টাকা: পাচার ও উদ্ধারের রাজনীতি by কামাল আহমেদ
প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন যে সুইজারল্যান্ডে যেসব বাংলাদেশির
টাকা গচ্ছিত আছে, তা ফেরত আনার ব্যবস্থা করা হবে। সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের
সম্প্রতি প্রকাশিত বার্ষিক হিসাব বিবরণীতে বিদেশিদের গচ্ছিত আমানতের বিবরণে
দেখা যায় যে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ বাংলাদেশি টাকার হিসাবে
২০১৩ সালে দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ১৬২ কোটিতে। ২০১২ সালে এই পরিমাণ ছিল এক
হাজার ৯০৮ কোটি টাকা (প্রথম আলো, ৩ জুলাই, ২০১৪)। প্রায় একই সময়ে জাতিসংঘ
উন্নয়ন কর্মসূচি, ইউএনডিপির প্রকাশিত আরেকটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ
থেকে বছরে গড়ে ৮০ কোটি ডলার (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ছয় হাজার ৪০০ কোটি
টাকা) বিদেশে পাচার হচ্ছে।
জাতিসংঘ সমীক্ষায় অবশ্য অর্থ পাচারের প্রধান মাধ্যম হিসেবে বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদেনে নানা রকম অনিয়ম ও ফাঁকফোকরের কথা বলা হয়েছে। হুন্ডি, সোনা বা অন্যান্য বিলাসসামগ্রীর চোরাকারবারি, মানব পাচার এবং মাদক ব্যবসার মতো বিভিন্ন মাধ্যমে আরও কত হাজার কোটি টাকা পাচার হয়, তার কোনো নির্ভরযোগ্য হিসাব পাওয়া দুষ্কর। তার পরও গত কদিনে রাজনৈতিক বিতর্ক শুধু সুইস ব্যাংকগুলোতে গচ্ছিত অর্থ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকতে দেখে কিছুটা বিস্মিত হতে হয়।
এখন থেকে ঠিক এক বছর আগে বাংলাদেশের ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ (জুলাই ১২ ও ১৪) ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টসের (আইসিআইজে) ফাঁস করা নথিপত্রের ভিত্তিতে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য এবং তাঁর সাংসদ স্ত্রী, পুত্রসহ আরও অন্তত কুড়িজন ব্যবসায়ীর বিদেশে সম্পদ গচ্ছিত রাখার বিবরণ প্রকাশ করে। তাঁরা সিঙ্গাপুর, ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জসহ করছাড়ের সুবিধা পাওয়া যায়, এমন কিছু দেশ বা দ্বীপরাজ্যে টাকা গচ্ছিত রেখেছেন বলে ওই সব নথিতে উল্লেখ ছিল। বৈধভাবে তাঁদের কারোরই বিদেশে সম্পদ স্থানান্তরের সুযোগ থাকার কথা নয়।
কিন্তু তাঁরা যে ওই সব দ্বীপরাজ্য বা দেশের ব্যাংকে নামে-বেনামে অর্থ গচ্ছিত রেখেছেন, তার বিস্তারিত বিবরণ আইসিআইজের নথিপত্রে তুলে ধরা হয়। বেনামি হিসাবগুলোর মালিকদের বেনামি কোম্পানির রেজিস্ট্রেশন এবং পরিচালকদের বৃত্তান্তসহ অনেক খুঁটিনাটি তথ্যও তাতে রয়েছে। এরপর ৩০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন এসব অভিযোগ তদেন্তর সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানায় (নিউ এজ, ১ অক্টোবর, ২০১৩)। কিন্তু, সেই তদন্তের আর কোনো অগ্রগতির কথা আজ পর্যন্ত শোনা যায়নি। সুতরাং, এ ধরনের কোনো তদন্ত আদৌ হচ্ছে কি না, কেউ যদি সেই সন্দেহ পোষণ করেন, তা বোধ হয় খুব একটা অযৌক্তিক হবে না। ফাঁস করা নথিগুলো যে বিশেষ কোনো দলকে রাজনৈতিক সুবিধা দেওয়া বা কাউকে বেকায়দায় ফেলার উদ্দেশ্যে আইসিআইজে করেছে, এমন উদ্ভট যুক্তি কেউ নিশ্চয়ই দেবেন না। আবার, এসব নথিকে ভিত্তিহীন বলারও কোনো সুযোগ নেই। ২০১৩ সালের এপ্রিলে আইসিআইজে প্রথম তাঁদের অনুসন্ধানের তথ্য প্রকাশ করে। তার পর থেকে গত এক বছরে আইসিআইজের ফাঁস করা নথিগুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ইউরোপ ও এশিয়ার নানা দেশ তদন্ত করে অনেকে ক্ষেত্রেই সাফল্য পেয়েছে। অফশোর ব্যাংকে টাকা গচ্ছিত রাখার তথ্য ফাঁসের পর ফ্রান্সে বাজেটমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হয়েছে এবং প্রেসিডেন্ট ওলাঁদ তাঁর মন্ত্রীদের সম্পদের বিবরণী প্রকাশ বাধ্যতামূলক করেছেন।
ইউরোপের কয়েকটি শক্তিশালী অর্থনীতি নিজেদের মধ্যে করদাতাদের বিষয়ে তথ্য আদান-প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।কর অবকাশের সুযোগ দেওয়ার জন্য সুইজারল্যান্ডের মতোই খ্যাত ক্ষুদ্র রাষ্ট্র লুক্সেমবুর্গ তার ব্যাংকিং খাতে গোপনীয়তার নীতির অবসান ঘটানোর কথা ঘোষণা করেছে। দক্ষিণ কোরিয়া সাবেক স্বৈরশাসক চুন দো হোয়ানের ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার কথা জানিয়ে আইনি ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। মঙ্গোলিয়ার পার্লামেন্টের ডেপুটি প্রেসিডেন্ট পদচ্যুত হয়েছেন। প্রতিবেশী ভারতও তাদের তথ্যের ভিত্তিতে তদন্ত শুরুর কথা জানিয়েছে।
সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত সম্পদ উদ্ধারের প্রক্রিয়া একটু জটিল এবং তাতে সাফল্যের বিষয়টি অনেকটাই অনিশ্চিত। সুইস সরকার এ পর্যন্ত শুধু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের ব্যাংকিং খাতের তথ্য বিনিময়ে রাজি হয়েছে৷ কেননা, তা না হলে সুইস ব্যাংকগুলোর যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসার পথ বন্ধ হয়ে যেত।ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গেও সুইসদের একই ধরনের সমঝোতা হবে বলে আভাস পাওয়া যায়। কিন্তু, বাংলাদেশের সঙ্গে এ ধরনের সমঝোতায় সুইসদের তেমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতার দৃষ্টান্তকে কাজে লাগিয়ে নৈতিক অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আবেদন-নিবেদন বা চাপ প্রয়োগের সুযোগ নিশ্চয়ই আছে। সেটা শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎপরতায় সম্ভব হবে, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই।এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পর্যায়েও উদ্যোগ প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে এ ধরনের সহযোগিতায় সুইজারল্যান্ড রাজি হওয়ায় নাইজেরিয়া শেষ পর্যন্ত সাবেক সেনাশাসক সানি আবাচার টাকা ফেরত পেয়েছে। এ ছাড়া, তারা ভারত সরকারকে ভারতীয়দের গচ্ছিত সম্পদের বিবরণও হস্তান্তর করেছে, যার ভিত্তিতে গত কংগ্রেস সরকারের আমলেই ভারতীয় কর বিভাগ পাঁচ শতাধিক ভারতীয়র আয়করের বিষয়ে আলাদা করে তদন্ত শুরু করে।
নিজ দেশে করফাঁকি অথবা উঁচুহারে কর এড়ানো ছাড়াও সম্পদ গোপন করার জন্য যেসব দেশ এবং দ্বীপরাজ্য সুখ্যাত, তার মধ্যে অনেকগুলোই ব্রিটিশ রাজ্য অথবা স্বশাসিত অঞ্চল। যেমন কেম্যান, বারমুডা, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, অ্যাঙ্গুইলা, মন্টসেরাট ইত্যাদি। এসব ব্রিটিশ স্বশাসিত অঞ্চল বা দ্বীপরাজ্য গত বছর ব্রিটিশ অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এক সমঝোতায় পৌঁছায় যে এখন থেকে তারা ব্রিটিশ, ফরাসি, জার্মান, ইতালীয় ও স্প্যানিশ নাগরিকদের ব্যাংক হিসাবের বিষয়ে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করবে। এ ছাড়া শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি সেভেনের অর্থমন্ত্রীরা ২০১৩ সালের মে মাসের এক সভায় কর ফাঁকির জন্য অর্থ পাচারের বিষয়টি মোকাবিলায় সহযোগিতা জোরদারের সিদ্ধান্ত নেন। সেই সভার পর স্বাগতিক অর্থমন্ত্রী জর্জ অসবর্ন জানান, ব্যক্তি ও কোম্পানিগুলোর জন্য পাওনা কর পরিশোধ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সেটা শুধু ব্রিটেন এবং ব্রিটিশ করদাতাদের জন্য নয়, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্যও একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ (দ্য গার্ডিয়ান, ২২ মে, ২০১৩)। ব্রিটিশ স্বশাসিত অঞ্চল বা দ্বীপরাজ্যগুলো থেকে তথ্য পাওয়ার জন্য এ ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকারের সাহায্য পাওয়া তাই অসাধ্য কিছু নয়।
আইসিআইজের ফাঁস করা বিবরণীতে যেসব বাংলাদেশির কথা প্রকাশ পেয়েছে, তাঁদের অধিকাংশেরই সম্পদ রক্ষিত আছে এসব দ্বীপরাজ্য ও সিঙ্গাপুরে। সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশিদের অবৈধ সম্পদ উদ্ধারের দৃষ্টান্ত (আরাফাত রহমান কোকোর টাকা) যেহেতু ইতিমধ্যেই স্থাপিত হয়েছে, সেহেতু অন্য বাংলাদেশিদের কারও কোনো অর্থ বেআইনিভাবে সেখানে থেকে থাকলে সেগুলোও নিশ্চয় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। বিদেশে যাঁরা দ্বিতীয় আবাস গড়েছেন, তাঁদের সম্পদের হিসাব যাচাই করাও সরকারের সাধ্যের বাইরে নয়। অথচ, এসব বিষয়ে কোনো উচ্চবাচ্য নেই। ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড এবং কেম্যান আইল্যান্ডসে বাংলাদেশিদের অর্থের তথ্য প্রকাশের এক বছর পরও তা উদ্ধারে সরকার বা দুর্নীতি দমন কমিশনের কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই। সেটা কি এ কারণে যে সরকারি ব্যাংক থেকে আত্মসাৎ হওয়া হাজার হাজার কোটি টাকার বৃহৎ অংশই সরকারের আশীর্বাদপুষ্টরা সেখানে গচ্ছিত রেখেছেন? শেয়ারবাজারের কারসাজিতে লোপাট হওয়া অর্থ, জ্বালানি খাতের ভর্তুকি, টেলিকম খাতের লেনদেনে চুরি—জালিয়াতি এবং বৃহৎ নির্মাণ প্রকল্পের সুবিধাভোগীদের সঙ্গে ক্ষমতার যোগসূত্রও কি তার অন্যতম কারণ?
কামাল আহমেদ: প্রথম আলো বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন৷
No comments