ডালিম যেভাবে ফোটে : সেইসব মূর্খ ও মূকের জীবনী

‘কবিতাকেও, জগতের সেইসব কথিত শেষ সঙ্গতির সাথে অনিবার্য যুদ্ধে জয়ী হতে হয়; এই যেমন ধরুন স্বাতীর দেয়া হাতঘড়িটির কথা; তার তিনটি কাঁটাই থেমে পড়েছে এখন, তবু সময় চলছে...’
কবিতাকে জগতের সেইসব কথিত শেষ সঙ্গতির সাথে অনিবার্য যুদ্ধে জয়ী হতে হয়। এটি কবি সজল সমুদ্র’র স্বীকারোক্তি। তার স্বীকারোক্তির রেশ টেনেই বলছি, বস্তুত এই যুদ্ধটা করতে হয় কবিকে। কবিতা তার তলোয়ার; ঢাল, বর্ম, অশ্বক্সসবকিছু। সেই শেষ অনিবার্য যুদ্ধের সমস্ত সরঞ্জাম কবিতা এবং এই যুদ্ধের ময়দানে জয়ী হতে হয় এসব যুদ্ধ সরঞ্জাম নিয়ে ছুটে আসা পদাতিক, কবিকে।
‘এত প্রান্ত বদল করি, এত ভঙ্গি ভাঙি রাতজুড়েক্স/ তবু হয় না নদীর মতো শুয়ে পড়া।’ এই প্রান্ত বদল আর রাতজুড়ে ভঙ্গি ভাঙার যুদ্ধ করতে করতেই কেটে যায় কবির এক জীবনক্সযে জীবনে মানুষ জড়িয়ে পড়ে পারস্পরিক ঝগড়ায়, কালো পিঁপড়েদের মতো।
সজল সমুদ্র খুব ছোট দৈর্ঘ্যরে কবিতা লেখেন। অন্তত ‘ডালিম যেভাবে ফোটে’ বইয়ের সবগুলো কবিতার দিকে তাকালে তেমনই দেখা যায়। কোনো একটি দীর্ঘ কবিতাও নেই এ বইয়ে। তবে এই সীমিত দৈর্ঘ্যরে কবিতাতেই তিনি ধরতে চেয়েছেন সমূহ ব্যাপ্তিকে। পেরেছেনও। সামগ্রিক অর্থে কবিতাকে এটাই পারতে হয়। ক্ষুদ্রের মধ্য দিয়ে সমগ্রকে ধরা।
‘বলো উটপাখি, কবে, কোথায় হারিয়েছো ডানা; তবুক্স/অজস ধূলিঝড়, এতটা নিরুত্তর কীভাবে পার হয়ে এলে!’ সজল সমুদ্র তার ‘মূক’ কবিতার সেই উটপাখি, যে অজস ধূলিঝড় পার হয়ে আজ এখানে এসেছে; তবে মূক নয়, নিরুত্তরও নয়।
‘ডালিম যেভাবে ফোটে’ বইটি হাতে নিলেই একটি প্রশ্ন আসে, ডালিম আবার কীভাবে ফোটে? নাম কবিতাটির দিকে তাকাইক্স
‘তুমি দিচ্ছ হাততালি, ডালিম যেভাবে ফেটে লিখে রাখে রক্তবর্ণনা...’
এখানেও তো ডালিম ফোটার কোনো অস্তিত্ব নেই। তখনই অনুভব করি, ডালিম কোনো ফল হয়ে আর নেই এখানে; হয়তো কোনো নারী কিংবা সমগ্র জীবন। কোনো এক মুহূর্তে এসে আমরা প্রত্যেকেই তাদের সশব্দে ফুটে ওঠার শব্দ শুনতে পাই।
‘ডালিম যেভাবে ফোটে’ কবির দ্বিতীয় বই। প্রথম বই ‘পত্রে রচিত ভোর’। একটি কবিতাকে অনেক কিছু অতিক্রম করতে হয়ক্সরাস্তা, রাত, মরুভূমি, গম্বুজ, একটি জীবনক্সসামগ্রিক অর্থে মহাকাল। স্বভাবতই কবিকেই এসব কিছু অতিক্রম করতে হয়। তবে যে কোনো কবির জন্য সবচেয়ে জরুরি প্রতিনিয়ত নিজেকে অতিক্রম করা। সজল সমুদ্র আক্ষরিক অর্থেই সেটা পেরেছেন। পত্রে রচিত ভোর এবং ডালিম যেভাবে ফোটে পাশাপাশি রাখলেই সেটা প্রমাণিত হবে।
সজল সমুদ্র ঠিক কীভাবে কবিতা লেখেন? দেখা যাকক্স
‘এত ঘন কুয়াশার ভেতরে, ময়ূরের পেখমে তাকিয়ে এখন কি দাঁড়িয়ে থাকা যায়!’ সজল সমুদ্র দাঁড়িয়ে থাকেনঙ্ঘনঘোর কুয়াশার ভেতরে, গম্বুজের মতো তুমুল ধৈর্যে। সেখান থেকে একসময় তার কাছে স্পষ্ট হতে শুরু করে দৃশ্যপট; ব্যথা-বেদনা, স্বাতীর দেয়া হাতঘড়ির তিনটি কাঁটা, যারা এই মুহূর্তে থেমে আছে, হরিণ, ফড়িং, হলঘরক্সকাচবান্ধব হিরার পৃথিবী। সবার গোচরে কিংবা অগোচরে মুঠোভর্তি করে তিনি সেসব তুলে আনেন কবিতায়। কখনও আমাদের আঙুল ধরে হাঁটতে হাঁটতে নিয়ে যান সুড়ঙ্গের ওপারেক্সযেখানে তার সঙ্গে সঙ্গে আমরাও দেখতে পাই কীটের হাততালি, গভীর গর্ত থেকে উড়ে আসা আপাত বিলুপ্ত মার্বল্ড বিড়াল। তার হাত শুশ্রূষায় পারদর্শী; আবার সেই হাতেই ছুরি চালিয়ে হাসতে হাসতে বের করে আনেন দীর্ঘশ্বাস, ঈর্ষা এবং দূরদিশাহীন গোপন হাসিক্সপুঞ্জীভূত আদিম আবেগ। আর এটাই সজল সমুদ্রের বৈশিষ্ট্য।
শব্দব্যবহারে যথেষ্ট সচেতনতা দেখিয়েছেন সজল। যে কোনো কবিতার যে কোনো পঙ্ক্তির যে কোনো শব্দই এই চিহ্ন বহন করে যাচ্ছে। যদিও ‘ধান-ভাবনা’, ‘ভাষাপ্রান্তর’, কিংবা ‘যেটুকু মানান আজ সই’ক্সএমন দুয়েকটি উপাদান ঠিক অসংলগ্ন নয়, তবে মানানসই মনে হয়নি। পারদর্শিতার প্রমাণ সজল তার প্রথম বইয়েই দিয়েছেন। কিন্তু কবিতায় তার চেয়েও যেটা গুরুত্বপূর্ণক্সদৃষ্টিভঙ্গি এবং গভীর জীবনবোধক্সতার উপস্থিতি সজল সমুদ্রের কবিতায় যত্রতত্র। ‘কাটা আপেলের টুকরো, প্রতিদিন তারই শ্বাস ফেলে চলি’; ‘বুঝিনি, আধপোড়া মোম গন্ধই ছড়ায় বেশি আলো ও উজ্জ্বলতার চেয়ে’; ‘বিউগল হাতে যাকে মৃত ভেবে যাও, লোকে তারই ডাকে আজও যুদ্ধে যায়, জাহাজ ভাসায়’; ‘দংশনে ভীত লোক, জেগে উঠবো জাদুকর পেলে’; ‘গ্রহণের যোগ্য চাঁদ প্রতিদিন আকাশে ওঠে না’ক্সএমন অজস্র পঙ্ক্তি ছড়িয়ে আছে বইয়ে। সজল সমুদ্র সেসব পঙ্ক্তিকে কুড়িয়ে এনে গেঁথেছেন গুল্মে, সুচারু হাতে।
সম্পূর্ণ সরিষার ক্ষেতে একা যে বাদাম গাছ, তার অনর্থ সমস্ত গল্পের জীবনী সজল সমুদ্র উদ্ধৃত করেছেন সযত্নে। ‘ডালিম যেভাবে ফোটে’ সেইসব মূর্খ ও মূকের জীবনী পাঠের আনন্দ দেবে, আনন্দ দেবে অস্পৃশ্য বোধকে স্পর্শের। হ রাসেল আহমেদ
বই
ডালিম যেভাবে ফোটে
সজল সমুদ্র

No comments

Powered by Blogger.