মনের আড়ালে by আনোয়ারুল হক
গতরাতে
শেষ করা গল্পের কপিটা পকেটে ভরে ঘরের দরজায় তালা দিয়ে রাস্তায় নেমে এলো
জাহিদ। শীতের সকালের নরম রোদে মন গুনগুনিয়ে ওঠে ওর। মনের ওপর চেপে থাকা
গল্পটা শেষ করতে পারার একটা তৃপ্তি তো আছেই, উপরি পাওনা হিসেবে আজকের সকাল
তাকে আরও চাঙ্গা করে দিল।
সামনে খালি রিকশা পেয়ে তাতে উঠে বসেই ভাবল, কোথায় যাবে সে?
এ সময়ে রিকশাওয়ালা ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করতেই সে বলে দিল, লালমাটিয়া যাও।
বলেই ভাবল, লালমাটিয়া! ওখানে তো মিতুদের বাসা।
রিকশাওয়ারার পিঠে হাত দিয়ে তাকে থামাতে গিয়েও হাতটা ফিরিয়ে নিল জাহিদ। কিছু বলল না। চাকা ঘুরতে লাগল কালো পিচ রাস্তায়। বাধা দেয়া গেল না। সেই সঙ্গে ঘুরতে লাগল জাহিদের মনের চাকা।
প্রায় এক বছর হতে চলল জাহিদ মিতুদের বাসায় যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। ও শুনেছে, তার নাম শুনলে নাকি এখন মিতু মুখ ফিরিয়ে নেয়। আর সেই মিতুকেই সে তার ভালোবাসার গল্পটা পড়ে শুনাতে চায়! অদ্ভুত তো! তার নিজের মনের গতি নিজেকেই যেন অবাক করে দেয়! তবুও জাহিদ টের পায় রিকশাটাকে ফিরানোর চেয়ে না ফিরানোর পাল্লাটাই বেশি ভারী।
কিন্তু ও যতই লালমাটিয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ততই ভালোলাগার বদলে তার মনটা সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। আগের ভাবনাটাই ফিরে এলো মনের চৌকাঠে। যাওয়াটা কি ঠিক হবে? এত দিন পরে হঠাৎ বাসায় হাজির হয়ে ‘তোকে একটা গল্প পড়ে শোনাতে এলাম’ বললে মিতু কি বিষয়টা সহজভাবে নেবে? যদি অপমান করে! কেননা তাদের বর্তমান সম্পর্ক তো আর আগের মতো নেই!
সেদিন ছিল ২৩ সেপ্টেম্বও, চাঁদের হিসাবে কৃষ্ণপক্ষ। তারিখটা মনে থাকবে ওর আজীবন। সেদিনের পর থেকে মিতুর সঙ্গে জাহিদের আর দেখা হয়নি। যখনই মনে হয়েছে, যাই! তখনই মনটাকে জোর করে ফিরিয়ে এনেছে সে। রূপকের কাছে শুনেছে, মিতু নাকি বলেছে, ওর সঙ্গে তার সম্পর্কের বিষয়টা নাকি এখন নিছক অতীতই। ওই সব ম্মৃতি সে আর মনে রাখে না। ভুলে গেছে! আর এই মিতুই তাকে একদিন বলেছিল, সে তাকে কোনোদিন ভুলে যাবে না! ছেড়ে যাবে না! ওদের বন্ধন চিরদিন অটুট থাকবে।
মিতুর বর্তমান ভাষ্য শুনে জাহিদ মনে মনে কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু আজ সে মিশ্চিত মিতালিকেও ভুলে যেতে পারেনি। অবচেতনের টানে তা না হলে সে লালমাটিয়া যাচ্ছে কেন!
জাহিদ আবার ভাবল, এখনও সে ইচ্ছা করলে ফিরে যেতে পারে। বলতে পারে, ‘এই রিকশা,সোজা যাবেন, মোহাম্মদপুর যাব’। রিকশা শংকর পার হয়ে এসে ডানে মোড় নিল। জাহিদ ফিরল না।
লালমাটিয়া ব্লক-ডি। এই রোডের শেষ মাথায় মিতুদের বাসা। দশতলা ফ্লাট বাড়ির ন’তলায় থাকে মিতুরা। লিফট আছে। উঠতে নামতে কোনো সমস্যা নেই। মিতুর বাবা রশিদ হায়দার সাহেব সরকারি আমলা। তাকে খুব কমই দেখেছে জাহিদ। সদা ব্যস্ত। ওর মাও কম এসেছে ওদের সামনে। আসলে মিতুদের পরিবারে মেয়ের ছেলে বন্ধুদের সম্পর্কে তার বাবা-মায়ের কোনো মাথাব্যথা নেই। জাহিদ জানত, ও ছাড়াও মিতুর অনেক ছেলে বন্ধু আছে। কিন্তু জাহিদ তো শুধু মিতুর ছেলে বন্ধুই ছিল না, ছিল তার চেয়ে আরও একটু বেশি কিছু। কে না জানত! আর মিতু তো জানত আরও বেশি এবং সাবার কাছে বলতও সে।
কথাটা মনে করে বড় করে নেয়া শ্বাসটা চেপে গেল না, ছেড়ে দিল জাহিদ। তারপর রিকশাওয়ালার পিঠে হাত ছোঁয়াল। জাহিদ আকাশমুখী বাড়িটার ওপরের দিকে তাকাল। ভাবল, মিতু কি বাসায় আছে? সে তো জানিয়ে আসছে না!
ওকে দেখে মিতু যদি কথা না বলে উপেক্ষা করে?
এখনও সময় আছে ফিরে যাওয়ার, তবুও কেন জানি ফিরতে মন চাইল না। বুক পকেটে রাখা গল্পের কপিটা ডান হাতের মুঠোয় তালুবন্দি করে লিফটের বোতামে তর্জনী রাখল জাহিদ।
লিফটের দরজা খুলতেই সোজা দরজার সামনে দাঁড়ানো মিতু। দু’জনেই অবাক! মিতুর চোখে অপ্রত্যাশিতের ছায়া। কিন্তু শান্ত নির্লিপ্ততায় স্থির। কাকচক্ষুজলের মতো মিতুর চোখ জাহিদের মুখের ওপর থমকে আছে। শুধু ঠোঁট নড়ল,- তুই!
-আমি তোর কাছেই এসেছিলাম।
-আমার কাছে!
মিতুর অবাক হওয়া গোপন থাকে না। জাহিদ মনে মনে লজ্জ্বা পেল। সত্যিই তাহলে মিতু তাকে আর প্রত্যাশা করে না! জাহিদ প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে গেল। মিতু সামনে, ও পেছনে।
-থাক্ তাহলে, আমি আজ যাই। অন্য আর একদিন আসব।
চলে যেতে উদ্যত জাহিদকে দাঁড়াতে হল মিতুর ডাকে। আহ্বানে কোনো আন্তরিকতা নেই, তবে অগত্যা আছে।
-এসেই যখন পড়েছিস্, ঘরে আয়।
-বাইরে যাবি না? তুই নিশ্চয়ই কোনো কাজে বের হচ্ছিলি?
মিতু স্বাভাবিক কণ্ঠে উত্তর দিল,
-আমি বাইরে যাচ্ছিলাম তুই বুঝলি কিসে? আমি বাইরে কোথাও যাচ্ছিলাম না। যাচ্ছিলাম ছাদে।
আহ্ ছাদ! জাহিদের নীলাকাশ। কতদিন হয়ে গেল সে আসে না বলে তো নীলাকাশও দেখে না! এই ঢাকা শহরে মিতুদের ছাদ ছাড়া আর এমন উন্মুক্ত আকাশ কোথায়!
বসতে বসতে মিতু গ্রীবা বাঁকিয়ে জাহিদকে দেখল। কোনো কথা হল না।
অনতি দূরে সোফায় বসা নতমুখী মিতুর চুলের সিঁথিতে জাহিদের চোখ। মিতু এমন মেয়ে তাকে যে কোনো পোশাকেই মানিয়ে যায়। গ্রামীণ চেক সুতির সালোয়ার কামিজে ওকে উজ্জ্বল মনে হলেও বিষণœ দেখায়। মিতু কোনো কথা বলে না। ডান হাতের তালুতে বাম হাত রেখে উৎকর্ণ সে। ভাবছে, কেন এসেছে জাহিদ?
জাহিদ কী বলে কথা শুরু করবে ভেবে পাচ্ছে না। অন্ধকার ঘরের কোণে তার চোখ। এসব বাড়িগুলো এমনই যে দিনের বেলাতেও আলো জ্বালিয়ে রাখতে হয়। মাথার ওপর সুদৃশ্য ঝারবাতি। তথাপি আঁধার সরেনি। বড় নিরিবিলি মিতুদের ঘর। বোঝা যায় ওর বাবা-মা কেউই বাসায় নেই। এতদিন বাদে এলো সে, কই মিতু তো তেমন আরও ছড়াল না! এ অবস্থায় গল্পটা পড়ে শোনানোর ইচ্ছাটা প্রকাশ করা কি ঠিক হবে ওর!
ভালোবাসা তাহলে মরে যায়! কথাটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে জাহিদের।
মিতু কথা বলল যেন অনেক দূর থেকে।
-তারপর, কী মনে করে? চা খাবি? বস, আমি নিয়ে আসি।
বেল টিপলেই যেখানে একাধিক কাজের লোক হাজির হয় সেখানে মিতু চা আনতে গেল! ফাঁকা ঘরে একা বসে থেকে জাহিদের নিজেকে খাপ্পর মারতে ইচ্ছা হল। মুখের ভেতরটা তেঁতো তেঁতো লাগছে। মিতু কি অযথাই দেরি করছে না? চা হাতে মিতু এলো ধীর পায়ে। যত্ন করে বানানো চা নিজেই জাহিদের হাতে তুলে দিল। আগের মতোই। জাহিদ ভাবল, তবু যেন আগের মতো নয়।
চা খেতে খেতে আবারও দু’জনের কোনো কথা হয় না। মিতুই আবার শুরু করল,
-তা কী জন্য এসেছিস বললি না তো?
- এমনিই। তবে যা ভেবে এসেছিলাম সে ইচ্ছাটা এখন আর নেই। এখন ইচ্ছা হচ্ছে অন্যরকম।
মিতু জাহিদের কথা শুনে রাঙা হল।
জাহিদ উঠে দাঁড়াতেই সোফায় বসা যুবতীর শরীরে বাঁকানো ধনুকের ভঙ্গিমা। মিতু ভয় পেয়েছে! ত্রস্তে উঠে দাঁড়াল। জাহিদ বলল,
-মিতু, আমি কি ভুল করেছিলাম তোকে ভলোবেসে? তুই না বলেছিলি আমাকে কোনোদিন ভুলে যাবি না? কেন এমন করলি মিতু?
মিতু কোনো জবাব দেয় না। ড্রইংরুমের কার্পেটে ওর চোখ। পাথর শরীর তার নড়ে না।
আর কিছু না বলে দরজার দিকে পা বাড়ায় জাহিদ।
বুক পকেটের গল্পের কপিটা খচখচ করে ওঠল।
খোলা দরজা দিয়ে দেখা যায় ঘরের ভেতরে এখনও আগের জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে মিতু। এবার তার চোখে চোখ পড়ল। অপলক। জাহিদের চোখ জলে ভরে ওঠে। সিঁড়ি ভাঙল জাহিদ। মিতু চোখের আড়াল হল ঢেউ ভাঙা জলের মতো।
না, সিনেমায় দেখা কোনো নায়িকার মতো মিতু দৌড়ে এসে পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরল না তো!
সে কি এমনটা আশা করেছিল! তা হয়তো নয়। তবে মিতুই যেন তাকে শিখিয়ে দিল,
জীবনের পথ বড় কঠিন। একা চলার।
পেছনে মিতু। সামনে ভেঙে ভেঙে নিচের দিকে নেমে যাওয়া সিঁড়ি। পা হড়কালেই মৃত্যু অথবা ভঙ্গুর জীবন।
জাহিদ দীর্ঘ সিঁড়ি ভেঙে নেমে এলো একা।
কিন্তু কিছুতেই মনের আড়াল করা যাবে না মিতুকে। কেউ জানবে না। জানবে শুধু সে। একা।
সামনে খালি রিকশা পেয়ে তাতে উঠে বসেই ভাবল, কোথায় যাবে সে?
এ সময়ে রিকশাওয়ালা ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করতেই সে বলে দিল, লালমাটিয়া যাও।
বলেই ভাবল, লালমাটিয়া! ওখানে তো মিতুদের বাসা।
রিকশাওয়ারার পিঠে হাত দিয়ে তাকে থামাতে গিয়েও হাতটা ফিরিয়ে নিল জাহিদ। কিছু বলল না। চাকা ঘুরতে লাগল কালো পিচ রাস্তায়। বাধা দেয়া গেল না। সেই সঙ্গে ঘুরতে লাগল জাহিদের মনের চাকা।
প্রায় এক বছর হতে চলল জাহিদ মিতুদের বাসায় যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। ও শুনেছে, তার নাম শুনলে নাকি এখন মিতু মুখ ফিরিয়ে নেয়। আর সেই মিতুকেই সে তার ভালোবাসার গল্পটা পড়ে শুনাতে চায়! অদ্ভুত তো! তার নিজের মনের গতি নিজেকেই যেন অবাক করে দেয়! তবুও জাহিদ টের পায় রিকশাটাকে ফিরানোর চেয়ে না ফিরানোর পাল্লাটাই বেশি ভারী।
কিন্তু ও যতই লালমাটিয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ততই ভালোলাগার বদলে তার মনটা সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। আগের ভাবনাটাই ফিরে এলো মনের চৌকাঠে। যাওয়াটা কি ঠিক হবে? এত দিন পরে হঠাৎ বাসায় হাজির হয়ে ‘তোকে একটা গল্প পড়ে শোনাতে এলাম’ বললে মিতু কি বিষয়টা সহজভাবে নেবে? যদি অপমান করে! কেননা তাদের বর্তমান সম্পর্ক তো আর আগের মতো নেই!
সেদিন ছিল ২৩ সেপ্টেম্বও, চাঁদের হিসাবে কৃষ্ণপক্ষ। তারিখটা মনে থাকবে ওর আজীবন। সেদিনের পর থেকে মিতুর সঙ্গে জাহিদের আর দেখা হয়নি। যখনই মনে হয়েছে, যাই! তখনই মনটাকে জোর করে ফিরিয়ে এনেছে সে। রূপকের কাছে শুনেছে, মিতু নাকি বলেছে, ওর সঙ্গে তার সম্পর্কের বিষয়টা নাকি এখন নিছক অতীতই। ওই সব ম্মৃতি সে আর মনে রাখে না। ভুলে গেছে! আর এই মিতুই তাকে একদিন বলেছিল, সে তাকে কোনোদিন ভুলে যাবে না! ছেড়ে যাবে না! ওদের বন্ধন চিরদিন অটুট থাকবে।
মিতুর বর্তমান ভাষ্য শুনে জাহিদ মনে মনে কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু আজ সে মিশ্চিত মিতালিকেও ভুলে যেতে পারেনি। অবচেতনের টানে তা না হলে সে লালমাটিয়া যাচ্ছে কেন!
জাহিদ আবার ভাবল, এখনও সে ইচ্ছা করলে ফিরে যেতে পারে। বলতে পারে, ‘এই রিকশা,সোজা যাবেন, মোহাম্মদপুর যাব’। রিকশা শংকর পার হয়ে এসে ডানে মোড় নিল। জাহিদ ফিরল না।
লালমাটিয়া ব্লক-ডি। এই রোডের শেষ মাথায় মিতুদের বাসা। দশতলা ফ্লাট বাড়ির ন’তলায় থাকে মিতুরা। লিফট আছে। উঠতে নামতে কোনো সমস্যা নেই। মিতুর বাবা রশিদ হায়দার সাহেব সরকারি আমলা। তাকে খুব কমই দেখেছে জাহিদ। সদা ব্যস্ত। ওর মাও কম এসেছে ওদের সামনে। আসলে মিতুদের পরিবারে মেয়ের ছেলে বন্ধুদের সম্পর্কে তার বাবা-মায়ের কোনো মাথাব্যথা নেই। জাহিদ জানত, ও ছাড়াও মিতুর অনেক ছেলে বন্ধু আছে। কিন্তু জাহিদ তো শুধু মিতুর ছেলে বন্ধুই ছিল না, ছিল তার চেয়ে আরও একটু বেশি কিছু। কে না জানত! আর মিতু তো জানত আরও বেশি এবং সাবার কাছে বলতও সে।
কথাটা মনে করে বড় করে নেয়া শ্বাসটা চেপে গেল না, ছেড়ে দিল জাহিদ। তারপর রিকশাওয়ালার পিঠে হাত ছোঁয়াল। জাহিদ আকাশমুখী বাড়িটার ওপরের দিকে তাকাল। ভাবল, মিতু কি বাসায় আছে? সে তো জানিয়ে আসছে না!
ওকে দেখে মিতু যদি কথা না বলে উপেক্ষা করে?
এখনও সময় আছে ফিরে যাওয়ার, তবুও কেন জানি ফিরতে মন চাইল না। বুক পকেটে রাখা গল্পের কপিটা ডান হাতের মুঠোয় তালুবন্দি করে লিফটের বোতামে তর্জনী রাখল জাহিদ।
লিফটের দরজা খুলতেই সোজা দরজার সামনে দাঁড়ানো মিতু। দু’জনেই অবাক! মিতুর চোখে অপ্রত্যাশিতের ছায়া। কিন্তু শান্ত নির্লিপ্ততায় স্থির। কাকচক্ষুজলের মতো মিতুর চোখ জাহিদের মুখের ওপর থমকে আছে। শুধু ঠোঁট নড়ল,- তুই!
-আমি তোর কাছেই এসেছিলাম।
-আমার কাছে!
মিতুর অবাক হওয়া গোপন থাকে না। জাহিদ মনে মনে লজ্জ্বা পেল। সত্যিই তাহলে মিতু তাকে আর প্রত্যাশা করে না! জাহিদ প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে গেল। মিতু সামনে, ও পেছনে।
-থাক্ তাহলে, আমি আজ যাই। অন্য আর একদিন আসব।
চলে যেতে উদ্যত জাহিদকে দাঁড়াতে হল মিতুর ডাকে। আহ্বানে কোনো আন্তরিকতা নেই, তবে অগত্যা আছে।
-এসেই যখন পড়েছিস্, ঘরে আয়।
-বাইরে যাবি না? তুই নিশ্চয়ই কোনো কাজে বের হচ্ছিলি?
মিতু স্বাভাবিক কণ্ঠে উত্তর দিল,
-আমি বাইরে যাচ্ছিলাম তুই বুঝলি কিসে? আমি বাইরে কোথাও যাচ্ছিলাম না। যাচ্ছিলাম ছাদে।
আহ্ ছাদ! জাহিদের নীলাকাশ। কতদিন হয়ে গেল সে আসে না বলে তো নীলাকাশও দেখে না! এই ঢাকা শহরে মিতুদের ছাদ ছাড়া আর এমন উন্মুক্ত আকাশ কোথায়!
বসতে বসতে মিতু গ্রীবা বাঁকিয়ে জাহিদকে দেখল। কোনো কথা হল না।
অনতি দূরে সোফায় বসা নতমুখী মিতুর চুলের সিঁথিতে জাহিদের চোখ। মিতু এমন মেয়ে তাকে যে কোনো পোশাকেই মানিয়ে যায়। গ্রামীণ চেক সুতির সালোয়ার কামিজে ওকে উজ্জ্বল মনে হলেও বিষণœ দেখায়। মিতু কোনো কথা বলে না। ডান হাতের তালুতে বাম হাত রেখে উৎকর্ণ সে। ভাবছে, কেন এসেছে জাহিদ?
জাহিদ কী বলে কথা শুরু করবে ভেবে পাচ্ছে না। অন্ধকার ঘরের কোণে তার চোখ। এসব বাড়িগুলো এমনই যে দিনের বেলাতেও আলো জ্বালিয়ে রাখতে হয়। মাথার ওপর সুদৃশ্য ঝারবাতি। তথাপি আঁধার সরেনি। বড় নিরিবিলি মিতুদের ঘর। বোঝা যায় ওর বাবা-মা কেউই বাসায় নেই। এতদিন বাদে এলো সে, কই মিতু তো তেমন আরও ছড়াল না! এ অবস্থায় গল্পটা পড়ে শোনানোর ইচ্ছাটা প্রকাশ করা কি ঠিক হবে ওর!
ভালোবাসা তাহলে মরে যায়! কথাটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে জাহিদের।
মিতু কথা বলল যেন অনেক দূর থেকে।
-তারপর, কী মনে করে? চা খাবি? বস, আমি নিয়ে আসি।
বেল টিপলেই যেখানে একাধিক কাজের লোক হাজির হয় সেখানে মিতু চা আনতে গেল! ফাঁকা ঘরে একা বসে থেকে জাহিদের নিজেকে খাপ্পর মারতে ইচ্ছা হল। মুখের ভেতরটা তেঁতো তেঁতো লাগছে। মিতু কি অযথাই দেরি করছে না? চা হাতে মিতু এলো ধীর পায়ে। যত্ন করে বানানো চা নিজেই জাহিদের হাতে তুলে দিল। আগের মতোই। জাহিদ ভাবল, তবু যেন আগের মতো নয়।
চা খেতে খেতে আবারও দু’জনের কোনো কথা হয় না। মিতুই আবার শুরু করল,
-তা কী জন্য এসেছিস বললি না তো?
- এমনিই। তবে যা ভেবে এসেছিলাম সে ইচ্ছাটা এখন আর নেই। এখন ইচ্ছা হচ্ছে অন্যরকম।
মিতু জাহিদের কথা শুনে রাঙা হল।
জাহিদ উঠে দাঁড়াতেই সোফায় বসা যুবতীর শরীরে বাঁকানো ধনুকের ভঙ্গিমা। মিতু ভয় পেয়েছে! ত্রস্তে উঠে দাঁড়াল। জাহিদ বলল,
-মিতু, আমি কি ভুল করেছিলাম তোকে ভলোবেসে? তুই না বলেছিলি আমাকে কোনোদিন ভুলে যাবি না? কেন এমন করলি মিতু?
মিতু কোনো জবাব দেয় না। ড্রইংরুমের কার্পেটে ওর চোখ। পাথর শরীর তার নড়ে না।
আর কিছু না বলে দরজার দিকে পা বাড়ায় জাহিদ।
বুক পকেটের গল্পের কপিটা খচখচ করে ওঠল।
খোলা দরজা দিয়ে দেখা যায় ঘরের ভেতরে এখনও আগের জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে মিতু। এবার তার চোখে চোখ পড়ল। অপলক। জাহিদের চোখ জলে ভরে ওঠে। সিঁড়ি ভাঙল জাহিদ। মিতু চোখের আড়াল হল ঢেউ ভাঙা জলের মতো।
না, সিনেমায় দেখা কোনো নায়িকার মতো মিতু দৌড়ে এসে পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরল না তো!
সে কি এমনটা আশা করেছিল! তা হয়তো নয়। তবে মিতুই যেন তাকে শিখিয়ে দিল,
জীবনের পথ বড় কঠিন। একা চলার।
পেছনে মিতু। সামনে ভেঙে ভেঙে নিচের দিকে নেমে যাওয়া সিঁড়ি। পা হড়কালেই মৃত্যু অথবা ভঙ্গুর জীবন।
জাহিদ দীর্ঘ সিঁড়ি ভেঙে নেমে এলো একা।
কিন্তু কিছুতেই মনের আড়াল করা যাবে না মিতুকে। কেউ জানবে না। জানবে শুধু সে। একা।
No comments