অভিশংসন উদ্যোগ কেন সমর্থনযোগ্য?
কী কারণে জানি না, দলনির্বিশেষে আমাদের সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী ও আইনবিদদের একটি প্রভাবশালী অংশ বছরের পর বছর ধরে সেই ১৯৭৭ সালে জেনারেল আইয়ুবের কাছ থেকে ধার করে জেনারেল জিয়া যে স্যুট পরেছিলেন, তাতে কোনো অসংগতি দেখেন না। এর মধ্যে তাঁরা বিচারিক জবাবদিহির নিখুঁত সৌন্দর্য ও স্বাধীনতা অবলোকন করে চলেছেন। অথচ বিশ্বের অন্যান্য দেশের দৃষ্টান্ত পর্যালোচনা করলে সহজে চোখে পড়ে যে, বাংলাদেশ একটি স্যুটের কেবল ওপরের অংশ পরে আছে। এর মানে হলো উন্নত বিশ্ব যাঁরা বিচারক অপসারণে অভিশংসনপ্রথা অনুসরণ করেন, তাঁদেরও জুডিশিয়াল কাউন্সিল আছে। আর সেটাও কেবল বিচারক সমন্বয়ে গঠিত। সংসদ কোনো ইমপিচমেন্ট মোশন পাস করলে সবার আগে ওই কাউন্সিল অনুসন্ধান করে। যদি তারা প্রাথমিক প্রমাণ না পায়, তাহলে মোশন আর এগোয় না। সেখানেই তার মৃত্যু ঘটে।
প্রতীয়মান হচ্ছে যে, সচেতন মহলের অনেকেই একটি গুরুতর ভুল ধারণা পোষণ করছেন। আর সেটাই সম্ভবত মূল বিপত্তি ঘটাচ্ছে। সেটা হলো, কাউন্সিল মানেই হলো বিচারক অপসারণের সব ক্ষমতা ঐতিহ্যগতভাবে সুপ্রিম কোর্টের। আর অভিশংসন মানেই আদালতের সব ক্ষমতা খর্ব হওয়া। আগে যে ক্ষমতা আদালতের ছিল, সেটা আর তাঁর থাকবে না। সংসদের কাছে চলে যাবে। কীভাবে এই ভুল ধারণা ছড়াল? ১৯৫৬ সালে যখন প্রথম আলোচনা হলো, তখনই ভুলের সূচনা। বলা হয়েছিল, রাজনীতিকেরা অপরিপক্ব। তাই ওঁদের হাতে এত বড় মহতী দায়িত্ব অর্পণ করা যাবে না। কেবল কাউন্সিলকেই সবটুকু দায়িত্ব দেওয়া হোক। কিন্তু পাকিস্তান শেষতক অভিশংসনই নিল। কিন্তু এটা চালু রাখতে হলে সাক্ষী গোপাল হলেও একটা সংসদ লাগে। সামরিক শাসনে সংসদ থাকে না। জেনারেল আইয়ুব প্রথম এই নজিরবিহীন কাউন্সিল চালু করলেন। তবে জেনারেল জিয়া ও তাঁর মিত্ররা বিচার বিভাগের তথাকথিত স্বাধীনতায় এতটাই মজলেন যে, তাঁরা আরেকটি মারাত্মক ক্ষতি করলেন। উন্নত গণতান্ত্রিক বিশ্বে এটা সুপ্রতিষ্ঠিত যে, বিচারক হয়ে বিচারকেরা যখন কোনো বিচারককে অপসারণের সুপারিশ করবেন, তখন সেটা চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে না। ভারত জন্ম থেকে তা মেনে আসছে। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ১৯৯২ সালে রায় দিয়েছেন, তিন সদস্যের জুডিশিয়াল কাউন্সিল যখন অপসারণ করতে বলবে, তখন সেটা হবে তার কথায় প্রস্তাবমাত্র। আইয়ুবও সেটা মেনেছিলেন। কিন্তু জিয়া মানলেন না। তবে তাঁর অগোচরেও হতে পারে। কেরানি-কীর্তি বা অসাবধানতাও হতে পারে। বাংলাদেশ সংবিধানের কাউন্সিলসংক্রান্ত ৯৬ অনুচ্ছেদ পাকিস্তানের সংবিধান থেকে অবিকল নকল করা হলো।
কেবল একটি শব্দ বাদে। পাকিস্তানের বিধান ছিল এবং এখনো আছে, কাউন্সিল যে ক্ষেত্রে অপসারণের সুপারিশ করবে, তখন রাষ্ট্রপতি অপসারণ করতে পারেন। আর বাংলাদেশে করা হলো রাষ্ট্রপতি অপসারণ করবেন। ‘মে’ মুছে ‘শ্যাল’ বসানো হয়েছিল। কাউন্সিলের সুপারিশের বিরুদ্ধে কোনো আপিল বা পুনর্বিবেচনার সুযোগ রহিত করা হয়েছিল। আমরা সুপারিশ করব কাউন্সিল রেখেই অভিশংসনপ্রথা আনতে হবে। এর অর্থ দাঁড়াবে বিচারকেরা এখনকার চেয়ে আরও বেশি সুরক্ষা লাভ করবেন। সেটা এই অর্থে যে, তাঁদের অপসারণে বা জবাবদিহির বিষয়টি বর্তমানের পাকিস্তানি মান থেকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হবে। ÿক্ষমতাসীনদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সতর্ক থেকেও আমরা মনে করি, যেভাবে কাউন্সিল বর্তমানে আছে, সেভাবে এটা থাকতে পারে না। যদি দেখা যায়, ৯৬ অনুচ্ছেদ ফেলে দিয়ে ১৯৭২ সালের বিধানটা কেবল অবিকল প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে, তাকে কার্যকর করতে পূর্ণাঙ্গ আইন করা হচ্ছে না, তখন বুঝতে হবে এটা প্রায় শতভাগ একটি রাজনৈতিক চমক। কেবল বিচার বিভাগকে ভয় দেখানোর জন্যও হতে পারে। ইমপিচমেন্টসংক্রান্ত একটি বিধান বাহাত্তরে লেখা হলেও তাকে কার্যকর করতে কোনো আইন করা হয়নি। এই আইনটাই আসল। কিন্তু এ নিয়ে কোনো কথা নেই। আর এই আইন না করার ফলে এ দেশের মানুষ ইমপিচমেন্ট সম্পর্কে কোনো স্বচ্ছ ধারণা পায়নি। ভারত ১৯৬৮ সালে এই আইন পাস করেছিল। এরপর ১৯৯২ সালে প্রথম বিচারপতি রামস্বামীকে অপসারণের উদ্যোগ নিলে সুপ্রিম কোর্টকে চারটে মামলায় রায় দিতে হয়। অভিশংসনে যাওয়ার আলোচনা শুরু না হতেই হাইকোর্টে রিট দায়েরের তোড়জোড় তাই অবাক করার মতো কোনো বিষয় নয়। বিশ্বের যেসব দেশ ইমপিচমেন্টপ্রথা অনুসরণ করে চলেছে, তার অধিকাংশই বিচার বিভাগকে যুক্ত রেখেছে। তাই সোজা কথায় ইমপিচমেন্ট হলো এমন একটি ব্যবস্থা,
যেখানে আমাদের বিদ্যমান সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বা তার মতো সংস্থা প্রাথমিক অনুসন্ধানের দায়িত্ব পালন করে থাকে। পুলিশি অভিযোগপত্র কি চূড়ান্ত? যদি তাই হতো, তাহলে তো বিচারের ধারণা চুলোয় যেত। আদালতের দরকার পড়ত না। সভ্য দুনিয়ায় কাউকে অপসারণে এমনতর কাউন্সিলের সুপারিশ হলো কিছুটা পুলিশি অভিযোগপত্রের মতো। যার ভিত্তিতে সংসদ বিচার করতে বসে। সেপারেশন অব পাওয়ার যেহেতু মানতে হবে, তাই সংসদ বিচারকের বিচার করে থাকে। একটি ইমপিচমেন্টের দুটি দিক থাকে। একটি বিচারিক, অন্যটি রাজনৈতিক। মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, অভিশংসন একান্তভাবে একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। এর বিরুদ্ধে আপিল চলবে না। এ কথা উপমহাদেশের ক্ষেত্রে খাটে না। আমাদের জন্যও নয়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ নয়। তার স্বাধীনতা ও জবাবদিহি অবিচ্ছেদ্য। এ-সংক্রান্ত আলোচনায় একটা রাখঢাক দেখা যাচ্ছে। এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। অভিশংসনসংক্রান্ত আইনে একটি উপযুক্ত সংশোধনী আনতে ভারতের আইন কমিশন ৫০০ পৃষ্ঠার রিপোর্ট লিখেছে। তার আলোকে ২০০৫ ও ২০০৬ সালে দুটো বিল পাস করানোর ব্যর্থ চেষ্টার পরে ২০১০ সালে আরও সংশোধনী এনে লোকসভা তা পাস করলেও তা কার্যকর হয়নি। সবশেষ গত ফেব্রুয়ারিতে কেবিনেট এর একটি সংশোধনী আনার প্রস্তাব অনুমোদন করলেও তা লোকসভায় পাস হতে পারেনি। আমাদের আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক, যিনি পঞ্চম সংশোধনী বাতিল মামলায় বাহাত্তরের সংবিধানের অনেক বিধান জীবিত করলেও এই অভিশংসনে আটকে যান। কারণ, তিনি হয়তো দেখেন, তাহলে বাকশালের চেহারাটা বোরোবে। চতুর্থ সংশোধনীতে ওই অভিশংসন বাতিল হয়েছিল। এর পরিবর্তে রাষ্ট্রপতির নোটিশে অপসারণের বিধান ছিল। আওয়ামী তরিকার আইনবিদেরা যে জিয়াকে অন্তত এই প্রশ্নে নির্দিষ্টভাবে গালি দেন না, তার কারণ তাহলে ওই অপ্রিয় সত্যটা বেরোবে। সবাই মানবেন, নোটিশের চেয়ে কাউন্সিল হাজার গুণে শ্রেয়।
এখন আইন কমিশন সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে গোপনীয়তার সঙ্গে অভিশংসনে যেতে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। এটা পীড়াদায়ক যে, আইন কমিশন বিষয়টির গোপনীয়তা রক্ষা করছে। এ ব্যাপারে কোথাও কোনো ধরনের গোপনীয়তা মার্জনা করা যাবে না। কিন্তু আগেই বলেছি, কাউন্সিল হলো আধখানা স্যুট। বিশ্বব্যাপী এ ধরনের কাউন্সিলকে ‘পিয়ার রিভিউ’, মানে অপসারণ-অযোগ্য ছোটখাটো অসদাচারণের দায়ে ‘মাইনর মেজার্স’ (লঘু শাস্তি) নেওয়ার এখতিয়ার প্রয়োগ করতে দেখা যায়। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টকে সর্বাগ্রে এই ‘পিয়ার রিভিউ’ মানতে হবে। কার্যকর করতে হবে। অপসারণ করা তো অনেক দূরের কথা। কেউ বলবেন, এ কথা তো কখনো সংবিধানে লেখা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় এ প্রশ্ন উঠেছিল। তাদের উচ্চ আদালত বলেছেন, এ কথা সংবিধানে লেখার দরকার নেই। অথচ বাংলাদেশের প্রত্যেক প্রধান বিচারপতি ও অন্য বিচারকদের এই ‘পিয়ার রিভিউ’র ধারণাকে আত্মস্থ করা কিংবা আলোচনা করার গরজ অনুভব করতেও আমরা দেখিনি। অবসরে গিয়েও তাঁরা নীরবতা পালন করেন। আর অনেক রাজনীতিক এসব আদৌ বোঝেন কি না, তা সন্দেহের বিষয়। ১৯৭০ (চান্দলার) থেকে ২০০১ (ম্যাকব্রাইড) পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ আদালত অর্ধডজন রায়ে বলেছেন, অপসারণ ব্যতিরেকে বিচারকেরা নিজেদের বিচার নিজেরাই করতে পারেন। কারণ, ‘পিয়ার রিভিউ একটি আন্তর্জাতিক রীতি’। ১৯৯৫ সালে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট এই অভিমত দৃঢ়তার সঙ্গে সমর্থন করেছেন। পাঁচটি কাজ তাঁরা করতে পারেন। উপদেশপত্র জারি, অবসর নেওয়ার অনুরোধ,
সীমিত সময়ের জন্য বিচারকাজ থেকে বিরত রাখা, সতর্কতা ও তিরস্কার। ভারতের আইন কমিশন বলেছে, এই তিরস্কার করাটা প্রকাশ্যে বা গোপনে হতে পারে। এই ‘সেলফ রেগুলেশন’ কীভাবে, কোথায় লেখা হবে, সেটা নিয়ে সর্বাগ্রে আলোচনা শুরু হোক। আদালতেরই কায়েমি ক্ষমতা সংসদ নিয়ে নিচ্ছে কিংবা জবাবদিহি প্রশ্নে সংসদকে কিছুতেই যুক্ত করা যাবে না কিংবা আদালত অপরিপক্ব সাংসদদের পাল্লায় পড়ছে—এ ধরনের বোধ সৃষ্টি করার যেকোনো প্রবণতা পরিত্যাজ্য। পক্ষে-বিপক্ষে যাঁরা কোমর বাঁধতে শুরু করেছেন, তাঁদের উচিত বিশ্ব কীভাবে চলছে, সেটা খোলা মনে পর্যালোচনা করা। অমুক বনাম অমুক লড়াইয়ের হুজুগ সৃষ্টিকারীদের কাছে সংযম ও বোধোদয় আশা করি। সংসদীয় অভিশংসন সমর্থন করলেও সেটা কী প্রক্রিয়ায়, সেটাই জ্বলন্ত প্রশ্ন। সংবিধানে কী লেখা হবে, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আইনের খসড়াটা জানা। জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে বহাল রেখেই সুরাহা বের করতে হবে। ২০০৫ সালের ব্রিটিশ আইন, ১৯৮৫ সালের কানাডীয় আইনের অধীনে উপ-আইন এবং জার্মান সংবিধানে ‘আত্মনিয়ন্ত্রণ’ স্বীকৃত। যুক্তরাষ্ট্রের আইনে ১৯৩৯ সালে যে ÿক্ষমতা (যেমন বিচারিক ক্ষমতা প্রত্যাহার) অনুচ্চ ছিল, সেটা ১৯৮০ ও ২০০২ সালের মধ্যে দুটি সংশোধনীতে উচ্চকিত হয়েছে। বিচারপতি ভেঙ্কটচালিয়ার নেতৃত্বাধীন ২০০১ সালের ভারতীয় সংবিধান সংস্কার কমিশনও এর পক্ষে মত দিয়েছে। আমরাও বলি, জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে তাদের এখতিয়ার স্পষ্ট করে দিতে হবে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com
No comments