ফিলিস্তিনি সাহিত্যে কবিতাই প্রাণ by গাস্সান কানাফানি
[‘প্রতিরোধ সাহিত্য’ তত্ত্বের অন্যতম
উদ্গাতা ফিলিস্তিনি কথাসাহিত্যিক গাস্সান (ফাইয়িজ) কানাফানি। রাজনৈতিক,
বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি গোটা
আরব বিশ্বে অল্প বয়সেই খ্যাতি অর্জন করেন। তার জন্ম ১৯৩৬ সালের এপ্রিলে
তৎকালীন ব্রিটিশ ম্যান্ডেটভুক্ত ফিলিস্তিনের অ্যাক্রি (এখনকার আক্কা) নামক
স্থানে, এক সম্ভ্রান্ত সুন্নি মুসলিম পরিবারে। ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল
অন্যান্য অনেক ফিলিস্তিনি এলাকার মতো তার জন্মস্থানও জবরদখল করে নেয়। হাজার
হাজার ফিলিস্তিনির সঙ্গে তিনিও সপরিবারে শরণার্থী হন, পালিয়ে যান প্রথমে
লেবাননে, পরে সিরিয়ার দামেস্কে। তিনি দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি সাহিত্যে
স্নাতক ক্লাসে ভর্তি হন, কিন্তু লেখাপড়া শেষ করতে পারেননি। ১৯৫৩ সালে জর্জ
হাবাশের নেতৃত্বাধীন বামপন্থী অ্যারাব ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্টে যোগ দেন।
পরে প্যালেস্টাইন লিবারেশন মুভমেন্ট এবং পপুলার ফ্রন্ট ফর লিবারেশন অফ
প্যালেস্টাইন (পিএফএলপি) গঠিত হলে তিনি তারও সদস্য হন। ১৯৭০ সালে তিনি
পিএফএলপির মুখপাত্র নিযুক্ত হয়েছিলেন।
কানাফানি প্রথমে শিক্ষকতা এবং পরে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাগজের সম্পাদক ছিলেন। সাহিত্য পত্রিকাও সম্পাদনা করেন। ‘রাষ্ট্রহীন’ মানুষ হিসেবে তাকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে লুকিয়ে থাকতে হয়েছে। ১৯৭২ সালের ৮ জুলাই লেবাননের বৈরুত শহরে গাড়ি বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন তিনি। ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়।
ফিলিস্তিনি প্রবন্ধ ও কথাসাহিত্যের বিকাশে কানাফানির অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। তার প্রথম উপন্যাস রিজাল ফিশ্-শামস (মেন ইন দি সান) প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে, বৈরুতে। তার অনেক উপন্যাস ও অন্যান্য রচনা ইংরেজিসহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি তার সাহিত্যকৃতির জন্য প্যালেস্টাইনসহ আরব বিশ্বের বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হন।
১৯৬৮ সালে ইরাকের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় গাস্সান কানাফানি সম্পাদিত (সুলাফা হিজাভি অনূদিত) পোয়েট্রি অফ রেজিস্ট্যান্স ইন অকুপায়েড প্যালেস্টাইন প্রকাশ করে। অনূদিত প্রবন্ধটি সেই সংকলনের ভূমিকা। উল্লেখ্য, এটি তার বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ রেজিস্ট্যান্স লিটারেচার ইন অকুপায়েড প্যালেস্টাইন (১৯৬৬) গ্রন্থের অংশবিশেষ।]
১৯৪৮ সালে ইহুদিবাদীদের হাতে ফিলিস্তিনের পতনের ফলে অধিকৃত ফিলিস্তিনে আরব জনগণের সংখ্যা এবং সমাজকাঠামোয় ধ্বংসাÍক পরিবর্তন সাধিত হয়। বিশ লাখ আরবের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ তাদের মাতৃভূমিতে থেকে যায়, এরা মূলত কৃষক। শহরগুলো ফাঁকা হয়ে যায় হয় যুদ্ধের সময়েই না হয় তার অব্যবহিত পরে। এর ফলে আরবদের সামাজিক পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটে, কারণ শহরগুলো ছিল রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ভাবোচ্ছ্বাসের কেন্দ্র।
ইহুদিবাদী দখলদাররা তাদের সামরিক আগ্রাসন বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের নিপীড়নমূলক উপায়সমূহ আরোপ করতে শুরু করে, পরিবেশ তাদের জন্য সহায়ক ছিল। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আরব পরিচয়ের ছিটেফোঁটা চিহ্নকেও উপড়ে ফেলা এবং সেখানে নতুন প্রবণতার বীজ বপন করা যা অবশ্যই গড়ে উঠবে ইহুদিবাদী রাজনৈতিক ও সাহিত্যিক জীবনের ছত্রচ্ছায়ায় এবং তার সঙ্গে সমন্বিত হয়ে।
এ করুণ পরাজয় পর্যন্ত ফিলিস্তিনি সাহিত্য ছিল আরবি সাহিত্য আন্দোলনের মূলস্রোতের অংশ যা বিকশিত হয় এই শতাব্দীর (বিংশ শতাব্দী-অনুবাদক) প্রথম ভাগ জুড়ে। রসদ মিলেছে তখনকার সাহিত্যিক আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী মিসরীয়, সিরিয়ান ও লেবাননীয় লেখকদের কাছ থেকে, তাদেরই প্রভাবে এটা গতিশীল হয়। এমনকি প্রখ্যাত ফিলিস্তিনি লেখকরাও তাদের খ্যাতির জন্য বিশেষভাবে ঋণী আরব রাজধানীগুলোর কাছে, যেখান থেকে তারা তাদের সৃষ্টিকর্মের জন্য সংবর্ধনা ও সহায়তা লাভ করেছেন। যে মুহূর্তে রাজনীতি এবং আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ফিলিস্তিন একটা গণনাযোগ্য অবস্থান লাভ করছে সেই মুহূর্তে ফিলিস্তিনি সাহিত্যের মানের নিম্নগামিতার পেছনে অনেক কারণ ছিল।
১৯৪৮ সালের পর ফিলিস্তিনি সাহিত্য একটা নতুন সাহিত্যিক আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করতে সক্ষম হয় যাকে ‘ফিলিস্তিনি বা শরণার্থী সাহিত্য’ বলার চেয়ে বরং ‘নির্বাসন সাহিত্য’ বলাই ভালো। কবিতা, এই আন্দোলনের প্রধান উপাদান, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উৎকর্ষ ও আঙ্গিকের ক্ষেত্রে একটা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করেছে। ১৯৪৮ সালের যুদ্ধ-পরবর্তী সংক্ষিপ্ত নীরবতার পর একটা বিশাল জাগরণ সৃষ্টি হয় এবং জনগণের জাতীয় অনুভূতির প্রতিফলন ঘটিয়ে প্রচুর সংখ্যায় জাতীয় কবিতা রচিত হতে থাকে। এটা আরব এবং বিদেশী প্রবণতার মধ্যে মিথষ্ক্রিয়া ঘটায় এবং ক্রমান্বয়ে আঙিকের ঐতিহ্যবাহী নিয়মগুলো ভাঙতে থাকে, পুরনো আবেগমথিত উচ্ছ্বাস পরিহার করা হয়, এবং উদ্ভূত হয় এমন একটা গভীর দুঃখবোধের অনন্য সাধারণ অনুভূতিসমেত যা বিরাজমান পরিস্থিতির বাস্তবতার সঙ্গে অনেক বেশি সমানুপাতিক।
অপরদিকে, অধিকৃত ফিলিস্তিনের ভেতরকার প্রতিরোধ সাহিত্যকে নীতিগত মৌলিক পার্থক্যের মোকাবেলা করতে হয়। লেখক এবং সংস্কৃতিকর্মীদের পুরো একটা প্রজন্মের দেশত্যাগের কারণে অধিকৃত ফিলিস্তিনে আরবি সাহিত্যের মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ে। যারা থেকে গেল তাদের নিয়ে যে সমাজ গঠিত হয় তা প্রধানত গ্রামীণ এবং তারা এমন এক রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নিপীড়নের শিকার যার উদাহরণ বিশ্বের আর কোথাও মিলবে না।
থেকে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের অধিকাংশেরই, তাদের সামাজিক অবস্থার জন্য, সাংস্কৃতিক মান এমন ছিল না যে তারা লেখক এবং শিল্পীর একটা নতুন প্রজন্ম গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।
যেসব আরব শহর গ্রাম থেকে উঠে আসা প্রতিভাবান তরুণদের স্বাগত জানাতে ও উৎসাহ দিতে লাগল সেগুলো শত্র“র নিষেধাজ্ঞার শহরে পরিণত হল।
এখানকার আরব জনগণ সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল, আরব দেশগুলোর সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগের উপায় রইল না।
ইহুদিবাদী সামরিক কর্তৃপক্ষ আরব জনগণের ওপর কঠোর সীমাবদ্ধতা আরোপ এবং তাদের সাহিত্যিক নির্মাণের ওপর খবরদারি করতে লাগল।
প্রকাশনা ও বিপণনের উপায়-উপকরণ হয় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ল না হয় কঠোর নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হল।
আরবদের জন্য বিদেশী ভাষা শিক্ষার সুযোগ থাকল না। খুব কম জনই হাইস্কুলে পড়ার অনুমতি পায়, আর প্রায় কাউকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ দেয়া হয় না।
এ নববিকশিত সাহিত্য পাঠের সময় এটা মনে রাখা উচিত যে, এখানকার আরব জনগণ তাদের অস্তিত্বকে দৃঢ় এবং নিজেদের প্রকাশ করার জন্য নিগ্রহ ও অত্যাচারের কালো রাত্রির মধ্যে দিয়ে সংগ্রাম করে চলেছে। এখন তারা তাদের নিজস্ব ভাবপ্রকাশের ভাষা ও কৌশল আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে যা ঘনীভূত হয়ে স্পন্দমান প্রতিরোধ সাহিত্য তৈরি করেছে।
এটা অনুধাবন করা এখন সহজ যে, এই কঠোর অবরোধের মধ্যে কবিতা কেন প্রতিরোধ আহ্বানের প্রথম অগ্রদূত হল; কারণটি হচ্ছে, কবিতা মুখে-মুখে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং প্রকাশনা ছাড়াই টিকে থাকতে সক্ষম। এর থেকে এ ব্যাখ্যাও পাওয়া যায় কেন কবিতা প্রারম্ভকালে ঐতিহ্যবাদী আঙিককে আশ্রয় করেছে, কারণ তা মুখস্থ করা অপেক্ষাকৃত সহজ এবং দ্রুত মানুষের আবেগকে প্রভাবিত করতে পারে।
প্রাথমিক জোয়ারের বৈশিষ্ট্য এই যে, সেগুলো ছিল ভালোবাসার গীতিকবিতা, কিন্তু পাশাপাশি ঐতিহ্যবাদী কবিতা এবং জনপ্রিয় মৌখিক কবিতাও রচিত হয় যা প্রতিরোধ অভিব্যক্তির প্রথম বীজ বপন করে। বাস্তবে, জনপ্রিয় কবিতা কুড়ির দশক থেকে ফিলিস্তিনের ইতিহাসে বড় ভূমিকা পালন করে যা গোটা আরব বিশ্বেই খ্যাতি লাভে সক্ষম হয়। নিচের গীতিকবিতাটি প্রায় প্রত্যেক ফিলিস্তিনিরই মুখস্থ, তারা এটা সবসময় আবৃত্তি করে; ১৯৩৬ সালে ব্রিটিশ ম্যান্ডেট যে ফিলিস্তিনি যোদ্ধাকে ফাঁসি দেয় তিনি ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার পূর্বাহ্নে তাৎক্ষণিকভাবে মুখে-মুখে রচনা করেছিলেন এই কবিতাটি:
ওগো রাত, আর একটু দাঁড়াও না, যতক্ষণ না
এই বন্দি তার গান শেষ করতে পারে...
ভোর নাগাদ তার পাখনাগুলো ঝাপটাতে শুরু করবে
আর ফাঁসিতে ঝুলন্ত মানুষটি
বাতাসে দোল খাবে।
ওগো রাত, কমাও তোমার গতিবেগ,
আমাকে তোমার কাছে আমার হৃদয় উজাড় করতে দাও,
তুমি কি ভুলে গেছ আমি কে, আর
আমার সমস্যা কী।
দয়া করো, আমার সময়গুলো
কীভাবেই না পিছলে গেলো তোমার হাত বেয়ে।
ভেব না যে ভয়ে কাঁদব আমি,
আমার অশ্র“ আমার দেশের জন্যে নিবেদিত,
আর বাড়িতে অপেক্ষমাণ
ওইসব ক্ষুধার্ত পিতৃহীন শিশুর জন্য।
আমার পরে তাদের কে দেবে খাবার?
আমার দুই ভাই-ই যে
আমার আগেই ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলেছে।
আর একাকী অশ্রুতে ভেসে
কীভাবে কাটাবে দিন আমার বিধবা?
তার হাতের মণিবন্ধে তার চুড়িও আমি
রেখে যেতে পারলাম না-
গোটা দেশ যে এখন অস্ত্র চেয়ে কাঁদছে।
১৯৪৮ সাল পর্যন্ত, সুরচিত মানসম্পন্ন সাহিত্যের আবির্ভাবের আগে, প্রায় দশ বছর এসব জনপ্রিয় ধারার কবিতা প্রাধান্য বিস্তার করে রাখে। এটাই সেই মাধ্যম যার সাহায্যে পরাজিত জনগণ নিজেদের প্রকাশ করার উপায় খুঁজে পেয়েছিল। তাদের জীবনের সব কিছুই এর মধ্যে জায়গা করে নেয়। ওইসব কবিতার কার্যকারিতার দ্বারা তারা সকালের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা, সন্ধ্যার আড্ডা এবং আর-আর সব জনসমাগমকে ভয়ানক বিক্ষোভ সমাবেশে পরিণত করতেন ফায়ারিং স্কোয়াডের তোয়াক্কা না করে। অনেক জনপ্রিয় কবিকে কারাগারে পাঠানো হয় অথবা রাখা হয় কঠোর অবরোধের মধ্যে। আর জনপ্রিয় কবিতা যতই প্রাচুর্যতা পায় ও সম্প্রসারিত হতে থাকে দখলদার শক্তি ততই বিস্তৃত করতে থাকে তাদের নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ড, কয়েকজন কবিকে তারা হত্যা করে এবং আরবদের সব ধরনের সমাবেশ সংগঠন নিষিদ্ধ করে দেয়। এসব ব্যবস্থা অবশ্য এই প্রতিরোধ প্রবণতাকে নির্মূল করতে পারেনি, তবে প্রবল ক্ষমতা ও প্রাণশক্তি নিয়ে নবরূপে বিস্ফোরিত হওয়ার আগ পর্যন্ত অন্তত পাঁচ বছর এটাকে দাবিয়ে রাখতে পেরেছিল। ষাটের দশকের শুরুতে, খুব আশ্চর্যজনকভাবে, সাহিত্যের একটা লক্ষ্যযোগ্য নতুন তরঙ্গস্রোত গতিমান হল। এই নতুন তরঙ্গের বিশ্বাস ও নীতি ছিল দুঃসাহসী, প্রাণশক্তি ও আশাবাদে পূর্ণ এবং লড়াকু তেজে ভীষণভাবে প্রাণিত, একই সময়ের নির্বাসিত কবিদের দুঃখভারাক্রান্ত ও আবেগতাড়িত সাহিত্য থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
এই নতুন জোয়ারের আগের দশককে সবচেয়ে ভালোভাবে বর্ণনা করা যায় এই বলে যে, এটা ছিল ব্যক্তিত্ব সমন্বয়ের কাল, সংগ্রামের যুক্তি ও লক্ষ্যর সঙ্গে আরব ব্যক্তিত্বের স্বরূপ উন্মোচন ও সমন্বয়ের কাল।
যে পরাজিত ও অসহায় জনগণ ১৯৪৮-এর অব্যবহিত পরের কয়েক বছর ভালোবাসার কবিতাকে আশ্রয় করেছিল তারাই ষাট দশকের আগমনে উদ্ভব ঘটাল প্রতিরোধের একটা সত্যিকারের শক্তির, যা অদম্য, নির্ভীক ও আশাবাদী।
ভালোবাসার কবিতার জন্ম একাকীত্ব ও বঞ্চনার তিক্ত অনুভূতি থেকে যা ১৯৪৮ সালের পর আরব জনগণকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। তারা একটা পরাজিত সংখ্যালঘিষ্ঠ জাতি এই অনুভূতি কালপরিক্রমায় পরিবর্তিত হতে শুরু করে লড়াকু মনোভাবে এবং তারা তাদের দুঃসহ অবস্থার মুখোমুখি মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়।
প্রতিরোধ কোনো মতেই সহজ বিকল্প ছিল না; বরং এটা ছিল নিত্যকার যুদ্ধ, এমন এক ভয়ঙ্কর শত্রুর সঙ্গে যারা এটাকে গ্রহণ করেছিল জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন হিসেবে। নিপীড়নের মাত্রা যত বিস্তৃত ও ভয়ঙ্কর হতে লাগল প্রতিরোধ ততই সংগঠিত হতে থাকল। নির্বাসনের কবিতার বিপরীতে, প্রতিরোধের কবিতা দুঃখ ও ক্রন্দনবোধ থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয়ে উদ্ভূত হল একটা বিস্ময়কর বৈপ্লবিক মনোবল নিয়ে। যথেষ্ট আশ্চর্যের ব্যাপার যে, আরব বিশ্বের সব রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে এটা দ্রুত তাল মেলাতে সক্ষম হল।
প্রতিরোধের কবিতা যে শুধু মর্ম এবং কাব্যধারণার পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করল তা-ই নয়, তার ফর্ম এবং টেকনিকও বদলে গেল। ঐতিহ্যবাদী কাব্যকাঠামো পরিত্যাগ করে গ্রহণ করল আধুনিক টেকনিক, কোনো শক্তি না হারিয়ে। মর্মার্থের দিক থেকে প্রতিরোধের কবিতা প্রকাশের বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করল :
প্রেম
নারীপ্রেমকে সম্পূর্ণরূপে সমন্বিত করা হল দেশপ্রেমের সঙ্গে। নারী ও মাটিকে সম্পূর্ণরূপে আত্মীকৃত করা হল একটা মহান প্রেম হিসেবে এবং সেটাকে রূপান্তরিত করা হলো স্বাধীনতার মহান লক্ষ্য।
ব্যঙ্গ
শত্রু এবং তাদের রাজনৈতিক অনুচরদের উপহাসের পাত্র বানানো হল এবং দমন-পীড়নকে প্রকাশ করা হল তিক্ত বিদ্রুপযুক্ত করে। এ প্রবণতা একটা জীবনমুখী ও অপরাজেয় মনোভাবকে প্রকাশিত করল এবং সব ঘটনাকে বিবেচনা করল ক্ষণস্থায়ী ও পরিবর্তনকালীন অবস্থা হিসেবে যা, আজ হোক বা কাল, পরিবর্তিত হয়ে যাবে এবং স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে।
বিদ্রোহ ও মোকাবেলা
শত্র“কে প্রকাশ্যে মুখোমুখি স্থাপন করা হলো যোদ্ধার অবিচল ও নির্ভীক মনোভাব নিয়ে। ফিলিস্তিনিদের জীবনবাস্তবতা থেকেই এর উদ্ভব যাকে সংক্ষেপে উপস্থাপন করা যায় এভাবে : আরব জনগণের অধিকাংশই গ্রামবাসী, ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের বিরুদ্ধে ১৯৪৮ সালের আগে যে বিপ্লব ও অভ্যুত্থানগুলো সংঘটিত হয় তার সঙ্গে তারা নিবিড়ভাবে জড়িত ছিল। সে কারণে তাদের ওপর নিপীড়নও ছিল সেরকমই কঠোর। তারা বাস করত খুবই করুণ পরিস্থিতির মধ্যে, প্রতিদিনের খাবার জোগাড় করতে তাদের যে সংগ্রাম করতে হতো তা ছিল খুবই ভোগান্তিময় ও কষ্টদায়ক। এটা বাস্তব যে, শত্র“র অস্তিত্ব সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদী পরিকল্পনার সৃষ্টি এবং তার টিকে থাকাও পুঁজিবাদের জোরে। তাছাড়া, প্রতিরোধের কবিতা হচ্ছে সব ইহুদিবাদী বিশ্বাস ও সংস্কারের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ। এটা তাদের একটা-একটা করে ধরেছে আর ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। এটা অত্যন্ত মজবুতভাবে গ্রথিত সাহিত্য যা শুধু আবেগ নয়, যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। মোটের ওপর, স্থায়ী আরব বিপ্লবের সঙ্গে তার গুরুত্বপূর্ণ সংযোগসূত্র রয়েছে এবং আরব প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে হাতে হাত ধরে অগ্রসর হয়েছে। সব বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও এটা একটা সত্যিকার সাহিত্য হিসেবে উদ্ভূত ও বিকশিত হতে পেরেছে এবং যোদ্ধা কবির ব্যক্তিত্বকে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে।
অনুবাদ : ফারজানা আফরোজ
কানাফানি প্রথমে শিক্ষকতা এবং পরে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাগজের সম্পাদক ছিলেন। সাহিত্য পত্রিকাও সম্পাদনা করেন। ‘রাষ্ট্রহীন’ মানুষ হিসেবে তাকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে লুকিয়ে থাকতে হয়েছে। ১৯৭২ সালের ৮ জুলাই লেবাননের বৈরুত শহরে গাড়ি বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন তিনি। ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়।
ফিলিস্তিনি প্রবন্ধ ও কথাসাহিত্যের বিকাশে কানাফানির অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। তার প্রথম উপন্যাস রিজাল ফিশ্-শামস (মেন ইন দি সান) প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে, বৈরুতে। তার অনেক উপন্যাস ও অন্যান্য রচনা ইংরেজিসহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি তার সাহিত্যকৃতির জন্য প্যালেস্টাইনসহ আরব বিশ্বের বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হন।
১৯৬৮ সালে ইরাকের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় গাস্সান কানাফানি সম্পাদিত (সুলাফা হিজাভি অনূদিত) পোয়েট্রি অফ রেজিস্ট্যান্স ইন অকুপায়েড প্যালেস্টাইন প্রকাশ করে। অনূদিত প্রবন্ধটি সেই সংকলনের ভূমিকা। উল্লেখ্য, এটি তার বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ রেজিস্ট্যান্স লিটারেচার ইন অকুপায়েড প্যালেস্টাইন (১৯৬৬) গ্রন্থের অংশবিশেষ।]
১৯৪৮ সালে ইহুদিবাদীদের হাতে ফিলিস্তিনের পতনের ফলে অধিকৃত ফিলিস্তিনে আরব জনগণের সংখ্যা এবং সমাজকাঠামোয় ধ্বংসাÍক পরিবর্তন সাধিত হয়। বিশ লাখ আরবের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ তাদের মাতৃভূমিতে থেকে যায়, এরা মূলত কৃষক। শহরগুলো ফাঁকা হয়ে যায় হয় যুদ্ধের সময়েই না হয় তার অব্যবহিত পরে। এর ফলে আরবদের সামাজিক পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটে, কারণ শহরগুলো ছিল রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ভাবোচ্ছ্বাসের কেন্দ্র।
ইহুদিবাদী দখলদাররা তাদের সামরিক আগ্রাসন বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের নিপীড়নমূলক উপায়সমূহ আরোপ করতে শুরু করে, পরিবেশ তাদের জন্য সহায়ক ছিল। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আরব পরিচয়ের ছিটেফোঁটা চিহ্নকেও উপড়ে ফেলা এবং সেখানে নতুন প্রবণতার বীজ বপন করা যা অবশ্যই গড়ে উঠবে ইহুদিবাদী রাজনৈতিক ও সাহিত্যিক জীবনের ছত্রচ্ছায়ায় এবং তার সঙ্গে সমন্বিত হয়ে।
এ করুণ পরাজয় পর্যন্ত ফিলিস্তিনি সাহিত্য ছিল আরবি সাহিত্য আন্দোলনের মূলস্রোতের অংশ যা বিকশিত হয় এই শতাব্দীর (বিংশ শতাব্দী-অনুবাদক) প্রথম ভাগ জুড়ে। রসদ মিলেছে তখনকার সাহিত্যিক আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী মিসরীয়, সিরিয়ান ও লেবাননীয় লেখকদের কাছ থেকে, তাদেরই প্রভাবে এটা গতিশীল হয়। এমনকি প্রখ্যাত ফিলিস্তিনি লেখকরাও তাদের খ্যাতির জন্য বিশেষভাবে ঋণী আরব রাজধানীগুলোর কাছে, যেখান থেকে তারা তাদের সৃষ্টিকর্মের জন্য সংবর্ধনা ও সহায়তা লাভ করেছেন। যে মুহূর্তে রাজনীতি এবং আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ফিলিস্তিন একটা গণনাযোগ্য অবস্থান লাভ করছে সেই মুহূর্তে ফিলিস্তিনি সাহিত্যের মানের নিম্নগামিতার পেছনে অনেক কারণ ছিল।
১৯৪৮ সালের পর ফিলিস্তিনি সাহিত্য একটা নতুন সাহিত্যিক আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করতে সক্ষম হয় যাকে ‘ফিলিস্তিনি বা শরণার্থী সাহিত্য’ বলার চেয়ে বরং ‘নির্বাসন সাহিত্য’ বলাই ভালো। কবিতা, এই আন্দোলনের প্রধান উপাদান, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উৎকর্ষ ও আঙ্গিকের ক্ষেত্রে একটা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করেছে। ১৯৪৮ সালের যুদ্ধ-পরবর্তী সংক্ষিপ্ত নীরবতার পর একটা বিশাল জাগরণ সৃষ্টি হয় এবং জনগণের জাতীয় অনুভূতির প্রতিফলন ঘটিয়ে প্রচুর সংখ্যায় জাতীয় কবিতা রচিত হতে থাকে। এটা আরব এবং বিদেশী প্রবণতার মধ্যে মিথষ্ক্রিয়া ঘটায় এবং ক্রমান্বয়ে আঙিকের ঐতিহ্যবাহী নিয়মগুলো ভাঙতে থাকে, পুরনো আবেগমথিত উচ্ছ্বাস পরিহার করা হয়, এবং উদ্ভূত হয় এমন একটা গভীর দুঃখবোধের অনন্য সাধারণ অনুভূতিসমেত যা বিরাজমান পরিস্থিতির বাস্তবতার সঙ্গে অনেক বেশি সমানুপাতিক।
অপরদিকে, অধিকৃত ফিলিস্তিনের ভেতরকার প্রতিরোধ সাহিত্যকে নীতিগত মৌলিক পার্থক্যের মোকাবেলা করতে হয়। লেখক এবং সংস্কৃতিকর্মীদের পুরো একটা প্রজন্মের দেশত্যাগের কারণে অধিকৃত ফিলিস্তিনে আরবি সাহিত্যের মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ে। যারা থেকে গেল তাদের নিয়ে যে সমাজ গঠিত হয় তা প্রধানত গ্রামীণ এবং তারা এমন এক রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নিপীড়নের শিকার যার উদাহরণ বিশ্বের আর কোথাও মিলবে না।
থেকে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের অধিকাংশেরই, তাদের সামাজিক অবস্থার জন্য, সাংস্কৃতিক মান এমন ছিল না যে তারা লেখক এবং শিল্পীর একটা নতুন প্রজন্ম গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।
যেসব আরব শহর গ্রাম থেকে উঠে আসা প্রতিভাবান তরুণদের স্বাগত জানাতে ও উৎসাহ দিতে লাগল সেগুলো শত্র“র নিষেধাজ্ঞার শহরে পরিণত হল।
এখানকার আরব জনগণ সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল, আরব দেশগুলোর সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগের উপায় রইল না।
ইহুদিবাদী সামরিক কর্তৃপক্ষ আরব জনগণের ওপর কঠোর সীমাবদ্ধতা আরোপ এবং তাদের সাহিত্যিক নির্মাণের ওপর খবরদারি করতে লাগল।
প্রকাশনা ও বিপণনের উপায়-উপকরণ হয় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ল না হয় কঠোর নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হল।
আরবদের জন্য বিদেশী ভাষা শিক্ষার সুযোগ থাকল না। খুব কম জনই হাইস্কুলে পড়ার অনুমতি পায়, আর প্রায় কাউকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ দেয়া হয় না।
এ নববিকশিত সাহিত্য পাঠের সময় এটা মনে রাখা উচিত যে, এখানকার আরব জনগণ তাদের অস্তিত্বকে দৃঢ় এবং নিজেদের প্রকাশ করার জন্য নিগ্রহ ও অত্যাচারের কালো রাত্রির মধ্যে দিয়ে সংগ্রাম করে চলেছে। এখন তারা তাদের নিজস্ব ভাবপ্রকাশের ভাষা ও কৌশল আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে যা ঘনীভূত হয়ে স্পন্দমান প্রতিরোধ সাহিত্য তৈরি করেছে।
এটা অনুধাবন করা এখন সহজ যে, এই কঠোর অবরোধের মধ্যে কবিতা কেন প্রতিরোধ আহ্বানের প্রথম অগ্রদূত হল; কারণটি হচ্ছে, কবিতা মুখে-মুখে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং প্রকাশনা ছাড়াই টিকে থাকতে সক্ষম। এর থেকে এ ব্যাখ্যাও পাওয়া যায় কেন কবিতা প্রারম্ভকালে ঐতিহ্যবাদী আঙিককে আশ্রয় করেছে, কারণ তা মুখস্থ করা অপেক্ষাকৃত সহজ এবং দ্রুত মানুষের আবেগকে প্রভাবিত করতে পারে।
প্রাথমিক জোয়ারের বৈশিষ্ট্য এই যে, সেগুলো ছিল ভালোবাসার গীতিকবিতা, কিন্তু পাশাপাশি ঐতিহ্যবাদী কবিতা এবং জনপ্রিয় মৌখিক কবিতাও রচিত হয় যা প্রতিরোধ অভিব্যক্তির প্রথম বীজ বপন করে। বাস্তবে, জনপ্রিয় কবিতা কুড়ির দশক থেকে ফিলিস্তিনের ইতিহাসে বড় ভূমিকা পালন করে যা গোটা আরব বিশ্বেই খ্যাতি লাভে সক্ষম হয়। নিচের গীতিকবিতাটি প্রায় প্রত্যেক ফিলিস্তিনিরই মুখস্থ, তারা এটা সবসময় আবৃত্তি করে; ১৯৩৬ সালে ব্রিটিশ ম্যান্ডেট যে ফিলিস্তিনি যোদ্ধাকে ফাঁসি দেয় তিনি ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার পূর্বাহ্নে তাৎক্ষণিকভাবে মুখে-মুখে রচনা করেছিলেন এই কবিতাটি:
ওগো রাত, আর একটু দাঁড়াও না, যতক্ষণ না
এই বন্দি তার গান শেষ করতে পারে...
ভোর নাগাদ তার পাখনাগুলো ঝাপটাতে শুরু করবে
আর ফাঁসিতে ঝুলন্ত মানুষটি
বাতাসে দোল খাবে।
ওগো রাত, কমাও তোমার গতিবেগ,
আমাকে তোমার কাছে আমার হৃদয় উজাড় করতে দাও,
তুমি কি ভুলে গেছ আমি কে, আর
আমার সমস্যা কী।
দয়া করো, আমার সময়গুলো
কীভাবেই না পিছলে গেলো তোমার হাত বেয়ে।
ভেব না যে ভয়ে কাঁদব আমি,
আমার অশ্র“ আমার দেশের জন্যে নিবেদিত,
আর বাড়িতে অপেক্ষমাণ
ওইসব ক্ষুধার্ত পিতৃহীন শিশুর জন্য।
আমার পরে তাদের কে দেবে খাবার?
আমার দুই ভাই-ই যে
আমার আগেই ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলেছে।
আর একাকী অশ্রুতে ভেসে
কীভাবে কাটাবে দিন আমার বিধবা?
তার হাতের মণিবন্ধে তার চুড়িও আমি
রেখে যেতে পারলাম না-
গোটা দেশ যে এখন অস্ত্র চেয়ে কাঁদছে।
১৯৪৮ সাল পর্যন্ত, সুরচিত মানসম্পন্ন সাহিত্যের আবির্ভাবের আগে, প্রায় দশ বছর এসব জনপ্রিয় ধারার কবিতা প্রাধান্য বিস্তার করে রাখে। এটাই সেই মাধ্যম যার সাহায্যে পরাজিত জনগণ নিজেদের প্রকাশ করার উপায় খুঁজে পেয়েছিল। তাদের জীবনের সব কিছুই এর মধ্যে জায়গা করে নেয়। ওইসব কবিতার কার্যকারিতার দ্বারা তারা সকালের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা, সন্ধ্যার আড্ডা এবং আর-আর সব জনসমাগমকে ভয়ানক বিক্ষোভ সমাবেশে পরিণত করতেন ফায়ারিং স্কোয়াডের তোয়াক্কা না করে। অনেক জনপ্রিয় কবিকে কারাগারে পাঠানো হয় অথবা রাখা হয় কঠোর অবরোধের মধ্যে। আর জনপ্রিয় কবিতা যতই প্রাচুর্যতা পায় ও সম্প্রসারিত হতে থাকে দখলদার শক্তি ততই বিস্তৃত করতে থাকে তাদের নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ড, কয়েকজন কবিকে তারা হত্যা করে এবং আরবদের সব ধরনের সমাবেশ সংগঠন নিষিদ্ধ করে দেয়। এসব ব্যবস্থা অবশ্য এই প্রতিরোধ প্রবণতাকে নির্মূল করতে পারেনি, তবে প্রবল ক্ষমতা ও প্রাণশক্তি নিয়ে নবরূপে বিস্ফোরিত হওয়ার আগ পর্যন্ত অন্তত পাঁচ বছর এটাকে দাবিয়ে রাখতে পেরেছিল। ষাটের দশকের শুরুতে, খুব আশ্চর্যজনকভাবে, সাহিত্যের একটা লক্ষ্যযোগ্য নতুন তরঙ্গস্রোত গতিমান হল। এই নতুন তরঙ্গের বিশ্বাস ও নীতি ছিল দুঃসাহসী, প্রাণশক্তি ও আশাবাদে পূর্ণ এবং লড়াকু তেজে ভীষণভাবে প্রাণিত, একই সময়ের নির্বাসিত কবিদের দুঃখভারাক্রান্ত ও আবেগতাড়িত সাহিত্য থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
এই নতুন জোয়ারের আগের দশককে সবচেয়ে ভালোভাবে বর্ণনা করা যায় এই বলে যে, এটা ছিল ব্যক্তিত্ব সমন্বয়ের কাল, সংগ্রামের যুক্তি ও লক্ষ্যর সঙ্গে আরব ব্যক্তিত্বের স্বরূপ উন্মোচন ও সমন্বয়ের কাল।
যে পরাজিত ও অসহায় জনগণ ১৯৪৮-এর অব্যবহিত পরের কয়েক বছর ভালোবাসার কবিতাকে আশ্রয় করেছিল তারাই ষাট দশকের আগমনে উদ্ভব ঘটাল প্রতিরোধের একটা সত্যিকারের শক্তির, যা অদম্য, নির্ভীক ও আশাবাদী।
ভালোবাসার কবিতার জন্ম একাকীত্ব ও বঞ্চনার তিক্ত অনুভূতি থেকে যা ১৯৪৮ সালের পর আরব জনগণকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। তারা একটা পরাজিত সংখ্যালঘিষ্ঠ জাতি এই অনুভূতি কালপরিক্রমায় পরিবর্তিত হতে শুরু করে লড়াকু মনোভাবে এবং তারা তাদের দুঃসহ অবস্থার মুখোমুখি মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়।
প্রতিরোধ কোনো মতেই সহজ বিকল্প ছিল না; বরং এটা ছিল নিত্যকার যুদ্ধ, এমন এক ভয়ঙ্কর শত্রুর সঙ্গে যারা এটাকে গ্রহণ করেছিল জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন হিসেবে। নিপীড়নের মাত্রা যত বিস্তৃত ও ভয়ঙ্কর হতে লাগল প্রতিরোধ ততই সংগঠিত হতে থাকল। নির্বাসনের কবিতার বিপরীতে, প্রতিরোধের কবিতা দুঃখ ও ক্রন্দনবোধ থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয়ে উদ্ভূত হল একটা বিস্ময়কর বৈপ্লবিক মনোবল নিয়ে। যথেষ্ট আশ্চর্যের ব্যাপার যে, আরব বিশ্বের সব রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে এটা দ্রুত তাল মেলাতে সক্ষম হল।
প্রতিরোধের কবিতা যে শুধু মর্ম এবং কাব্যধারণার পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করল তা-ই নয়, তার ফর্ম এবং টেকনিকও বদলে গেল। ঐতিহ্যবাদী কাব্যকাঠামো পরিত্যাগ করে গ্রহণ করল আধুনিক টেকনিক, কোনো শক্তি না হারিয়ে। মর্মার্থের দিক থেকে প্রতিরোধের কবিতা প্রকাশের বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করল :
প্রেম
নারীপ্রেমকে সম্পূর্ণরূপে সমন্বিত করা হল দেশপ্রেমের সঙ্গে। নারী ও মাটিকে সম্পূর্ণরূপে আত্মীকৃত করা হল একটা মহান প্রেম হিসেবে এবং সেটাকে রূপান্তরিত করা হলো স্বাধীনতার মহান লক্ষ্য।
ব্যঙ্গ
শত্রু এবং তাদের রাজনৈতিক অনুচরদের উপহাসের পাত্র বানানো হল এবং দমন-পীড়নকে প্রকাশ করা হল তিক্ত বিদ্রুপযুক্ত করে। এ প্রবণতা একটা জীবনমুখী ও অপরাজেয় মনোভাবকে প্রকাশিত করল এবং সব ঘটনাকে বিবেচনা করল ক্ষণস্থায়ী ও পরিবর্তনকালীন অবস্থা হিসেবে যা, আজ হোক বা কাল, পরিবর্তিত হয়ে যাবে এবং স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে।
বিদ্রোহ ও মোকাবেলা
শত্র“কে প্রকাশ্যে মুখোমুখি স্থাপন করা হলো যোদ্ধার অবিচল ও নির্ভীক মনোভাব নিয়ে। ফিলিস্তিনিদের জীবনবাস্তবতা থেকেই এর উদ্ভব যাকে সংক্ষেপে উপস্থাপন করা যায় এভাবে : আরব জনগণের অধিকাংশই গ্রামবাসী, ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের বিরুদ্ধে ১৯৪৮ সালের আগে যে বিপ্লব ও অভ্যুত্থানগুলো সংঘটিত হয় তার সঙ্গে তারা নিবিড়ভাবে জড়িত ছিল। সে কারণে তাদের ওপর নিপীড়নও ছিল সেরকমই কঠোর। তারা বাস করত খুবই করুণ পরিস্থিতির মধ্যে, প্রতিদিনের খাবার জোগাড় করতে তাদের যে সংগ্রাম করতে হতো তা ছিল খুবই ভোগান্তিময় ও কষ্টদায়ক। এটা বাস্তব যে, শত্র“র অস্তিত্ব সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদী পরিকল্পনার সৃষ্টি এবং তার টিকে থাকাও পুঁজিবাদের জোরে। তাছাড়া, প্রতিরোধের কবিতা হচ্ছে সব ইহুদিবাদী বিশ্বাস ও সংস্কারের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ। এটা তাদের একটা-একটা করে ধরেছে আর ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। এটা অত্যন্ত মজবুতভাবে গ্রথিত সাহিত্য যা শুধু আবেগ নয়, যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। মোটের ওপর, স্থায়ী আরব বিপ্লবের সঙ্গে তার গুরুত্বপূর্ণ সংযোগসূত্র রয়েছে এবং আরব প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে হাতে হাত ধরে অগ্রসর হয়েছে। সব বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও এটা একটা সত্যিকার সাহিত্য হিসেবে উদ্ভূত ও বিকশিত হতে পেরেছে এবং যোদ্ধা কবির ব্যক্তিত্বকে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে।
অনুবাদ : ফারজানা আফরোজ
No comments