ফিলিস্তিনি সাহিত্য : প্রতিরোধ ও স্বপ্নের রূপকল্প by নাজিব ওয়াদুদ
অতীতে,
সুদূর অতীতে, ফিলিস্তিন বৃহত্তর আরবভূমির অংশ হিসেবে গণ্য ছিল। তার ভাষা
বরাবরই আরবি, সুতরাং ‘ফিলিস্তিনি সাহিত্য’ বলে আলাদা কোনো সাহিত্যের
অস্তিত্ব আগে, বিশেষত বিংশ শতাব্দীর চতুর্থ দশকের আগে ছিল না। ফিলিস্তিন
অঞ্চলে বসবাসকারীরা যেমন আরব হিসেবেই পরিচিত হতো, তেমনই তাদের রচিত
সাহিত্যও আরবি সাহিত্য হিসেবেই পরিগণিত ছিল। ১৯৪৮ সালে ইহুদিবাদী সন্ত্রাসী
রাষ্ট্র ইসরাইলের জন্ম এবং লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে হত্যা ও ভিটেছাড়া করার
মধ্য দিয়ে যে-নতুন ইতিহাসের গতিলাভ ঘটে, তার ফলে ‘ফিলিস্তিনি জাতি’র উদ্ভব
ঘটে এবং এই জাতির সাহিত্য আরবি হওয়া সত্ত্বেও ‘ফিলিস্তিনি সাহিত্য’ নামে
স্বতন্ত্র পরিচয় লাভ করে। ফিলিস্তিনি সাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশ ফিলিস্তিনি
জাতিগঠনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত।
প্রায় চারশ বছর ধরে ফিলিস্তিন অঞ্চল ছিল বৃহত্তর সিরিয়ার অংশ হিসেবে তুর্কি ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীন। এখানকার অধিবাসীরা ছিল আরব। ওসমানীয় শাসকরা এখানে উপনিবেশ সৃষ্টি করেননি, বরং তাদের পক্ষে স্থানীয়রাই এখানকার প্রকৃত শাসক ছিল। এক পর্যায়ে, বিশেষত অর্থনৈতিক কারণে, খুবই সীমিত পরিসরে ফিলিস্তিনে ইহুদি অভিবাসন অনুমোদন করা হয়। এভাবে, ১৯০৮ সালে, ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের সময়, ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার দশ শতাংশে উন্নীত হয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ফিলিস্তিনিরা অন্য আরবদের মতো ব্রিটিশ সহায়তায় তুর্কিদের বিতাড়িত করে। কিন্তু ১৯১৮ সালে ব্রিটিশরা পুরো ফিলিস্তিন দখল করে নেয়। দখলদারিত্ব কায়েম রাখতে ব্রিটিশরা ইহুদিদের সঙ্গে সমঝোতা করে এবং ব্যাপক অভিবাসন ঘটাতে থাকে। ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য একটা আবাসভূমি তৈরি করে দেয়ার অঙ্গীকারও (বালফুর ঘোষণা) করে। ব্রিটিশ শাসকদের প্রশ্রয়ে একের পর এক ইহুদি বসতি গড়ে উঠতে থাকে। শুরু হয় বসতি স্থাপনকারীদের সঙ্গে আদিবাসী ফিলিস্তিনিদের সংঘাত। এই সময়ই সচেতন ফিলিস্তিনিরা অনুধাবন করেন যে বিপদ আসন্ন। শুরু হয় ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা সংগ্রাম। একইসঙ্গে তাদের মোকাবিলা করতে হয় ইহুদি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোকেও। যদিও ফিলিস্তিনিরা তখনও পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন ছিল, তবু মূলত তখন থেকেই ফিলিস্তিনের অধিবাসীরা ‘ফিলিস্তিনি’ হয়ে উঠতে শুরু করেন, কারণ প্রতিবেশী অন্য আরবদের তুলনায় তাদের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যায়। যে ফিলিস্তিন ভূমিতে আরব-ফিলিস্তিনিরা খুব কম করে হলেও সপ্তম শতাব্দী থেকে বসবাস করে আসছিল, ১৯৪৭ সালে ইউরোপ-আমেরিকা নিয়ন্ত্রিত জাতিসংঘ সেই ভূমিকে ভাগ করে ইহুদিদের জন্য ইসরাইল এবং আরবদের জন্য ফিলিস্তিন নামে দুটো পৃথক রাষ্ট্র তৈরির সিদ্ধান্ত নিল। ইসরাইল ১৯৪৮ সালের মে মাসে স্বাধীনতা ঘোষণা করে, আরবরা তা প্রত্যাখ্যান করে, শুরু হয় যুদ্ধ। ইউরোপ-আমেরিকার মদদপুষ্ট ইসরাইলিদের কাছে আরবরা পরাজিত হয়। ইসরাইল জাতিসংঘ-নির্ধারিত নতুন ‘ফিলিস্তিন’-এর অনেক জায়গা দখল করে নেয়, জাতিসংঘ ১৯৪৭ সালে সীমান্তে ফেরত যেতে বললেও ইসরাইল তাতে অস্বীকৃতি জানায়। অন্তত সাত লাখ ফিলিস্তিনিকে ভিটেছাড়া হতে হয়। তারপর থেকে আরও অনেক যুদ্ধ ও ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে, এর মধ্যে ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। এসব যুদ্ধের ফল হয়েছে এই যে, ইসরাইলিরা আরও ফিলিস্তিনি ও আরবভূমি দখল করে নিয়েছে এবং আরও-আরও ফিলিস্তিনিকে প্রতিবেশী আরব দেশগুলোয় পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছে শরণার্থী শিবিরে, আর কখনও নিজ দেশে ফিরতে পারেনি তারা। ১৯৫৮ সালে ইয়াসির আরাফাত ‘ফাতাহ’ সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনি মুক্তিসংগ্রাম শুরু করেন। আরব লীগের উদ্যোগে বিভিন্ন ফিলিস্তিনি সংগ্রামী সংগঠনের সমন্বয়ে ‘ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থা’ (প্যালেস্টিনিয়ান লিবারেশন অর্গানাইজেশন, সংক্ষেপে পিএলও) গঠিত হয় ১৯৬৪ সালে। এতে ফিলিস্তিনিদের ঐক্যবদ্ধ মুক্তিসংগ্রাম নতুন মাত্রা পায়। এভাবে ফিলিস্তিনিরা ‘ফিলিস্তিনি’ নামের একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। ফিলিস্তিনিদের কেবল যে ইসরাইলিদের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে তা-ই নয়, কখনও জর্দান, কখনও লেবাননের ফালাঞ্জিস্ট খ্রিস্টানদের আক্রমণের শিকারও তাদের হতে হয়েছে। হাজার-হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, আর লাখ লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থীকে এখান থেকে সেখানে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে, পোহাতে হয়েছে নিদারুণ দুর্ভোগ। ওদিকে অধিকৃত ফিলিস্তিনে ইসরাইলিরা একের পর এক ইহুদি বসতি স্থাপনের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের বাড়ি-ঘর ও জমি-জমা দখল করে নিতে থাকে। প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকে ফিলিস্তিনি শরণার্থীর সংখ্যা। ১৯৮৭ সালে অধিকৃত ফিলিস্তিনে ফিলিস্তিনিরা আন্দোলন (প্রথম ইন্তিফাদা) শুরু করে। ইসরাইলি সৈন্যদের আগ্নেয়াস্ত্রের মোকাবিলায় ফিলিস্তিনি তরুণ ও কিশোররা হাতে তুলে নেয় পাথর। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত স্থায়ী এই প্রথম ইন্তিফাদায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনি হতাহত হয়, গ্রেফতার হয় অন্তত দশ হাজার। এই আন্দোলনের ফলে সারা বিশ্বে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে জনমত সৃষ্টি হয়। ১৯৮৮ সালে পিএলও-র পক্ষে স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন ইয়াসির আরাফাত। ১৯৯৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পিএলও এবং ইসরাইলের মধ্যে অসলো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে পক্ষ দুটি পরস্পরের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয় এবং শান্তি প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়ার অঙ্গীকার করে। এর ফলে পশ্চিম তীরের অধিকাংশ এলাকা এবং গাজা উপত্যকায় ‘ফিলিস্তিনি জাতীয় কর্তৃপক্ষ’-র শাসন কায়েম হয়। কিন্তু ইসরাইল বারংবার চুক্তি ও অঙ্গীকার ভঙ্গ করে ফিলিস্তিনিদের ওপর আগ্রাসন এবং নতুন নতুন ইহুদি বসতি স্থাপন অব্যাহত রাখে। ২০০০ সালে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনের উদ্যোগে পিএলও প্রধান ইয়াসির আরাফাত এবং ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাকের মধ্যে ক্যাম্পডেভিড সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এই সম্মেলন ব্যর্থ হয়। এরপর আরও অনেক সমঝোতা চেষ্টা চলেছে, কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছু হয়নি। ১৯৮৯ সাল থেকে গাজার ওপর নানা রকম নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রাখে ইসরাইল। ২০০১ সাল থেকে অদ্যাবধি সম্পূর্ণরূপে গাজা অবরোধ করে রেখেছে। ২০০৮ সালে ইসরাইল গাজা আক্রমণ করে। এই যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের ব্যাপক প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতি হয়। ২০১২ সালে আরেকবার ইসরাইলের আগ্রাসনের শিকার হয় গাজা। সর্বশেষ গত দুই সপ্তাহ ধরে ইসরাইল গাজায় সর্বাত্মক হামলা চালাচ্ছে। বর্বর বিমান হামলায় প্রতিদিন শিশু, নারী, বৃদ্ধসহ শতাধিক নিরস্ত্র মানুষ নিহত হচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, হাসপাতাল, সবকিছু।
২০০৪ সালের ১১ নভেম্বর ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর পর পিএলও কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং ফিলিস্তিনিদের ঐক্য ভেঙে যায়। কর্তৃত্ব নিয়ে ফিলিস্তিনিদের প্রধান দুটি সংগঠন ফাতাহ ও হামাসের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এই দ্বন্দ্ব মাঝে-মধ্যেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে পরিণত হয়েছে। ফলে এখন অবস্থা হয়েছে এরকম যে ফিলিস্তিনি জাতীয় কর্তৃপক্ষের নামে বাস্তবে পশ্চিম তীর শাসন করছে ফাতাহ, আর গাজা শাসিত হচ্ছে হামাস দ্বারা। অসলো চুক্তির পর অনেক ফিলিস্তিনি নির্বাসন থেকে দেশে ফিরে আসে। কিন্তু লাখ লাখ ফিলিস্তিনি এখনও থেকে গেছে গোটা মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপ ও আমেরিকায়। এরা গড়ে তুলেছে ফিলিস্তিনি প্রবাসী (ডায়াস্পোরা) প্রজন্ম। এভাবে ফিলিস্তিনিরা বিভক্ত হয়ে পড়েছে মোটা দাগের তিনটি দলে- এক. ইসরাইলি শাসনের অধীন দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে বসবাসকারী ফিলিস্তিনি, পশ্চিম তীর ও গাজায় বসবাসরত ‘স্বাধীন’ ফিলিস্তিনি এবং বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসী ফিলিস্তিনি। এই তিন শ্রেণীর ফিলিস্তিনির মধ্যে মাতৃভূমি ও স্বাধীনতা প্রশ্নে সমভাবাপন্ন আবেগ-অনুভূতি থাকলেও বাস্তব জীবনাভিজ্ঞতা ভিন্ন রকম। ফলে এদের আশা-আকাক্সক্ষাও ভিন্ন রকম হয়ে উঠেছে। এসব কারণে ফিলিস্তিনি জাতি পৃথিবীর ইতিহাসে একটি উদাহরণহীন অনন্য সত্তা হিসেবে পরিগণিত।
বলা বাহুল্য, ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘ ভোগান্তি, বাস্তুচ্যুতি, বঞ্চনা, যুদ্ধের অভিজ্ঞতা, অন্তর্দ্বন্দ্ব, সংগ্রাম, মৃত্যু, এসব কিছুই প্রতিফলিত হয়েছে তাদের সাহিত্যে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বিশেষ করে শিক্ষা সুবিধার সম্প্রসারণ এবং প্রিন্টিং প্রেসের প্রবর্তন ফিলিস্তিনি সাহিত্যের উত্থানকে উদ্দীপিত করে। গোটা আরব দুনিয়া জুড়ে এ সময় যে-আরবীয় জাতীয়তাবাদের স্ফূরণ ঘটে, জায়নবাদের সঙ্গে সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে ফিলিস্তিনে তা একটা বিশেষ ধরনের স্থানীয় রূপ পরিগ্রহ করে। জায়নবাদীরা তখন পাশ্চাত্য শক্তির মদদে ফিলিস্তিনে একটা ইহুদি রাষ্ট্র গড়ার জন্য সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন চালাচ্ছিল।
ওসমানীয় শাসনের শেষদিকে উদারবাদী সংস্কারের পর ফিলিস্তিনে অনেকগুলো সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়, যেমন : ১৯০৮ সালে হাইফা থেকে বের হয় আল কারমেল, ১৯১১-তে জাফা থেকে ফিলিস্তিন, এবং তারপরের বছর জেরুসালেম থেকে আদ্-দস্তুর। জায়নবাদের বিপদ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার জন্য নিয়মিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ ছাপা হতো এসব দৈনিকে। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশদের আগমনের পর ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের প্রতি তাদের সমর্থনজ্ঞাপক নীতি ও পদক্ষেপের প্রতিবাদ করত এই পত্রিকাগুলো। ফিলিস্তিনি লেখকরা অন্যান্য আরব দেশের সাময়িকীগুলোতেও নিয়মিত লিখতেন এবং সেই সময় সারা আরব জুড়ে সাধারণভাবে আরবি ভাষা এবং সাহিত্যের যে-পুনর্জাগরণ চলছিল তাতে তারা সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছিলেন। রওভি ইয়াসিন আল-খালিদী (১৮৬৪-১৯১৩), নাজিব নাসার (১৮৬৫-১৯৪৮), মুহাম্মদ ইস’আফ আন্-নাশ্শাশিবি (১৮৮২-১৯৪৮) এবং খলিল আস্-সাকাকিনী (১৮৭৮-১৯৫৩) হচ্ছেন এই সময়কার সবচেয়ে বিখ্যাত এবং সৃজনশীল গদ্যকার। তারা পাঠককে উপহার দেন আধুনিকমনস্ক স্টাইল এবং আইডিয়া। এভাবে, এদের হাতেই, ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব সাহিত্যের উদ্ভব শুরু হয়।
ফিলিস্তিনি সাহিত্য একটি স্পষ্ট বাঁক নেয় ১৯৪৮ সালের ‘নাকবা’র পরে। নাকবা বলতে ফিলিস্তিনিরা ইসরাইল রাষ্ট্রের উত্থান এবং তার ফল হিসেবে ফিলিস্তিনি সমাজের ধ্বংস ও ছিন্নভিন্ন হওয়াকে বোঝান। গদ্য এবং পদ্য উভয় প্রকরণেই নির্বাসনের নিদারুণ মনস্তাপ প্রতিফলিত হতে থাকে। ১৯৪৮ সালের এই বিপর্যয় সাত লক্ষাধিক ফিলিস্তিনিকে ভিটেছাড়া করে। অন্যদিকে, ইসরাইলের দখলদারিত্বে বসবাস করতে থাকে অনেক ফিলিস্তিনি, আÍীয়-স্বজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, ইসরাইলি অস্তিত্বের প্রথম আঠারো বছর তাদের বাস করতে হয় সামরিক শাসনের অধীনে। তাদের এই বন্দিত্ব ও পরাধীনতা বোধের কথাও উঠে আসে বিকাশমান সাহিত্যের বিভিন্ন প্রকরণের মধ্য দিয়ে। ১৯৬৭ সালে ইসরাইল নতুন করে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকা, মিসরের সিনাই উপদ্বীপ এবং সিরিয়ার গোলান মালভূমি দখল করে নেয়। এই নিষ্ঠুর সামরিক দখলদারিত্বের অভিজ্ঞতা ফিলিস্তিনি লেখকদের অধিকতর বক্তব্যধর্মী সাহিত্যের দিকে ঠেলে দেয়। ‘প্রতিরোধ সাহিত্য’ নামে নতুন একটি সাহিত্যিক ধারাও গতিমান হয়। এর মূল সুর ছিল একদিকে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগ্রামের যথার্থ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ ও গৌরবগাথা, অন্যদিকে ইসরাইল রাষ্ট্রকে প্রত্যাখ্যান ও তার বিরোধিতাকে উচ্চকিত করা।
নাকবা-পরবর্তী লেখায় ইসরাইল রাষ্ট্র ও তার সামরিক দখলদারিত্বের মধ্যে বসবাসরত এবং অন্যত্র নির্বাসিত ও শরণার্থী জীবন-যাপনকারীসহ সব শ্রেণীর ফিলিস্তিনির অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে। এ সময় আরেকটি বৈশিষ্ট্য স্পষ্টতর হচ্ছিল। সেটা হল মহিলা লেখকদের উত্থান। মহিলা লেখকরা জাতীয় স্বাধীনতার সঙ্গে নারী স্বাধীনতাকেও সম্পৃক্ত করেন। ১৯৪৮ সালের নাকবা বা মহাবিপর্যয়ের বেশ আগে থেকেই ফিলিস্তিনি সাহিত্য ফিলিস্তিনি সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এসেছে। আরবি সাহিত্যের ধারাবাহিকতায় ফিলিস্তিনি সাহিত্যেও কবিতা মানোত্তীর্ণ প্রকরণ হিসেবে প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে বহুকাল। মহাবিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে ফিলিস্তিনিরা যে-মহাদুর্ভোগ ও ক্ষতির জগতে পতিত হয়, তার ফলে ছোটগল্প ও উপন্যাসের জন্য প্রয়োজনীয় দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতা আগের চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায় সুলভ ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ফলে ছোটগল্প ও উপন্যাস ফিলিস্তিনিদের স্মৃতি এবং আÍপরিচয়কে তুলে ধরার জন্য দ্রুত সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যমে পরিণত হয়।
প্রাথমিক পর্যায়ে ফিলিস্তিনি সাহিত্যের মূল লক্ষ্য ছিল ‘নিপীড়িতদের সাহিত্য’কে উপস্থাপন করার মাধ্যমে হতাশদের মনে আশার সঞ্চার করা। এই বৈশিষ্ট্য তিনটি ধারায় প্রবহমান হয়। প্রথমত, এতে হৃত বাসভূমির অতি-সৌন্দর্যায়ন এবং ‘পুরনো ফিলিস্তিন’কে পৃথিবীর অবিকল্প স্বর্গ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, আর পবিত্র মাতৃভূমির ভাবমর্যাদা উদ্ধার করার মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের মুক্তিসংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা। দ্বিতীয় মাত্রাটি উদ্ভূত হয় প্রথমটি থেকে, সেটা হল- আসল আশীর্বাদপুষ্ট ‘পুরনো ফিলিস্তিন’ তার পবিত্রতাসমেত ফিরে আসবে ভবিষ্যতে এবং অতীতের মতোই সুখী ও সমৃদ্ধ হবে, এই স্বপ্নের ব্যাপ্তি প্রসারিত হয় অনাগত ভবিষ্যতের মধ্যে। তৃতীয় মাত্রাটি উপরের দুটি বিষয়ের যোগফল। এর প্রকাশ দেশত্যাগ এবং আশ্রয়সন্ধানের গুরুত্বের প্রেক্ষাপটে- এটা দারুণ ক্লেশের একটা অসুস্থ সময় যা ফিলিস্তিনিদের তেজস্বিতার পরীক্ষা নেয় এবং তারপর ঘোষণা করে তার আসন্ন বিজয়। এই পুরো ধারণাটি, যে কেউ বুঝতে পারবেন, সুস্পষ্টরূপে শুরু হয় পতনের সময়। তারপর সময় আসে ক্ষতি এবং ভোগান্তির, যা শেষ পর্যন্ত পরিণতি পায় নিষ্কৃতি এবং নির্বাসন ও বিচ্ছিন্নতার মোকাবিলার কালে। নির্বাসিত লেখকদের যখন অতিরিক্ত ‘ধর্মীয় আশাবাদে’ আস্থাশীল হতে দেখা যায়, যা তাদের অতীত এবং বর্তমানকে একসূত্রে গাঁথতে সাহায্য করে, তখন ইসরাইলি দখলদারিত্বের মধ্যে বসবাসকারীরা পছন্দ করেন রূঢ় ও কুৎসিত ব্যঙ্গ, যা অতীতের জন্য কাতর কিন্তু একইসঙ্গে ফিসফিস করে বলে, অতীত আর ফিরছে না।
ফিলিস্তিনি সাহিত্যে ইতিহাস, রাজনীতি এবং সাহিত্য এমনভাবে পরস্পর জড়াজড়ি করে থাকে যে তাদের আলাদা করা যায় না। ফিলিস্তিনি লেখকরা মনে করেন তাদের সামনে কোনো বিকল্প নেই, এবং তারা এই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছেন, বাস্তবতাকে তারা সব রূঢ়তাসমেতই উপস্থাপন করেন।
প্রায় চারশ বছর ধরে ফিলিস্তিন অঞ্চল ছিল বৃহত্তর সিরিয়ার অংশ হিসেবে তুর্কি ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীন। এখানকার অধিবাসীরা ছিল আরব। ওসমানীয় শাসকরা এখানে উপনিবেশ সৃষ্টি করেননি, বরং তাদের পক্ষে স্থানীয়রাই এখানকার প্রকৃত শাসক ছিল। এক পর্যায়ে, বিশেষত অর্থনৈতিক কারণে, খুবই সীমিত পরিসরে ফিলিস্তিনে ইহুদি অভিবাসন অনুমোদন করা হয়। এভাবে, ১৯০৮ সালে, ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের সময়, ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার দশ শতাংশে উন্নীত হয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ফিলিস্তিনিরা অন্য আরবদের মতো ব্রিটিশ সহায়তায় তুর্কিদের বিতাড়িত করে। কিন্তু ১৯১৮ সালে ব্রিটিশরা পুরো ফিলিস্তিন দখল করে নেয়। দখলদারিত্ব কায়েম রাখতে ব্রিটিশরা ইহুদিদের সঙ্গে সমঝোতা করে এবং ব্যাপক অভিবাসন ঘটাতে থাকে। ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য একটা আবাসভূমি তৈরি করে দেয়ার অঙ্গীকারও (বালফুর ঘোষণা) করে। ব্রিটিশ শাসকদের প্রশ্রয়ে একের পর এক ইহুদি বসতি গড়ে উঠতে থাকে। শুরু হয় বসতি স্থাপনকারীদের সঙ্গে আদিবাসী ফিলিস্তিনিদের সংঘাত। এই সময়ই সচেতন ফিলিস্তিনিরা অনুধাবন করেন যে বিপদ আসন্ন। শুরু হয় ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা সংগ্রাম। একইসঙ্গে তাদের মোকাবিলা করতে হয় ইহুদি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোকেও। যদিও ফিলিস্তিনিরা তখনও পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন ছিল, তবু মূলত তখন থেকেই ফিলিস্তিনের অধিবাসীরা ‘ফিলিস্তিনি’ হয়ে উঠতে শুরু করেন, কারণ প্রতিবেশী অন্য আরবদের তুলনায় তাদের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যায়। যে ফিলিস্তিন ভূমিতে আরব-ফিলিস্তিনিরা খুব কম করে হলেও সপ্তম শতাব্দী থেকে বসবাস করে আসছিল, ১৯৪৭ সালে ইউরোপ-আমেরিকা নিয়ন্ত্রিত জাতিসংঘ সেই ভূমিকে ভাগ করে ইহুদিদের জন্য ইসরাইল এবং আরবদের জন্য ফিলিস্তিন নামে দুটো পৃথক রাষ্ট্র তৈরির সিদ্ধান্ত নিল। ইসরাইল ১৯৪৮ সালের মে মাসে স্বাধীনতা ঘোষণা করে, আরবরা তা প্রত্যাখ্যান করে, শুরু হয় যুদ্ধ। ইউরোপ-আমেরিকার মদদপুষ্ট ইসরাইলিদের কাছে আরবরা পরাজিত হয়। ইসরাইল জাতিসংঘ-নির্ধারিত নতুন ‘ফিলিস্তিন’-এর অনেক জায়গা দখল করে নেয়, জাতিসংঘ ১৯৪৭ সালে সীমান্তে ফেরত যেতে বললেও ইসরাইল তাতে অস্বীকৃতি জানায়। অন্তত সাত লাখ ফিলিস্তিনিকে ভিটেছাড়া হতে হয়। তারপর থেকে আরও অনেক যুদ্ধ ও ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে, এর মধ্যে ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। এসব যুদ্ধের ফল হয়েছে এই যে, ইসরাইলিরা আরও ফিলিস্তিনি ও আরবভূমি দখল করে নিয়েছে এবং আরও-আরও ফিলিস্তিনিকে প্রতিবেশী আরব দেশগুলোয় পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছে শরণার্থী শিবিরে, আর কখনও নিজ দেশে ফিরতে পারেনি তারা। ১৯৫৮ সালে ইয়াসির আরাফাত ‘ফাতাহ’ সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনি মুক্তিসংগ্রাম শুরু করেন। আরব লীগের উদ্যোগে বিভিন্ন ফিলিস্তিনি সংগ্রামী সংগঠনের সমন্বয়ে ‘ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থা’ (প্যালেস্টিনিয়ান লিবারেশন অর্গানাইজেশন, সংক্ষেপে পিএলও) গঠিত হয় ১৯৬৪ সালে। এতে ফিলিস্তিনিদের ঐক্যবদ্ধ মুক্তিসংগ্রাম নতুন মাত্রা পায়। এভাবে ফিলিস্তিনিরা ‘ফিলিস্তিনি’ নামের একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। ফিলিস্তিনিদের কেবল যে ইসরাইলিদের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে তা-ই নয়, কখনও জর্দান, কখনও লেবাননের ফালাঞ্জিস্ট খ্রিস্টানদের আক্রমণের শিকারও তাদের হতে হয়েছে। হাজার-হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, আর লাখ লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থীকে এখান থেকে সেখানে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে, পোহাতে হয়েছে নিদারুণ দুর্ভোগ। ওদিকে অধিকৃত ফিলিস্তিনে ইসরাইলিরা একের পর এক ইহুদি বসতি স্থাপনের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের বাড়ি-ঘর ও জমি-জমা দখল করে নিতে থাকে। প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকে ফিলিস্তিনি শরণার্থীর সংখ্যা। ১৯৮৭ সালে অধিকৃত ফিলিস্তিনে ফিলিস্তিনিরা আন্দোলন (প্রথম ইন্তিফাদা) শুরু করে। ইসরাইলি সৈন্যদের আগ্নেয়াস্ত্রের মোকাবিলায় ফিলিস্তিনি তরুণ ও কিশোররা হাতে তুলে নেয় পাথর। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত স্থায়ী এই প্রথম ইন্তিফাদায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনি হতাহত হয়, গ্রেফতার হয় অন্তত দশ হাজার। এই আন্দোলনের ফলে সারা বিশ্বে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে জনমত সৃষ্টি হয়। ১৯৮৮ সালে পিএলও-র পক্ষে স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন ইয়াসির আরাফাত। ১৯৯৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পিএলও এবং ইসরাইলের মধ্যে অসলো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে পক্ষ দুটি পরস্পরের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয় এবং শান্তি প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়ার অঙ্গীকার করে। এর ফলে পশ্চিম তীরের অধিকাংশ এলাকা এবং গাজা উপত্যকায় ‘ফিলিস্তিনি জাতীয় কর্তৃপক্ষ’-র শাসন কায়েম হয়। কিন্তু ইসরাইল বারংবার চুক্তি ও অঙ্গীকার ভঙ্গ করে ফিলিস্তিনিদের ওপর আগ্রাসন এবং নতুন নতুন ইহুদি বসতি স্থাপন অব্যাহত রাখে। ২০০০ সালে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনের উদ্যোগে পিএলও প্রধান ইয়াসির আরাফাত এবং ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাকের মধ্যে ক্যাম্পডেভিড সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এই সম্মেলন ব্যর্থ হয়। এরপর আরও অনেক সমঝোতা চেষ্টা চলেছে, কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছু হয়নি। ১৯৮৯ সাল থেকে গাজার ওপর নানা রকম নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রাখে ইসরাইল। ২০০১ সাল থেকে অদ্যাবধি সম্পূর্ণরূপে গাজা অবরোধ করে রেখেছে। ২০০৮ সালে ইসরাইল গাজা আক্রমণ করে। এই যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের ব্যাপক প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতি হয়। ২০১২ সালে আরেকবার ইসরাইলের আগ্রাসনের শিকার হয় গাজা। সর্বশেষ গত দুই সপ্তাহ ধরে ইসরাইল গাজায় সর্বাত্মক হামলা চালাচ্ছে। বর্বর বিমান হামলায় প্রতিদিন শিশু, নারী, বৃদ্ধসহ শতাধিক নিরস্ত্র মানুষ নিহত হচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, হাসপাতাল, সবকিছু।
২০০৪ সালের ১১ নভেম্বর ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর পর পিএলও কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং ফিলিস্তিনিদের ঐক্য ভেঙে যায়। কর্তৃত্ব নিয়ে ফিলিস্তিনিদের প্রধান দুটি সংগঠন ফাতাহ ও হামাসের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এই দ্বন্দ্ব মাঝে-মধ্যেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে পরিণত হয়েছে। ফলে এখন অবস্থা হয়েছে এরকম যে ফিলিস্তিনি জাতীয় কর্তৃপক্ষের নামে বাস্তবে পশ্চিম তীর শাসন করছে ফাতাহ, আর গাজা শাসিত হচ্ছে হামাস দ্বারা। অসলো চুক্তির পর অনেক ফিলিস্তিনি নির্বাসন থেকে দেশে ফিরে আসে। কিন্তু লাখ লাখ ফিলিস্তিনি এখনও থেকে গেছে গোটা মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপ ও আমেরিকায়। এরা গড়ে তুলেছে ফিলিস্তিনি প্রবাসী (ডায়াস্পোরা) প্রজন্ম। এভাবে ফিলিস্তিনিরা বিভক্ত হয়ে পড়েছে মোটা দাগের তিনটি দলে- এক. ইসরাইলি শাসনের অধীন দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে বসবাসকারী ফিলিস্তিনি, পশ্চিম তীর ও গাজায় বসবাসরত ‘স্বাধীন’ ফিলিস্তিনি এবং বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসী ফিলিস্তিনি। এই তিন শ্রেণীর ফিলিস্তিনির মধ্যে মাতৃভূমি ও স্বাধীনতা প্রশ্নে সমভাবাপন্ন আবেগ-অনুভূতি থাকলেও বাস্তব জীবনাভিজ্ঞতা ভিন্ন রকম। ফলে এদের আশা-আকাক্সক্ষাও ভিন্ন রকম হয়ে উঠেছে। এসব কারণে ফিলিস্তিনি জাতি পৃথিবীর ইতিহাসে একটি উদাহরণহীন অনন্য সত্তা হিসেবে পরিগণিত।
বলা বাহুল্য, ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘ ভোগান্তি, বাস্তুচ্যুতি, বঞ্চনা, যুদ্ধের অভিজ্ঞতা, অন্তর্দ্বন্দ্ব, সংগ্রাম, মৃত্যু, এসব কিছুই প্রতিফলিত হয়েছে তাদের সাহিত্যে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বিশেষ করে শিক্ষা সুবিধার সম্প্রসারণ এবং প্রিন্টিং প্রেসের প্রবর্তন ফিলিস্তিনি সাহিত্যের উত্থানকে উদ্দীপিত করে। গোটা আরব দুনিয়া জুড়ে এ সময় যে-আরবীয় জাতীয়তাবাদের স্ফূরণ ঘটে, জায়নবাদের সঙ্গে সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে ফিলিস্তিনে তা একটা বিশেষ ধরনের স্থানীয় রূপ পরিগ্রহ করে। জায়নবাদীরা তখন পাশ্চাত্য শক্তির মদদে ফিলিস্তিনে একটা ইহুদি রাষ্ট্র গড়ার জন্য সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন চালাচ্ছিল।
ওসমানীয় শাসনের শেষদিকে উদারবাদী সংস্কারের পর ফিলিস্তিনে অনেকগুলো সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়, যেমন : ১৯০৮ সালে হাইফা থেকে বের হয় আল কারমেল, ১৯১১-তে জাফা থেকে ফিলিস্তিন, এবং তারপরের বছর জেরুসালেম থেকে আদ্-দস্তুর। জায়নবাদের বিপদ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার জন্য নিয়মিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ ছাপা হতো এসব দৈনিকে। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশদের আগমনের পর ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের প্রতি তাদের সমর্থনজ্ঞাপক নীতি ও পদক্ষেপের প্রতিবাদ করত এই পত্রিকাগুলো। ফিলিস্তিনি লেখকরা অন্যান্য আরব দেশের সাময়িকীগুলোতেও নিয়মিত লিখতেন এবং সেই সময় সারা আরব জুড়ে সাধারণভাবে আরবি ভাষা এবং সাহিত্যের যে-পুনর্জাগরণ চলছিল তাতে তারা সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছিলেন। রওভি ইয়াসিন আল-খালিদী (১৮৬৪-১৯১৩), নাজিব নাসার (১৮৬৫-১৯৪৮), মুহাম্মদ ইস’আফ আন্-নাশ্শাশিবি (১৮৮২-১৯৪৮) এবং খলিল আস্-সাকাকিনী (১৮৭৮-১৯৫৩) হচ্ছেন এই সময়কার সবচেয়ে বিখ্যাত এবং সৃজনশীল গদ্যকার। তারা পাঠককে উপহার দেন আধুনিকমনস্ক স্টাইল এবং আইডিয়া। এভাবে, এদের হাতেই, ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব সাহিত্যের উদ্ভব শুরু হয়।
ফিলিস্তিনি সাহিত্য একটি স্পষ্ট বাঁক নেয় ১৯৪৮ সালের ‘নাকবা’র পরে। নাকবা বলতে ফিলিস্তিনিরা ইসরাইল রাষ্ট্রের উত্থান এবং তার ফল হিসেবে ফিলিস্তিনি সমাজের ধ্বংস ও ছিন্নভিন্ন হওয়াকে বোঝান। গদ্য এবং পদ্য উভয় প্রকরণেই নির্বাসনের নিদারুণ মনস্তাপ প্রতিফলিত হতে থাকে। ১৯৪৮ সালের এই বিপর্যয় সাত লক্ষাধিক ফিলিস্তিনিকে ভিটেছাড়া করে। অন্যদিকে, ইসরাইলের দখলদারিত্বে বসবাস করতে থাকে অনেক ফিলিস্তিনি, আÍীয়-স্বজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, ইসরাইলি অস্তিত্বের প্রথম আঠারো বছর তাদের বাস করতে হয় সামরিক শাসনের অধীনে। তাদের এই বন্দিত্ব ও পরাধীনতা বোধের কথাও উঠে আসে বিকাশমান সাহিত্যের বিভিন্ন প্রকরণের মধ্য দিয়ে। ১৯৬৭ সালে ইসরাইল নতুন করে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকা, মিসরের সিনাই উপদ্বীপ এবং সিরিয়ার গোলান মালভূমি দখল করে নেয়। এই নিষ্ঠুর সামরিক দখলদারিত্বের অভিজ্ঞতা ফিলিস্তিনি লেখকদের অধিকতর বক্তব্যধর্মী সাহিত্যের দিকে ঠেলে দেয়। ‘প্রতিরোধ সাহিত্য’ নামে নতুন একটি সাহিত্যিক ধারাও গতিমান হয়। এর মূল সুর ছিল একদিকে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগ্রামের যথার্থ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ ও গৌরবগাথা, অন্যদিকে ইসরাইল রাষ্ট্রকে প্রত্যাখ্যান ও তার বিরোধিতাকে উচ্চকিত করা।
নাকবা-পরবর্তী লেখায় ইসরাইল রাষ্ট্র ও তার সামরিক দখলদারিত্বের মধ্যে বসবাসরত এবং অন্যত্র নির্বাসিত ও শরণার্থী জীবন-যাপনকারীসহ সব শ্রেণীর ফিলিস্তিনির অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে। এ সময় আরেকটি বৈশিষ্ট্য স্পষ্টতর হচ্ছিল। সেটা হল মহিলা লেখকদের উত্থান। মহিলা লেখকরা জাতীয় স্বাধীনতার সঙ্গে নারী স্বাধীনতাকেও সম্পৃক্ত করেন। ১৯৪৮ সালের নাকবা বা মহাবিপর্যয়ের বেশ আগে থেকেই ফিলিস্তিনি সাহিত্য ফিলিস্তিনি সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এসেছে। আরবি সাহিত্যের ধারাবাহিকতায় ফিলিস্তিনি সাহিত্যেও কবিতা মানোত্তীর্ণ প্রকরণ হিসেবে প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে বহুকাল। মহাবিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে ফিলিস্তিনিরা যে-মহাদুর্ভোগ ও ক্ষতির জগতে পতিত হয়, তার ফলে ছোটগল্প ও উপন্যাসের জন্য প্রয়োজনীয় দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতা আগের চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায় সুলভ ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ফলে ছোটগল্প ও উপন্যাস ফিলিস্তিনিদের স্মৃতি এবং আÍপরিচয়কে তুলে ধরার জন্য দ্রুত সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যমে পরিণত হয়।
প্রাথমিক পর্যায়ে ফিলিস্তিনি সাহিত্যের মূল লক্ষ্য ছিল ‘নিপীড়িতদের সাহিত্য’কে উপস্থাপন করার মাধ্যমে হতাশদের মনে আশার সঞ্চার করা। এই বৈশিষ্ট্য তিনটি ধারায় প্রবহমান হয়। প্রথমত, এতে হৃত বাসভূমির অতি-সৌন্দর্যায়ন এবং ‘পুরনো ফিলিস্তিন’কে পৃথিবীর অবিকল্প স্বর্গ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, আর পবিত্র মাতৃভূমির ভাবমর্যাদা উদ্ধার করার মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের মুক্তিসংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা। দ্বিতীয় মাত্রাটি উদ্ভূত হয় প্রথমটি থেকে, সেটা হল- আসল আশীর্বাদপুষ্ট ‘পুরনো ফিলিস্তিন’ তার পবিত্রতাসমেত ফিরে আসবে ভবিষ্যতে এবং অতীতের মতোই সুখী ও সমৃদ্ধ হবে, এই স্বপ্নের ব্যাপ্তি প্রসারিত হয় অনাগত ভবিষ্যতের মধ্যে। তৃতীয় মাত্রাটি উপরের দুটি বিষয়ের যোগফল। এর প্রকাশ দেশত্যাগ এবং আশ্রয়সন্ধানের গুরুত্বের প্রেক্ষাপটে- এটা দারুণ ক্লেশের একটা অসুস্থ সময় যা ফিলিস্তিনিদের তেজস্বিতার পরীক্ষা নেয় এবং তারপর ঘোষণা করে তার আসন্ন বিজয়। এই পুরো ধারণাটি, যে কেউ বুঝতে পারবেন, সুস্পষ্টরূপে শুরু হয় পতনের সময়। তারপর সময় আসে ক্ষতি এবং ভোগান্তির, যা শেষ পর্যন্ত পরিণতি পায় নিষ্কৃতি এবং নির্বাসন ও বিচ্ছিন্নতার মোকাবিলার কালে। নির্বাসিত লেখকদের যখন অতিরিক্ত ‘ধর্মীয় আশাবাদে’ আস্থাশীল হতে দেখা যায়, যা তাদের অতীত এবং বর্তমানকে একসূত্রে গাঁথতে সাহায্য করে, তখন ইসরাইলি দখলদারিত্বের মধ্যে বসবাসকারীরা পছন্দ করেন রূঢ় ও কুৎসিত ব্যঙ্গ, যা অতীতের জন্য কাতর কিন্তু একইসঙ্গে ফিসফিস করে বলে, অতীত আর ফিরছে না।
ফিলিস্তিনি সাহিত্যে ইতিহাস, রাজনীতি এবং সাহিত্য এমনভাবে পরস্পর জড়াজড়ি করে থাকে যে তাদের আলাদা করা যায় না। ফিলিস্তিনি লেখকরা মনে করেন তাদের সামনে কোনো বিকল্প নেই, এবং তারা এই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছেন, বাস্তবতাকে তারা সব রূঢ়তাসমেতই উপস্থাপন করেন।
No comments