চট্টগ্রামে পরকীয়ায় ভাঙলো ৪০ সংসার by মহিউদ্দীন জুয়েল
চট্টগ্রামে পরকীয়ায় জড়িত হওয়ায় ভেঙে
যাচ্ছে সাজানো সংসার। তছনছ হয়ে যাচ্ছে তরুণ-তরুণীদের সাজানো বাসরও।
অবিশ্বাস জন্ম নিচ্ছে নারী-পুরুষের হৃদয়ে। গত ৬ মাসে পরকীয়ার ঘটনায়
বিচ্ছিন্ন হয়েছে অন্তত ৪০টি বিয়ে। বিচ্ছেদ সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন
২০ নারী। পরনারী আর পরপুরুষের মিলনে বাধা দেয়ায় ঘটেছে হত্যার ঘটনাও।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, পুলিশ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর একাধিক সূত্র জানিয়েছে এমনি তথ্য। বলেছে, পরকীয়ার পাশাপাশি সাগরপাড়ের এ শহরে অত্যধিক হারে বেড়েছে লিভ টুগেদারের মতো সম্পর্কও। পরকীয়ার কারণে পরনারী আর পরপুরুষের হাত ধরে চলে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে প্রায়ই।
বিশেষ করে তরুণ ছেলেমেয়েদের মাঝে বিয়ে নিয়ে কাজ করছে ভীষণ অস্থিরতা। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা ছাত্র-অবস্থায় বিয়ে করে সেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। বাধ্য হয়েই তাই তারা এগিয়ে যাচ্ছেন ছাড়াছাড়িতে। অন্যদিকে অফিসের কলিগের সঙ্গে সম্পর্ক চলে যাচ্ছে লিভ টুগেদারের মতো বিষয়ে। অনেকে ভাড়া বাসায় কিংবা কোন হোটেলে গিয়ে রাত কাটাচ্ছেন গোপনে। এ সব ঘটনা সমাজের উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নমধ্যবিত্ত সব পেশার মানুষের মধ্যেই ঘটছে।
‘গভীর রাতে দেখতাম ফোনে কথা বলতো। অফিস থেকে বাসায় ফিরতো অনেক দেরিতে। কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে জানতে চাইলে সঠিক জবাব দিতো না। একসময় আমার প্রতি তার আকর্ষণ কমে গেল। রাতে ঘুমানোর কথা বললে রেগে যেতো। একদিন ধরা পড়লো সব কিছু। সামাজিক চক্ষুলজ্জার ভয়ে ডিভোর্স দেয়ার সিদ্ধান্ত নিই। জানতে পারি সে সুন্দরী সহকর্মীর পরকীয়ায় মজেছে। আর তাতেই ভেঙেছে আমার সাজানো সংসার।’
কথাগুলো বলছিলেন সাবরিনা আহমেদ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০০ সালে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করেছেন। বর্তমানে শহরের মেয়র গলিতে বসবাস করছেন তিনি। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষক।
সাবরিনা বললেন, ‘নাম প্রকাশ করতে লজ্জা নেই। আমি নিজের গুণেই পরিচিত হতে চাই। স্বামীর পরকীয়ার ঘটনায় মোটেও লজ্জিত নই। একসময় লজ্জা পাওয়ার ভয় ছিল। এখন নেই। একা আছি। বেশ আছি। বিয়ে করার কথা ভাবছি না।’
বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির চট্টগ্রাম বিভাগের প্রধান ওয়াহিদা ইদরিস বলেন, ‘বিয়ে নারী পুরুষের চমৎকার একটি সম্পর্ক। তবে কেবল পরকীয়া নয়, নানা ধরনের সামাজিক অশান্তি, পারিবারিক নির্যাতনের কারণেও কিন্তু অনেক বিয়ে খুব তাড়াতাড়ি ভেঙে যাচ্ছে। চট্টগ্রামে এই ধরনের ঘটনা সত্যিই উদ্বেগজনক। আমি মনে করি সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে পারস্পরিকভাবে অবশ্যই দু’জনকে শ্রদ্ধা, ভালবাসা আর বিশ্বাসকে টিকিয়ে রাখতে হবে।’
চট্টগ্রাম পুলিশের দু’টি সূত্র জানায়, জেলা ও শহরের আশপাশের থানাগুলোতে সপ্তাহে গড়ে ৩টি করে এ সংক্রান্ত মামলা দায়ের হচ্ছে। এর একটি থাকছে বিয়ে ভাঙার ঘটনা। এর মধ্যে রয়েছে পরকীয়ার বিষয়টি। দেখা যাচ্ছে স্বামী থাকে বিদেশে। বউ বাড়িতে একা। আর এ সুযোগে তারা গোপন সম্পর্ক গড়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, যে মহিলা বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন তার ছোট্ট শিশু রয়েছে বাড়িতে।
চলতি মাসে গত ১৩ই আগস্ট রাঙ্গুনিয়ায় ঘটেছে এমনি এক ঘটনা। সেখানে বাড়ির গৃহশিক্ষকের হাত ধরে পালিয়ে গেছেন শাবলী আকতার নামে এক প্রবাসীর স্ত্রী। অথচ গত ৭ বছর আগে বিয়ে হয়েছিল তার।
কক্সবাজারে গত ৪ঠা আগস্ট বাড়ি থেকে পালাতে গিয়ে পুলিশের হাতে আটক হয় এক প্রেমিক জুটি। পরে জানা গেল মেয়েটি এক প্রবাসীর স্ত্রী। পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে কাউকে কিছু না বলে পালিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে গোপনে স্বামীর অগোচরে প্রেম করছিল চট্টগ্রামের বাঁশখালী এলাকার এক যুবকের সঙ্গে। পরিচয়ে জানা গেল আটক যুবকের নাম তবারেক হোসেন। গ্রামের বাড়ি বাঁশখালী থানার চম্বল ইউনিয়নের পূর্ব চম্বল এলাকায়। আর মেয়েটির দু’টি সন্তান রয়েছে।
তবে কেবল ছাড়াছাড়ি নয়, পরকীয়ার জ্বালা সইতে না পেরে আত্মহত্যা করার একাধিক ঘটনায় উদ্বেগ বেড়েছে সামাজিক সর্ম্পকে। হচ্ছে হত্যার ঘটনাও। ৪ মাস আগে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় পরকীয়া প্রেমের জের ধরে খেজুরতলা এলাকায় বন্ধুর ছুরিকাঘাতে খুন হন রানা (৩৮)। এ ঘটনায় আটক করা হয় ঘাতক বন্ধু খায়রুলের স্ত্রী সালমা বেগম (৩০)-কে।
পরে জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, স্বামীর অগোচরে তার বন্ধুর সঙ্গে প্রেম করছিল সে। বিষয়টি টের পাওয়ায় এই ঘটনা ঘটেছে। নিহত রানা ও অভিযুক্ত খায়রুল উভয়ের বাড়ি নেত্রকোণা জেলার মদন উপজেলার একই গ্রামে। ঘটনার আগে রানাকে নিজের বাসায় স্ত্রীর পাশে দেখতে পায় রানা। এরপর উত্তেজিত হয়ে তার বুকে ছুরি মারে। এ ঘটনায় পতেঙ্গা থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সালিশি আদালত থেকে জানা যায়, বন্দরনগরীতে প্রতিদিন গড়ে বিবাহবিচ্ছেদের জন্য ৭-৮ জন আবেদন করছেন। সর্বশেষ ২০১৩ সালে মোট ৩৪৫৪টি বিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়েছে। চলতি বছর এই সংখ্যা আরও বেশি বলে তারা প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছেন।
No comments