মাটি, মানুষ ও জীবন চেতনার কথাশিল্পী by খুরশীদ আলম বাবু
নাজিব
ওয়াদুদ (জন্ম ২০ জুলাই ১৯৬১) সাধনাসিক্ত তরুণ কথাকারদের একজন। বিগত
শতাব্দীর আশির দশকের শেষ দিকে তার আবির্ভাব, তবে নব্বই দশকে তার প্রতিভার
আসল ব্যাপ্তি ঘটেছে। প্রথমে একথা কবুল করা ভালো, নাজিব ওয়াদুদের একেবারে
প্রথম দিককার গল্প তেমন হৃদয়গ্রাহ্য না হলেও পরবর্তীকালে আমরা বিস্ময়ের
সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, তিনি উত্তরণের মাত্রা দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিলেন।
গল্পকারদের মধ্যে উজ্জ্বলতম বলে আখ্যায়িত করতে দ্বিধা থাকছে না। অন্তত অতি
সম্প্রতি প্রকাশিত ‘বরেন্দ্রবাংলার গল্প’ গ্রন্থের গল্পগুলো তার সামর্থের
পরিচয় আরও উজ্জ্বলতর করেছে। ‘বরেন্দ্রবাংলার গল্প’র পরিবেশ মূলত বরেন্দ্র
অঞ্চল; এখানকার মাটি, আবহাওয়া ও পরিবেশ খুব রুক্ষ। এই পরিমণ্ডলের মধ্যে
বসবাসরত মধ্যবিত্ত থেকে নিুবিত্ত পরিবারের মানব-মানবীদের প্রেম-ব্যর্থতা
কিছুটা হলেও অর্থনৈতিক অসাম্যতার দিকেই আলোকপাত করে। ‘বরেন্দ্রবাংলার
গল্প’-তে মানুষ, জমি-জমা, হাট-বাজার, যাত্রা-পালার এমন জীবন্ত বর্ণনা এসেছে
যা অন্য কোনো গল্পকারের লেখায় সচরাচর দেখি না। সেজন্য আমাদের এ গল্পকারকে
নিয়ে বিস্তর আলোচনার অবকাশ আছে।
এ গ্রন্থে মোট ১১টি গল্প সংকলিত হয়েছে, এগুলোর মধ্যে প্রথম শ্রেণীর গল্প রয়েছে অর্ধেকের বেশি; উদাহরণ হিসেবে কয়েকটির শিরোনাম উল্লেখ করা যায় : আবাদ, কান্না-হাসির উপাখ্যান, দখল, পিছুটান, মেঘ ভাঙা রোদ ও পদ্মাবতী। খুব রক্ষণশীলভাবে এ হিসাব দেয়া হল।
এ গ্রন্থের অধিকাংশ গল্পের পরিমণ্ডল হল বরেন্দ্র অঞ্চল। প্রতিটি গল্পেই তার নানা রকম চিত্রায়ন লক্ষ্য করা যায়। ‘আবাদ’ গল্পটি এক মহাকাব্যিক পটভূমিতে সৃজিত হয়েছে। গল্পের নায়ক জগলু নিুবিত্ত নির্ঝঞ্ঝাট কৃষক, রূপাকে ভালোবাসে। রূপাও জানে জগলু তাকে ভালোবাসে। তার বন্ধু সিরাজ নকশাল আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে, শেষ পর্যন্ত রক্ষীবাহিনীর হাতে নিহত হয়। সেই রাজনৈতিক ঝামেলায় সন্দেহের বশবর্তী হয়ে পুলিশ জগলুকে গ্রেফতার করে। বেশকিছু কাল কারাভোগের পর কোনোভাবে জেল থেকে ছাড়া পায়। ফিরে আসে গ্রামে এক নতুন মানুষ হয়ে। তার মধ্যে জন্ম নেয় এক নতুন জীবনচেতনা? বাঁচতে হবে, বাঁচার জন্য লড়তে হবে, আর কোনো সংগ্রামই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় না। সে নিষ্ফলা জমি চাষ করতে মন-প্রাণ ঢেলে দেয়। জগলু জেলে থাকার সময় রূপার অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে যায়, কিন্তু ‘বাঞ্জা’ বলে তাকে পরিত্যাগ করে তার স্বামী। তখন ফিরে আসে গ্রামে, বাপের বাড়ি। আবার দেখা হয় জগলুর সঙ্গে। রূপাকে বিয়ে করতে চায় জগলু। রূপা কোনো দিনই কল্পনা করতে পারেনি যে জগলু তাকে বিয়ে করতে চাইবে। জগলুর একটাই কথা? প্রতিজ্ঞা ও অধ্যবসায় থাকলে সব হয়। জগলুর সিদ্ধান্তে অবাক হয় রূপার বাপও। কিন্তু গল্পকার আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন এক অদৃশ্য কারসাজির কথা? ‘পৃথিবীর গোপন কোণে কোণে বুঝি কিসের আবাদের প্রস্তুতি চলতে থাকে।’ বড় অদ্ভুত গল্প। আমার বিবেচনায় বাংলা কথাসাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য শ্রেষ্ঠ ছোটগল্প।
‘দখল’ গল্পে একজন প্রেমিকার হৃদয় পাওয়ার জন্য দুই যুবকের প্রতিযোগিতা, পড়তে ভালো লাগেই। গ্রামীণ সমাজ বাস্তবতার পাশাপাশি প্রকৃতির চিত্রায়ন এবং হাস্যময় পরিবেশ সৃষ্টিতে লেখকের দক্ষতা পুরোপুরি বজায় থেকেছে। পাশাপাশি ‘পিছুটান’ গল্পে গল্পকার নাজিব ওয়াদুদ দেখিয়েছেন বেকারত্ব একটি পরিবারে কত সমস্যার সৃষ্টি করে, আর সেই বেকার ছেলে প্রত্যাশিত চাকরি পেলে কী বিপরীত দৃশ্যের অবতারণা হয়। জীবনের বাস্তবতা এবং মানবচরিত্রের বৈচিত্র্যময়তার কী যে এক অসামান্য কোলাজ সৃষ্টি করেছেন গল্পকার তার সহজ-সরল ভাষায় লেখা স্বল্পায়তনের এ গল্পে, তা না পড়লে বোঝা যায় না।
‘কাক’ গল্পে নাজিব ওয়াদুদ এক ধরনের মানবিক রাজনৈতিক সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন। আমার বিশ্বাস, অনেক পাঠকের কাছে তা অতিরিক্ত পাওনা বলেই মনে হবে। গল্পকার গল্প বলে গিয়েছেন স্বচ্ছ ও সহজাত দক্ষতায়। ‘মেঘ ভাঙা রোদ’ গল্পে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাস্তব জীবনের লড়াই সমার্থক হয়ে উঠেছে। মাটি, মানুষ ও মানবীয় সম্পর্ক এখানে একাকার।
পদ্মা তীরের এক গ্রাম্য বিধবার অপরূপ জীবনচিত্র ফুটে উঠেছে ‘পদ্মাবতী’ গল্পে। ভাষা, কথনকৌশল, উল্লম্ফন, সব মিলিয়ে একটি অসাধারণ গল্প ‘পদ্মাবতী’। ‘কান্না-হাসির উপাখ্যান’ একটি সাধারণ কৃষক পরিবারের দৈনন্দিনতার গল্প।
মাটি, মানুষ এবং জীবনযুদ্ধের বিষয় আশয় ‘বরেন্দ্রবাংলার গল্প’ গ্রন্থের গল্পগুলোতে অত্যন্ত চমৎকার ভাষায় অবলীলাক্রমে উঠে এসেছে। গল্পের ভাষা তার বিষয়বস্তুর অনুগামী হয়েছে। বাস্তববাদের বিষয়বস্তু কফি হাউসের ভাষায় আবর্তিত হয়ে যায়নি। নাজিব ওয়াদুদ আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের মূলধারার অনুবর্তী হলেও তার প্রত্যেকটি গল্পই তার নিজস্ব ক্র্যাফটসম্যানশিপের উদাহরণ। বাহুল্যবর্জিত, ইঙ্গিতময়, উপভোগ্য গতিশীল বর্ণনা, অসাধারণ জীবন্ত সংলাপ এবং আঞ্চলিক ঐতিহ্য ও ভাষার ব্যবহার এ ক্র্যাফটসম্যানশিপ মূল উপাদান। গল্পকার হিসেবে নাজিব ওয়াদুদের এটাই বড় সাফল্য।
এ গ্রন্থে মোট ১১টি গল্প সংকলিত হয়েছে, এগুলোর মধ্যে প্রথম শ্রেণীর গল্প রয়েছে অর্ধেকের বেশি; উদাহরণ হিসেবে কয়েকটির শিরোনাম উল্লেখ করা যায় : আবাদ, কান্না-হাসির উপাখ্যান, দখল, পিছুটান, মেঘ ভাঙা রোদ ও পদ্মাবতী। খুব রক্ষণশীলভাবে এ হিসাব দেয়া হল।
এ গ্রন্থের অধিকাংশ গল্পের পরিমণ্ডল হল বরেন্দ্র অঞ্চল। প্রতিটি গল্পেই তার নানা রকম চিত্রায়ন লক্ষ্য করা যায়। ‘আবাদ’ গল্পটি এক মহাকাব্যিক পটভূমিতে সৃজিত হয়েছে। গল্পের নায়ক জগলু নিুবিত্ত নির্ঝঞ্ঝাট কৃষক, রূপাকে ভালোবাসে। রূপাও জানে জগলু তাকে ভালোবাসে। তার বন্ধু সিরাজ নকশাল আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে, শেষ পর্যন্ত রক্ষীবাহিনীর হাতে নিহত হয়। সেই রাজনৈতিক ঝামেলায় সন্দেহের বশবর্তী হয়ে পুলিশ জগলুকে গ্রেফতার করে। বেশকিছু কাল কারাভোগের পর কোনোভাবে জেল থেকে ছাড়া পায়। ফিরে আসে গ্রামে এক নতুন মানুষ হয়ে। তার মধ্যে জন্ম নেয় এক নতুন জীবনচেতনা? বাঁচতে হবে, বাঁচার জন্য লড়তে হবে, আর কোনো সংগ্রামই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় না। সে নিষ্ফলা জমি চাষ করতে মন-প্রাণ ঢেলে দেয়। জগলু জেলে থাকার সময় রূপার অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে যায়, কিন্তু ‘বাঞ্জা’ বলে তাকে পরিত্যাগ করে তার স্বামী। তখন ফিরে আসে গ্রামে, বাপের বাড়ি। আবার দেখা হয় জগলুর সঙ্গে। রূপাকে বিয়ে করতে চায় জগলু। রূপা কোনো দিনই কল্পনা করতে পারেনি যে জগলু তাকে বিয়ে করতে চাইবে। জগলুর একটাই কথা? প্রতিজ্ঞা ও অধ্যবসায় থাকলে সব হয়। জগলুর সিদ্ধান্তে অবাক হয় রূপার বাপও। কিন্তু গল্পকার আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন এক অদৃশ্য কারসাজির কথা? ‘পৃথিবীর গোপন কোণে কোণে বুঝি কিসের আবাদের প্রস্তুতি চলতে থাকে।’ বড় অদ্ভুত গল্প। আমার বিবেচনায় বাংলা কথাসাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য শ্রেষ্ঠ ছোটগল্প।
‘দখল’ গল্পে একজন প্রেমিকার হৃদয় পাওয়ার জন্য দুই যুবকের প্রতিযোগিতা, পড়তে ভালো লাগেই। গ্রামীণ সমাজ বাস্তবতার পাশাপাশি প্রকৃতির চিত্রায়ন এবং হাস্যময় পরিবেশ সৃষ্টিতে লেখকের দক্ষতা পুরোপুরি বজায় থেকেছে। পাশাপাশি ‘পিছুটান’ গল্পে গল্পকার নাজিব ওয়াদুদ দেখিয়েছেন বেকারত্ব একটি পরিবারে কত সমস্যার সৃষ্টি করে, আর সেই বেকার ছেলে প্রত্যাশিত চাকরি পেলে কী বিপরীত দৃশ্যের অবতারণা হয়। জীবনের বাস্তবতা এবং মানবচরিত্রের বৈচিত্র্যময়তার কী যে এক অসামান্য কোলাজ সৃষ্টি করেছেন গল্পকার তার সহজ-সরল ভাষায় লেখা স্বল্পায়তনের এ গল্পে, তা না পড়লে বোঝা যায় না।
‘কাক’ গল্পে নাজিব ওয়াদুদ এক ধরনের মানবিক রাজনৈতিক সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন। আমার বিশ্বাস, অনেক পাঠকের কাছে তা অতিরিক্ত পাওনা বলেই মনে হবে। গল্পকার গল্প বলে গিয়েছেন স্বচ্ছ ও সহজাত দক্ষতায়। ‘মেঘ ভাঙা রোদ’ গল্পে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাস্তব জীবনের লড়াই সমার্থক হয়ে উঠেছে। মাটি, মানুষ ও মানবীয় সম্পর্ক এখানে একাকার।
পদ্মা তীরের এক গ্রাম্য বিধবার অপরূপ জীবনচিত্র ফুটে উঠেছে ‘পদ্মাবতী’ গল্পে। ভাষা, কথনকৌশল, উল্লম্ফন, সব মিলিয়ে একটি অসাধারণ গল্প ‘পদ্মাবতী’। ‘কান্না-হাসির উপাখ্যান’ একটি সাধারণ কৃষক পরিবারের দৈনন্দিনতার গল্প।
মাটি, মানুষ এবং জীবনযুদ্ধের বিষয় আশয় ‘বরেন্দ্রবাংলার গল্প’ গ্রন্থের গল্পগুলোতে অত্যন্ত চমৎকার ভাষায় অবলীলাক্রমে উঠে এসেছে। গল্পের ভাষা তার বিষয়বস্তুর অনুগামী হয়েছে। বাস্তববাদের বিষয়বস্তু কফি হাউসের ভাষায় আবর্তিত হয়ে যায়নি। নাজিব ওয়াদুদ আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের মূলধারার অনুবর্তী হলেও তার প্রত্যেকটি গল্পই তার নিজস্ব ক্র্যাফটসম্যানশিপের উদাহরণ। বাহুল্যবর্জিত, ইঙ্গিতময়, উপভোগ্য গতিশীল বর্ণনা, অসাধারণ জীবন্ত সংলাপ এবং আঞ্চলিক ঐতিহ্য ও ভাষার ব্যবহার এ ক্র্যাফটসম্যানশিপ মূল উপাদান। গল্পকার হিসেবে নাজিব ওয়াদুদের এটাই বড় সাফল্য।
No comments