বিশ্ব অর্থনীতির ফাটল ও বাংলাদেশ
যুক্তরাষ্ট্রের সীমানা ছাড়িয়ে ২০০৭-এর আর্থিক সংকট থেকে উদ্ভূত মন্দা যখন আরেক উন্নত বিশ্ব ইউরোপের আর্থিক ভিত নড়বড়ে করে দেয়, তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। দেরি হয়ে গেছে বলার কারণ, এই সংকটের বিষয়ে সতর্কবাণী করা হলেও তাতে কেউ কর্ণপাত করেনি। এই সতর্কতার আগাম ঘোষণাকারীদের একজন ছিলেন রঘুরাম রাজন, তখনকার আইএমএফের প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং বর্তমানে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ফল্ট লাইনস: হাউ ফ্র্যাকচারস স্টিল থ্রেটেন দ্য ওয়ার্ল্ড ইকোনমি (২০১০) প্রকাশিত হওয়ার পাঁচ বছর আগেই এক সম্মেলনে তিনি তাঁর প্রবন্ধে আর্থিক খাতের ভবিষ্যৎ বিপদগুলো তুলে ধরে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে একটা বড় ধরনের সংকট নেমে আসতে পারে। সে সময় তাঁর এই ভবিষ্যদ্বাণীতে কেউ কর্ণপাত করেনি, বরং ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন তিনি। ‘ফল্ট লাইনস’ নামের মাজেজা বোঝানোর জন্য ভূতাত্ত্বিক একটা রূপক ব্যবহার করেছেন তিনি। ভূতত্ত্বে ফল্ট বলতে বোঝায় চ্যুতি, অর্থাৎ ভূগর্ভস্থ শিলাস্তরে ফাটল দেখা দিলে তার কারণে ভূগর্ভে যে ধস বা চ্যুতি হয়, তার প্রভাবে ভূপৃষ্ঠে চ্যুতি ঘটতে পারে, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ভূমিকম্পের মাধ্যমে। এই চ্যুতির সৃষ্টি হয় ভূগর্ভে শিলাস্তরের ওপর বিভিন্ন ধরনের চাপ কিংবা যেকোনো বিরূপ প্রভাবের কারণে।
আমেরিকা ও তার সন্নিহিত অর্থনীতিগুলোতে সাধারণ চোখে অদৃশ্য অর্থনৈতিক ফাটলগুলোকেই তিনি ভূতত্ত্বের চ্যুতির সঙ্গে তুলনা করেছিলেন এবং তাঁর ধারণাকে অগ্রাহ্য করার ফলাফল ভোগ করেছিল বিশ্ব অর্থনীতি। তাঁর আশঙ্কা যখন সত্যিই ফলে যায়, তখন ‘নিউজ প্রোগ্রামগুলো, ম্যাগাজিনগুলো, বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতেরা এমনকি ইংল্যান্ডের রানি—সবাই একই প্রশ্ন বিভিন্নভাবে করতে থাকেন, ‘এটা যে আসছে, তা কেউ দেখেনি কেন?’ রাজন বলেন যে অনেকেই দেখতে পেয়ে সাবধানও করেছিল। তিনি সখেদে লেখেন, ‘সমস্যা এটা ছিল না যে কেউ এই বিপদ সম্পর্কে সাবধান করে দেয়নি, সমস্যা এটাই ছিল যে যাঁরা একটা অতিরঞ্জিত অর্থনীতি থেকে লাভবান হয়েছেন—যাঁদের মধ্যে অনেক লোকই ছিলেন—তাঁদের শোনার আগ্রহ ছিল কম।’ রাজনের বইটিতে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য কিছু মারাত্মক হুমকির আভাস দেওয়া হয়েছে, যেগুলোকে ভূগর্ভস্তরের অদৃশ্যমান ফাটল হিসেবে রূপকায়িত করা হয়েছে। ২০০৭-০৮ সালের আর্থিক বিপর্যয় তাঁর এই আভাসের একটা জ্বলন্ত উদাহরণ। দীর্ঘ সময় ধরে অর্থনীতির একটা চাঙা অবস্থার সুযোগে সৃষ্টি হয়েছিল এসব ফাটল। আমেরিকার হাউজিং খাতে দ্রুত ঋণ স্ফীতি থেকে যে বিশাল বুদ্বুদ তৈরি হয়েছিল, তার ঢেউ এসে পড়েছিল ইউরোপীয় অর্থনীতিতেও। অথচ অতীতের এজাতীয় বিপর্যয়গুলো আঞ্চলিকভাবেই সীমাবব্ধ থাকত। বিপর্যয়ের এই উৎসটির মূলে ছিল পর্যাপ্ত তারল্য এবং অপরিমিত ঋণঝুঁকি। গ্রাহক-ঋণগ্রহীতা, ব্যাংক ও অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলোর উত্তরোত্তর বেড়ে যাওয়া লোভের কারণে উপেক্ষা করা হয়েছিল সব ধরনের ঝুঁকি।
বইটির মূল যে প্রতিপাদ্য, বিশ্ব অর্থনীতির সামনের ফাটল বা ঝুঁকিগুলো আমাদের অর্থনীতির জন্য দূরাগত মনে হলেও ২০০৭-০৮ সালের বিশ্ববিপর্যয়ের অভিজ্ঞতার পর সেই ভরসার স্থানটি নড়বড়ে হয়ে গেছে। যেমন প্রথম ফাটলটি দেখা গেছে আমেরিকায়, ওপরের দিকের মানুষের আয় অনুপাতহীনভাবে বেড়ে গেলে রাজনীতিবিদেরা মধ্যবিত্ত ভোট ব্যাংকটির ওপর মনোযোগ দেয়, তাদের চাকরি-বাকরি, বেতন ইত্যাদির দ্রুত সমাধান নেই বলে রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকেরা বরং এই শ্রেণিটির জন্য সুলভ ভোক্তাঋণ, বাড়ি কেনার ঋণ—এসবের ব্যবস্থা করে দেন। রাজনের বর্ণিত এটিই প্রথম ফাটল। আমরা জানি, এই সুলভ ঋণের বুদ্বুদ বিস্ফোরিত হয়ে কীভাবে মার্কিন অর্থনীতি এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য দেশের অর্থনীতিকেও বিপর্যস্ত করেছিল। রাজন এই লক্ষণের মধ্যে একটা ফাটল দেখতে পেলেও এখানে মূলত দুটি দুর্বলতা ক্রিয়াশীল। প্রথমটি আমেরিকার মানুষের ভেতরকার ক্রমবর্ধমান আয়ের বৈষম্য। তিনি তাঁর বইতেই দেখিয়েছেন, ১৯৭৬ সালে সে দেশের ওপরের শ্রেণির ১ শতাংশ মানুষের কাছে যেত মোট আয়ের ৮ দশমিক ৯ শতাংশ, কিন্তু ২০০৭ সালে এই হার দাঁড়িয়েছে ২৩ দশমিক ৫ শতাংশে। অর্থাৎ ১৯৭৬ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে প্রকৃত আয় যতটুকু বেড়েছে, তার ৫৮ শতাংশ গেছে সমাজের ওপরের ১ শতাংশ মানুষের কাছে। এখানে আমরা স্মরণ করতে পারি ‘ওয়াল স্ট্রিট দখল করো’ আন্দোলনের কথা। পুঁজিপতি ও বৃহৎ করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থলোভ, সীমাহীন দুর্নীতি, সরকারি নীতিনির্ধারণে ধনবাদী পরিবার ও প্রতিষ্ঠানসমূহের অন্যায় প্রভাবের কারণেই ঘটে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বঞ্চনা। এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদই ছিল এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য। ক্রমবর্ধমান এই শ্রেণিবৈষম্য ঘোচানোর কোনো ত্বরিত ব্যবস্থা নেই বলে মধ্য ও নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য রাজনৈতিক ইচ্ছাতেই মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল ঋণবাজার, যাতে তারা তাদের আয়-স্বল্পতার বিষয়টা অনুভব করতে না পারে। এই ব্যবস্থা কিংবা অব্যবস্থাপনার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে আমেরিকার ‘সাব-প্রাইম মর্টগেজ’ সংকটের মধ্য দিয়ে। আর দ্বিতীয় দুর্বলতাটি হচ্ছে রাজনৈতিক বিবেচনায় সস্তা ঋণের ঢালাও ব্যবস্থা। রাজন মন্তব্য করেন, ‘একটা পয়সাওয়ালা সরকারের ছড়িয়ে দেওয়া সস্তা টাকা যখন পরিশীলিত, প্রতিযোগিতাপূর্ণ, অনৈতিক আর্থিক খাতের মুনাফালোভের সংস্পর্শে আসে, তখন একটা গভীর ফাটল তৈরি হয়।’
রাজন দ্বিতীয় ফাটলটি আবিষ্কার করেছেন রপ্তানি খাতের ওপর কিছু দেশের অতিনির্ভরশীলতার কৌশলের ভেতর। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর রপ্তানিনির্ভর কৌশল সাময়িকভাবে ফলদায়ী এবং কার্যকর হলেও সেটি দীর্ঘ সময় ধরে অনুসরণ করা উচিত নয়। তাঁর মতে, বিদেশি ভোক্তাদের চাহিদা মেটাতে ব্যস্ত রপ্তানিকারক দেশগুলোতে অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও ভোগের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি উপেক্ষা করা হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক শক্ত অবস্থানে থাকার জন্য এসব দেশ রপ্তানি খাতের ওপর সম্পূর্ণ গুরুত্ব আরোপ করলেও অভ্যন্তরীণ পণ্য ও সেবা খাতে বহু দুর্বলতা পুঞ্জীভূত হতে থাকে। রাজন জাপান ও জার্মানির উদাহরণ টেনেছেন এ প্রসঙ্গে। তিনি উল্লেখ করেছেন যে ক্যানন, টয়োটা বা স্যামসাংয়ের মতো বড় জাপানি কোম্পানিগুলো বিশ্ববাজারের বিরাট অংশ দখল করতে পারলেও দেশটি অন্যান্য সেবা খাতে অদক্ষ রয়ে গেছে। যেমন জাপানের কোনো ব্যাংক এইচএসবিসির মতো, কোনো সুপার স্টোর ওয়ালমার্টের মতো কিংবা কোনো রেস্তোরাঁ ম্যাকডোনাল্ডসের মতো প্রতিষ্ঠা পায়নি। চীনের বর্তমান আগ্রাসী রপ্তানিনীতির ভবিষ্যৎ বিপদ সম্পর্কেও সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন তিনি। রঘুরাম রাজন তৃতীয় ফাটলটি আবিষ্কার করেন শিল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঋণ গ্রহণের প্রবণতার ভেতর। ১৯৯০ সালের পূর্ব এশীয় সংকটের উদাহরণ দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন যে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের জন্য উন্নত দেশ থেকে ঋণ গ্রহণ কীভাবে অর্থনীতির জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করে। বিদেশি ঋণদাতারা তাদের ঋণকে সুরক্ষিত করার জন্য স্বল্পমেয়াদি ঋণ মঞ্জুর করে, যাতে দ্রুত তাদের লগ্নি ফিরিয়ে নেওয়া যায়, ঋণ শোধের শর্তও থাকে বিদেশি মুদ্রায়, যাতে গ্রহীতা দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন বা মুদ্রাস্ফীতির কারণে পরিশোধযোগ্য ঋণ কমে না যায় এবং ঋণ ছাড় করানোর ব্যবস্থা হয় স্থানীয় কোনো ব্যাংকের মাধ্যমে, যাতে পরিশোধে ব্যর্থতার কোনো সম্ভাবনা থাকলে সেটা সরকারি নিশ্চয়তার চাদরে ঢাকা থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের বেকারত্ব মোচনের প্রয়াসের মধ্যে চতুর্থ ফাটলটি আবিষ্কার করেছেন রাজন। তাঁর মতে, স্বল্পমেয়াদি বেকার ভাতা ও স্বাস্থ্যসেবার উচ্চ খরচ সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি দুর্বলতর করে তোলে। আমেরিকার সরকারি বিনিয়োগ যথেষ্ট না হওয়ায় বেকারত্ব মোচনের জন্য অর্থনৈতিক প্রণোদনার বিষয়টিকে মুদ্রানীতির সঙ্গে সম্পর্কিত করার মাধ্যমে এই ফাটল তৈরি হয়। রাজন তাঁর বইতে এসব আর্থিক বিপর্যয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং নীতিনির্ধারকদের নেতিবাচক ভূমিকার কথাও তুলে ধরেছেন। বইটির ভূমিকার একাধিক জায়গায় তিনি রাজনীতির দায়দায়িত্বের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, খুব মারাত্মক কিছু ফাটলের দায়ভার অর্থনীতিতে নয়, রাজনীতির মধ্যে নিহিত।
তাঁর মতে, রাজনীতিবিদেরা সেসব উপেক্ষা করেই যাবেন কিংবা নেহাত এড়াতে না পারলে কাউকে বলির পাঁঠা বানাবেন। তিনি মনে করেন, এই উপেক্ষার কারণ এই নয় যে এসব পরিবর্তন করা কঠিন। কারণ এ-ও যে এসব ফাটলের কিছু কিছু রাজনীতিবিদের মাধ্যমেও বিস্তৃত হয়। আরেক জায়গায় তিনি আরও স্পষ্টভাবে লিখেছেন, প্রায় সব আর্থিক সংকটের রয়েছে রাজনৈতিক উৎস, যদিও তা ক্ষেত্রবিশেষে আলাদা হয় এবং এসব উত্তরণেও দরকার হয় শক্ত রাজনৈতিক শক্তি। রঘুরাম রাজন তাঁর উপেক্ষিত ভবিষ্যদ্বাণীর কথা উল্লেখ করে নিজেকে গ্রিক পুরাণের ক্যাসেন্ড্রার সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাঁর আবিষ্কৃত এসব ফাটল আরও বিস্তৃত হয়ে আবার কোন বিপর্যয় ঘটাবে, তার আশঙ্কা আমাদের অর্থ খাতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঘটে যাওয়া কিছু দুর্ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ২০১০-এর শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, তারপর হল-মার্ক এবং সর্বশেষ বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি—এই সবকিছুই ছিল রাজনৈতিক প্রভাবপুষ্ট কিংবা রাজনীতি-সুরক্ষিত। সর্বশেষ বেসিক ব্যাংকে ঋণ বিতরণের নামে যে নির্লজ্জ লুণ্ঠন চলেছে, সে বিষয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ভয়ংকর যেসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তার পরও কারও কোনো টনক না নড়া এবং শেষে কেবল দু-একজনকে বলির পাঁঠা বানানোর ঘটনার মতো রাজনৈতিক পদক্ষেপের কথা রঘুরাম রাজনের বইতে স্পষ্ট উল্লেখ আছে। এর আগের ঘটনাগুলোতেও এ রকম রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বা প্রভাবের প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছিল। পরিতাপের বিষয়, আমরা বা আমাদের রাজনীতিবিদেরা কখনোই শিক্ষা গ্রহণ করি না। রাজনের ভবিষ্যদ্বাণী যেমন উপেক্ষা করেছিলেন নীতিনির্ধারক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব, আমাদের দেশেও ঠিক সেটাই ঘটে সব সময়। এই নিবন্ধ কিংবা রাজনের গ্রন্থ—কোনো কিছু থেকেই কেউ শিক্ষা গ্রহণ করবে না। আর তাই একের পর এক এজাতীয় ঘটনা ঘটতেই থাকে, যার কোনো প্রতিবিধান আমরা আজ অবধি দেখতে পাইনি। এবং তার প্রধানতম কারণ রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার৷
fmainuddin@hotmail.com
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার৷
fmainuddin@hotmail.com
No comments