কেন লিখি বুদ্ধদেব বসু ও আবু সয়ীদ আইয়ুবের দর্শন by রাজীব সরকার
কেন
লিখি? এ প্রশ্নের উত্তর দেশে-বিদেশে বরেণ্য লেখকরা নানাভাবে দিয়েছেন।
তাদের মতবৈচিত্র্যের প্রতি দৃষ্টি রেখে তাদের বক্তব্যকে মোটা দাগে দুই ভাগে
ভাগ করা যায়; প্রথমত সমাজের কল্যাণ সাধন তথা কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য
সাধনের উপায় হিসেবে সাহিত্যচর্চা, দ্বিতীয়ত আপন মনের আনন্দে তথা সৌন্দর্য
সৃষ্টির জন্য সাহিত্যচর্চা। দ্বিতীয়োক্ত ধারার অনুসারীরা বাংলা সাহিত্যে
‘কলাকৈবল্যবাদী’ বলে পরিচিত। 'Art for life's sake' I 'Art for art's sake'
-এই দুই ঘরানার মধ্যে সীমাবদ্ধ সাহিত্যচর্চার উদ্দেশ্য। এর বাইরে আরেকটি
ধারা ইদানীং জাঁকিয়ে বসেছে। এর মূলে রয়েছে সাহিত্যের পণ্যায়ন।
পণ্য-ভোগবাদের স্থুল জগতে এখন সাহিত্যেরও প্রবেশাধিকার তৈরি হয়েছে। এ
ঘরানার লেখকদের দায়বদ্ধতা সাহিত্যের বাজারের কাছে। বইমেলার বাজার, শারদীয়া
সংখ্যার বাজার, ঈদসংখ্যার বাজার- নানা উপলক্ষে এ লেখকরা সরব হয়ে ওঠেন।
পাঠক-পাঠিকার মনোরঞ্জন যেহেতু এ লেখকদের একমাত্র উদ্দেশ্য তাই সমাজের
কল্যাণ সাধন সম্ভব না হলেও আত্মহিত সাধনে তারা পুরোপুরি সফল, অন্তত বৈষয়িক
প্রাপ্তিযোগের দিক থেকে।
বর্তমান আলোচনায় যৌক্তিক কারণেই স্মরণ করতে হচ্ছে বাংলা সাহিত্যের দুই কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব বুদ্ধদেব বসু ও আবু সয়ীদ আইয়ুবকে। সাহিত্যচর্চার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাদের বক্তব্য এযুগেও প্রাসঙ্গিক। তাদের বক্তব্য তথা জীবনদর্শন গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, বাংলা সমালোচনা সাহিত্যে এ দুই লেখকের সমকক্ষতা কেউ অর্জন করতে পারেননি।
কলাকৈবল্যবাদের পক্ষে বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন বুদ্ধদেব বসু। তিনি মনে করেন সাহিত্য-শিল্পকলার কোনো সামাজিক উপযোগিতা থাকতে পারে না। সমাজের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটেছে আধুনিককালের শিল্পীর। যে কোনো মহৎ শিল্পীর অন্তিম পরিণতি স্বেচ্ছা নির্বাসন। শার্ল বোদলেয়ার : তার কবিতার ভূীমকায় বুদ্ধদেব লেখেন :
‘যে মধ্য-উনিশ শতকে ইংল্যান্ডে উপযোগবাদের অভ্যুদয় হল, সেই সময়ে বোদলেয়ার ঘোষণা করেন যে, কবি কোনো ‘কাজে লাগেন’ না, যে বায়রনি বিদ্রোহের দিন গত হয়েছে, পূর্ণ হয়েছে সমাজের সঙ্গে কবির বিচ্ছেদ, প্রতিবাদ করলেও প্রতিবাদের পাত্রকে স্বীকার করে নিতে হয়, অতএব, একমাত্র যা সহনীয় ও সম্ভব তা উপেক্ষা ও স্বেচ্ছাবৃত্ত নির্বাসন।
গত শতকের তিরিশের দশক থেকে মার্কসবাদী চেতনা প্রবল হয়ে ওঠে বাংলা সাহিত্যে। প্রগতিশীল রাজনীতির ধারক এ লেখক-সমালোচকদের দৃষ্টিতে কলাকৈবল্যবাদ জীবন থেকে পলায়নের নামান্তর। এ বক্তব্যের জবাবে বুদ্ধদেব রচনা করেন ‘পলায়ন’ নামে একটি তাৎপর্যপূর্ণ প্রবন্ধ। প্রবন্ধের শুরুতেই তিনি জানান যে, তার বক্তব্য প্রতিপক্ষের প্রগতিশীল বন্ধুদের কাছে ‘পলায়নী মনোবৃত্তি’র পরিচায়ক। রাজনৈতিক বিষয়ে কিছু কবিতা লিখলেই যদি পলায়নবাদীর কলংক ঘুচে যায় তবে সে চেষ্টা তার পক্ষে অসম্ভব নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি ভরসা পান না কারণ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের ওপরও এ অপবাদ বর্ষিত হয় যিনি রাজনৈতিক রচনার অতুলনীয় ভাণ্ডার।
যারা বুদ্ধদেব ও তার সাহিত্যিক সহযাত্রীদের পলায়নবাদী বলেছেন, তাদের বুদ্ধদেব অশ্রদ্ধা করেননি। তার মতে তারা বিদ্বান ও কৃতী ব্যক্তি হতে পারেন, কিন্তু সাহিত্যবিচার তাদের এলাকা নয়। তাদের সীমাবদ্ধতা হচ্ছে তারা সাহিত্যের বিষয়বস্তু মাত্র বিবেচনা করেন, শিল্পকর্ম হিসেবে তাকে দেখেন না। তাদের লক্ষ্য মহৎ হতে পারে কিন্তু সাহিত্য বা শিল্পকর্ম দ্বারা সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে এমন ধারণা ভুল। বোঝা শক্ত নয় যে, মার্কসবাদী তাত্ত্বিক ও লেখকদের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন বুদ্ধদেব বসু। তাদের বিরুদ্ধে তার অভিযোগ :
‘তারা চান আমাদের দিয়ে তাদের কথা বলাতে, সাহিত্যকে প্রত্যক্ষভাবে সামাজিক লক্ষ্য সাধনের অস্ত্র করে তুলতে; কিন্তু এ উপায়ে তাদের উদ্দেশ্যের দিকে অগ্রসর হওয়ার কোনো আশা নেই, অথচ সাহিত্যের ক্ষতির আশঙ্কা আছে। সেসব লেখারই তারা খুব বেশি তারিফ করেন, যেগুলো গল্পচ্ছলে প্রপাগাণ্ডা কিংবা কবিতার আকারে তত্ত্বকথা, তার মূল্য নেই বলি না, সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়েরও মূল্য আছে, তবে সে মূল্য সাহিত্যিক নয়। এসব যারা লেখেন আশা করি তারা সামাজিক লক্ষ্য সাধনের আগ্রহে দিন রাত জ্বলছেন, কিন্তু তাই যদি হয়, গল্প কবিতা লিখে যে কিছুই হবে না তা তারা নিশ্চয়ই জানেন, কী করলে হতে পারে তাও জানেন, তবে সে কাজ না করে খামখা কালি-কাগজ খরচ করেন কেন? তাহলে বলতে হয় যে, কর্মক্ষেত্রে নামার শক্তি কি ইচ্ছা তাদের নেই, সেজন্য অতি কঠোর ভীষণ কর্মছাড়া যা কখনোই সাধিত হতে পারে না, গরম গরম কিছু লিখলেই তা যেন হয়ে যাবে, এ রকম একটা ভালো তারা সর্বদাই করে থাকেন। অর্থাৎ কর্মক্ষেত্র থেকে পালিয়ে তারা আশ্রয় নেন সাহিত্যের নিরাপদ প্রঙ্গণে- সে হিসেবে এস্কেপিস্ট যদি কোনো কিছুকে বলা যায় তো তাদের প্রপাগাণ্ডিক রচনাকেই। অন্তত শিল্প রচনায় কলাকৌশলের কঠিন সংযম থেকে তারা যে প্রায়ই পলাতক তাতে সন্দেহ নেই।’
বুদ্ধদেবের তীক্ষ্ণ যুক্তি ও আকর্ষণীয় গদ্যশৈলী প্রতিপক্ষকে সহজেই কাবু করতে সক্ষম এমন উদাহরণ অগণিত। এ ক্ষেত্রেও তিনি ব্যতিক্রম নন।
‘রাজনীতিবিমুখ বলে বুদ্ধদেবের পরিচিতি রয়েছে। একাধিক লেখায় তিনি বলেছেন যে, রাজনীতি কখনোই তার আগ্রহের বিষয় ছিল না। এর মানে এই নয় যে, তিনি জীবনবিমুখ। ‘সভ্যতা ও ফ্যাসিজম’ নামে একটি অবিস্মরণীয় ও মানবতাবাদী প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, অসুন্দর ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে কবি-শিল্পীরা সহজাত গুণেই রুখে দাঁড়াবে। এর মধ্যে রাজনীতির কোনো দৃঢ়তত্ত্ব নেই। মনুষ্যত্বের, কবি চরিত্রের এটি ন্যূনতম দাবি। এটি বর্বরতার বিরুদ্ধাচরণ মাত্র, এর সঙ্গে রাজনীতির কোনো যোগাযোগ নেই। সাহিত্যচর্চার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসুর চূড়ান্ত অবস্থান বোঝা যায় ‘পলায়ন’ প্রবন্ধের শেষাংশে :
‘আমি যদি আমার রচনায় ধনতন্ত্রের কালান্তক মূর্তির বর্ণনা করি তাহলেই যেমন লাফিয়ে উঠবার কিছু নেই, তেমনি যদি প্রিয়ার আঁখির বন্দনা করি তাতেও হতাশ হওয়ার কারণ দেখি না। যে কোনো অবস্থায়, যে কোনো দুরবস্থায়, উভয় বস্তুই কাব্যের বিষয় হতে পারে এবং উভয়ক্ষেত্রেই শুধু এটুকু বিচার করতে হবে যে, রচনাটা যথার্থ সাহিত্য হয়েছে কি না। শিল্পকলার মূল্য তার নিজেরই মধ্যে, অন্য কোনো উপলক্ষ কি উদ্দেশ্য থেকে ধার করা নয়, এ কথা ভুলে যাওয়া আর মূলগত মূল্যবোধ হারানো একই কথা।’
আবু সয়ীদ আইয়ুবের দৃষ্টিভঙ্গি বুদ্ধদেব বসুর মতো অনমনীয় নয়। সাহিত্যের চরম ও উপকরণ মূল্য প্রবন্ধে তিনি স্বীকার করেছেন :
‘নির্জনতা-বিলাসী শিল্পীর দিন গিয়েছে। পুণ্যোদক নির্ঝরিণীর তীরে স্নিগ্ধছায় তরুতলে বসে মন্দাক্রান্তা ছন্দে বিরহগাথা রচনা করে আধিক্ষামা বলিব্যাকুলা দয়িতার উদ্দেশে পাঠানো এ যুগের কবির কাজ নয়। পুরাতন সমাজের পাড় ভাঙছে একদিকে, নতুন সমাজের পলি জমছে আর একদিকে। এই ভাঙাগড়ার মহাযজ্ঞশালায় ডাক পড়েছে সমস্ত শিল্পীর।... সমাজ জীবনের ভাঙাগড়ার মাঝখান দিয়ে চলেছে ইতিহাসের যে ধারা, কোনো শিল্পী যদি তার সৃষ্টিক্ষেত্রকে তার তরঙ্গাঘাত থেকে সযত্নে বাঁচিয়ে রাখেন তবে তার উর্বরতা যাবে নষ্ট হয়ে, তা আর শস্যশ্যামল থাকবে না, হবে ধূসর ভূমি- আধুনিক কৃষ্টিতে যে মরুভূীম দেখতে পেয়ে বিলাপ করেছেন এলিয়ট তার ক্ষুদ্রকায় মহাকাব্যে।’
নিজের এ বক্তব্যে বেশিদিন আস্থাবান থাকতে পারেননি তিনি। কারণ এক প্রবল রাজনৈতিক ধারা সাহিত্যকে আপন ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে টেনে আত্মসাৎ করতে উদ্যত, যেভাবে মধ্যযুগে ধর্ম আত্মসাৎ করেছিল শিল্প-সাহিত্য-দর্শন ও বিজ্ঞানের স্বতন্ত্র বিকাশকে। যে কোনো বিবেকবান শিল্পীর মতো আইয়ুব এ আত্মসাৎ প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করেছেন। সেই প্রচল রাজনৈতিক ধারা বা মার্কসবাদী চেতনাকে তিনি তাচ্ছিল্য করেননি। সেই চেতনা যদি বলে, সমাজের চরম সংকটকালে লেখক নির্লিপ্ত থাকতে পারেন না, ধনী-নির্ধনের চূড়ান্ত দ্বন্দ্বের সময় লেখককেও নির্ধনের পক্ষে দাঁড়াতে হবে, সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে হবে তবে সেই চেতনার আহ্বানে সাড়া দিতে আইয়ুব প্রস্তুত। কিন্তু সেই চেতনার প্রবক্তারা মনে করেন, সেই চেতনাপুষ্ট সাহিত্যই শ্রেষ্ঠ সাহিত্য। তার অভিযোগ সাহিত্যিকের সমাজচেতনা প্রবন্ধে :
‘আমাদের বিপ্লবী নেতারা সরাসরিভাবে বলে বসলেন যে, এই সাহিত্যই সেরা সাহিত্য, একমাত্র সাহিত্য, অন্য যে কোনো প্রকারের সাহিত্য অগ্রাহ্য, অসহ্য। যদি তারা এ যুগের সবচেয়ে প্রাগ্রসর রাজনৈতিক আদর্শ ও ভাবধারার সঙ্গে সাহিত্যিকের পরিচয় ঘটিয়ে এবং তার প্রতি তাদের সহানুভূতি আকর্ষণ করেই ক্ষান্ত হতেন, এই নতুন মতাদর্শকে শিল্পকর্মে রূপায়িত করার ভার শিল্পীদের ওপরই ছেড়ে দিতেন, তা হলেও নালিশের প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু শিল্পী-সাহিত্যের কাছে তারা দাবি করলেন সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ এবং আত্মবিলোপ।
স্বভাবতই শিল্পীর এ আত্মবিলোপের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন আইয়ুব। আত্মবিলোপ আত্মহত্যারই নামান্তর। তিনি এক্ষেত্রে সচেতন যে কোনো সাহিত্যিক যদি প্রগতির প্রকৃত আদর্শ গ্রহণ করে থাকেন এবং সেই আদর্শ যদি তার মনের ভেতর সাড়া জাগায়, তবে সেই আদর্শে তার সাহিত্যসম্ভার সমৃদ্ধ হবে। সাহিত্যিকের পক্ষে সুস্থ রাজনৈতিক চেতনার স্পর্শ বাঁচিয়ে চলার পরিণাম আপন সাহিত্যি সৃষ্টিকে ক্ষীণ শৌখিন করে তোলা। কারণ শিল্পী সাহিত্যিকের মন হচ্ছে সমাজের সূক্ষœতম বীণাতন্ত্র। সমাজের সংকটের আওয়াজ সর্বাগ্রে ধ্বনিত হবে সেই বীণার তারে এবং তার ঝংকার সাড়া জাগবে দেশজোড়া মানুষের চিত্তে। আইয়ুব মনে করেন দুঃখ থেকে পরিত্রাণের পথ শিল্পীকেই সবার আগে দেখাতে হবে। সমাজসেবী ও সাহিত্যসেবীর সহযোগ অবাঞ্ছিত নয়। তবে তা যেন রাষ্ট্রনেতার কাছে সাহিত্যিকের আÍবিলোপ না হয়। শিল্পীর স্বাধীন মনকে উপেক্ষা করে সামষ্টিক কল্যাণের জন্য বহিরাগত নির্দেশ, সাহিত্য সমালোচনাকে দলীয় অনুজ্ঞায় পরিণত করার প্রয়াস অবশ্যই নিন্দনীয়।
আইয়ুব বিশ্বাস করেন যে, শিল্পসৃষ্টি বা সত্যসন্ধানের ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বরূপের উন্মোচন একান্ত অপরিহার্য। এটি মোটেও ব্যক্তিসর্বস্বতা নয়। এদের বৈচিত্র্য ও স্বাতন্ত্রই সমষ্টির জীবনকে সমৃদ্ধ করবে, সে জীবনপ্রবাহে বেগ সঞ্জার করবে। এ বক্তব্যের প্রতিধ্বনি শুনি রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’তে। কবিগুরুর উপলব্ধি :
‘সমষ্টির খাতিরে ব্যষ্টির প্রতি পীড়নে এরা কোনো বাধাই মানতে চায় না। ভুলে যায় ব্যষ্টিকে দুর্বল করে সমষ্টিকে সবল করা যায় না; ব্যষ্টি যদি শৃঙ্খলিত হয় তবে সমষ্টি স্বাধীন হতে পারে না।’
বুদ্ধদেব বসুর মতো আবু সয়ীদ আইয়ুবের ‘মার্কসবাদবিরোধী’ পরিচিতি নেই। বুদ্ধদেবের বাক্যবাণে মার্কসবাদী চেনতা যেভাবে আহত হয়েছে এর নজির আইয়ুবের রচনায় নেই। বুদ্ধদেবের মতো সমকালীন সাহিত্য আন্দোলনকে প্রতিষ্ঠাদানের কোনো দায় আইয়ুবের ছিল না। তাই বুদ্ধদেবের তুলনায় আইয়ুবের বক্তব্য অধিকতর নির্মোহ ও যুক্তিপ্রভাবিত। মার্কসবাদী সাহিত্য আন্দোলন যে সাহিত্য বিষয়ের সীমানা প্রসারিত করেছে এ বিষয়ে আইয়ুব সচেতন ছিলেন। তাই মার্কসবাদী সাহিত্যবীক্ষাকে প্রাপ্য স্বীকৃতি দিতে তিনি কুণ্ঠিত নন :
‘সমাজের বৃহত্তর অংশ- যাদের ছোটোলোক বলে এতদিন উপেক্ষা করা হয়েছে- আজ তারা সাহিত্যে যেটুকু স্থান পাচ্ছে তার জন্য প্রধানত মার্কসবাদী প্রচেষ্টাই দায়ী। মার্কসবাদীদের আর একটি করণীয় কৃতিত্ব ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের নিবিড় সম্পর্ককে সাহিত্যিকের চোখে প্রত্যক্ষ করে তোলা। এর ফলে আমাদের সাহিত্যের, বিশেষত কথাসাহিত্যের মেরুদণ্ড শক্ত হয়েছে। মার্কসবাদী সাহিত্যনীতির সঙ্গে আমাদের অনেকের অল্পবিস্তর মতভেদ আছে। মতভেদ আছে বলে আমরা যেন ভুলে না যাই যে তারা সাহিত্যে এক নূতন সমাজচেতনা এনেছেন এবং প্রর্বতন সমাজচেতনাকে দৃঢ় ও প্রশস্ত করেছেন। এই সমাজচেতনার সাহিত্যিক ও সামাজিক মূল্য স্থায়ী।’
মার্কসবাদী সাহিত্যচেতনা তথা সাহিত্যিকের রাজনৈতিক চেতনার প্রতি আইয়ুবের মতো সমর্থন বুদ্ধদেব বসুর কোনো রচনায় পাওয়া যায় না। লেখালেখির দায় সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যাই হোক না কেন, বাংলা সাহিত্যের প্রতি যে দু’জনই দায়িত্ববান ছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সমাজের প্রতি তারা কতটুকু দায়বদ্ধ ছিলেন সেই বিতর্কে না গিয়ে সাহিত্যের প্রতি যে দায়িত্বশীলতার পরিচয় তারা দিয়েছেন তা স্মরণ করা লেখক মাত্রেরই অবশ্য কর্তব্য।
বর্তমান আলোচনায় যৌক্তিক কারণেই স্মরণ করতে হচ্ছে বাংলা সাহিত্যের দুই কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব বুদ্ধদেব বসু ও আবু সয়ীদ আইয়ুবকে। সাহিত্যচর্চার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাদের বক্তব্য এযুগেও প্রাসঙ্গিক। তাদের বক্তব্য তথা জীবনদর্শন গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, বাংলা সমালোচনা সাহিত্যে এ দুই লেখকের সমকক্ষতা কেউ অর্জন করতে পারেননি।
কলাকৈবল্যবাদের পক্ষে বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন বুদ্ধদেব বসু। তিনি মনে করেন সাহিত্য-শিল্পকলার কোনো সামাজিক উপযোগিতা থাকতে পারে না। সমাজের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটেছে আধুনিককালের শিল্পীর। যে কোনো মহৎ শিল্পীর অন্তিম পরিণতি স্বেচ্ছা নির্বাসন। শার্ল বোদলেয়ার : তার কবিতার ভূীমকায় বুদ্ধদেব লেখেন :
‘যে মধ্য-উনিশ শতকে ইংল্যান্ডে উপযোগবাদের অভ্যুদয় হল, সেই সময়ে বোদলেয়ার ঘোষণা করেন যে, কবি কোনো ‘কাজে লাগেন’ না, যে বায়রনি বিদ্রোহের দিন গত হয়েছে, পূর্ণ হয়েছে সমাজের সঙ্গে কবির বিচ্ছেদ, প্রতিবাদ করলেও প্রতিবাদের পাত্রকে স্বীকার করে নিতে হয়, অতএব, একমাত্র যা সহনীয় ও সম্ভব তা উপেক্ষা ও স্বেচ্ছাবৃত্ত নির্বাসন।
গত শতকের তিরিশের দশক থেকে মার্কসবাদী চেতনা প্রবল হয়ে ওঠে বাংলা সাহিত্যে। প্রগতিশীল রাজনীতির ধারক এ লেখক-সমালোচকদের দৃষ্টিতে কলাকৈবল্যবাদ জীবন থেকে পলায়নের নামান্তর। এ বক্তব্যের জবাবে বুদ্ধদেব রচনা করেন ‘পলায়ন’ নামে একটি তাৎপর্যপূর্ণ প্রবন্ধ। প্রবন্ধের শুরুতেই তিনি জানান যে, তার বক্তব্য প্রতিপক্ষের প্রগতিশীল বন্ধুদের কাছে ‘পলায়নী মনোবৃত্তি’র পরিচায়ক। রাজনৈতিক বিষয়ে কিছু কবিতা লিখলেই যদি পলায়নবাদীর কলংক ঘুচে যায় তবে সে চেষ্টা তার পক্ষে অসম্ভব নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি ভরসা পান না কারণ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের ওপরও এ অপবাদ বর্ষিত হয় যিনি রাজনৈতিক রচনার অতুলনীয় ভাণ্ডার।
যারা বুদ্ধদেব ও তার সাহিত্যিক সহযাত্রীদের পলায়নবাদী বলেছেন, তাদের বুদ্ধদেব অশ্রদ্ধা করেননি। তার মতে তারা বিদ্বান ও কৃতী ব্যক্তি হতে পারেন, কিন্তু সাহিত্যবিচার তাদের এলাকা নয়। তাদের সীমাবদ্ধতা হচ্ছে তারা সাহিত্যের বিষয়বস্তু মাত্র বিবেচনা করেন, শিল্পকর্ম হিসেবে তাকে দেখেন না। তাদের লক্ষ্য মহৎ হতে পারে কিন্তু সাহিত্য বা শিল্পকর্ম দ্বারা সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে এমন ধারণা ভুল। বোঝা শক্ত নয় যে, মার্কসবাদী তাত্ত্বিক ও লেখকদের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন বুদ্ধদেব বসু। তাদের বিরুদ্ধে তার অভিযোগ :
‘তারা চান আমাদের দিয়ে তাদের কথা বলাতে, সাহিত্যকে প্রত্যক্ষভাবে সামাজিক লক্ষ্য সাধনের অস্ত্র করে তুলতে; কিন্তু এ উপায়ে তাদের উদ্দেশ্যের দিকে অগ্রসর হওয়ার কোনো আশা নেই, অথচ সাহিত্যের ক্ষতির আশঙ্কা আছে। সেসব লেখারই তারা খুব বেশি তারিফ করেন, যেগুলো গল্পচ্ছলে প্রপাগাণ্ডা কিংবা কবিতার আকারে তত্ত্বকথা, তার মূল্য নেই বলি না, সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়েরও মূল্য আছে, তবে সে মূল্য সাহিত্যিক নয়। এসব যারা লেখেন আশা করি তারা সামাজিক লক্ষ্য সাধনের আগ্রহে দিন রাত জ্বলছেন, কিন্তু তাই যদি হয়, গল্প কবিতা লিখে যে কিছুই হবে না তা তারা নিশ্চয়ই জানেন, কী করলে হতে পারে তাও জানেন, তবে সে কাজ না করে খামখা কালি-কাগজ খরচ করেন কেন? তাহলে বলতে হয় যে, কর্মক্ষেত্রে নামার শক্তি কি ইচ্ছা তাদের নেই, সেজন্য অতি কঠোর ভীষণ কর্মছাড়া যা কখনোই সাধিত হতে পারে না, গরম গরম কিছু লিখলেই তা যেন হয়ে যাবে, এ রকম একটা ভালো তারা সর্বদাই করে থাকেন। অর্থাৎ কর্মক্ষেত্র থেকে পালিয়ে তারা আশ্রয় নেন সাহিত্যের নিরাপদ প্রঙ্গণে- সে হিসেবে এস্কেপিস্ট যদি কোনো কিছুকে বলা যায় তো তাদের প্রপাগাণ্ডিক রচনাকেই। অন্তত শিল্প রচনায় কলাকৌশলের কঠিন সংযম থেকে তারা যে প্রায়ই পলাতক তাতে সন্দেহ নেই।’
বুদ্ধদেবের তীক্ষ্ণ যুক্তি ও আকর্ষণীয় গদ্যশৈলী প্রতিপক্ষকে সহজেই কাবু করতে সক্ষম এমন উদাহরণ অগণিত। এ ক্ষেত্রেও তিনি ব্যতিক্রম নন।
‘রাজনীতিবিমুখ বলে বুদ্ধদেবের পরিচিতি রয়েছে। একাধিক লেখায় তিনি বলেছেন যে, রাজনীতি কখনোই তার আগ্রহের বিষয় ছিল না। এর মানে এই নয় যে, তিনি জীবনবিমুখ। ‘সভ্যতা ও ফ্যাসিজম’ নামে একটি অবিস্মরণীয় ও মানবতাবাদী প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, অসুন্দর ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে কবি-শিল্পীরা সহজাত গুণেই রুখে দাঁড়াবে। এর মধ্যে রাজনীতির কোনো দৃঢ়তত্ত্ব নেই। মনুষ্যত্বের, কবি চরিত্রের এটি ন্যূনতম দাবি। এটি বর্বরতার বিরুদ্ধাচরণ মাত্র, এর সঙ্গে রাজনীতির কোনো যোগাযোগ নেই। সাহিত্যচর্চার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসুর চূড়ান্ত অবস্থান বোঝা যায় ‘পলায়ন’ প্রবন্ধের শেষাংশে :
‘আমি যদি আমার রচনায় ধনতন্ত্রের কালান্তক মূর্তির বর্ণনা করি তাহলেই যেমন লাফিয়ে উঠবার কিছু নেই, তেমনি যদি প্রিয়ার আঁখির বন্দনা করি তাতেও হতাশ হওয়ার কারণ দেখি না। যে কোনো অবস্থায়, যে কোনো দুরবস্থায়, উভয় বস্তুই কাব্যের বিষয় হতে পারে এবং উভয়ক্ষেত্রেই শুধু এটুকু বিচার করতে হবে যে, রচনাটা যথার্থ সাহিত্য হয়েছে কি না। শিল্পকলার মূল্য তার নিজেরই মধ্যে, অন্য কোনো উপলক্ষ কি উদ্দেশ্য থেকে ধার করা নয়, এ কথা ভুলে যাওয়া আর মূলগত মূল্যবোধ হারানো একই কথা।’
আবু সয়ীদ আইয়ুবের দৃষ্টিভঙ্গি বুদ্ধদেব বসুর মতো অনমনীয় নয়। সাহিত্যের চরম ও উপকরণ মূল্য প্রবন্ধে তিনি স্বীকার করেছেন :
‘নির্জনতা-বিলাসী শিল্পীর দিন গিয়েছে। পুণ্যোদক নির্ঝরিণীর তীরে স্নিগ্ধছায় তরুতলে বসে মন্দাক্রান্তা ছন্দে বিরহগাথা রচনা করে আধিক্ষামা বলিব্যাকুলা দয়িতার উদ্দেশে পাঠানো এ যুগের কবির কাজ নয়। পুরাতন সমাজের পাড় ভাঙছে একদিকে, নতুন সমাজের পলি জমছে আর একদিকে। এই ভাঙাগড়ার মহাযজ্ঞশালায় ডাক পড়েছে সমস্ত শিল্পীর।... সমাজ জীবনের ভাঙাগড়ার মাঝখান দিয়ে চলেছে ইতিহাসের যে ধারা, কোনো শিল্পী যদি তার সৃষ্টিক্ষেত্রকে তার তরঙ্গাঘাত থেকে সযত্নে বাঁচিয়ে রাখেন তবে তার উর্বরতা যাবে নষ্ট হয়ে, তা আর শস্যশ্যামল থাকবে না, হবে ধূসর ভূমি- আধুনিক কৃষ্টিতে যে মরুভূীম দেখতে পেয়ে বিলাপ করেছেন এলিয়ট তার ক্ষুদ্রকায় মহাকাব্যে।’
নিজের এ বক্তব্যে বেশিদিন আস্থাবান থাকতে পারেননি তিনি। কারণ এক প্রবল রাজনৈতিক ধারা সাহিত্যকে আপন ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে টেনে আত্মসাৎ করতে উদ্যত, যেভাবে মধ্যযুগে ধর্ম আত্মসাৎ করেছিল শিল্প-সাহিত্য-দর্শন ও বিজ্ঞানের স্বতন্ত্র বিকাশকে। যে কোনো বিবেকবান শিল্পীর মতো আইয়ুব এ আত্মসাৎ প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করেছেন। সেই প্রচল রাজনৈতিক ধারা বা মার্কসবাদী চেতনাকে তিনি তাচ্ছিল্য করেননি। সেই চেতনা যদি বলে, সমাজের চরম সংকটকালে লেখক নির্লিপ্ত থাকতে পারেন না, ধনী-নির্ধনের চূড়ান্ত দ্বন্দ্বের সময় লেখককেও নির্ধনের পক্ষে দাঁড়াতে হবে, সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে হবে তবে সেই চেতনার আহ্বানে সাড়া দিতে আইয়ুব প্রস্তুত। কিন্তু সেই চেতনার প্রবক্তারা মনে করেন, সেই চেতনাপুষ্ট সাহিত্যই শ্রেষ্ঠ সাহিত্য। তার অভিযোগ সাহিত্যিকের সমাজচেতনা প্রবন্ধে :
‘আমাদের বিপ্লবী নেতারা সরাসরিভাবে বলে বসলেন যে, এই সাহিত্যই সেরা সাহিত্য, একমাত্র সাহিত্য, অন্য যে কোনো প্রকারের সাহিত্য অগ্রাহ্য, অসহ্য। যদি তারা এ যুগের সবচেয়ে প্রাগ্রসর রাজনৈতিক আদর্শ ও ভাবধারার সঙ্গে সাহিত্যিকের পরিচয় ঘটিয়ে এবং তার প্রতি তাদের সহানুভূতি আকর্ষণ করেই ক্ষান্ত হতেন, এই নতুন মতাদর্শকে শিল্পকর্মে রূপায়িত করার ভার শিল্পীদের ওপরই ছেড়ে দিতেন, তা হলেও নালিশের প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু শিল্পী-সাহিত্যের কাছে তারা দাবি করলেন সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ এবং আত্মবিলোপ।
স্বভাবতই শিল্পীর এ আত্মবিলোপের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন আইয়ুব। আত্মবিলোপ আত্মহত্যারই নামান্তর। তিনি এক্ষেত্রে সচেতন যে কোনো সাহিত্যিক যদি প্রগতির প্রকৃত আদর্শ গ্রহণ করে থাকেন এবং সেই আদর্শ যদি তার মনের ভেতর সাড়া জাগায়, তবে সেই আদর্শে তার সাহিত্যসম্ভার সমৃদ্ধ হবে। সাহিত্যিকের পক্ষে সুস্থ রাজনৈতিক চেতনার স্পর্শ বাঁচিয়ে চলার পরিণাম আপন সাহিত্যি সৃষ্টিকে ক্ষীণ শৌখিন করে তোলা। কারণ শিল্পী সাহিত্যিকের মন হচ্ছে সমাজের সূক্ষœতম বীণাতন্ত্র। সমাজের সংকটের আওয়াজ সর্বাগ্রে ধ্বনিত হবে সেই বীণার তারে এবং তার ঝংকার সাড়া জাগবে দেশজোড়া মানুষের চিত্তে। আইয়ুব মনে করেন দুঃখ থেকে পরিত্রাণের পথ শিল্পীকেই সবার আগে দেখাতে হবে। সমাজসেবী ও সাহিত্যসেবীর সহযোগ অবাঞ্ছিত নয়। তবে তা যেন রাষ্ট্রনেতার কাছে সাহিত্যিকের আÍবিলোপ না হয়। শিল্পীর স্বাধীন মনকে উপেক্ষা করে সামষ্টিক কল্যাণের জন্য বহিরাগত নির্দেশ, সাহিত্য সমালোচনাকে দলীয় অনুজ্ঞায় পরিণত করার প্রয়াস অবশ্যই নিন্দনীয়।
আইয়ুব বিশ্বাস করেন যে, শিল্পসৃষ্টি বা সত্যসন্ধানের ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বরূপের উন্মোচন একান্ত অপরিহার্য। এটি মোটেও ব্যক্তিসর্বস্বতা নয়। এদের বৈচিত্র্য ও স্বাতন্ত্রই সমষ্টির জীবনকে সমৃদ্ধ করবে, সে জীবনপ্রবাহে বেগ সঞ্জার করবে। এ বক্তব্যের প্রতিধ্বনি শুনি রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’তে। কবিগুরুর উপলব্ধি :
‘সমষ্টির খাতিরে ব্যষ্টির প্রতি পীড়নে এরা কোনো বাধাই মানতে চায় না। ভুলে যায় ব্যষ্টিকে দুর্বল করে সমষ্টিকে সবল করা যায় না; ব্যষ্টি যদি শৃঙ্খলিত হয় তবে সমষ্টি স্বাধীন হতে পারে না।’
বুদ্ধদেব বসুর মতো আবু সয়ীদ আইয়ুবের ‘মার্কসবাদবিরোধী’ পরিচিতি নেই। বুদ্ধদেবের বাক্যবাণে মার্কসবাদী চেনতা যেভাবে আহত হয়েছে এর নজির আইয়ুবের রচনায় নেই। বুদ্ধদেবের মতো সমকালীন সাহিত্য আন্দোলনকে প্রতিষ্ঠাদানের কোনো দায় আইয়ুবের ছিল না। তাই বুদ্ধদেবের তুলনায় আইয়ুবের বক্তব্য অধিকতর নির্মোহ ও যুক্তিপ্রভাবিত। মার্কসবাদী সাহিত্য আন্দোলন যে সাহিত্য বিষয়ের সীমানা প্রসারিত করেছে এ বিষয়ে আইয়ুব সচেতন ছিলেন। তাই মার্কসবাদী সাহিত্যবীক্ষাকে প্রাপ্য স্বীকৃতি দিতে তিনি কুণ্ঠিত নন :
‘সমাজের বৃহত্তর অংশ- যাদের ছোটোলোক বলে এতদিন উপেক্ষা করা হয়েছে- আজ তারা সাহিত্যে যেটুকু স্থান পাচ্ছে তার জন্য প্রধানত মার্কসবাদী প্রচেষ্টাই দায়ী। মার্কসবাদীদের আর একটি করণীয় কৃতিত্ব ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের নিবিড় সম্পর্ককে সাহিত্যিকের চোখে প্রত্যক্ষ করে তোলা। এর ফলে আমাদের সাহিত্যের, বিশেষত কথাসাহিত্যের মেরুদণ্ড শক্ত হয়েছে। মার্কসবাদী সাহিত্যনীতির সঙ্গে আমাদের অনেকের অল্পবিস্তর মতভেদ আছে। মতভেদ আছে বলে আমরা যেন ভুলে না যাই যে তারা সাহিত্যে এক নূতন সমাজচেতনা এনেছেন এবং প্রর্বতন সমাজচেতনাকে দৃঢ় ও প্রশস্ত করেছেন। এই সমাজচেতনার সাহিত্যিক ও সামাজিক মূল্য স্থায়ী।’
মার্কসবাদী সাহিত্যচেতনা তথা সাহিত্যিকের রাজনৈতিক চেতনার প্রতি আইয়ুবের মতো সমর্থন বুদ্ধদেব বসুর কোনো রচনায় পাওয়া যায় না। লেখালেখির দায় সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যাই হোক না কেন, বাংলা সাহিত্যের প্রতি যে দু’জনই দায়িত্ববান ছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সমাজের প্রতি তারা কতটুকু দায়বদ্ধ ছিলেন সেই বিতর্কে না গিয়ে সাহিত্যের প্রতি যে দায়িত্বশীলতার পরিচয় তারা দিয়েছেন তা স্মরণ করা লেখক মাত্রেরই অবশ্য কর্তব্য।
No comments