স্নেহ, সন্তান, পিতা-মাতা by ড. মাহফুজ পারভেজ
অল্প বয়সী একটি সন্তান, ছেলে কিংবা মেয়ে হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে, ডাক্তারের কাছে আর ফার্মেসিতে ছোটাছুটি করছেন পিতা, মা দারুণ উদ্বেগ নিয়ে বসে আছেন সন্তানের রোগশয্যার পাশে। এমন চিত্র প্রতিদিনের না হলেও প্রতিটি পরিবারেই পরিচিত দৃশ্য। মাঝে মাঝে এমন উদ্বেগাকুল পরিস্থিতি প্রায়-সকল পরিবারেই দেখা যায়। রোগের যন্ত্রণায় সন্তান যখন ছটফট করে, পিতা-মাতার ভেতরেও তখন ছটফটানি কম থাকে না। সন্তান দূরে কোথাও থাকলে, বিদেশে বিদেশের স্কুলে-কলেজে-কর্মক্ষেত্রে, তখন যেন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার তীব্রতা আরও বাড়ে। মানুষের মধ্যে এ বাৎসল্য, আপত্য স্নেহ অতিপ্রাকৃতিক বায়োলোজিক্যাল বিষয়। ইংরেজিতে বলা যায় ইনস্টিংকটিভ। প্রকৃতিই শরীরবৃত্তীয়ভাবে এমনটি মানুষের রক্তে-স্বভাবে-প্রবণতায় ভরে দিয়েছে। বংশের ধারাবাহিকতা, ঐতিহ্যের চেরাগ, নিজের উত্তরাধিকার রক্ষার জন্যই মানুষ এই স্নেহ ও বাৎসল্য অনুসরণ করে। এজন্যই চলতি কথায় বলে স্নেহ নিম্নগামী। পিতা-মাতা সন্তানদের লালন-পালনের জন্য যেমন সদাব্যস্ত, সে সন্তানরা যখন বড় হয়, নিজেরাও সন্তানের বাবা কিংবা মা হয়, তখন তারাও সন্তানদের সুরক্ষা কিংবা সুচিকিৎসা বা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য সব সময় যত্নবান থাকেন। প্রকৃতি ও শরীরবৃত্তীয় এ ব্যাপারটিকে সামনে রেখে পারিবারিক-সামাজিক বাস্তবতায় কিছু প্রশ্ন ওঠে। যেমন, প্রকৃতি ও শরীরচক্র কি উপরের দিকে তাকাতে নিষেধ করেছে? স্নেহ নিম্নগামী বলেই কি সন্তানের জন্য যত ব্যতিব্যস্ততা, নিজের পিতা-মাতার জন্য ততটুকু নয় কেন? নিজের পিতা-মাতার বিপদ-আপদ, অসুখে তাকাবার সময় অনেকেরই নেই কেন? যদিও একজন মানুষের পক্ষে নিজের সন্তান আর নিজের পিতা বা মাতার মধ্যে পার্থক্য বা তারতম্য করা ভয়ানক কঠিন ও অসম্ভব কাজ। তথাপি, স্নেহ বা বাৎসল্য যতটুকু নিচের দিকে সন্তান বা তস্য-সন্তানদের দিকে নামে, ওপরের দিকে পিতা বা মাতার ক্ষেত্রে ততটুকু ওঠে না। সমাজে এমন একচক্ষু বিশিষ্ট মানুষের অভাব তো নেই-ই, বরং সংখ্যায় তারা বাড়ছে। নিজের স্ত্রী-সন্তানের বাইরে বৃহত্তর পরিবার-পরিজন তো দূরের কথা, জন্মদাতা পিতা-মাতার দায়িত্ব পালন, এমন কি, মামুলি খোঁজ-খবর করার প্রয়োজনও বোধ করে না অনেক সাবালক সন্তান। ইদানীং সংবাদপত্রে নানা ঘটনার উল্লেখ দেখে শিউরে উঠতে হয় বেশি বয়সে অনেক পিতা-মাতাকেই অসহায়ভাবে জীবন কাটাতে দেখা যাচ্ছে। এ অসহায়ত্ব আর্থিকভাবে, শারীরিকভাবে, সামাজিক বা পারিবারিকভাবে। শেষ বয়সে যখন বাধ্য হয়েই সাবালক ও প্রতিষ্ঠিত সন্তানদের তথা নিজের পুত্র বা কন্যার ওপর নির্ভর করতে হয়, তখন যদি আশাহত বা প্রত্যখ্যাত হতে হয়, তাহলে পুরো ব্যাপারটিই মর্মান্তিক আকার ধারণ করে। যে পুত্র বা কন্যাকে মানুষ করার জন্য তাঁরা প্রভূত পরিশ্রম ও যথাসাধ্য চেষ্টা, অর্থ ব্যয় ও পরিশ্রম করেছেন, শেষ জীবনে তাঁরা সেই সন্তানের আশ্রয়ে থাকতে চাইবেন, এটাই স্বাভাবিক ও সঙ্গত। কিন্তু এই স্বাভাবিক ও সঙ্গত প্রত্যাশা সব সময় বাস্তবায়িত হয়। বয়স্ক অনেকের জীবনেই প্রতিদানে পাওয়া যায় নিজ সন্তানদের পক্ষ থেকে অভব্য, নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন, অমানবিক ব্যবহার। পিতা-মাতাকে খেতে না দেয়া, বাড়ি থেকে বিতাড়ন, নির্যাতন করা, সম্পত্তি পেতে হত্যার মতো ঘটনাও ঘটছে অহরহ। অসহায় মা-বাবা নিষ্ঠুর সন্তানদের বিরুদ্ধে আদালতে পর্যন্ত যেতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেক শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত বয়সী-পিতা-মাতা লোক-লজ্জা ও সামাজিক ভয়ে মুখ বুজে সহ্য করছেন নানা রকমের অবজ্ঞা ও অবহেলা। রোগ-শোকের উপশম পাওয়ার বদলে সাধারণ-স্বাভাবিক-সম্মানজনক দৈনন্দিন জীবনও তারা যাপন করতে পারছেন না নিজেরই সন্তানের অধীনে; অথচ সেই অবোধ শিশুকেই তিলে তিলে বড় করেছিলেন এই পিতা-মাতাই। পিতা-মাতার বুকে বড়-হওয়া সন্তান সেই পিতা-মাতাকে সুপ্ত কারাগারের নিত্য যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে শেষ জীবনের পথ পাড়ি দিতে বাধ্য করছে। অথচ সমাজ-সংস্কৃতি-ধর্মে পিতা-মাতার মর্যাদা এবং তাদের প্রতি কর্তব্য সম্পর্কে সবিশেষ জোর দেয়া হয়েছে। ইসলামে পিতা-মাতার মর্যাদা অপরিসীম। তারা যেন সন্তানের আচরণে কষ্ট পেয়ে ‘উহ্’ শব্দটিও না করেন, এমনই সতর্কতা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, পিতা-মাতা সন্তানের প্রতি সন্তুষ্ট থাকলে আল্লাহ সোবহানাহুতায়ালাও সন্তুষ্ট থাকবেন। পিতা-মাতাই সন্তানের জন্য জান্নাত বা জাহান্নাম। অর্থাৎ পিতা-মাতার সঙ্গে আচরণ্ের মাধ্যমেই একজন সন্তান তার জান্নাত বা জাহান্নাম লাভ করতে পারে। শুধু ইসলাম নয়, অন্যান্য ধর্মেও পিতা-মাতার গুরুত্ব রয়েছে। বৈদিক শ্লোকের ভাষায়, ‘পিতা হি পরমন্তপঃ’। অতএব, জীবনের বাস্তবতা, ব্যস্ততা বা সীমাবদ্ধতার কারণে পিতা-মাতাকে অবজ্ঞা, অবহেলা, নির্যাতনের কোনও সুযোগ নেই। এটা আইনের দিক থেকে, ধর্মের দিক থেকে, নৈতিকতা ও মানবিকতার দিক থেকে জঘন্য অপরাধ। নিজের সন্তানকে স্নেহ ও বাৎসল্য প্রদানের সময় নিজের পিতা-মাতার কাছ থেকে পাওয়া স্নেহ-বাৎসল্যের কথাও কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ রাখা দরকার। নিজের পিতা-মাতাকে অবহেলা ও অন্যায় আচরণের শিকারে পরিণত করলে, শেষ বয়সে নিজেদেরও তেমন বিপদে পড়তে হতে পারে আর জীবনের পরের দুর্ভোগ তো থাকছেই। পবিত্র রমজানের পরেই কৃচ্ছ্র সাধন আর সংযমের পুরস্কার-স্বরূপ আসবে ঈদের অনাবিল আনন্দ। তখন ঈদের সেই মহৎ উৎসবে নিজের সন্তান আর নিজের পিতা-মাতাকেসহ সবাইকে যদি আনন্দে-হাসিতে-খুশিতে উদ্ভাসিত করা যায়, তার চেয়ে স্বর্গীয়-নির্মল আনন্দময় প্রাপ্তি আর কি হতে পারে! এই অনির্বচনী খুশির সামনে ঈদের বৈষয়িক ও জাগতিক আনন্দ তুচ্ছ। বরং বস্তুগত দিক থেকে কম হলেও ভাবগত, মনোগত ও আত্মিক দিক থেকে উন্নত ও আনন্দময় ঈদের প্রতি সকলের লক্ষ্য থাকা দরকার। যেখানে নিজের পিতা-মাতা, সন্তান, পরিজন, সমাজ, সংসার, সবাইকে নিয়ে আনন্দ উপভোগ করা যাবে, সেখানেই নিহিত থাকবে ঈদের প্রকৃত আনন্দ, প্রাপ্তি ও মর্যাদা।
No comments