পথে বিস্তর ভোগান্তি তবু ঘরে ফেরার আনন্দ
ঈদে সীমাহীন ভোগান্তি ও ঝুঁকির মধ্যে গন্তব্যে গেছেন শেষ সময়ের যাত্রীরা। শিল্প-কারখানা ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ঈদের আগে শেষ কর্মদিবস শেষে রোববার বাস, ট্রেন ও লঞ্চ টার্মিনালে জনসে াত নামে। কাক্সিক্ষত যানবাহন না পাওয়া, যানজটসহ নানা ভোগান্তির শিকার হন এসব ঘরমুখো মানুষ। ঢাকায় বাস ও ট্রেনের সিডিউলে বিপর্যয় নেমে আসে। একই সঙ্গে দেখা দেয় পরিবহন সংকট। কাক্সিক্ষত যানবাহন পেতে যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। বাধ্য হয়ে অসংখ্য মানুষ বৃষ্টি মৌসুমে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাস, ট্রেন ও লঞ্চের ছাদে চড়ে হাজার হাজার মানুষ ঢাকা ছেড়েছেন। কেউ কেউ বেছে নিয়েছেন বিকল্প পথ। অপরদিকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন নৌপথের যাত্রীদের। পথিমধ্যে যাত্রীবোঝাই একটি লঞ্চের তলা ফেটে গেলেও অল্পের জন্য দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন প্রায় আড়াই হাজার যাত্রী। অপর এক লঞ্চের ইঞ্জিন মাঝপথে নষ্ট হয়ে ঝুঁকিতে পড়েন যাত্রীরা। ঢাকার বাস, ট্রেন ও লঞ্চ টার্মিনাল ঘুরে জনভোগান্তির নানা চিত্র দেখা গেছে। ঈদে বিপুলসংখ্যক মানুষ বিভিন্ন গন্তব্যে চলে যাওয়ায় ফাঁকা হতে শুরু করেছে ঢাকা।
পরিবহন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, রাতে বৃষ্টির কারণে শ্লথগতিতে বাস চলেছে। অনেক স্থানে দেখা দিয়েছে যানজট। এ কারণে অনেক বাস নির্ধারিত সময়ে ঢাকায় ঢুকতে পারেনি। এসব কারণে গণপরিবহনের সিডিউল ভেঙে পড়েছে। এছাড়া পোশাক ও শিল্প-কারখানা এবং সরকারি-বেসরকারি অফিস রোববার একযোগে বন্ধ হওয়ার পর যাত্রীদের ঢল নামে। এত সংখ্যক যাত্রী একই সঙ্গে সুষ্ঠুভাবে পরিবহনের সামর্থ্য গণপরিবহনের নেই। এ কারণেই ভোগান্তির শিকার যাত্রীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। ক্ষুব্ধ যাত্রীরা ৫-৭টি লঞ্চে হামলা চালিয়ে ভাংচুর করেছে। মারধর করেছে বাস শ্রমিকদের।
রাজধানীর বাস, ট্রেন ও লঞ্চ টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে, ঈদের আনন্দ প্রিয়জনের সঙ্গে উপভোগ করতে শেষ মুহুর্তের বাড়ি ফেরা মানুষের ঢল নেমেছে। সব দুর্ভোগ-বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে শিকড়ের টানে ছুটছেন তারা। হাত-কাঁধে ব্যাগ-লাগেজ নিয়ে কাক্সিক্ষত যানে ওঠার প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা। কেউ সফল হয়েছেন, আবার অনেকেই বিফল। ঈদযাত্রীদের পদচারণায় টার্মিনালগুলোর কোথাও যেন একটু ফাঁকা নেই। সর্বত্র টুইটম্বুর। যে যেভাবে সুযোগ পেয়েছেন সেভাবে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাস ও লঞ্চের মালিক-শ্রমিকরা বাড়তি ভাড়া নেয়ার প্রতিযোগিতায় নামেন। অতিরিক্ত আয়ের আশায় ঝুঁকি নিয়ে ছাদে যাত্রী বহন করেছেন। যাত্রীদের অভিযোগ, ভিড়ের মাঝে পকেটমার, লাগেজ পার্টির তৎপরতা বেড়ে গেছে। অনেকেই মোবাইল, মানিব্যাগ ও ব্যাগ খুইয়েছেন।
বাসের সিডিউল বিপর্যয় : যাত্রীর চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে পড়ে বাসের নির্ধারিত সিডিউল। রোববার বেশির ভাগ বাস নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ১ থেকে ৫ ঘণ্টা পর্যন্ত দেরিতে ছেড়ে গেছে। বাস কাউন্টারগুলোতে শত শত মানুষের দীর্ঘ অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। বিশেষ করে শিশু ও নারীরা বেশি সমস্যায় পড়েন। বাসের সিডিউল ভেঙে পড়ার কারণ জানতে চাইলে পরিবহন শ্রমিকরা জানান, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ায় ফেরি রুটে শনিবার রাতে বৈরী আবহাওয়ার কারণে ফেরির চলাচলে সমস্যা হয়। বাস পারাপারে অতিরিক্ত সময় লাগছে। এসব কারণ ছাড়াও পথে যানজটের কারণে নির্ধারিত সময়ে ঢাকায় বাস ঢুকতে পারছে না। বরিশালগামী যাত্রী ওহিদুজ্জামান জানান, সাকুরা পরিবহনের বাস ৭টায় ছাড়ার কথা থাকলেও ১০টা পর্যন্ত ওই গাড়ি গাবতলী আসেনি। সিলেটগামী যাত্রী মোঃ হাবিবুর রহমান জানান, সোহাগ পরিবহনের টিকিট আগে সংগ্রহ করেছেন। সকাল ৭টার গাড়ি ১০টা পর্যন্ত কাউন্টারে আসেনি। কখন গাড়িটি ছেড়ে যাবে তা তিনি জানেন না।
বাস-ট্রাকের ছাদে চড়ে বাড়ি ফেরা : রাজধানী থেকে বিভিন্ন দূরপাল্লার রুটে বাসের ছাদ ও ট্রাকে চড়ে গন্তব্যে গেছেন অনেক যাত্রী। আগাম টিকিট সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হওয়া এবং নিু আয়ের মানুষ মূলত এসব যানবাহনে চড়েছেন। ঢাকা থেকে রাজশাহী, সৈয়দপুর, দিনাজপুর, রংপুর, দাউদকান্দি, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর, নরসিংদীসহ বিভিন্ন রুটের বাসের ভেতর দাঁড়িয়ে ও ছাদে চড়ে যেতে দেখা গেছে। গাড়ির নির্ধারিত সিটের বাইরে হাঁটার পথে মোড়া ও ইঞ্জিন কভারের ওপর যাত্রী নেয়া হয়েছে। নিু আয়ের মানুষরা জানান, জীবনের ঝুঁকি জেনেও কম ভাড়ায় গন্তব্যে যাচ্ছেন তারা।
এদিকে ঈদে যাত্রীদের চাপ বেড়ে যাওয়ায় বাস মালিকরা ঢাকার ভেতরে চলাচলকারী সিটি সার্ভিস ও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলাচল করে এমন বাস ঢাকা থেকে দূরপাল্লার রুটে যাত্রী নিয়ে গেছে। এসব বাস পথিমধ্যে নষ্ট হয়ে সড়কে যানজটের সৃষ্টি করে- পুলিশের কাছে এমন তথ্য থাকা সত্ত্বেও চলাচলের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে সায়েদাবাদ থেকে কিশোরগঞ্জ, ভৈরব, দাউদকান্দি, মহাখালী থেকে ময়মনসিংহ, জামালপুর, গাবতলী থেকে পাবনা, রাজশাহীসহ বেশ কিছু রুটে পুরনো ভাঙাচোরা বাস ছেড়ে গেছে।
নৌপথে ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা : বৃষ্টি মৌসুমে নদী উত্তাল, বেড়েছে পানিপ্রবাহ। এ পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে ঢাকা ছেড়েছে ৪১ রুটের লঞ্চ। প্রতিটি লঞ্চের ছাদে বহন করা হয়েছে। নদীর মাঝপথে নৌকা থেকে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় যাত্রী তোলা হয়েছে। রোববার ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া সুন্দরবন, সুরভী, কীর্তনখোলা, দ্বীপরাজ, পারাবতসহ অন্য সবগুলো লঞ্চই ছাদে যাত্রী নিয়ে গেছে। নৌপথে দক্ষিণাঞ্চলগামী যাত্রীদের যাওয়ার অন্যতম স্থান ঢাকা নদীবন্দরে (সদরঘাট) সকাল থেকে মানুষের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে। পন্টুনে আসামাত্রই লঞ্চগুলোতে মানুষ হুমড়ি খেয়ে যাত্রীদের উঠতে দেখা যায়। অল্পসংখ্যক লোক কেবিন ও সোফার আগাম টিকিট সংগ্রহ করতে পেরেছেন। এর বাইরে বিশালসংখ্যক যাত্রী লঞ্চের পাটাতনে (ডেকে) আসন পেতে যাওয়ার চেষ্টা করেন। যারা ডেকে জায়গা পাননি তারা লঞ্চের ছাদে চড়েই গন্তব্যে রওনা হন। সদরঘাট ঘুরে দেখা গেছে, দুপুর থেকেই বেশির ভাগ লঞ্চ যাত্রীতে টইটম্বুর। কোথাও যাত্রীদের বসার জায়গা নেই। এমনকি কেবিনের সামনের রাস্তায় মানুষ বসে আছে। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে অনেকে। তবুও আরও বেশি যাত্রী নেয়ার আশায় এসব লঞ্চ ছাড়েননি মালিকরা। এ নিয়ে অনেক যাত্রী প্রতিবাদ ও হৈচৈ করলে লঞ্চের কর্মচারী ও ঘাট শ্রমিকরা তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে চুপ থাকতে বাধ্য করছে। এসব ঘটনায় ক্ষুব্ধ যাত্রীরা ৫-৭টি লঞ্চে হামলা চালিয়ে ভাংচুর করে। অতিরিক্ত পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। লঞ্চ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ নৌচলাচল সংস্থার সভাপতি মাহবুব উদ্দিন বীরবিক্রম বলেন, গার্মেন্টের কিছু উৎচ্ছৃখল শ্রমিক তাড়াতাড়ি লঞ্চ ছাড়তে বাধ্য করার কৌশল হিসেবে হামলা চালিয়েছে।
বিকল্প পথে বাড়ি ফেরা : গণপরিবহনের সঙ্কট থাকায় বিকল্প পথে গন্তব্যে গেছেন অনেকে। মাইক্রোবাস, ট্যাক্সিক্যাব ও লোকাল বাস রিজার্ভ করে গেছেন অনেকেই। আবার কেউ কেউ ব্যক্তিগত গাড়িতে বাড়ি গেছেন।
No comments