বিশ্বকাপ শিরোপা চ্যাম্পিয়ন্স -এক কদম বাকি লিওনেল মেসির
নকআউট পর্বের খেলায় বড় তারকাদের দিতে হয়
স্নায়ুর আলাদা পরীক্ষাও। তবে লিওনেল মেসি দেখালেন তিনি অন্য ধাতুর গড়া।
কোয়ার্টার ফাইনালে ইউরোপের ডার্ক হর্স বেলজিয়ামের মোকাবিলা করছিল
আর্জেন্টিনা। আর পুরো দল ও ভক্তদের প্রত্যাশার বোঝা ঘাড়ে নিয়ে মাঠে পুরো
ম্যাচে মেসি খেলে গেলেন ঠাণ্ডা মাথায়। একই চিত্র দেখা গেলো সেমিফাইনালের
গরম লড়াইয়েও। বিশ্বকাপে ২৪ বছর পর সেমিফাইনাল খেলছিল আর্জেন্টিনা। আর
নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে সেমিফাইনালেও ডাচ তারকাদের আলাদা নজরে থাকছিলেন
প্রতিপক্ষ ফরোয়ার্ড লিওনেল মেসিই। এতে পরিস্থিতি বুঝে মাঠে নিজের নিয়মিত
পজিশন থেকে একটু নিচে নেমে খেলতে দেখা গেল মেসিকে। বিশ্বসেরা ফরোয়ার্ডকে
এদিন ভূমিকা নিতে দেখা যায় দলের রক্ষণেও। আত্মবিশ্বাসী অধিনায়ক লিওনেল মেসি
দলে সঞ্জীবনীর সঞ্চার করেন ম্যাচের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। ক্যারিয়ারে ‘সব
পাওয়া’ লিওনেল মেসির একমাত্র অপূর্ণতা বিশ্বকাপে। এজন্য পেলে, ম্যারাডোনার
মতো গ্রেট ফুটবলারদের কাতারে মেসির নাম নিতে দ্বিধা বোদ্ধাদের। সাদামাটা
এক দল নিয়ে ১৯৮৬’র বিশ্বকাপ জেতেন আর্জেন্টিনা অধিনায়ক দিয়েগো ম্যারাডোনা।
আর ব্রাজিল গ্রেট পেলের ঝুলিতে ১৯৫৮, ১৯৬২ ও ১৯৭০’র বিশ্বকাপ শিরোপা। তবে
লিওনেল মেসির সামনে আর মাত্র এক কদম । ১৩ জুলাইয়ের ফাইনালে সুযোগ খোলা রইলো
লিওনেল মেসিরও। আর্জেন্টিনা দলের জার্সি গায়ে শিরোপা উদযাপন করেছেন মেসি
আগেও। জাবালেতা, রোমেরো, ডি মারিয়া, অ্যাগুয়েরোদের সঙ্গে লিওনেল মেসি জেতেন
২০০৮’র অলিম্পিক ফুটবলের শিরোপা। অধিনায়ক মেসির অসাধারণ নৈপুণ্যে ২০০৫’র
আসরে আর্জেন্টিনা জেতে অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ। সেবার মেসি নিজে জেতেন
সর্বোচ্চ গোলদাতা ও সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। বিশ্বকাপে আগের ৭ ম্যাচে
মাত্র এক গোল নিয়ে এবারের আসরে খেলতে নামেন লিওনেল মেসি। আসরে নিজেদের
সূচনায় ইউরোপিয়ান প্রতিপক্ষ বসনিয়া হার্জেগোভিনার সঙ্গে লড়াইয়ে দলের ২-১
গোলের জয়ে মেসি নিজে পান দুর্দান্ত এক গোল। ইরানের বিপক্ষে গ্রুপের দ্বিতীয়
ম্যাচের ইনজুরি সময়ে আর্জেন্টিনার জয়সূচক একমাত্র গোলটি আসে ডি বক্সের
বাইরে থেকে মেসির দারুণ এ শট থেকে। গ্রুপের তৃতীয় ম্যাচেও দেখা যায়
অপ্রতিরোধ্য মেসিকে। নাইজেরিয়ার বিপক্ষে আর্জেন্টিনার ৩-২ গোলের কঠিন
ম্যাচে মেসি করেন জোড়া গোল। দ্বিতীয় রাউন্ডে সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে নিজে
গোল পাননি মেসি। তবে অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া দলের জয়সূচক গোলটি পান মাঝমাঠ
থেকে বল পায়ে মেসির ক্ষিপ্র গতির এক দারুণ পাস থেকে । বেলজিয়ামের বিপক্ষে
কোয়ার্টার ফাইনালেও আর্জেন্টিনা দলের বল পায়ে আক্রমণ দানা বাঁধছিল ওই
মেসিরই পায়ের জাদুতে। এতে নিজে গোল না পেলেও আর্জেন্টিনার জয়সূচক একমাত্র
গোলটি আসে বল পায়ে মেসির কারুকুরি শেষেই। দৃষ্টিনন্দন ড্রিবলিংয়ে দুই
বেলজিক তারকা মারুয়ান ফেলাইনি ও টোবি অল্ডারউইরাল্ডকে পরাস্ত করে ডি
মারিয়াকে দারুণ এক পাস ঠেলে দেন মেসি ম্যাচের মাত্র অষ্টম মিনিটে। এতে ডি
মারিয়ার পা ঘুরে গঞ্জালো হিগুয়াইনের শট ঠাই নেয় বেলজিয়ামের জালে।
আর্জেন্টাইন ফুটবল গ্রেট দিয়েগো ম্যারাডোনার সঙ্গে লিওনেল মেসির তুলনাটা
নতুন নয়। তবে কোয়ার্টার ফাইনালে বেলজিয়ামের বিপক্ষে লড়াইয়ের আগে এ আলোচনা
পায় অন্য মাত্রা। বেলজিয়ামের বিপক্ষে বিশ্বকাপে সর্বশেষ লড়াইটি
আর্জেন্টাইনদের জন্য আলাদা তাৎপর্যের । ১৯৮৬’র বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে
বেলজিয়ামকে ২-০ গোলে হারায় আর্জেন্টিনা। পরে ফাইনাল শেষে জিতে নেয় সেবারের
বিশ্বকাপ। আর বেলজিয়ামের বিপক্ষে জোড়া গোল পান আর্জেন্টিনা অধিনায়ক দিয়েগো
ম্যারাডোনা। পাঁচ গোল নিয়ে ম্যারাডোনা জিতে নেন সেবারের সেরা খেলোয়াড়ের
পুরস্কার গোল্ডেন বলও। এবার কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনা-বেলজিয়াম
ম্যাচের আগে স্পট লাইট ছিল যথারীতি মেসির দিকে। আর্জেন্টিনার ফুটবল ভক্তরা
সাবেক তারকা দিয়েগো ম্যারাডোনোর মতো ম্যাজিক দেখতে চাচ্ছিলেন লিওনেল মেসির
খেলায়ও। আর এবারের বেলজিয়াম ডিফেন্স আলাদা চ্যালেঞ্জ রাখছিল আর্জেন্টিনা
ফরোয়ার্ডদের সামনে। আসরে আগের চার ম্যাচে মাত্র দুই গোল হজম করেছিল
বেলজিয়াম। আলজেরিয়ার বিপক্ষে এর এক গোল ছিল পেনাল্টিতে। আর লিওনেল মেসির
জন্য আলাদা চ্যালেঞ্জটা বেলজিয়াম গোলরক্ষক থিবো কুরতোয়ায়। সর্বশেষ মওসুমে
বল পায়ে মেসি পান ৪১ গোল। তবে লা লিগা চ্যাম্পিয়ন অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের এ
গোলরক্ষকের বিপক্ষে গেল মওসুম ৬ ম্যাচে একবারও গোলের দেখা পাননি বার্সেলোনা
তারকা মেসি । কুরতোয়ার বিপক্ষে মেসি গোল পাননি এবারও। তবে কোয়ার্টার
ফাইনালে ম্যাচের আগাগোড়া ঠাণ্ডা মাথায় নৈপুণ্য দেখিয়ে মেসি আর্জেন্টিনা
দলকে স্বপ্ন পথে এগিয়ে নেন আর এক কদম। সেমিফাইনালে
নেদারল্যান্ডস-আর্জেন্টিনা লড়াইয়ের আগেও ইতিহাসের দিকে চোখ ছিল
ফুটবলপ্রেমীদের। নিজ মাটিতে ১৯৭৮’র আসরে ফাইনালে নেদারল্যান্ডসকে ৩-১ গোলে
হারিয়ে প্রথমবার বিশ্বকাপ শিরোপার স্বাদ নেয় আর্জেন্টাইনরা। আর এবারের
সেমিফাইনালের আগে প্রতিশোধের মানসিকতা প্রকাশ করেন ডাচ গোলরক্ষক জেসপার
সিলেসেনও। বেলজিয়ামের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে
কিছুটা নিরব দেখাচ্ছিল মেসির নৈপুণ্য। এসময় মাঠে একটু নিচের দিকে নেমে
খেলছিলেন তিনি। তবে এতেও আর্জেন্টিনা দলে আক্রমণে প্রধান ভূমিকাটা রাখছিলেন
আগের টানা চারবারের ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলার মেসিই। দ্বিতীয়ার্ধের ৪৫ মিনিট
তার সফল পাসের হারটা ছিল ৮৬.৪%। এসময় মেসি সতীর্থদের যোগান দেন নির্ভুল ২২
পাস। সেমিফাইনালেও মাঠে একটু নিচের দিকে নেমে খেলতে দেখা যায় মেসিকে। তবে
ঝটিকা আক্রমণে মেসির বাড়নো পাস থেকে গোল আদায়ে ব্যর্থ হন হিগুয়াইন,
পালাসিও, ম্যাক্সি রদ্রিগেসরা। আর টাইব্রেকারে প্রথম পেনাল্টি থেকে গোল
নিয়ে দলের আত্মবিশ্বাস ধরে রাখেন অধিনায়ক মেসিই। টাইব্রেকারে সাফল্য শেষে
আর্জেন্টিনা শিবিরের আর সবার মতো আবেগাপ্লুত হয়ে পড়তে দেখা যায় লিওনেল
মেসিকেও। মাঠে আর্জেন্টাইন সমর্থকদের গ্যালারির সামনে হেসে-কেঁদে নেচে-গেয়ে
আবেগ দেখান এ ফুচবল জাদুকর। চলতি আসরে আর্জেন্টিনার পাঁচ ম্যাচে দলের
সর্বোচ্চ ৪ গোল লিওনেল মেসির। ২৪ বছর পর বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলছে
আর্জেন্টিনা। আর মাত্র এক ম্যাচ। মেসি ম্যাজিকে এতে সাফল্য নিয়ে তৃতীয়বারের
মতো বিশ্বকাপ শিরোপাস্বপ্নে বিভোর আর্জেন্টাইনরা। আর ভক্ত সমর্থকরাতো
বটেই, বোদ্ধা বিশ্লেষকরাও মনে করছেন, আসর শেষে এবারের বিশ্বকাপটা মেসির
হাতেই বেশি মানাবে।
মেসির অর্জন
অলিম্পিক ফুটবল শিরোপা: ২০০৮
অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ: ২০০৫
স্প্যানিশ লা লিগা শিরোপা: ৬ বার
ইউয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগ: ৩ বার
No comments