খালেদুজ্জামানের শোকাহত পিতাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিলেন ওসি by ওয়েছ খছরু
ছেলেকে অপহরণের পর সিলেটের ওসি আতাউরের
কাছে ছুটে গিয়েছিলেন গোলাপগঞ্জের সালেহ আহমদ সলুস। ওসির কাছে ছেলেকে
উদ্ধারের জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন। কিন্তু ওসি আতাউর রহমান তার কথায় কান
দেননি। শত আকুতির মুখেও তিনি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন বৃদ্ধকে। এরপর
তিনি ছুটে যান বিয়ানীবাজার থানার ওসি আবুল কালাম আজাদের কাছে। ঘটনার বিবরণ
শুনে প্রথম রাতেই ওসি বেশ তৎপর হয়ে উঠেছিলেন। এলাকায় অভিযান চালিয়ে
গ্রেপ্তার করেছিলেন দুইজনকে। উদ্ধার করেছিলেন অপহৃত কবিরের ব্যবহৃত মোবাইল
ফোন। সোমবার রাতের অ্যাকশনের পর থেকে নীরব হয়ে যান ওসি আজাদ। সালেহ আহমেদ
বারবার তার কাছে ছুটে গেলেও তিনি তেমন আগ্রহ আর দেখাননি। গ্রহণ করেননি
মামলাও। তবে হতভাগা কলেজছাত্র খালেদুজ্জামানের লাশ উদ্ধারের পর শুক্রবার
বিয়ানীবাজারের পুলিশ ওই মামলা রেকর্ড করলো। শোকাহত পিতা সালেহ আহমদ
জানিয়েছেন, তিন থানার পুলিশের পায়ে হাতে ধরে কত আকুতি জানালাম। কিন্তু আমার
পুত্রকে জীবিত পেলাম না। অপহরণের চারদিন পর পেলাম পুত্রের লাশ।’ তিনি
বলেন, ‘পুলিশ তৎপর হলে হয়তো আমি আমার সন্তানকে জীবিত পেতাম।’ সিলেট
মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির মেধাবী ছাত্র খালেদুজ্জামান অপহরণ হয়েছিল গত
সোমবার। ঘটনার চার দিন পর শুক্রবার সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের সুরমা নদীতে তারা
লাশ পাওয়া যায়। ১২ লাখ টাকা মুক্তিপণের দাবিতে তাকে নির্মমভাবে খুন করা হয়।
আর এ ঘটনায় তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছে গোলাপগঞ্জে। শনিবার সড়ক অবরোধ ও
মানববন্ধনের পর গতকাল রোববারও হাজার হাজার মানুষ চৌমুহনীতে দাঁড়িয়ে এ ঘটনার
প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এ সময় তারা ঘোষণা দিয়েছেন, ঈদের মধ্যে আসামিদের
গ্রেপ্তার করতে না পারলে ঈদের পর দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র খালেদুজ্জামানের
বাড়ি সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মীপাশা ইউনিয়নের নিমাদল পশ্চিমপাড়া
গ্রামে। সূত্র জানায়, খালেদুজ্জামান অন্যান্য দিনের মতো সোমবার ভার্সিটিতে
যান। এ সময় তার পরিচিত গোলাপগঞ্জ বাজারের নূর ম্যানশনের স্পাইডার
ইলেক্ট্রনিক্সের মালিক সাইব উদ্দিন আহমদের পুত্র কম্পিউটার মেকানিক্স কবির
আহমদ তাকে সিলেট নগরীর বন্দরবাজারে যাওয়ার জন্য বলে। কথা ছিল
খালেদুজ্জামানের একটি আইপ্যাড কবির বিক্রি করে দেবে। এ বিক্রয়ের বিষয়ে আলাপ
করতে কবিরের ফোন পেয়ে খালেদুজ্জামান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার খালাতো ভাই ও
সহপাঠী বিয়ানীবাজার উপজেলার চারখাই বাঘবাড়ী গ্রামের বদরুল ইসলামের পুত্র
জহিরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে করিম উল্যাহ মার্কেটের সামনে যায়। এ সময় কবির
জানায়, আইপ্যাড বিক্রির বিষয়ে ক্রেতাদের সঙ্গে তার ২৮ হাজার টাকা মূল্য
নির্ধারণ করা হয়। খালেদুজ্জামানকে ২০ হাজার টাকা দিয়ে সে ৮ হাজার টাকা লাভ
নেবে। এতে উভয়পক্ষ রাজি হলে টাকা লেনদেনের স্থান হিসেবে গোলাপগঞ্জ
চৌমুহনীকে নির্ধারণ করা হয়। কবিরের কথামতো খালেদুজ্জামান ও জহিরুল ইসলামসহ
তারা ৩ জন গোলাপগঞ্জে পৌঁছার পর হঠাৎ কবিরের মোবাইলে একটি ফোন আসে। তখন
কবির জানায়, টাকা নিতে হলে বিয়ানীবাজার উপজেলার রামধাবাজার যেতে হবে।
কবিরের কথামতো তারা দু’জন তার সঙ্গে রামধা বাজারের উদ্দেশে রওনা হয়।
একপর্যায়ে কবির রামধা বাজারের নিকটবর্তী তার নিজ বাড়ি চকগ্রামে নিয়ে যায়।
সেখানে যাওয়ার পর তাদেরকে একটি ঘরে আটক করে জহিরুল ইসলামকে খুব মারধর করে
ছেড়ে দেয়। এ সময় খালেদুজ্জামানকে আটক করে রাখে। জহিরুল কোনক্রমে প্রাণে
রক্ষা পেয়ে হেতিমগঞ্জ বাজারে এসে বিষয়টি কয়েকজন আত্মীয়কে জানায়। এরপর
খালেদুজ্জামানের সন্ধানে আত্মীয়-স্বজনরা বের হন। একপর্যায়ে কবির ফোনে
জানায়, তার এক বোনসহ তাকে ও খালেদুজ্জামানকে একটি চক্র অপহরণ করে মুক্তিপণ
দাবি করছে। ১২ লাখ টাকা অপহরণকারীদের দেয়া না হলে তাদেরকে মেরে ফেলা হতে
পারে। বিষয়টি বিয়ানীবাজার থানাকে অবহিত করা হলে বিয়ানীবাজার থানার পুলিশ
রামধা চকগ্রামে এসে কবিরের বাড়ি তল্লাশি করে কাউকে না পেয়ে তার পিতাকে আটক
করে থানায় নিয়ে গেলে এলাকার এক প্রবীণ ব্যক্তির জিম্মায় এক পর্যায়ে ছেড়ে
দেয়া হয়। কবিরের বাড়ি তল্লাশির সময় একটি মোবাইল উদ্ধার করা হয়। অপহরণের
বিষয়টি জানাতে কবির যে মোবাইল দিয়ে কথা বলেছিল, ওই মোবাইলই তার ঘর থেকে আটক
করা হয়। তখন পুলিশ ও খালেদুজ্জামানের আত্মীয়-স্বজনরা বুঝতে পারে আসলে
অপহরণের মতো কোন ঘটনা ঘটেনি। সব ছিল কবিরের সাজানো নাটক। লাশ উদ্ধারের পর
পরই মুখ বাঁধা খালেদুজ্জামানের বিকৃত ছবিটি অনুরূপ ভাবে ফেসবুকের মাধ্যমে
প্রচার করে খুনি কবিরের ফাঁসি দাবি করেন অনেকেই। এ নিয়ে গোলাপগঞ্জের
সর্বমহলে যেন গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে। এদিকে খালেদুজ্জামান অপহরণের
পরপরই তার আত্মীয়-স্বজন কোতোয়ালি থানায় যোগাযোগ করলে তারা বিষয়টি
বিয়ানীবাজার থানার ওপর চাপাতে চান। বিয়ানবাজার থানায় গিয়ে বিষয়টি অবহিত
করার পর পুলিশ অনেকটা গাছাড়া অবস্থায় এগোতে থাকে। পুলিশের আচরণে
খালেদুজ্জামানের আত্মীয়-স্বজনরা চরমভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের
অভিযোগ, যথাসময়ে পুলিশ পদক্ষেপ নিলে খালেদুজ্জামানকে জীবিত উদ্ধার করা
সম্ভব হতো। শুক্রবারে খুব ভোরে লাশটি কুশিয়ারা নদী থেকে উদ্ধারের পর
ফেঞ্চুগঞ্জ থানার পুলিশ সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে লাশ মর্গে পাঠায়। শনিবার
লাশের ময়নাতদন্ত শেষে আসরের নামাজের পর তার নিজ এলাকা নিমাদল শাহারপাড়া
ঈদগাহ মাঠে জানাজার নামাজ শেষে দাফন করা হয়। বিয়ানীবাজার থানার পুলিশ
মামলাটি প্রথমে নিতে না চাইলেও গত শুক্রবার মধ্যরাতে মামলাটি গ্রহণ করে।
বিয়ানীবাজার থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ গতকাল রোববার মানবজমিনকে জানিয়েছেন,
পুলিশের কোন গাফিলতি ছিল না। বিষয়টি মীমাংসা করে খালেদুজ্জামানকে উদ্ধারের
চেষ্টা চলে। পুলিশও তৎপর ছিল। তিনি বলেন, লাশ উদ্ধারের পর থেকে পুলিশ
আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে। খালেদুজ্জামানের পিতা সালেহ আহমদ
সলুস বাদী হয়ে কবিরকে ১নং আসামি করে তার পিতাসহ আরও ৫ জনের বিরুদ্ধে হত্যা
মামলা দায়ের করেন। এ ঘটনায় বিয়ানীবাজার থানার পুলিশ প্রথমেই কবিরের এক
আত্মীয়কে আটক করে বলে জানা যায়। এদিকে শনিবার দুপুরে খালেদুজ্জামানের লাশ
হেতিমগঞ্জ এলাকায় নিয়ে আসা হলে বিক্ষুব্ধ জনতা খুনিদের ফাঁসির দাবিতে
সিলেট-জকিগঞ্জ সড়ক অবরোধ করে রাখে। পরে স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের
অনুরোধে বিক্ষুব্ধ জনতা অবরোধ তুলে নেয়। গতকাল গোলাপগঞ্জ চৌমুহনীতে সমাবেশ
করে ঈদ পর্যন্ত আলটিমেটাম দিয়েছেন তারা।
No comments