গাজাজুড়েই ধ্বংসস্তূপ
গাজায় ইসরায়েলি হামলা বন্ধের দাবিতে গতকাল হংকংয়ে বিক্ষোভ। ছবি: এএফপি |
ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে গাজা ভূখণ্ড। ইসরায়েলের স্থল অভিযান শুরুর পর ট্যাংকের গোলার পাশাপাশি যুদ্ধবিমান থেকে যে পরিমাণ বোমা ফেলা হয়, তাতে গাজার অনেক ভবন যে নিশ্চিহ্ন হবে, সেটা অনুমেয়ই ছিল। কিন্তু গত শনিবার যুদ্ধবিরতির সময় গাজায় যে ধ্বংসের চিহ্ন দেখা গেল, তাতে স্তম্ভিত গাজাবাসী। খবর ওয়াশিংটন পোস্টের। ১২ ঘণ্টার ওই যুদ্ধবিরতির সময় গাজাবাসীর সামনে স্পষ্ট হয় ইসরায়েলি ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন। ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রা দেখে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তাঁরা। নারীরা বিলাপ করছেন না। পুরুষেরা যেন স্তব্ধ হয়ে গেছেন। সামনে শুধুই ধ্বংসস্তূপ। ভাঙা দেয়াল, খোলা ইট, কংক্রিট, রড বেরিয়ে আছে কোথাও কোথাও। ভাঙা দেয়ালে বুলেট বা গোলার চিহ্ন স্পষ্ট। কোনো কোনো ধ্বংসস্তূপে তখনো ট্যাংকের গোলা বা বোমার আগুন জ্বলছে। প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিরা বলছেন, ১২ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতির আগের ২৪ বা ৪৮ ঘণ্টা ইসরায়েলি গোলা-বোমার নৃশংসতার চিহ্ন বহন করছে এই ধ্বংসস্তূপ। কূটনীতিকেরা যখন একটি মানবিক যুদ্ধবিরতির জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন ইসরায়েল ভয়াবহ এই ধ্বংসযজ্ঞে মেতে ওঠে। গাজার পূর্বাঞ্চলের শাজাইয়া শহরের বাসিন্দা রাফেত সুকার তাঁর বিধ্বস্ত বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, এখানে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়ে গেছে। হামলায় রাফেত সুকারের বাড়ির পেছনের অর্ধেক অংশ মাটিতে মিশে গেছে। রাফেত সুকারের ভাই রামি সুকার বলেন, ‘ইসরায়েলি বর্বরতার এই চিত্র দেখে এখন মনে হচ্ছে, এই হামলার পরও আমরা আসলে অলৌকিকভাবে বেঁচে আছি।’ আসলে গাজায় এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে হামলায় চালায়নি ইসরায়েল। আগের দিনও যেখানে চারতলা ভবন দাঁড়িয়ে ছিল, পরদিন সেখানে ধ্বংসস্তূপ। মসজিদের মিনারগুলো ধ্বংস করা হয়েছে।
অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল সাক্ষী হয়ে আছে বেপরোয়া ইসরায়েলি হামলার। জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রণে থাকা আশ্রয়শিবির ও হাসপাতালেও বেশ কিছু হামলার ঘটনা ঘটেছে। পানির পাম্প স্টেশনে চালানো হামলায় মেশিনগুলো বিকল হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ স্টেশনেও হামলা চালানো হয়েছে। অদূরে রাস্তায় বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে গেছে এবং তার ছিঁড়ে পড়ে আছে। যুদ্ধবিরতির সময়ে উদ্ধারকাজ শুরু করেন গাজার জরুরি বিভাগের কর্মীরা। হতাহত ব্যক্তিদের উদ্ধারে সাইরেন বাজিয়ে চলছে অ্যাম্বুলেন্স। তবে ধ্বংসস্তূপের কারণে কোথাও কোথাও আটকা পড়ছে। বুলডোজার দিয়ে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য পথ তৈরি করা হচ্ছে। বাড়িঘরের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে নিহত তো বটেই, আহত অনেকেও আটকা পড়ে আছেন। জরুরি বিভাগের কর্মী ইউসুফ আবিদ আল-হামিদ বলেন, ‘হতাহত ব্যক্তিদের বের করে আনতে ১২ ঘণ্টারও বেশি সময় লাগবে। এ কাজের জন্য আমাদের ভারী যন্ত্রপাতি দরকার। খালি হাতে আমরা কিছুই করতে পারব না।’ ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা থেকে রেহাই পায়নি গৃহপালিত প্রাণীও। গাজার বিভিন্ন মাঠ, খামার ও বাড়িতে গরু, ঘোড়া ও গাধা মরে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। মেষের খামারেও গোলা ছোড়া হয়েছে। গাজার উত্তরাঞ্চলে বেইত হানুন এলাকায় ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গে লড়াই হয়েছে গাজা ভূখণ্ডের ক্ষমতায় থাকা কট্টরপন্থী ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসের যোদ্ধাদের। সেখানে কোনো কোনো জায়গায় বুলেটের চিহ্ন ও রক্তের দাগ দেখা যায়। কোথাও কোথাও পড়ে আছে ব্যান্ডেজের সাদা কাপড়। বেইত হানুনের বাসিন্দা জুহায়ের হামাদ ১৭ দিন পর নিজের বাড়ির সামনে গিয়ে দেখেন, তা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ‘বাচ্চাদের জন্য কিছু কাপড় নিতে এসেছিলাম। ধ্বংসস্তূপের নিচে সবকিছু চাপা পড়ে গেছে।’ বলছিলেন জুহায়ের হামাদ। এখানে চারতলা একটি ভবনে চার ভাইসহ পরিবার নিয়ে থাকতেন মোহাম্মদ হেলু। তিনি বলেন, ‘এই ভবন তৈরি করতে ২০ বছর পরিশ্রম করেছি। এখন সবকিছু শেষ হয়ে গেল।’
No comments