কবিতা এক অমীমাংসিত শিল্প by আল মাহমুদ
আল
মাহমুদ বাংলা কবিতায় এক অনিবার্য কিংবদন্তির নাম। দীর্ঘ পথপরিক্রমা শেষে
তিনি যেখানে এসে দাঁড়িয়েছেন, সেখানে এখন গোধূলিসন্ধির নৃত্য; চতুর্দিকে
ঘনায়মান তমসার নিদারুণ প্রতিচ্ছায়া। কিন্তু আল মাহমুদ বহু আগেই অকম্পিত
কণ্ঠস্বরে ঘোষণা করেছিলেন সেই অমোঘ সত্যবাণী : ‘পরাজিত হয় না কবিরা।’
সুতরাং আল মাহমুদ আছেন প্রায় সর্বব্যাপ্ত হয়ে- বাংলা কবিতায় আজও
প্রতিদ্বন্দ্বীহীন অধীশ্বর তিনি। এ জন্য একমাত্র আল মাহমুদই বলতে পারেন;
‘আমি সীমাহীন যেন-বা প্রাচীন বটবৃক্ষের মতো’। ১৯৩৬ সালে ১১ জুলাই
বি-বাড়িয়ায় মীর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পড়াশোনা ও বেড়ে উঠা কুমিল্লা শহর ও
চট্টগ্রামে। সাহিত্য জীবন শুরু করেন ঢাকায়। প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ
‘লোক-লোকান্তর (১৯৬৩)’। ‘লোক-লোকান্তর’ ও ‘কালের কলস’ মাত্র এ দুটি
কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯৬৮ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। খ্যাতির
শীর্ষে পৌঁছে দেন ১৯৭৩ সালে ‘সোনালী কাবিন’ প্রকাশ করে। পরবর্তীকালে
সাহিত্য প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি একুশে পদক, ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার,
অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার, ফররুখ স্মৃতি পুরস্কার ও জীবনানন্দ
দাশ পুরস্কারসহ নানা সম্মাননায় ভূষিত হলেও পাঠক হৃদয়ে তিনি যে অমরতা লাভ
করেছেন তার সঙ্গে কোনো কিছু তুল্য নয়। প্রায় ষাট বছরের কবি জীবনে তিনি
অসংখ্য কবিতা লিখেছেন এবং এখনও অনবরত ডিকটেশনে লিখে চলেছেন। তার অধিকাংশ
কবিতাই কালোর্ত্তীণ, স্বমহিমায় ভাস্বর। স্বপ্নকামী মানুষের প্রেরণার বাতিঘর
হয়ে আমৃত্যু লিখে যেতে চান। আজ ১১ জুলাই কবির ৮৯তম জন্মদিন উপলক্ষে কবির
সঙ্গে বাংলাসাহিত্যের নানা দিকসহ সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে আলাপ করেছেন তরুণ
লেখক আবিদ আজম ও কবি ইমরান মাহফুজ। বি.স.
প্রশ্ন : সুধীন দত্ত বলেছেন- শব্দ দিয়েই কবিতা তৈরি হয়। আপনি কি মনে করেন?
আল মাহমুদ : কবিতা এক অমীমাংসিত শিল্প। এর সংজ্ঞা আজ পর্যন্ত নিরূপণ সম্ভব হয়নি। আমি বলি- কবিতা পরিশ্র“ত চিন্তা যা উৎকৃষ্ট শব্দের মাধ্যমে বেরিয়ে আসে। শুধুমাত্র শব্দ দিয়ে কবিতার অবয়ব তৈরি হয় না।
প্রশ্ন : ‘চোখ’ শিরোমের একটি কবিতায় লিখেছেন- এখন চোখ নিয়েই হল আমার সমস্যা।/ যেন জন্ম থেকেই/ অতিরিক্ত অবলোকন শক্তিকে ধারণ করে আছি...। মূলত চোখ নিয়ে কি সমস্যার কথা বুঝিয়েছেন?
আল মাহমুদ : আমি আসলে অতিরিক্ত দেখি। সাধারণ মানুষ যা দেখতে পায় না আমি তা দেখতে পাই। তুমি পোশাক পরে আছ আমি পোশাক দেখি না, আমি ভিতর দেখি। এটাই একজন কবির দেখা। কবির অবলোকন শক্তি।
প্রশ্ন : আপনার বিখ্যাত কবিতার বই ‘সোনালী কাবিন’। এই নামের কবিতায় বলেছেন- সোনার দিনার নেই, দেন মোহর চেয়ো না হরিণী/ যদি নাও দিতে পারি, কাবিনবিহীন হাত দুটি। কবিরা আসলে সব সময় সাময়িক অর্থের পরোয়া না করে ভালোবাসা দিতে আগ্রহী? কবিদের এই আগ্রহে কি নারীর সব পাওয়া যায়?
আল মাহমুদ : না। কারণ, কাবিন বিহীন এই নয় যে, কোনো মূল্য না দিয়ে প্রেম কেনা যায়। এটা ভালোবাসার বহির্প্রকাশ। নিশ্চয় তার মূল্য দিতে হয়। চাওয়া-পাওয়ায় মিল করে নিতে হয়। বিনা প্রেম সে নাহি মিলে নন্দলালা।
প্রশ্ন : এ সময়ে অনেকে আধুনিক কবিতা লিখতে গিয়ে কবিতার মূল জায়গা থেকে সরে যায়। এতে কি পাঠকের সঙ্গে কবির দূরত্ব তৈরি হয় না?
আল মাহমুদ : কবি যদি আধুনিক কবিতা কি, তা না বোঝেন তা হলে তো কবিতা হল না। কবির কবিতা কমিউনিকেট করতে হবে পাঠকের হৃদয়ের সঙ্গে। তা না হলে কবি ফেইল করল। আমরা তো সারা বছর কবিতা লিখেছি। কই কেউ তো কখনও অভিযোগ করেনি।
প্রশ্ন : আল্লামা রুমি, হাফিজ, জামিসহ এদের অনেক লেখা পড়েছেন, আপনার লেখা পড়ে বোঝা যায়। তাদের নিয়ে কিছু বলা যায়?
আল মাহমুদ : এরা খুবই অসাধারণ কবি ছিলেন। তাদের লেখা আমি ইংরেজিতে পড়েছি। তাদেরও কিছু লেখা আমার মনে ছায়া ফেলেছে। যা কবিতার জন্য খুব কাজ দিয়েছে। আর ভালো কবির কবিতা পড়লে প্রভাব পড়েই স্বাভাবিক। আমাকে তুমি এদের ভাবশিষ্য বলতে পার।
প্রশ্ন : সালমান রুশদি বলেছেন- লেখকদের অধিক স্বাধীনতা থাকা দরকার। আপনি কি তাই মনে করেন?
আল মাহমুদ : লেখকরা তো জন্ম থেকেই স্বাধীন। তারা কাউকে জিজ্ঞাস করে লেখেন না। মনের আনন্দে লিখে যান অবিরত। স্বাধীনতার প্রশ্ন আসবে কেন?
প্রশ্ন : আপনি আপনার একটি বইয়ের উৎসর্গে লিখেছেন, আমাদের কাব্য হিংসা অমর হোক- শামসুর রাহমান, ফজল শাহাবুদ্দীন, শহীদ কাদরী। সাহিত্যের ভালোবাসা কি এমনই হয়?
আল মাহমুদ : সত্যিকার অর্থে আমাদের মধ্যে তখন এ বিষয়টাই কাজ করত। আর কাব্য হিংসা বলতে আমরা এক অন্যের লেখার প্রতি চরম ঈর্ষাকাতর হতাম। শামসুর রাহমান, ফজল শাহাবুদ্দীন, শহীদ কাদরী তিনজন ভালো বন্ধু ছিলাম। এরা প্রত্যেকে বড়মানের কবিও। আর একজন- পঞ্চাশের সৈয়দ হক ভাই, তারও ভালো কিছু লেখা আছে। আমাদের সময়ের প্রত্যেক লেখকের কিছু না কিছু ভালো কাজ আছে, যেমন ধরো মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহ, আমাকে ছন্দ শিখিয়েছিলেন।
প্রশ্ন : আমরা দেখি কবিরা গান লিখলে সেটা বেশ ভালো হয় এবং আলোচনায় আসে। পঞ্চাশের অনেক কবিই গান লিখেছেন। সে ক্ষেত্রে আপনি ভিন্ন। কেন লিখেননি? না আগ্রহ হয়নি?
আল মাহমুদ : হ্যাঁ গান আমি লিখিনি। আমার কেন যেন মনে হয় আমার কবিতার মধ্যে সঙ্গীত আছে। আর আমি মূলত লিরিকধর্মী কবি। আমার কবিতায় গীতিময়তার ফলে গান লিখতে আগ্রহী হইনি। লিখলে হয় তো লিখতে পারতাম। যে শহরে জন্ম আমার, সে শহরকে সঙ্গীতের শহর বলা হতো। সঙ্গীতের সব যন্ত্র এখানে তৈরি হতো। আমি দেখতাম যে সিরিজ কাগজ দিয়ে সেতার, এশরাজ ঘষছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম। আমি অনেকবার বলেছি যে আমি কবি না হলে সঙ্গীতজ্ঞ হতাম।
প্রশ্ন : কবিরা কখনও কখনও লক্ষ্যহীন চলে বা লেখে। একজন কবির কি কোনো চূড়ান্ত লক্ষ্য থাকা উচিত?
আল মাহমুদ : প্রকৃত কবিরা শুধু লেখে না, তারা পরিশ্রম করে পড়ে, ঘুরে, কবিতার ছন্দ মিল রেখে জায়গায় পৌঁছাতে চায়। একটা কবিতাকে সার্থক করে তুলতে চায়। এটাই কবির লক্ষ্য হওয়া উচিত। কবিদের সম্পর্কে বলা হয়েছে- ওনারা উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায়। একজন কবিকে লক্ষ্যহীন হলে চলে না। তার কিছু দায়িত্ব আছে, কতর্ব্য আছে।
প্রশ্ন : কবি ফররুখ ও জসীম উদ্দীন আপনার প্রিয় কবি। এরা গুরুত্বপূর্ণ হলেও অনেকটা আলোচনার বাইরে বা আড়ালে মনে হয়। বিষয়টা কেন, বলতে পারেন?
আল মাহমুদ : আলোচনার বাইরে বা আড়ালে বিষয়টা একদম ঠিক নয়। এই যে তোমার মনে আছে তাহলে আড়াল হল কি করে? তাছাড়া তারা বাংলাভাষার মৌলিক কবি। বাংলা কবিতার কথা বলতে গেলে তাদের নাম উচ্চারণ করতেই হবে। তাদের কবিতায় আছে নতুনত্ব এবং ভাবনার উপাদান। কবিদের তালিকায় এদের নাম লেখা অপরিহার্য।
প্রশ্ন : কাব্যজীবনে আপনাকে বাংলাভাষা ছাড়া অন্য ভাষার সাহিত্য খুব বেশি টাচ করেছে কি?
আল মাহমুদ : সব ভাষার সাহিত্যই টুকটাক পড়েছি। সামান্য যা জেনেছি তা দিয়েই কবিতার সঙ্গে যোগাযোগ করে একটা সম্পর্ক দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছি। পরে বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে ভালো সম্পর্কও তৈরি হয়েছে। যা আমার লেখায় এসেছে।
প্রশ্ন : মানিক বন্দোপাধ্যায়ের লেখা ‘পদ্মা নদীর মাঝি’। বাংলাসাহিতের আলোচিত উপন্যাসের একটি। আপনার এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন এতে একটি খুঁত আছে। সেটি কি?
আল মাহমুদ : প্রথম কথা হচ্ছে, মানবিক শিল্প নির্ভুল হয় না। তবু লেখকের চেষ্টা থাকে পারফেকশনের জন্য। কিন্তু এই উপন্যাসে দেয়া হয়েছে মুসলমানদের ব্যাপরে অন্য ধারণা। উপন্যাসে একটা চরিত্র আছে কুবের মাঝি। নতুন কোনো দ্বীপে দরিদ্র মানুষদের নিয়ে যাচ্ছে সে। সেটা হল ময়নাদ্বীপ। এই যে চিন্তা। এটাই তো অস্বাভাবিক। এখানে ভালো করে পড়ে দেখ বুঝবে।
প্রশ্ন : ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ আপনার এই বইটি নিয়ে একবার বাংলাদেশ টেলিভিশনে মনজুরে মাওলার সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়েছিল। বিষয়টা কি এবং কেন হয়েছে?
আল মাহমুদ : টেলিভিশনে উনি আমাকে বলল- লোকে বলে আপনার ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ বইটি পঞ্চাশভাগ সত্য আর পঞ্চাশভাগ মিথ্যা। কথাটা শুনে আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। বললাম- আমি কবি মানুষ। একটা আত্মোপন্যাস লিখেছি। আপনি নিজেও ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। একটা উপন্যাসে পঞ্চাশভাগ সত্য আর পঞ্চাশভাগ মিথ্যা যখন বললেন, তাহলেই আমার বইটি সার্থক। তারপর আর কোনো কথা বলেনি।
প্রশ্ন : আপনার গল্প ‘জলবেশ্যা’ থেকে কলকাতায় ‘টান’ নামে নির্মাণ করা হয়েছে বাংলা সিনেমা। এই বিষয়ে কিছু বলেন?
আল মাহমুদ : অসাধারণ একটি গল্প। তারা গল্পটি প্রছন্দ করে সম্মানী দিয়ে অনুমতি নিয়ে গেল। নির্মিত চলচ্চিত্রটি উদ্বোধন করার কথাও বলে ছিল। কিন্তু আমার বয়স হয়ে গেছে, সে রকম চলাফেরা করতে পারি না। বললাম যে, যেতে পারব না।
প্রশ্ন : ‘ফুরফুরে পাঞ্জাবি পরে সাহিত্য হয় না’ একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন। সহজ করে কথাটা বললে কি বলবেন?
আল মাহমুদ : ‘বিনা প্রেম সে নাহি মিলে নন্দলালা’, ঠিক এমনই। পরিশ্রম আর ভালবাসা ছাড়া কোনো কিছুই অর্জন হয় না। প্রচুর পড়া, ঘুরা, লিখা সবই করতে হবে। অলস হয় বসে থাকলে চলবে না।
প্রশ্ন : বয়স আপনার আশির কোঠায়। এখন শুরু করেছেন ‘এ গল্পের শেষ নেই শুরুও ছিল না’ শিরোনামে মহাকাব্য। শেষ করতে পারবেন কি?
আল মাহমুদ : দোয়া কর ইনশাহআল্লাহ শেষ করব। অনেক আগেই মাহাকব্য লেখার ইচ্ছা থাকলেও হয়ে উঠেনি। এটি শুরু করেছি গত বছর থেকে। দেখি কতটুকু লিখতে পারি। শরীরটা যদি আল্লাহ সুস্থ্য রাখেন।
প্রশ্ন : বর্তমানে আপনি বাংলাভাষার প্রধান কবি। বিষয়টা কেমন উপভোগ করেন?
আল মাহমুদ : ভালোই লাগছে। আমি তো এখনও লিখে চলেছি। জীবনে বহু পরিশ্রম করেছি। সাহিত্যে এসে ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করিনি। সবকিছু অর্জন করেছি কাজের মাধ্যমে। সর্বোপরি সাহিত্যকে ভালোবাসার জন্যই আমার এ অবস্থান। আর কবিতাই আমার বাড়ি-ঘর। তাই সম্পদ নেই, আছে খ্যাতি।
প্রশ্ন : সুধীন দত্ত বলেছেন- শব্দ দিয়েই কবিতা তৈরি হয়। আপনি কি মনে করেন?
আল মাহমুদ : কবিতা এক অমীমাংসিত শিল্প। এর সংজ্ঞা আজ পর্যন্ত নিরূপণ সম্ভব হয়নি। আমি বলি- কবিতা পরিশ্র“ত চিন্তা যা উৎকৃষ্ট শব্দের মাধ্যমে বেরিয়ে আসে। শুধুমাত্র শব্দ দিয়ে কবিতার অবয়ব তৈরি হয় না।
প্রশ্ন : ‘চোখ’ শিরোমের একটি কবিতায় লিখেছেন- এখন চোখ নিয়েই হল আমার সমস্যা।/ যেন জন্ম থেকেই/ অতিরিক্ত অবলোকন শক্তিকে ধারণ করে আছি...। মূলত চোখ নিয়ে কি সমস্যার কথা বুঝিয়েছেন?
আল মাহমুদ : আমি আসলে অতিরিক্ত দেখি। সাধারণ মানুষ যা দেখতে পায় না আমি তা দেখতে পাই। তুমি পোশাক পরে আছ আমি পোশাক দেখি না, আমি ভিতর দেখি। এটাই একজন কবির দেখা। কবির অবলোকন শক্তি।
প্রশ্ন : আপনার বিখ্যাত কবিতার বই ‘সোনালী কাবিন’। এই নামের কবিতায় বলেছেন- সোনার দিনার নেই, দেন মোহর চেয়ো না হরিণী/ যদি নাও দিতে পারি, কাবিনবিহীন হাত দুটি। কবিরা আসলে সব সময় সাময়িক অর্থের পরোয়া না করে ভালোবাসা দিতে আগ্রহী? কবিদের এই আগ্রহে কি নারীর সব পাওয়া যায়?
আল মাহমুদ : না। কারণ, কাবিন বিহীন এই নয় যে, কোনো মূল্য না দিয়ে প্রেম কেনা যায়। এটা ভালোবাসার বহির্প্রকাশ। নিশ্চয় তার মূল্য দিতে হয়। চাওয়া-পাওয়ায় মিল করে নিতে হয়। বিনা প্রেম সে নাহি মিলে নন্দলালা।
প্রশ্ন : এ সময়ে অনেকে আধুনিক কবিতা লিখতে গিয়ে কবিতার মূল জায়গা থেকে সরে যায়। এতে কি পাঠকের সঙ্গে কবির দূরত্ব তৈরি হয় না?
আল মাহমুদ : কবি যদি আধুনিক কবিতা কি, তা না বোঝেন তা হলে তো কবিতা হল না। কবির কবিতা কমিউনিকেট করতে হবে পাঠকের হৃদয়ের সঙ্গে। তা না হলে কবি ফেইল করল। আমরা তো সারা বছর কবিতা লিখেছি। কই কেউ তো কখনও অভিযোগ করেনি।
প্রশ্ন : আল্লামা রুমি, হাফিজ, জামিসহ এদের অনেক লেখা পড়েছেন, আপনার লেখা পড়ে বোঝা যায়। তাদের নিয়ে কিছু বলা যায়?
আল মাহমুদ : এরা খুবই অসাধারণ কবি ছিলেন। তাদের লেখা আমি ইংরেজিতে পড়েছি। তাদেরও কিছু লেখা আমার মনে ছায়া ফেলেছে। যা কবিতার জন্য খুব কাজ দিয়েছে। আর ভালো কবির কবিতা পড়লে প্রভাব পড়েই স্বাভাবিক। আমাকে তুমি এদের ভাবশিষ্য বলতে পার।
প্রশ্ন : সালমান রুশদি বলেছেন- লেখকদের অধিক স্বাধীনতা থাকা দরকার। আপনি কি তাই মনে করেন?
আল মাহমুদ : লেখকরা তো জন্ম থেকেই স্বাধীন। তারা কাউকে জিজ্ঞাস করে লেখেন না। মনের আনন্দে লিখে যান অবিরত। স্বাধীনতার প্রশ্ন আসবে কেন?
প্রশ্ন : আপনি আপনার একটি বইয়ের উৎসর্গে লিখেছেন, আমাদের কাব্য হিংসা অমর হোক- শামসুর রাহমান, ফজল শাহাবুদ্দীন, শহীদ কাদরী। সাহিত্যের ভালোবাসা কি এমনই হয়?
আল মাহমুদ : সত্যিকার অর্থে আমাদের মধ্যে তখন এ বিষয়টাই কাজ করত। আর কাব্য হিংসা বলতে আমরা এক অন্যের লেখার প্রতি চরম ঈর্ষাকাতর হতাম। শামসুর রাহমান, ফজল শাহাবুদ্দীন, শহীদ কাদরী তিনজন ভালো বন্ধু ছিলাম। এরা প্রত্যেকে বড়মানের কবিও। আর একজন- পঞ্চাশের সৈয়দ হক ভাই, তারও ভালো কিছু লেখা আছে। আমাদের সময়ের প্রত্যেক লেখকের কিছু না কিছু ভালো কাজ আছে, যেমন ধরো মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহ, আমাকে ছন্দ শিখিয়েছিলেন।
প্রশ্ন : আমরা দেখি কবিরা গান লিখলে সেটা বেশ ভালো হয় এবং আলোচনায় আসে। পঞ্চাশের অনেক কবিই গান লিখেছেন। সে ক্ষেত্রে আপনি ভিন্ন। কেন লিখেননি? না আগ্রহ হয়নি?
আল মাহমুদ : হ্যাঁ গান আমি লিখিনি। আমার কেন যেন মনে হয় আমার কবিতার মধ্যে সঙ্গীত আছে। আর আমি মূলত লিরিকধর্মী কবি। আমার কবিতায় গীতিময়তার ফলে গান লিখতে আগ্রহী হইনি। লিখলে হয় তো লিখতে পারতাম। যে শহরে জন্ম আমার, সে শহরকে সঙ্গীতের শহর বলা হতো। সঙ্গীতের সব যন্ত্র এখানে তৈরি হতো। আমি দেখতাম যে সিরিজ কাগজ দিয়ে সেতার, এশরাজ ঘষছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম। আমি অনেকবার বলেছি যে আমি কবি না হলে সঙ্গীতজ্ঞ হতাম।
প্রশ্ন : কবিরা কখনও কখনও লক্ষ্যহীন চলে বা লেখে। একজন কবির কি কোনো চূড়ান্ত লক্ষ্য থাকা উচিত?
আল মাহমুদ : প্রকৃত কবিরা শুধু লেখে না, তারা পরিশ্রম করে পড়ে, ঘুরে, কবিতার ছন্দ মিল রেখে জায়গায় পৌঁছাতে চায়। একটা কবিতাকে সার্থক করে তুলতে চায়। এটাই কবির লক্ষ্য হওয়া উচিত। কবিদের সম্পর্কে বলা হয়েছে- ওনারা উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায়। একজন কবিকে লক্ষ্যহীন হলে চলে না। তার কিছু দায়িত্ব আছে, কতর্ব্য আছে।
প্রশ্ন : কবি ফররুখ ও জসীম উদ্দীন আপনার প্রিয় কবি। এরা গুরুত্বপূর্ণ হলেও অনেকটা আলোচনার বাইরে বা আড়ালে মনে হয়। বিষয়টা কেন, বলতে পারেন?
আল মাহমুদ : আলোচনার বাইরে বা আড়ালে বিষয়টা একদম ঠিক নয়। এই যে তোমার মনে আছে তাহলে আড়াল হল কি করে? তাছাড়া তারা বাংলাভাষার মৌলিক কবি। বাংলা কবিতার কথা বলতে গেলে তাদের নাম উচ্চারণ করতেই হবে। তাদের কবিতায় আছে নতুনত্ব এবং ভাবনার উপাদান। কবিদের তালিকায় এদের নাম লেখা অপরিহার্য।
প্রশ্ন : কাব্যজীবনে আপনাকে বাংলাভাষা ছাড়া অন্য ভাষার সাহিত্য খুব বেশি টাচ করেছে কি?
আল মাহমুদ : সব ভাষার সাহিত্যই টুকটাক পড়েছি। সামান্য যা জেনেছি তা দিয়েই কবিতার সঙ্গে যোগাযোগ করে একটা সম্পর্ক দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছি। পরে বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে ভালো সম্পর্কও তৈরি হয়েছে। যা আমার লেখায় এসেছে।
প্রশ্ন : মানিক বন্দোপাধ্যায়ের লেখা ‘পদ্মা নদীর মাঝি’। বাংলাসাহিতের আলোচিত উপন্যাসের একটি। আপনার এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন এতে একটি খুঁত আছে। সেটি কি?
আল মাহমুদ : প্রথম কথা হচ্ছে, মানবিক শিল্প নির্ভুল হয় না। তবু লেখকের চেষ্টা থাকে পারফেকশনের জন্য। কিন্তু এই উপন্যাসে দেয়া হয়েছে মুসলমানদের ব্যাপরে অন্য ধারণা। উপন্যাসে একটা চরিত্র আছে কুবের মাঝি। নতুন কোনো দ্বীপে দরিদ্র মানুষদের নিয়ে যাচ্ছে সে। সেটা হল ময়নাদ্বীপ। এই যে চিন্তা। এটাই তো অস্বাভাবিক। এখানে ভালো করে পড়ে দেখ বুঝবে।
প্রশ্ন : ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ আপনার এই বইটি নিয়ে একবার বাংলাদেশ টেলিভিশনে মনজুরে মাওলার সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়েছিল। বিষয়টা কি এবং কেন হয়েছে?
আল মাহমুদ : টেলিভিশনে উনি আমাকে বলল- লোকে বলে আপনার ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ বইটি পঞ্চাশভাগ সত্য আর পঞ্চাশভাগ মিথ্যা। কথাটা শুনে আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। বললাম- আমি কবি মানুষ। একটা আত্মোপন্যাস লিখেছি। আপনি নিজেও ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। একটা উপন্যাসে পঞ্চাশভাগ সত্য আর পঞ্চাশভাগ মিথ্যা যখন বললেন, তাহলেই আমার বইটি সার্থক। তারপর আর কোনো কথা বলেনি।
প্রশ্ন : আপনার গল্প ‘জলবেশ্যা’ থেকে কলকাতায় ‘টান’ নামে নির্মাণ করা হয়েছে বাংলা সিনেমা। এই বিষয়ে কিছু বলেন?
আল মাহমুদ : অসাধারণ একটি গল্প। তারা গল্পটি প্রছন্দ করে সম্মানী দিয়ে অনুমতি নিয়ে গেল। নির্মিত চলচ্চিত্রটি উদ্বোধন করার কথাও বলে ছিল। কিন্তু আমার বয়স হয়ে গেছে, সে রকম চলাফেরা করতে পারি না। বললাম যে, যেতে পারব না।
প্রশ্ন : ‘ফুরফুরে পাঞ্জাবি পরে সাহিত্য হয় না’ একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন। সহজ করে কথাটা বললে কি বলবেন?
আল মাহমুদ : ‘বিনা প্রেম সে নাহি মিলে নন্দলালা’, ঠিক এমনই। পরিশ্রম আর ভালবাসা ছাড়া কোনো কিছুই অর্জন হয় না। প্রচুর পড়া, ঘুরা, লিখা সবই করতে হবে। অলস হয় বসে থাকলে চলবে না।
প্রশ্ন : বয়স আপনার আশির কোঠায়। এখন শুরু করেছেন ‘এ গল্পের শেষ নেই শুরুও ছিল না’ শিরোনামে মহাকাব্য। শেষ করতে পারবেন কি?
আল মাহমুদ : দোয়া কর ইনশাহআল্লাহ শেষ করব। অনেক আগেই মাহাকব্য লেখার ইচ্ছা থাকলেও হয়ে উঠেনি। এটি শুরু করেছি গত বছর থেকে। দেখি কতটুকু লিখতে পারি। শরীরটা যদি আল্লাহ সুস্থ্য রাখেন।
প্রশ্ন : বর্তমানে আপনি বাংলাভাষার প্রধান কবি। বিষয়টা কেমন উপভোগ করেন?
আল মাহমুদ : ভালোই লাগছে। আমি তো এখনও লিখে চলেছি। জীবনে বহু পরিশ্রম করেছি। সাহিত্যে এসে ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করিনি। সবকিছু অর্জন করেছি কাজের মাধ্যমে। সর্বোপরি সাহিত্যকে ভালোবাসার জন্যই আমার এ অবস্থান। আর কবিতাই আমার বাড়ি-ঘর। তাই সম্পদ নেই, আছে খ্যাতি।
No comments