স্বাধীনতা হরণ করবেন মন্ত্রী!
সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী এবার সরাসরি গণমাধ্যম তথা সাংবাদিকদের হুমকি দিয়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। গত বুধবার সচিবালয়ে আয়োজিত এক সভায় নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনার যা খুশি তাই দেখাবেন, বারবার দেখিয়ে একটা সেন্টিমেন্ট তৈরি করবেন, মানুষকে উত্তেজিত করছেন। আপনাদের জন্য এমন আইন করা হচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে আপনাদের স্বাধীনতাই থাকবে না।’ (প্রথম আলো, ২৩ জুলাই, ২০১৪)
এর মাধ্যমে মন্ত্রী জানিয়ে দিলেন যে বর্তমান সরকারের আমলে সাংবাদিকেরা যতটুকু স্বাধীনতা ভোগ করছেন, সেটি থাকা উচিত নয়। সাংবাদিক বা গণমাধ্যমের কোনো স্বাধীনতা থাকতে পারে না। স্বাধীনতা থাকবে কেবল মন্ত্রী-সাংসদ ও তাঁদের সাঙ্গপাঙ্গদের। এর বাইরে এ দেশে সবাইকে পরাধীন হয়ে বেঁচে থাকতে হবে। সৈয়দ মহসিন আলী ব্যক্তিমাত্র নন। তিনি সরকারের একজন পূর্ণ মন্ত্রী ও সাংসদ। তাই তাঁর এই বচনকে অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই। কেন তিনি কঠোর আইন করবেন, তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, নারায়ণগঞ্জসহ সারা দেশে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা যে হত্যা, লুটপাট, চাঁদাবাজি, দখলবাজির ঘটনা ঘটাচ্ছেন, তা লেখা যাবে না, বারবার দেখানো যাবে না। মামাবাড়ির আবদার! আওয়ামী লীগের নেতারা নিজেরা খুনোখুনি, লাঠালাঠি করবেন। নিজেরা না পারলে ভাড়াটে দিয়ে খুন করিয়ে লাশ নদীতে ভাসিয়ে কিংবা গাড়িতেই পুড়িয়ে দেবেন। মন্ত্রী-নেতারা তা চেয়ে চেয়ে দেখবেন, কিন্তু সাংবাদিকেরা প্রচার করতে পারবেন না। দেখালেই আইন করে বন্ধ করে দেবেন। কেন বন্ধ করবেন? নিহত ব্যক্তিদের শোকাহত স্বজনদের ছবি বারবার দেখলে সম্ভবত মন্ত্রীপ্রবরের সুখ ও আনন্দ মাটি হয়ে যায়।
ঘুম নষ্ট হয়। সম্ভবত এ জন্যই তিনি সাংবাদিকেরা যাতে স্বাধীনভাবে ছবি তুলতে না পারেন, খবর প্রকাশ করতে না পারেন—সে ধরনের আইন করার কথা বেলছেন। গণতান্ত্রিক সরকারের গণতান্ত্রিক মন্ত্রী বটে! কেবল সৈয়দ মহসিন আলী নন, ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের বদৌলতে নির্বাচিত হওয়া সাংসদ ও মন্ত্রীদের অনেকেই ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন। আবোলতাবোল বলছেন। সমাজকল্যাণমন্ত্রী মন্ত্রণালয়ের কোনো কাজে কৃতিত্ব দেখাতে না পারলেও সৈয়দ মহসিন আলী এর আগে প্রকাশ্য সভায় মঞ্চে বসে সিগারেটে সুখটান দিয়ে পত্রিকায় খবর হয়েছিলেন। সাংবাদিকদের স্বাধীনতা হরণসংক্রান্ত মন্ত্রীর এই বক্তব্যকে অসার প্রলাপ বলে অগ্রাহ্য করা যেত, যদি না গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের নানা আনজাম সরকারের ভেতর থেকেই শুরু না হতো। গতকাল বুধবার প্রথম আলোয় দুটি খবরই পাশাপাশি প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম কলামের খবরটির শিরোনাম ছিল: স্বাধীনতাই থাকবে না। দ্বিতীয়টি: সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ, তথ্য মন্ত্রণালয়ই আইন সংশোধনের উদ্যোক্তা এ মাসের গোড়ার দিকে জেলা প্রশাসক সম্মেলন সামনে রেখে ঢাকার জেলা প্রশাসক ১৯৭৩ সালের প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস আইনের সংবাদপত্র বন্ধ করার ধারাটি পুনরুজ্জীবিত করার প্রস্তাব করেন। তাঁর এই বদমতলবের কথা প্রথম আলো ফাঁস করে দিলে সাংবাদিক সমাজের পক্ষ থেকে ব্যাপক সমালোচনা হয়। সাংবাদিক ইউনিয়নের দুই অংশ, সম্পাদক পরিষদ এর প্রতিবাদ জানায়। এমনকি তথ্য মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদের স্থায়ী কমিটিও সংশোধনীটি সুপারিশ না করার জন্য মন্ত্রণালয়কে বলে। শেষ পর্যন্ত জেলা প্রশাসক সম্মেলনে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা না হওয়ায় সবাই ধারণা করেছিলেন, সরকারের সুমতি হয়েছে।
তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুও আমাদের আশ্বস্ত করেছিলেন যে সরকার ১৯৭৩ সালের প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস আইন সংশোধনের কথা ভাবছে না। তিনি বা তাঁর মন্ত্রণালয়ও বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত নয়। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হলো মন্ত্রীর জ্ঞাতে হোক, অজ্ঞাতে হোক তাঁর মন্ত্রণালয়ই প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়। গতকাল প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ৫ জানুয়ারির অস্বাভাবিক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর ‘বর্তমান সরকার গত ফেব্রুয়ারিতে এই উদ্যোগ নেয়। সংশোধিত আইনটি চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে কার্যকরের প্রস্তাব করা আছে। দ্য প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস (ডিক্লারেশন অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন) অ্যাক্ট, ২০১৪ শিরোনামে এই সংশোধিত আইনের খসড়ায় রাষ্ট্রবিরোধী ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করলে সংবাদপত্র বন্ধ করার বিধান রাখা হয়।’ প্রথম আলোর অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ‘তথ্য মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে গোপনে অনেক দূর এগিয়েছে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে প্রথমে আট সদস্যের কমিটি করা হয়। কমিটি আইনের খসড়া তৈরির জন্য মন্ত্রণালয়ের অধীন চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরকে (ডিএফপি) দায়িত্ব দেয়। এই কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের দুজন যুগ্ম সচিব, প্রধান তথ্য কর্মকর্তা, ডিএফপির মহাপরিচালক, ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (জেলা প্রশাসক), আইন মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) একজন করে প্রতিনিধি।’ কমিটির প্রথম সভা হয় গত ২৪ ফেব্রুয়ারি। সভায় ‘দ্য প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস (ডিক্লারেশন অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন) অ্যাক্ট, ১৯৭৩’ যুগোপযোগী করার সিদ্ধান্ত হয়। ১৮ মার্চ ডিএফপি থেকে সংশোধনীসহ আইনের খসড়াটি তথ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠান ডিএফপির সাবেক মহাপরিচালক। ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত কমিটির দ্বিতীয় সভায় খসড়ার ওপর আলোচনা হয়। খসড়ায় বলা হয়, রাষ্ট্র ও ধর্মবিরোধী যেকোনো অভিযোগে পত্রিকার প্রকাশনা বাতিল করতে পারবেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। তবে এটা কার্যকর করবে তথ্য মন্ত্রণালয় বা আদালত। সে ক্ষেত্রে অভিযুক্ত সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষ আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবে। আদেশ দেওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে ভুক্তভোগী প্রেস আপিল বোর্ডে আপিল করতে পারবে।
এ ব্যাপারে তথ্যমন্ত্রীর সাফাই হলো: কর্মকর্তাদের দিয়ে গঠিত কমিটির সুপারিশে কিছু আসে যায় না। রাজনৈতিক পর্যায়ে সংবাদপত্রের প্রকাশনা নিষিদ্ধবিষয়ক আইন প্রণয়নের কোনো চিন্তাভাবনা নেই। রাজনৈতিক পর্যায়ে চিন্তাভাবনা না থাকলে তাঁর অধীন কর্মকর্তারা এই দুঃসাহস কোথায় পেলেন? তাঁরাই কি সরকারের ভেতরে আরেকটি সরকার, না তথ্য মন্ত্রণালয়ে অনেক কিছু হচ্ছে, যার খবর খোদ মন্ত্রীই জানেন না? প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনসের আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনের সংশ্লিষ্ট ধারাবলে অতীতের সরকারগুলো বিরুদ্ধমতের সংবাদপত্র বন্ধ করে দিত। যিনি আজ তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়েজিত, সেই হাসানুল হক ইনুর দল জাসদের মুখপত্র দৈনিক গণকণ্ঠ ১৯৭৪ সালে কীভাবে বন্ধ হয়েছিল, সেটি নিশ্চয়ই তাঁর অজানা নয়। এই আইনটি প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রণীত বলে বিএনপি ও জাতীয় পার্টি এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল। কিন্তু তারাও ক্ষমতায় এসে বাতিল করেনি; বরং রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছে। এই আইন বলেই স্বৈরাচারী এরশাদ আশির দশকে বাংলার বাণী, সাপ্তাহিক একতা, সাপ্তাহিক রোববার, সাপ্তাহিক যায়যায়দিনসহ বহু পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এসব কারণেই স্বৈরাচারের পতনের পর সাহাবুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস আইনের সংবাদপত্রের প্রকাশনা বাতিলসংক্রান্ত ধারাটি বাতিল করে দেয়। এটি ছিল দেশের গণমাধ্যমকর্মীদের দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের বিজয়। এখন গণতান্ত্রিক সরকারই ফের সেই বিজয়কে এখন ছিনিয়ে নিতে চাইছে। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, সংশোধিত আইনের ২২ ধারায় ‘প্রমাণীকরণ বাতিল’ শীর্ষক ১(চ) উপধারায় বলা হয়েছে, সংবাদপত্রে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বা রাষ্ট্রদ্রোহ কোনো বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে মর্মে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সন্তুষ্ট হলে তিনি ঘোষণাপত্রের নিবন্ধন বাতিল করতে পারবেন। সদ্য শেষ হওয়া জেলা প্রশাসক সম্মেলনের কার্যপত্রেও এই দুটি বিষয় উল্লেখ ছিল। তবে জেলা প্রশাসক সম্মেলনের কার্যপত্রে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ ও ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ শব্দগুচ্ছ উল্লেখ থাকলেও মন্ত্রণালয়ের খসড়া আইনে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ এবং ‘ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত’ কথাগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের প্রস্তাবের সঙ্গে তথ্য মন্ত্রণালয়ের করা খসড়া সংশোধনীর মিল রয়েছে। আইনের ১(ঙ) ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, ডিএফপি থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী সংবাদপত্রের প্রকাশক বা সম্পাদকের শর্ত অনুযায়ী শিক্ষাগত বা সাংবাদিকতার যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতায় ঘাটতি থাকলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পত্রিকার প্রমাণীকরণ বাতিল করতে পারবেন। এসব মন্ত্রী, মন্ত্রণালয় বা ডিিস সাহেবদের কর্মকাণ্ডে এটা পরিষ্কার যে সরকার আগের কালো আইনটিই ফিরিয়ে আনতে চাইছে কিছুটা ঘোরপ্যাঁচ করে। আগের আইনে জেলা প্রশাসক চাইলেই যেকোনো সংবাদপত্রের প্রকাশনা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিতে পারতেন। অর্থাৎ সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই তাকে হত্যা করতে হবে। সাংবাদিক সমাজের আপত্তির মূল কারণও ছিল এটি। কোনো সংবাদপত্র অসত্য বা উসকানিমূলক সংবাদ পরিবেশন করলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান দেশের প্রচলিত আইনেই আছে। কিন্তু এই ব্যবস্থা নেওয়ার অর্থ এই নয় যে পত্রিকাটির ভবিষ্যৎ প্রকাশনা বন্ধ করা। পৃথিবীর অনেক গণতান্ত্রিক দেশেই পত্রিকা প্রকাশের জন্য আলাদা ছাড়পত্র নিতে হয় না। কেবল সংশ্লিষ্ট বিভাগকে অবহিত করলেই হয়। প্রস্তাবিত সংেশাধনীতে প্রেস আপিল বোর্ডে আপিল করা বা আত্মপক্ষ সমর্থনের যে সুযোগ রাখার কথা বলা হয়েছে, তার ফল কী হবে তাও বুঝতে কারও অসুবিধা হয় না। এটি হবে নিছক লোক দেখানো বা আইওয়াশ। সংবাদপত্রের প্রকাশনা বাতিলসংক্রান্ত ধারাগুলো বাতিল হয়েছে ২৩ বছর আগে। ইতিমধ্যে বিএনপি দুবার, আওয়ামী লীগ দুবার পাঁচ বছর করে ক্ষমতায় ছিল। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল দুই বছর। এই দীর্ঘ সময়ে দেশ পরিচালনায় কোনো সরকারেরই সেই বাতিল হওয়া কালো আইনটির প্রয়োজন হয়নি। এখন কেন হলো?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabo3@dhaka.net
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabo3@dhaka.net
No comments