নিহালের সোনালী কেশ ও বন্য ফুল
নাজমা খলিল-হাবিব অনুবাদ : মুসাররাত নওশাবা
আবু মুহাম্মাদ তার বাস চালিয়ে নিয়ে চলেছেন পশ্চিম বৈরুতের উপকণ্ঠে, সরু রাস্তা বুর্জ আলবারাজ্নাহ, হারেত হেরিক এবং হায়াহ ইসিলাম হয়ে। প্রত্যেক স্টপেজ থেকে পনের-ষোল বছরের বালক-বালিকা গাড়িতে উঠছে। যাত্রা শুরুর আধা ঘণ্টার মধ্যেই বাসটা পূর্ণ হয়ে গেল এবং শান্তিপূর্ণভাবে এগিয়ে চলল সিবলিনের ভোকেশনাল ইন্সটিটিউট অভিমুখে। আর কয়েকটা মাস, তাহলেই নিহাল ডিপ্লোমা-ইন-অ্যাডুকেশন ডিগ্রি লাভ করবে। সেটা এমন একটা জীবন যার কথা সে স্বপ্নেও ভাবেনি, এটা হচ্ছে হাতের কাছের সবচেয়ে ভালো ডিগ্রি। তার পিতা সম্পদশালী হলে সে বৈরুতের আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে পড়তে পারত ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য... যদি তার পিতা সারাটা জীবন না কাটিয়ে দিতেন তার জনগণের জন্য, রক্ষণশীল সংকীর্ণমনা গ্রামবাসীর সেবায়, তাহলে সে এতদিনে সিনেমার স্টার বনে যেতে পারত। তার সৌন্দর্য সবচেয়ে সুন্দরীদের চেয়েও বেশি। সেরকমই বলেন তার মা, রাবাব খালা আর সব প্রিয় প্রতিবেশী।
এই বার্তাই সে পায় যখন বয়স্করাও তার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে, তরুণদের কথা তো বলাই বাহুল্য। যাই হোক, শিক্ষকতা খারাপ চাকরি নয়। কে জানে আল্লাহ হয়তো কোনো একজন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবেন যে হবে তার ভালো স্বামী, আর এইভাবে হয়তো তার বুর্জোয়া স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে।
বাসে সবশেষে উঠল আহমদ। সে যাত্রীদের সালাম জানাল, যাদের বেশির ভাগই মেয়ে। শিগগিরই সে তাদের পেছনে লাগল।
‘আমি অবাক হয়ে ভাবি কেন এইসব মেয়েরা আজকাল এমন কঠিন পথ বেছে নেয়। আমি কসম খেয়ে বলছি, আমি মেয়ে হলে প্রতিদিন ভোরে ওঠা, স্কুল বাস ধরার জন্য উন্মাদের মতো ছোটা, একটা ডিগ্রির জন্য বছরের পর বছর ক্লাসরুমে বন্দি হয়ে থাকা, এইসবের ধার ধারতাম না... এই যে মেয়েরা! কিসের জন্য তোমরা ডিগ্রির পেছনে ছুটছ? সামনের কোনো একদিন কোনো একজন প্রিয় মানুষ এসে তোমাকে তার বাসায় নিয়ে যাবে, তখন তোমার ডিগ্রিগুলো রান্না-বান্না, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা আর বাচ্চা মানুষ করতে করতে হারিয়ে যাবে।’
‘তোমার নির্বোধ পরামর্শ থেকে আমাদের রেহাই দাও,’ নিহাল বলল।
‘বিশেষভাবে তুমি, তোমার সোনালী চুলই যথেষ্ট যার জন্য শত শত পুরুষ তোমাকে বিয়ে করার জন্য মরতে ছুটবে।’
‘হেই... চুপ করো!’
‘...’ ‘ধরো, ওহে মূর্খ, যে, আমি তোমাকে বিয়ে করলাম, তারপর কয়েক বছর পর একটা অন্ধ বোমা বা ইসরাইলি বোমাহামলা বা স্থানীয় দুটি দলের খণ্ডযুদ্ধ তোমাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিল... তখন আমার এবং আমার সন্তানদের কী অবস্থা হবে? আমরা কি তখন মসজিদের দ্বারে দ্বারে ভিখ মেঙ্গে বেড়াব? নাকি আমার সন্তানদের জীবন ধারণের জন্য পথে পথে চিরুনি আর চুইংগাম বিক্রি করতে পাঠাব?’
‘তুমি উদ্ধত, অযৌক্তিক প্রকৃতির মেয়ে। তুমি তোমার এই সংসারাভিজ্ঞ মন আর নাম উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেছ। নিহাল! খোদার কসম, তোমার এই অদ্ভূত নাম তারা কোথা থেকে পেয়েছে?’
‘অদ্ভূত, আঁ? তুমি, মিস্টার মূর্খ, তোমার জানা উচিত যে এটা একটা মৌলিক, শিল্পিত নাম, সঙ্গীতময়, যা হৃদয় ও কানে একটা প্রভাব রেখে যায়। তোমাদের মতো না! ...মহাদেশের অর্ধেক লোকেরই এই নাম রয়েছে।’
‘...’
সে আবার তার নিজের স্বপ্নে বিভোর হল। শান্ত নিদ্রাচ্ছন্ন সমুদ্র ও তার অলস ঢেউ লক্ষ্য করে কয়েকদিন আগে টিভিতে দেখা একটা আমেরিকান মুভির কথা মনে পড়ল তার। নায়িকাটা তার বয়সের, তাকে ঈর্ষা হয় তার।
‘এরকম কেন হয় যে তার জন্য যা অনুমোদিত আমার জন্য তা অনুমোদন করা হয় না? ভবিষ্যতে আমার স্বামী হতে সম্মত এমন একজন পুরুষের সঙ্গে যেতে আমাকে অনুমতি দেয়া হবে না কেন? কোনো তরুণ যখন আমার ঠোঁটে চুরি করে চুমু দেয় তখন কেন আমাকে রাগের ভান করতে হবে? অথচ ভেতরে ভেতরে আমি সেটাই চাই এবং এমনকি তার পরিকল্পনা করি? আমি কেন খোদার দেয়া এই সৌন্দর্য নিয়ে গর্ব করতে পারব না? এই সৌন্দর্য যদি কোনো মূর্খকে উত্তেজিত করেই থাকে তাতে আমার কী দোষ? কেন এমন হবে যে যখনই আমি আমার উলঙ্গ শরীরের প্রশংসা করব তখন আমার পাপ বোধ হবে? দশ মিটারেরও বেশি দূর থেকে কোনো অসুস্থ মনের মানুষ বাইনোকুলার দিয়ে আমার ঘরে উঁকি দিবে বলে আমাকে কেন আমার ঘরের জানালা বন্ধ করে রাখতে হবে? কেন...কেন...কেন...’
সামনের সিটে বসা রান্দা তার মায়ের পরিচ্ছন্নতার বাতিক নিয়ে অভিযোগ করছিল। সে তাকে প্রত্যেক সপ্তাহের শেষে জানালা, মেঝে, টাইল্স, এমনকি দেওয়াল ধোয়া-মোছা করতে পর্যন্ত বাধ্য করে। সুদীর্ঘকাল শরণার্থী শিবিরে একটা কক্ষের মতো একটা তাঁবুতে বসবাস করেছে সে, তারপর সে ‘সত্যিকারের’ দেওয়াল এবং টাইল্সওয়ালা একটা ছোট্ট বাড়ির মালিক হয়েছে। সে এটাকে সাংঘাতিক ভালোবাসে। সে এটাকে আমাদের চেয়েও বেশি ভালোবাসে।’
‘ওহ খোদা! বখে-যাওয়া মেয়েদের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করো,’ আহমদ বলল। ‘ধরো তোমাদের নিজ দেশের গ্রাম ‘সাসা’ থেকে তোমরা বিতাড়িত হওনি, তাহলে ভোরে জাগার আগে কী করতে? ডুমুর তোলা, বা গরুকে খাওয়ানো, বা মাঠ থেকে গম সংগ্রহ করে আনা, সূর্যোদয়ের আগেই এসব করতে হতো।’
‘এই যে ছিদ্রান্বেষণকারী জীব, শান্তি বজায় রাখো! তোমার পরামর্শ কেউ শুনতে চায় না।’
লায়লা তার প্রেমিক সম্পর্কে অভিযোগ করছিল যে, এইবার নিয়ে তৃতীয়বারের মতো সে আবুধাবি থেকে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত বাতিল করল।
‘সে আর ফিরছে! ওরে চালাক মেয়ে, সে তোমাকে ছেড়ে পালিয়েছে।’ আহমদ বলল। সবাই হো-হো করে হেসে উঠল।
‘দুঃখ কোরো না প্রিয়ে! তোমার জন্য আমার কাছে আরও ভালো পাত্র আছে।’
‘তোমার নিজের চরকায় তেল দাও গে হে চতুর গাধা।’
মালুফ সাহেব ক্লাসে যেরকম উৎসাহ নিয়ে সর্বসাম্প্রতিক আধুনিক তত্ত্ব বর্ণনা করেন তার অনুকরণ করল সুকাইনা- ‘মহারাজ ভাবেন আমরা প্যারিসে বাস করি। তিনি চান আমরা সেইসব তত্ত্বগুলো বাস্তবায়ন করি যেগুলো উপযুক্ত ওইসব ছাত্রদের জন্য যারা উন্নয়নের শত-সহস্র ধাপ এগিয়ে রয়েছে, যারা শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত ক্লাসরুমে যায়, যাদের পেছনে রয়েছে মুভি ও থিয়েটার, যেখানে একটা ক্লাসে ১৫ জনের বেশি ছাত্র নেই, যেখানকার শিক্ষকরা এক সপ্তাহে আয় করে আমাদের এক বছরের চেয়েও বেশি। কী স্বপ্নদ্রষ্টা রে আমার!’
সুকাইনা তার শিক্ষকের অনুকরণে মুখ বাঁকিয়ে বলে চলে- ‘শিক্ষকদের ক্রমিক মুছে দাও। শাস্তি এবং পুরস্কার তুলে দাও। ছাত্রদেরই সিদ্ধান্ত নিতে দাও কখন তারা কী শিখবে’ ...আমি কসম খেয়ে বলতে পারি, এরকম করলে লোকজন আমাদের পাথর ছুঁড়ে মারবে।’
ফাদি তার হাতের তাস থেকে চোখ না সরিয়ে বলল, ‘যীশু বলেছেন, তাদের কথার প্রতি মনোযোগ দাও, কাজের প্রতি নয়। আগে ডিগ্রি নাও, ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দিয়ো না।’
‘দয়া করে শোনো বাছারা! শান্ত হও, আমি খবর শুনতে চাই,’ বললেন আবু মুহাম্মাদ।
‘আবু মুহাম্মাদ চাচা, নিজেকে কষ্ট দিয়েন না, আজকের খবর কালকের মতোই, ঠিক যেমন একইরকম হবে আগামীকালও।’
বিলাল আর ফাদি পেছনের সিটে বসে তাস খেলছিল। একঝলক মৃদু বাতাস সমুদ্র থেকে তাজা সুবাস বয়ে নিয়ে এলো, ফাদি তাস থেকে মাথা তুলে মুখ ডলল, তারপর গভীর শ্বাস টানল। সুবাস তাকে উৎফুল্ল করে তুলল। সে বলল, ‘যদি পাপ না হতো তাহলে পোকামাকড় আর পচা শেকড়ের সঙ্গে নিরানন্দ অন্ধকার মাটির নিচে নয়, আমাকে উদোম শরীরে স্ফূলিঙ্গময় তরঙ্গের ভাঁজের মধ্যে মুক্তা ও মাছেদের সঙ্গে দাফন করতে বলতাম।’
খালদা চেকপয়েন্টে সবাই নীরব হয়ে রইল। কয়েক মিটার দূরে, শারদীয় আবহাওয়ায় প্রভাবিত হয়ে, ফিরোজের একটা গান গাইতে শুরু করল আজ্জা:
‘জানালার নিচে
সেপ্টেম্বরের সোনালী হলুদ পাতারা
তোমার প্রেমের কথা
স্মরণ করিয়ে দেয়...
ওহ! ...সেপ্টেম্বরের সোনালী পাতারা...’
মেয়েরা পরস্পরের চোখের দিকে তাকিয়ে বিদ্বেষপরায়ণ হাসি হাসল। সবাই জানে আজ্জা যা ভাবছে সেটা একটা গোপন ব্যাপার। সবাই নীরব প্রেমের ব্যাপার নিয়ে ফিসফাস করতে লাগল যেটা তার এবং স্বাস্থ্য বিভাগের ছাত্র হাসানের মধ্যে ডালপালা ছড়াচ্ছে।
হঠাৎ আবু মুহাম্মাদ চেঁচিয়ে উঠলেন : ‘জারজ কোথাকার! আর একটু হলে আমাদের সমুদ্রের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলছিল আরকি!’ একটা গাড়ি তীর বেগে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো।
নিহাল ঘড়ির দিকে তাকাল। ‘আবু মুহাম্মাদ চাচা, দয়া করে আরেকটু দ্রুত চালাও।’
‘সেখানে আমার মহামূল্যবান সুন্দরী মেয়ে।’
একটা গাড়ি আরেকটা গাড়িকে ছাড়িয়ে গেলো; দুই চালক পরস্পরকে গালাগাল করতে লাগল। আবু মুহাম্মাদ তার মাথা একবার বামে একবার ডানে নড়াল, সে অবাক হয়ে ভাবে অনর্থক লোক দেখানোর জন্য লোকেরা কেন যে জীবনের ঝুঁকি নেয়। তিনি নিহালের দিকে ঘুরে বললেন, ‘উদ্বিগ্ন হয়ো না সুন্দরী, আমরা ঠিক সময়ে পৌঁছে যাব।’ বাসটা প্রধান সড়ক থেকে একটা পাশপথে নামল, সেটা সিবলিনের ইন্সটিটিউশনের দিকে গেছে। আর মাত্র কয়েক মিনিটের পথ।
অকস্মাৎ একটা বিমান আকাশে বজ পাত ঘটাল।
তারা তার পরিচয় বা প্রকার আন্দাজ করার সময়টুকুও কি পেলো?!...
আমাদের সবার কফি পান প্রায় শেষ, তখন রেডিওতে ঘোষণা এলো : ‘কয়েক মিনিট আগে সাইদার পুবে সমুদ্রতীর বরাবর ইসরাইলি বিমানহামলা হয়েছে, একটা বিমান ছাত্রবহনকারী বাসের ওপর বোমাবর্ষণ করেছে, বাসটা সিবলিনের ভোকেশনাল ইন্সটিটিউটে যাচ্ছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বাসের টুকরোগুলো ঘটনাস্থল থেকে কয়েকশ’ মিটার দূরে পর্যন্ত ছিটকে পড়ে।’
আমরা নিহালের দেহাবশেষ খুঁজে জড়ো করলাম। তার সোনালী হলুদ কেশরাশি সিবলিনগামী রাস্তার দুইধারে, পাহাড় এবং বন্য ফুলের মধ্যে, বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ছিল।
আবু মুহাম্মাদ তার বাস চালিয়ে নিয়ে চলেছেন পশ্চিম বৈরুতের উপকণ্ঠে, সরু রাস্তা বুর্জ আলবারাজ্নাহ, হারেত হেরিক এবং হায়াহ ইসিলাম হয়ে। প্রত্যেক স্টপেজ থেকে পনের-ষোল বছরের বালক-বালিকা গাড়িতে উঠছে। যাত্রা শুরুর আধা ঘণ্টার মধ্যেই বাসটা পূর্ণ হয়ে গেল এবং শান্তিপূর্ণভাবে এগিয়ে চলল সিবলিনের ভোকেশনাল ইন্সটিটিউট অভিমুখে। আর কয়েকটা মাস, তাহলেই নিহাল ডিপ্লোমা-ইন-অ্যাডুকেশন ডিগ্রি লাভ করবে। সেটা এমন একটা জীবন যার কথা সে স্বপ্নেও ভাবেনি, এটা হচ্ছে হাতের কাছের সবচেয়ে ভালো ডিগ্রি। তার পিতা সম্পদশালী হলে সে বৈরুতের আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে পড়তে পারত ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য... যদি তার পিতা সারাটা জীবন না কাটিয়ে দিতেন তার জনগণের জন্য, রক্ষণশীল সংকীর্ণমনা গ্রামবাসীর সেবায়, তাহলে সে এতদিনে সিনেমার স্টার বনে যেতে পারত। তার সৌন্দর্য সবচেয়ে সুন্দরীদের চেয়েও বেশি। সেরকমই বলেন তার মা, রাবাব খালা আর সব প্রিয় প্রতিবেশী।
এই বার্তাই সে পায় যখন বয়স্করাও তার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে, তরুণদের কথা তো বলাই বাহুল্য। যাই হোক, শিক্ষকতা খারাপ চাকরি নয়। কে জানে আল্লাহ হয়তো কোনো একজন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবেন যে হবে তার ভালো স্বামী, আর এইভাবে হয়তো তার বুর্জোয়া স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে।
বাসে সবশেষে উঠল আহমদ। সে যাত্রীদের সালাম জানাল, যাদের বেশির ভাগই মেয়ে। শিগগিরই সে তাদের পেছনে লাগল।
‘আমি অবাক হয়ে ভাবি কেন এইসব মেয়েরা আজকাল এমন কঠিন পথ বেছে নেয়। আমি কসম খেয়ে বলছি, আমি মেয়ে হলে প্রতিদিন ভোরে ওঠা, স্কুল বাস ধরার জন্য উন্মাদের মতো ছোটা, একটা ডিগ্রির জন্য বছরের পর বছর ক্লাসরুমে বন্দি হয়ে থাকা, এইসবের ধার ধারতাম না... এই যে মেয়েরা! কিসের জন্য তোমরা ডিগ্রির পেছনে ছুটছ? সামনের কোনো একদিন কোনো একজন প্রিয় মানুষ এসে তোমাকে তার বাসায় নিয়ে যাবে, তখন তোমার ডিগ্রিগুলো রান্না-বান্না, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা আর বাচ্চা মানুষ করতে করতে হারিয়ে যাবে।’
‘তোমার নির্বোধ পরামর্শ থেকে আমাদের রেহাই দাও,’ নিহাল বলল।
‘বিশেষভাবে তুমি, তোমার সোনালী চুলই যথেষ্ট যার জন্য শত শত পুরুষ তোমাকে বিয়ে করার জন্য মরতে ছুটবে।’
‘হেই... চুপ করো!’
‘...’ ‘ধরো, ওহে মূর্খ, যে, আমি তোমাকে বিয়ে করলাম, তারপর কয়েক বছর পর একটা অন্ধ বোমা বা ইসরাইলি বোমাহামলা বা স্থানীয় দুটি দলের খণ্ডযুদ্ধ তোমাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিল... তখন আমার এবং আমার সন্তানদের কী অবস্থা হবে? আমরা কি তখন মসজিদের দ্বারে দ্বারে ভিখ মেঙ্গে বেড়াব? নাকি আমার সন্তানদের জীবন ধারণের জন্য পথে পথে চিরুনি আর চুইংগাম বিক্রি করতে পাঠাব?’
‘তুমি উদ্ধত, অযৌক্তিক প্রকৃতির মেয়ে। তুমি তোমার এই সংসারাভিজ্ঞ মন আর নাম উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেছ। নিহাল! খোদার কসম, তোমার এই অদ্ভূত নাম তারা কোথা থেকে পেয়েছে?’
‘অদ্ভূত, আঁ? তুমি, মিস্টার মূর্খ, তোমার জানা উচিত যে এটা একটা মৌলিক, শিল্পিত নাম, সঙ্গীতময়, যা হৃদয় ও কানে একটা প্রভাব রেখে যায়। তোমাদের মতো না! ...মহাদেশের অর্ধেক লোকেরই এই নাম রয়েছে।’
‘...’
সে আবার তার নিজের স্বপ্নে বিভোর হল। শান্ত নিদ্রাচ্ছন্ন সমুদ্র ও তার অলস ঢেউ লক্ষ্য করে কয়েকদিন আগে টিভিতে দেখা একটা আমেরিকান মুভির কথা মনে পড়ল তার। নায়িকাটা তার বয়সের, তাকে ঈর্ষা হয় তার।
‘এরকম কেন হয় যে তার জন্য যা অনুমোদিত আমার জন্য তা অনুমোদন করা হয় না? ভবিষ্যতে আমার স্বামী হতে সম্মত এমন একজন পুরুষের সঙ্গে যেতে আমাকে অনুমতি দেয়া হবে না কেন? কোনো তরুণ যখন আমার ঠোঁটে চুরি করে চুমু দেয় তখন কেন আমাকে রাগের ভান করতে হবে? অথচ ভেতরে ভেতরে আমি সেটাই চাই এবং এমনকি তার পরিকল্পনা করি? আমি কেন খোদার দেয়া এই সৌন্দর্য নিয়ে গর্ব করতে পারব না? এই সৌন্দর্য যদি কোনো মূর্খকে উত্তেজিত করেই থাকে তাতে আমার কী দোষ? কেন এমন হবে যে যখনই আমি আমার উলঙ্গ শরীরের প্রশংসা করব তখন আমার পাপ বোধ হবে? দশ মিটারেরও বেশি দূর থেকে কোনো অসুস্থ মনের মানুষ বাইনোকুলার দিয়ে আমার ঘরে উঁকি দিবে বলে আমাকে কেন আমার ঘরের জানালা বন্ধ করে রাখতে হবে? কেন...কেন...কেন...’
সামনের সিটে বসা রান্দা তার মায়ের পরিচ্ছন্নতার বাতিক নিয়ে অভিযোগ করছিল। সে তাকে প্রত্যেক সপ্তাহের শেষে জানালা, মেঝে, টাইল্স, এমনকি দেওয়াল ধোয়া-মোছা করতে পর্যন্ত বাধ্য করে। সুদীর্ঘকাল শরণার্থী শিবিরে একটা কক্ষের মতো একটা তাঁবুতে বসবাস করেছে সে, তারপর সে ‘সত্যিকারের’ দেওয়াল এবং টাইল্সওয়ালা একটা ছোট্ট বাড়ির মালিক হয়েছে। সে এটাকে সাংঘাতিক ভালোবাসে। সে এটাকে আমাদের চেয়েও বেশি ভালোবাসে।’
‘ওহ খোদা! বখে-যাওয়া মেয়েদের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করো,’ আহমদ বলল। ‘ধরো তোমাদের নিজ দেশের গ্রাম ‘সাসা’ থেকে তোমরা বিতাড়িত হওনি, তাহলে ভোরে জাগার আগে কী করতে? ডুমুর তোলা, বা গরুকে খাওয়ানো, বা মাঠ থেকে গম সংগ্রহ করে আনা, সূর্যোদয়ের আগেই এসব করতে হতো।’
‘এই যে ছিদ্রান্বেষণকারী জীব, শান্তি বজায় রাখো! তোমার পরামর্শ কেউ শুনতে চায় না।’
লায়লা তার প্রেমিক সম্পর্কে অভিযোগ করছিল যে, এইবার নিয়ে তৃতীয়বারের মতো সে আবুধাবি থেকে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত বাতিল করল।
‘সে আর ফিরছে! ওরে চালাক মেয়ে, সে তোমাকে ছেড়ে পালিয়েছে।’ আহমদ বলল। সবাই হো-হো করে হেসে উঠল।
‘দুঃখ কোরো না প্রিয়ে! তোমার জন্য আমার কাছে আরও ভালো পাত্র আছে।’
‘তোমার নিজের চরকায় তেল দাও গে হে চতুর গাধা।’
মালুফ সাহেব ক্লাসে যেরকম উৎসাহ নিয়ে সর্বসাম্প্রতিক আধুনিক তত্ত্ব বর্ণনা করেন তার অনুকরণ করল সুকাইনা- ‘মহারাজ ভাবেন আমরা প্যারিসে বাস করি। তিনি চান আমরা সেইসব তত্ত্বগুলো বাস্তবায়ন করি যেগুলো উপযুক্ত ওইসব ছাত্রদের জন্য যারা উন্নয়নের শত-সহস্র ধাপ এগিয়ে রয়েছে, যারা শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত ক্লাসরুমে যায়, যাদের পেছনে রয়েছে মুভি ও থিয়েটার, যেখানে একটা ক্লাসে ১৫ জনের বেশি ছাত্র নেই, যেখানকার শিক্ষকরা এক সপ্তাহে আয় করে আমাদের এক বছরের চেয়েও বেশি। কী স্বপ্নদ্রষ্টা রে আমার!’
সুকাইনা তার শিক্ষকের অনুকরণে মুখ বাঁকিয়ে বলে চলে- ‘শিক্ষকদের ক্রমিক মুছে দাও। শাস্তি এবং পুরস্কার তুলে দাও। ছাত্রদেরই সিদ্ধান্ত নিতে দাও কখন তারা কী শিখবে’ ...আমি কসম খেয়ে বলতে পারি, এরকম করলে লোকজন আমাদের পাথর ছুঁড়ে মারবে।’
ফাদি তার হাতের তাস থেকে চোখ না সরিয়ে বলল, ‘যীশু বলেছেন, তাদের কথার প্রতি মনোযোগ দাও, কাজের প্রতি নয়। আগে ডিগ্রি নাও, ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দিয়ো না।’
‘দয়া করে শোনো বাছারা! শান্ত হও, আমি খবর শুনতে চাই,’ বললেন আবু মুহাম্মাদ।
‘আবু মুহাম্মাদ চাচা, নিজেকে কষ্ট দিয়েন না, আজকের খবর কালকের মতোই, ঠিক যেমন একইরকম হবে আগামীকালও।’
বিলাল আর ফাদি পেছনের সিটে বসে তাস খেলছিল। একঝলক মৃদু বাতাস সমুদ্র থেকে তাজা সুবাস বয়ে নিয়ে এলো, ফাদি তাস থেকে মাথা তুলে মুখ ডলল, তারপর গভীর শ্বাস টানল। সুবাস তাকে উৎফুল্ল করে তুলল। সে বলল, ‘যদি পাপ না হতো তাহলে পোকামাকড় আর পচা শেকড়ের সঙ্গে নিরানন্দ অন্ধকার মাটির নিচে নয়, আমাকে উদোম শরীরে স্ফূলিঙ্গময় তরঙ্গের ভাঁজের মধ্যে মুক্তা ও মাছেদের সঙ্গে দাফন করতে বলতাম।’
খালদা চেকপয়েন্টে সবাই নীরব হয়ে রইল। কয়েক মিটার দূরে, শারদীয় আবহাওয়ায় প্রভাবিত হয়ে, ফিরোজের একটা গান গাইতে শুরু করল আজ্জা:
‘জানালার নিচে
সেপ্টেম্বরের সোনালী হলুদ পাতারা
তোমার প্রেমের কথা
স্মরণ করিয়ে দেয়...
ওহ! ...সেপ্টেম্বরের সোনালী পাতারা...’
মেয়েরা পরস্পরের চোখের দিকে তাকিয়ে বিদ্বেষপরায়ণ হাসি হাসল। সবাই জানে আজ্জা যা ভাবছে সেটা একটা গোপন ব্যাপার। সবাই নীরব প্রেমের ব্যাপার নিয়ে ফিসফাস করতে লাগল যেটা তার এবং স্বাস্থ্য বিভাগের ছাত্র হাসানের মধ্যে ডালপালা ছড়াচ্ছে।
হঠাৎ আবু মুহাম্মাদ চেঁচিয়ে উঠলেন : ‘জারজ কোথাকার! আর একটু হলে আমাদের সমুদ্রের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলছিল আরকি!’ একটা গাড়ি তীর বেগে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো।
নিহাল ঘড়ির দিকে তাকাল। ‘আবু মুহাম্মাদ চাচা, দয়া করে আরেকটু দ্রুত চালাও।’
‘সেখানে আমার মহামূল্যবান সুন্দরী মেয়ে।’
একটা গাড়ি আরেকটা গাড়িকে ছাড়িয়ে গেলো; দুই চালক পরস্পরকে গালাগাল করতে লাগল। আবু মুহাম্মাদ তার মাথা একবার বামে একবার ডানে নড়াল, সে অবাক হয়ে ভাবে অনর্থক লোক দেখানোর জন্য লোকেরা কেন যে জীবনের ঝুঁকি নেয়। তিনি নিহালের দিকে ঘুরে বললেন, ‘উদ্বিগ্ন হয়ো না সুন্দরী, আমরা ঠিক সময়ে পৌঁছে যাব।’ বাসটা প্রধান সড়ক থেকে একটা পাশপথে নামল, সেটা সিবলিনের ইন্সটিটিউশনের দিকে গেছে। আর মাত্র কয়েক মিনিটের পথ।
অকস্মাৎ একটা বিমান আকাশে বজ পাত ঘটাল।
তারা তার পরিচয় বা প্রকার আন্দাজ করার সময়টুকুও কি পেলো?!...
আমাদের সবার কফি পান প্রায় শেষ, তখন রেডিওতে ঘোষণা এলো : ‘কয়েক মিনিট আগে সাইদার পুবে সমুদ্রতীর বরাবর ইসরাইলি বিমানহামলা হয়েছে, একটা বিমান ছাত্রবহনকারী বাসের ওপর বোমাবর্ষণ করেছে, বাসটা সিবলিনের ভোকেশনাল ইন্সটিটিউটে যাচ্ছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বাসের টুকরোগুলো ঘটনাস্থল থেকে কয়েকশ’ মিটার দূরে পর্যন্ত ছিটকে পড়ে।’
আমরা নিহালের দেহাবশেষ খুঁজে জড়ো করলাম। তার সোনালী হলুদ কেশরাশি সিবলিনগামী রাস্তার দুইধারে, পাহাড় এবং বন্য ফুলের মধ্যে, বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ছিল।
No comments