁদের দুর্জয় প্রণয়কাহিনী অবলম্বনে রচিত। অন্যদিকে অদ্বৈতের আখ্যানকাব্যটি গড়ে ওঠেছে গাঁওয়ের পরধান মদন সরকারের ছেলে ফটিকচান্দের সঙ্গে তাঁতিঘরের মেয়ে হীরামতির প্রেমকাহিনী নিয়ে। হীরামতি ও এক অপরূপা সুন্দরী। উভয়কাব্যে প্রেমের আবেদন ও কাহিনীর বর্ণনায় অনেকটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। অদ্বৈতের ভাষায়-
পরমা সুন্দরী কন্যা বিন্দা তাঁতির মাইয়া।
হাইট্যা যাইতে পথের মানুষ বারেক থাকে চাইয়া॥
এই না গুণের হীরামতি কিনা কাম করিল।
জলের ঘাটে গিয়া সেই দিন পিরিতে মজিল॥
জলের ঘাটেই প্রেমিক-প্রেমিকার দেখা হয়। প্রেমিক নানান কথাবার্তায় প্রেমিকার মন ভুলাতে চাই। মৈমনসিংহ গীতিকায় নায়কের প্রেমানুভূতি প্রকাশ পায় এভাবে-
জল ভর সুন্দরী কইন্যা জলে দিছ ঢেউ।
হাসি মুখে কওনা কথা সঙ্গে নাই মোর কেউ॥
অদ্বৈতের ভাষায় সেই প্রেমানুভূতির বর্ণনাটি এসেছে-
জল যে ভর ওলো ছেমড়ি শুনো আমার কথা।
আঁখি তুইল্যা রাও না কর, খাও আমার মাথা॥
উত্তরে হীরামতি বলে,
তুমি যে রে পরের ছাইলা আমি পরের মাইয়া।
কেমনে করি রাও তোমার পানে চাইয়া॥
প্রেমের সরাসরি আবেদন হীরামতির মনে লজ্জাবোধ হয়। মহুয়া ও হীরামতির চেয়ে কঠোর ভাষায় জবাব দেয়-
লজ্জা নাই নির্লজ্জ ঠাকুর, লজ্জা নাইরে তর।
গলায় কলসি বাইন্ধ্যা জলে ডুইব্যা মর॥
এভাবে সংলাপমুখরতার ভেতর দিয়ে কাহিনী কাব্য পরিণতি লাভ করে। কাহিনী কাব্য দুটির পরিণতি ভিন্ন হলেও কথা ও ভাবের ক্ষেত্রে যথেষ্ট মিল রয়েছে। হীরামতি কাব্যে হীরামতিকে বড় বউ এর মুখে কঠোর তিরস্কার শুনতে হয়-
লইজ্যা নাই নিলইজ্যা মাইয়া লইজ্যা নাইলো তোর।
ভাঙ্গা কলসি গলায় বাইন্ধ্যা সায়রে ডুইব্যা মর॥
কাহিনীর মিল-অমিল সত্ত্বেও অদ্বৈত মল্লবর্মণ এখানকার পরিবেশ-প্রাকৃতিকে অক্ষয় প্রেমের সংলাপে নিবিড় ও মাধুর্যমণ্ডিত করে তুলেছেন। তাইতো তার প্রেমের আকুতি-মিনতি ফুটে ওঠে নানা উপমায়-
বড়ভাগ্যে হইলো কন্যা জলের ঘাটে দেখা॥
জলে থাকে জলকুম্ভীর আকাশে থাকে চিল।
এইবার সুন্দরী আমার মন কইরা দে মিল॥
আড়ায় থাকে দোয়েলরে কোয়েল থাকে গাছে।
তোমারে না দেখলে আমার পরাণ নাহি বাঁচে॥
বনে থাকে বনরুইত মায়দানে চরে গরু।
এই বার পরাইয়া দে কন্যা শ্যামপিরিতের খাড়–॥
হাওর এলাকার কুড়া ও ডাহুক দুটি অতি পরিচিত পাখি। ড. দীনেশ চন্দ্র সেন মৈমনসিংহ গীতিকায় কুড়া পাখির ডাকে কাব্যনায়ক চাঁদ বিনোদের ঘুম ভেঙে যাওয়ার কথা বর্ণনা করেছেন। চাঁদ বিনোদ কুড়া শিকারে ভিনদেশে গিয়েছিল। ক্লান্ত বিনোদ ঘুমিয়ে পড়লে মলুয়া তাকে দেখতে পায়। অদ্বৈতের কাব্যে ডাহুকের বর্ণনা এসেছে। শিকারি ডাহুক দিয়ে বন্য ডাহুক ধরা হয় বলে ডাহুক শিকারি আড়ালে ওঁৎপেতে থাকে। পালিত ডাহুকের ডাক যেন বন্য ডাহুকের মরণ ফাঁদ। সে কারণে কাব্যপ্রেমিকের মন ডাহুকের ডাকে মুগ্ধ নয়।
নদীর কিনারে গেলাম পার হইবার আশে।
নাও আছে কাণ্ডারি নাই, শুধু ডিঙ্গা ভাসে॥
এই ত ভাদর মাসে ডাহুক করে রাও।
যেই দেশে নাই ডাহুক ডুম্বুর সে দেশ চইল্যা যাও॥
ডাহুক মারুম ডুম্বুর মারুম পাইড়া ভাঙ্গুম বাসা।
তুই বন্ধুর লাগিয়া আমার তরুতলে বাসা॥
এসব আখ্যানকাব্যে ভাটির দেশের বর্ণনা নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে। আর এখানকার লোককবিদের হাতে রচিত কাব্যিক প্রেমের পরিণতিও যেন ত্যাগের মহিমায় চির উজ্জ্বল হয়ে আছে।
মহুয়ার জীবন বিসর্জন, ভাটির নির্জন হাওরে কাজল রেখার নির্বাসন, দীর্ঘ দুঃখ-কষ্ট সয়ে মদিনার মৃত্যু, ব্যর্থ প্রেমের যন্ত্রণায় কাতর চন্দ্রাবতী ও তার প্রেমিকের জীবন বিয়োগ সবকিছুই জলে ডুবে মরার শামিল। আধুনিক যুগের কবি অদ্বৈত মল্লবর্মণের কাব্যে সেই সুরের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। তার ভাষায়-
লোকাচারের বিয়া নিয়া সুখে বাস করে।
মনে-প্রাণের বিয়া নিয়া জলে ডুইব্যা মরে॥
কয়েকশ বছর পথ পরিক্রমার পরও সেই ভাব, কথা ও সুর জনমানসে সমাদৃত। তাইতো এখানকার সাধারণ মানুষ গানের দল বেঁধে গ্রামে গ্রামে এসব গেয়ে বেড়ায়। তারা গান গেয়ে মনে প্রশান্তি লাভ করে। নাট্যগুণেসমৃদ্ধ এসব গানের দলগুলোর মধ্যে- আলোমতি প্রেমকুমার, গুণাই, রূপবান, বেদের মেয়ে জোৎস্না, কাজল রেখা, অরুণ শান্তি, আপন দুলাল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও কিশোরগঞ্জের লোকনাট্য দলের উদ্যোগে মহুয়া, মলুয়া, কাজল রেখাসহ বিভিন্ন পালা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে প্রচার করতে দেখা যায়। আজকের দিনেও এসব বিচিত্র প্রেমকাহিনী সাধারণ মানুষের মনে সমান আবেদন সৃষ্টি করে। চিরন্তন প্রেমের এ ধারা দেশের অসংখ্য সাহিত্যসেবী মানুষের মনকেও আলোড়িত করে।
এছাড়া মধ্যযুগে অনুবাদ সাহিত্য ব্যাপক গতি লাভ করেছিল। বাজিতপুর থানার সাহাপুরের কবি অনন্তরামদত্ত প্রাচীন কবিদের মধ্যে, বিশেষ করে অনুবাদ কাব্যে প্রাতঃস্মরণীয়। এ পথে এগিয়ে এসেছিলেন বাংলাসাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতী। তিনি এলাকার স্বল্প শিক্ষিত লোকের উপযোগী করে রামায়ণের অংশমাত্র রচনা করেছিলেন। কটিয়াদীর কবি রামেশ্বর নন্দী ও কবি সঞ্জয় বাংলাভাষায় মাহাভারত রচনা করেছিলেন। সঞ্জয়ের মহাভারত অধিকতর সরল ভাষায় লিখিত বলে বেশি প্রচার লাভ করেছিল। কবি গঙ্গানারায়ণের সমসাময়িকক কবি ছিলেন জগন্নাথ দাস। উভয়ের জন্মস্থান নিকলী থানার ধারিশ্বরে। সাধক জগন্নাথ দাস দুর্গাপুরাণ রচনা করেছিলেন। তবে চন্দ্রাবতীর রচনায় রামায়ণের কোনো পুঁথি পাওয়া যায়নি। মহিলা কণ্ঠ থেকে সংগৃহীত হয়েই তা আমাদের পূর্ববঙ্গ গীতিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কবি চন্দ্রাবতী বাল্যকাল থেকে কবিতা রচনায় মনোযোগী হয়ে ওঠলেও রামায়ণ রচনার উদ্দেশ্য স্বতঃস্ফূর্ত নয়। চন্দ্রাবতী পরমা সুন্দরী ছিলেন। নয়ান ঘোষের বর্ণনায়, তার রূপ ও গুণের খ্যাতি শুনে অনেক সম্ভ্রান্ত ব্যক্ত তার পানি গ্রহণে ইচ্ছুক হতো। চন্দ্রার প্রার্থেব প্রেমিক ছিলেন ছেলেবেলার সঙ্গী পার্শ্ববর্তী গ্রামের জয়ানন্দ নামক এক ব্রাহ্মণ যুবক। চন্দ্রা ও জয়ানন্দের বিবাহ প্রস্তাবে সম্মত হয়ে কবি দ্বীজবংশীদাস বিবাহের যাবতীয় আয়োজনে মন দেন। এরই মাঝে ঘটে যায় আরেক ঘটনা। জয়ানন্দ মুসলিম রমণী কমলার প্রেমে ধর্মান্তরিত হয়ে ঘর বাঁধেন। এতে চন্দ্রাবতী দারুণভাবে ভেঙে পড়েন। তিনি ফুলেশ্বরী নদীর তীরে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা ও চিরকুমারী থাকার প্রার্থনা জানালে পিতা তার দুটি ইচ্ছাই মেনে নিলেন। উপরন্তু চন্দ্রাবতী যাতে নিদারুণ আঘাতে একেবারে মুষড়ে না পড়েন সেজন্য তার মনকে অন্যদিকে নির্দিষ্ট করার লক্ষ্যে রামায়ণ রচনার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে জয়ানন্দ তার ভুল বুঝতে পেরে চন্দ্রাকে একনজর দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেন। অভিমানী চন্দ্রা তার শেষ ইচ্ছা পূরণে অসম্মতির কথা লিখে জানান। পত্র পাঠে জয়ানন্দ পাগলপারা হয়ে মন্দিরের কাছে উপস্থিত হন। চন্দ্রা তাকে শূন্য হাতে ফিরিয়ে দেন। হতভাগা জয়ানন্দ রুদ্ধদ্বার মন্দিরের আঙ্গিনায় সদ্যফোটা সন্ধ্যামালতী ফুলের রস নিংড়িয়ে কপাটের ওপর চারছত্র কবিতা লিখে যান।
শৈশবকালের সঙ্গী তুমি যৌবনকালের সাথী।
অপরাধ ক্ষমা কর তুমি চন্দ্রাবতী।
পাপিষ্ঠ জানিয়া মোরে না হইলে সম্মত
বিদায় মাগি চন্দ্রাবতী জনমের মত।
চন্দ্রাবতী এ লেখা দেখে তা ধুয়ে-মুছে ফেলার জন্য নদীর ঘাটে জল আনতে
পা বাড়ান। সেখানেও চারছত্র কবিতা তার চোখে পড়ে।
জলে গেল চন্দ্রাবতী চক্ষে বহে পানি।
হেনকালে দেখে নদী ধরিছে উজানী।
একেলা জলের ঘাটে সঙ্গে নাহি কেহ।
জলের উপরে ভাসে জয়ানন্দের দেহ।
কবি চন্দ্রাবতীর জীবনেতিহাস বড়ই করুণ ও এক বিয়োগান্ত কাহিনী বলে নয়ান ঘোষ উল্লেখ করেন। নিঃসঙ্গ কবিকে জীবনভর নিদারুণ দুঃখ-কষ্টের ভার বয়ে বেড়াতে হয়। সে কারণেই হয়তো তার হাতে রামায়ণ রচনা বেশি দূর এগোয়নি। তিনি সীতার বনবাস পর্যন্ত লিখেছিলেন। রামায়ণ ছাড়াও তিনি মৈমনসিংহ গীতিকার দস্যু কেনারাম ও মলুয়া পালাটি রচনা করেছেন। অথচ তার ব্যক্তিজীবনও চন্দ্রাবতীর পালা নামে ভাটি এলাকার বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছিল। চন্দ্রাবতী পালায় প্রেমিকের মৃত্যুর ইঙ্গিত যেন অসংখ্য আখ্যানকাব্যে মূর্ত হয়ে ওঠে। শুধু পরিণতি নয়, জলের ঘাটে সুন্দরী মেয়ের স্বাভাবিক আসা-যাওয়া প্রেমিকের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। তাইতো প্রণয়ী প্রেমিকের আকুতি-মিনতি কুমারী মেয়ের মনকে আন্দলিত করে। সে সমাজের অনেক কিছুকেই তুচ্ছ ভেবে আবেদনে সাড়া দেয়।
এমন সুন্দরী কইন্যা জলের ঘাটে আইছে নয়ন পাগল কইরাছে....॥
জলের ঘাটে বাঁশি বাজে গো কমলা আমরা জলে যাই.....॥
জলের ঘাটের প্রেম নিবেদনের এই সুরটি আজও এখানকার অসংখ্য লোক শিল্পীর কণ্ঠে শোভা পায়। ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের সম্পাদনায় প্রকাশিত চুয়াল্লিশটি গীতিকার মধ্যে ত্রিশটি গীতিকা-ই পূর্ব মৈমনসিংহ গীতিকা হতে সংগৃহীত। এসব কাহিনী বৃহত্তম ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও বি.বাড়িয়া জেলার মধ্যস্থিত বিল-হাওর ও নদ-নদী প্লাবিত বিস্তৃত ভাটি অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ প্রণয়গাথা হিসেবে সারাবিশ্বে প্রশংসিত। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দীনেশ চন্দ্র সেনকে লিখেছেন, বাংলা প্রাচীন বাংলাসাহিত্যে মঙ্গলকাব্য প্রভৃতি কাব্যগুলো ধনীদের ফরমাসে ও খরচে খনন করা পুষ্করিণী, কিন্তু ময়মনসিংহ গীতিকা বাংলা পল্লী হৃদয়ের গভীর স্তর থেকে স্বতঃউচ্ছ্বসিত উৎস, অকৃত্রিম বেদনার স্বচ্ছধারা। বাংলাসাহিত্যে এমন আত্মবিস্মৃত রস সৃষ্টি আর কখনও হয়নি। এ মাটির এ লোক ঐতিহ্য বাংলাসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। যে কেউ এখানে এলে হয়তো মনে পড়ে মৈমনসিংহ গীতিকার সেই মহুয়া, মলুয়া, চন্দ্রাবতী, কাজল রেখা বা সখিদের কথা। প্রখ্যাত গবেষক ড. আশরাফ সিদ্দিকী একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকার প্রকাশনা উৎসবে এসে এ কথাই ভেবেছিলেন। এখানকার আদিবাসীদের মনেও সেসব গীতিকার কথা দোলা দেয় যখন বছরের কোনো এক সময় অচেনা বেদে বহর পাড়াগাঁ সুর হাঁকিয়ে বেড়ায়-
আমরা সাপের খেলা দেখাই,
দাঁতের পোক ফেলাই,
মাজার বিষ নামাই।
বেদেনীর সুরে ভাসে মহুয়ার মুখ। তারপর মনে পড়ে ভাটির প্রত্যন্ত হাওরে নির্বাসিত কাজল রেখার কথা। ক্রমে ক্রমে অনেক কথা হয়তো মনে পড়ে। সাহিত্যের সেই অক্ষত ধারাকে বুকে-পিঠে লালন করেছেন এখানকার লোককবিরা। তাদের কথা ও সুুরে চিরভাস্বর হয়ে ওঠে প্রেম-সৌন্দর্য ও নিঃস্বর্গের এদেশ। এ ধারার বাইরেও অনেক স্বনামধন্য কবির আবির্ভাব হয়েছিল। তাদের মধ্যে গচিহাটার কবি রামকুমার নন্দী, জঙ্গলবাড়ির কবি পূর্ণচন্দ্র রায় ও বাজিতপুর থানার বালিগাঁও-এর কবি অপূর্ব কৃষ্ণ ঘোষ অন্যতম। কিন্তু মৈমনসিংহ গীতিকার কাহিনীগুলো বাস্তব ও মর্মস্পর্শী বলে এর আবেদন সর্বাধিক। চরিত্রগুলো একান্তই ভাটির নদ-নদী, হাওর-বাঁওড় ও খাল-বিল প্রভৃতি প্রাকৃতিক সত্তাকেজুড়ে রয়েছে। লোকসাহিত্যের প্রখ্যাত গবেষক ড. আশুতোষ ভট্টাচার্যের বাড়ি এ মাটিরই বকজোড়কান্দি গ্রামে। ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য মনে করেন, পূর্ব মৈমনসিংহ গীতিকাগুলো প্রধানত পরিণত বয়স্কা কুমারীর স্বাধীন প্রেমের অধিকার ও ব্যক্তিগত হৃদয় বেদনা লইয়াই রচিত। এসব গীতিকায় নারীরা এক প্রেম শক্তির অধিকারিণী। তারা প্রেম, নারীত্ব, সতীধর্মে অবিচল। কাহিনীর এ ধারা আমাদের লোককবিদের হাতে মাধুর্য লাভ করেছে।
১৯৪৬-৪৮ সালে বাংলাসাহিত্যের অমর কথাশিল্পী অদ্বৈত মল্লবর্মণের লেখা আখ্যানকাব্যে সেভাব নবরূপে ফুটে উঠে। এ কাব্যে তিনি ভাটির নিভৃতে মানুষের একান্ত ভাষাকে শিল্পমণ্ডিত করে নিবিড়ভাব সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। তার জন্ম ভাটিরাজ্যের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার গোকর্ণঘাট। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি নিুবর্ণের মালো বা জেলে পরিবারের একজন জেলে-নমঃশূদ্র। চরম অবহেলা ও দুঃখ-কষ্টের ভেতর দিয়ে বেড়ে ওঠা কবির জীবন বিয়োগের পর তার বিখ্যাত উপন্যাস তিতাস একটি নদীর নাম সিনেমা পর্দায় দেখে, দেশ-বিদেশের সাহিত্যসেবীরা থমকে দাঁড়ায়। প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিমলমিত্র লিখেছেন, অদ্বৈত বাবু হয়তো চলে গেলেন, কিন্তু বাংলাসাহিত্যের একটি অক্ষয় স্বাক্ষর রেখে গেলেন তার তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর লোক হিসেবে তিনি নিরীহ ও বিপন্ন মানুষের জীবনবোধকে স্বচক্ষে অবলোকন করেছেন। চরিত্র নির্মাণে তার হৃদয়ের অকৃত্রিম দরদ সিক্ত হয়ে উঠেছে। তাই অদ্বৈতের লেখা যেমন নিুবর্ণের হিন্দুদের সাহিত্যসেবার গৌরব অর্জন করল, তেমনিভাবে তাদের জীবনবোধও বাংলাসাহিত্যে ঠাঁই করে নিল। স্বভাবতই অদ্বৈতের লেখা এখানকার পরিবেশ-প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় হয়ে উঠেছে। তিনি মাসিক মোহাম্মদীর ১৩ বর্ষ, ৮ম সংখ্যায় হীরামতিনামক আখ্যানকাব্যটি ছদ্মনামে প্রকাশ করেন। গীতিকাগুলোর মধ্যে মহুয়া পালাটিতে মৈমনসিংহ গীতিকার চমৎকার বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। এক অপরূপ সুন্দরী বেদের মেয়ে মহুয়ার সঙ্গে বামনকান্দার ব্রাহ্মণ জামিদার নদের চাঁদের দুর্জয় প্রণয়কাহিনী অবলম্বনে রচিত। অন্যদিকে অদ্বৈতের আখ্যানকাব্যটি গড়ে ওঠেছে গাঁওয়ের পরধান মদন সরকারের ছেলে ফটিকচান্দের সঙ্গে তাঁতিঘরের মেয়ে হীরামতির প্রেমকাহিনী নিয়ে। হীরামতি ও এক অপরূপা সুন্দরী। উভয়কাব্যে প্রেমের আবেদন ও কাহিনীর বর্ণনায় অনেকটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। অদ্বৈতের ভাষায়-
পরমা সুন্দরী কন্যা বিন্দা তাঁতির মাইয়া।
হাইট্যা যাইতে পথের মানুষ বারেক থাকে চাইয়া॥
এই না গুণের হীরামতি কিনা কাম করিল।
জলের ঘাটে গিয়া সেই দিন পিরিতে মজিল॥
জলের ঘাটেই প্রেমিক-প্রেমিকার দেখা হয়। প্রেমিক নানান কথাবার্তায় প্রেমিকার মন ভুলাতে চাই। মৈমনসিংহ গীতিকায় নায়কের প্রেমানুভূতি প্রকাশ পায় এভাবে-
জল ভর সুন্দরী কইন্যা জলে দিছ ঢেউ।
হাসি মুখে কওনা কথা সঙ্গে নাই মোর কেউ॥
অদ্বৈতের ভাষায় সেই প্রেমানুভূতির বর্ণনাটি এসেছে-
জল যে ভর ওলো ছেমড়ি শুনো আমার কথা।
আঁখি তুইল্যা রাও না কর, খাও আমার মাথা॥
উত্তরে হীরামতি বলে,
তুমি যে রে পরের ছাইলা আমি পরের মাইয়া।
কেমনে করি রাও তোমার পানে চাইয়া॥
প্রেমের সরাসরি আবেদন হীরামতির মনে লজ্জাবোধ হয়। মহুয়া ও হীরামতির চেয়ে কঠোর ভাষায় জবাব দেয়-
লজ্জা নাই নির্লজ্জ ঠাকুর, লজ্জা নাইরে তর।
গলায় কলসি বাইন্ধ্যা জলে ডুইব্যা মর॥
এভাবে সংলাপমুখরতার ভেতর দিয়ে কাহিনী কাব্য পরিণতি লাভ করে। কাহিনী কাব্য দুটির পরিণতি ভিন্ন হলেও কথা ও ভাবের ক্ষেত্রে যথেষ্ট মিল রয়েছে। হীরামতি কাব্যে হীরামতিকে বড় বউ এর মুখে কঠোর তিরস্কার শুনতে হয়-
লইজ্যা নাই নিলইজ্যা মাইয়া লইজ্যা নাইলো তোর।
ভাঙ্গা কলসি গলায় বাইন্ধ্যা সায়রে ডুইব্যা মর॥
কাহিনীর মিল-অমিল সত্ত্বেও অদ্বৈত মল্লবর্মণ এখানকার পরিবেশ-প্রাকৃতিকে অক্ষয় প্রেমের সংলাপে নিবিড় ও মাধুর্যমণ্ডিত করে তুলেছেন। তাইতো তার প্রেমের আকুতি-মিনতি ফুটে ওঠে নানা উপমায়-
বড়ভাগ্যে হইলো কন্যা জলের ঘাটে দেখা॥
জলে থাকে জলকুম্ভীর আকাশে থাকে চিল।
এইবার সুন্দরী আমার মন কইরা দে মিল॥
আড়ায় থাকে দোয়েলরে কোয়েল থাকে গাছে।
তোমারে না দেখলে আমার পরাণ নাহি বাঁচে॥
বনে থাকে বনরুইত মায়দানে চরে গরু।
এই বার পরাইয়া দে কন্যা শ্যামপিরিতের খাড়–॥
হাওর এলাকার কুড়া ও ডাহুক দুটি অতি পরিচিত পাখি। ড. দীনেশ চন্দ্র সেন মৈমনসিংহ গীতিকায় কুড়া পাখির ডাকে কাব্যনায়ক চাঁদ বিনোদের ঘুম ভেঙে যাওয়ার কথা বর্ণনা করেছেন। চাঁদ বিনোদ কুড়া শিকারে ভিনদেশে গিয়েছিল। ক্লান্ত বিনোদ ঘুমিয়ে পড়লে মলুয়া তাকে দেখতে পায়। অদ্বৈতের কাব্যে ডাহুকের বর্ণনা এসেছে। শিকারি ডাহুক দিয়ে বন্য ডাহুক ধরা হয় বলে ডাহুক শিকারি আড়ালে ওঁৎপেতে থাকে। পালিত ডাহুকের ডাক যেন বন্য ডাহুকের মরণ ফাঁদ। সে কারণে কাব্যপ্রেমিকের মন ডাহুকের ডাকে মুগ্ধ নয়।
নদীর কিনারে গেলাম পার হইবার আশে।
নাও আছে কাণ্ডারি নাই, শুধু ডিঙ্গা ভাসে॥
এই ত ভাদর মাসে ডাহুক করে রাও।
যেই দেশে নাই ডাহুক ডুম্বুর সে দেশ চইল্যা যাও॥
ডাহুক মারুম ডুম্বুর মারুম পাইড়া ভাঙ্গুম বাসা।
তুই বন্ধুর লাগিয়া আমার তরুতলে বাসা॥
এসব আখ্যানকাব্যে ভাটির দেশের বর্ণনা নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে। আর এখানকার লোককবিদের হাতে রচিত কাব্যিক প্রেমের পরিণতিও যেন ত্যাগের মহিমায় চির উজ্জ্বল হয়ে আছে।
মহুয়ার জীবন বিসর্জন, ভাটির নির্জন হাওরে কাজল রেখার নির্বাসন, দীর্ঘ দুঃখ-কষ্ট সয়ে মদিনার মৃত্যু, ব্যর্থ প্রেমের যন্ত্রণায় কাতর চন্দ্রাবতী ও তার প্রেমিকের জীবন বিয়োগ সবকিছুই জলে ডুবে মরার শামিল। আধুনিক যুগের কবি অদ্বৈত মল্লবর্মণের কাব্যে সেই সুরের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। তার ভাষায়-
লোকাচারের বিয়া নিয়া সুখে বাস করে।
মনে-প্রাণের বিয়া নিয়া জলে ডুইব্যা মরে॥
কয়েকশ বছর পথ পরিক্রমার পরও সেই ভাব, কথা ও সুর জনমানসে সমাদৃত। তাইতো এখানকার সাধারণ মানুষ গানের দল বেঁধে গ্রামে গ্রামে এসব গেয়ে বেড়ায়। তারা গান গেয়ে মনে প্রশান্তি লাভ করে। নাট্যগুণেসমৃদ্ধ এসব গানের দলগুলোর মধ্যে- আলোমতি প্রেমকুমার, গুণাই, রূপবান, বেদের মেয়ে জোৎস্না, কাজল রেখা, অরুণ শান্তি, আপন দুলাল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও কিশোরগঞ্জের লোকনাট্য দলের উদ্যোগে মহুয়া, মলুয়া, কাজল রেখাসহ বিভিন্ন পালা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে প্রচার করতে দেখা যায়। আজকের দিনেও এসব বিচিত্র প্রেমকাহিনী সাধারণ মানুষের মনে সমান আবেদন সৃষ্টি করে। চিরন্তন প্রেমের এ ধারা দেশের অসংখ্য সাহিত্যসেবী মানুষের মনকেও আলোড়িত করে।
No comments