জাতীয় পার্টি সরকারের অংশ -বৃটিশ সরকারের মূল্যায়ন
বাংলাদেশে
জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাসহ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো
দুর্বল। সরকারিভাবে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি হলেও তারা ক্ষমতাসীন সরকারের
অংশ। এমনকি তারা মন্ত্রিত্বও পেয়েছে। এখানে ন্যায়বিচার পাওয়া কঠিন হতে
পারে। মিডিয়া, সুশীল সমাজ ও দাতা সম্প্রদায় সোচ্চার থাকার পরও ঘুষ ও
দুর্নীতি ব্যাপক। দেশীয় আইনের অধীনে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের যেসব
চুক্তিতে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে তা বাস্তবায়ন ও প্রয়োগ দুর্বল। বিচার
বহির্ভূত হত্যাকা-, শারীরিক নির্যাতন, দুর্নীতির অভিযোগ আছে আইন প্রয়োগকারী
সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে। এদেশে মৃত্যুদ-ের সাজা বহাল রয়েছে। বাংলাদেশ নিয়ে
এক প্রতিবেদনে এ কথা বলেছে বৃটিশ সরকার। বাংলাদেশে ব্যবসা করতে আসা
যুক্তরাজ্যের কোম্পানি বা ব্যবসায়ীরা নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক যে সব ঝুঁকির
মুখে পড়তে পারেন সে বিষয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এর শিরোনাম
‘ওভারসিজ বিজনেস রিস্ক- বাংলাদেশ’। এতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক,
মানবাধিকার, ঘুষ-দুর্নীতি, সন্ত্রাসী হুমকি, সংগঠিত সন্ত্রাস সহ বিভিন্ন
ইস্যু তুলে যুক্তরাজ্যের ব্যবসায়ীদের সতর্ক করা হয়েছে। ওই রিপোর্টে বলা
হয়েছে, এক সময় বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তানের অংশ। ১৯৭১ সালের রক্তাক্ত
স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয় এ দেশটি। এটি একটি সংসদীয়
গণতন্ত্রের দেশ। এখানে রয়েছে মুক্তবাজার অর্থনীতি। প্রধান দু’টি রাজনৈতিক
দল আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) স্থানীয় রাজনীতিতে
প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। কিন্তু এ দল দু’টির মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত
নাজুক। রাজনৈতিক অবস্থা এখনও সংঘাতময় ও তা কেন্দ্রনির্ভর। প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনার অধীনে ক্ষমতায় বর্তমান সরকার। তার নেতৃত্বাধীন মহাদলীয় জোট এ
বছরের ৫ই জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় অর্জন করে, যদিও বিএনপি ওই
নির্বাচন বর্জন করে। তাই জাতীয় সংসদের অর্ধেকের বেশি আসনে প্রার্থী
নির্বাচিত হন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। বিরোধী দলগুলো এ নির্বাচন চেয়েছিল
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। সরকার সংবিধান সংশোধন করেছে। এ
পদক্ষেপ বিতর্কিত। এ সংশোধনীর মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচন তদারকের জন্য
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। ফলে বিএনপির বর্জনের মধ্য দিয়ে
জাতীয় পার্টি এখন সরকারিভাবে বিরোধী দল। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়,
ইন্টারন্যাশনাল কোভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস, দ্য
ইন্টারন্যাশনাল কোভেন্যান্ট অন ইকোনমিক, সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল রাইটস,
কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব দ্য চাইল্ড সহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মূল
কতগুলো চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশ বাংলাদেশ। কিন্তু দেশীয় আইনে এর
বাস্তবায়ন ও প্রয়োগ দুর্বল। এ দেশে ট্রেড ইউনিয়ন আছে। কিন্তু তাতে রয়েছে
অনেকগুলো বিধিনিষেধ ও হয়রানির অভিযোগ। ২০০৬ সালের শ্রম আইনের অধীনে শিশু
শ্রম নিষিদ্ধ। তা সত্ত্বেও এ বিষয়টি রয়েছে গুরুতর উদ্বেগজনক অবস্থায়। ওই
রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ভাল। জুনে সমাপ্ত
অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল শতকরা ৬ ভাগের কম। গত ১৫ বছরে গড় প্রবৃদ্ধি ৫ থেকে ৬
ভাগ প্রতি বছর। বাংলাদেশ তৈরী পোশাক খাতে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।
রপ্তানি আয়ের শতকরা ৮০ ভাগ আসে এ খাত থেকে। এ থেকে যে অর্থ আসে তা জাতীয়
প্রবৃদ্ধির শতকরা ১২ ভাগ। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পরও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে
তৈরী পোশাকের রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ১৫ ভাগ। এ খাতটিকে আরও
সম্প্রসারিত করা উচিত। পশ্চিমা সরকার ও বিনিয়োগকারীদের চাপ ও সমর্থনে সরকার
শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতির চেষ্টা করছে। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, ২০০৫
সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্য ছিল শতকরা ৪০ ভাগ। তা ২০১৪ সালে কমে এসে
দাঁড়িয়েছে শতকরা ৩০ ভাগ। ২০০৯ সাল থেকে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমেছে
এক-পঞ্চমাংশ। তাদের সংখ্যা ৩ কোটি ৯০ লাখ। এর মধ্যে অতি দরিদ্রের সংখ্যা এক
কোটি ৬০ লাখের বেশি। সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে একই ধারায়
এগিয়ে যাচ্ছে। এর অনেক মানদ- ভারতের চেয়েও ভাল। তবে বেসরকারি খাতে কার্যকর
উন্নয়নে একটি বাধা হলো দুর্নীতি। এ ঘটনা ব্যবসায় বড় একটি ঝুঁকি। কেনাবেচার
ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময়ই থাকে স্বচ্ছতার অভাব। রয়েছে প্রশাসনিক বেশ কিছু
জটিলতা। এ ঝুঁকিকে সতর্কতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। রাজনীতিবিদ, আমলা ও
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা মাঝেমাঝেই খেয়ালখুশি মতো ক্ষমতা
ব্যবহার করেন। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ক্ষমতার অপব্যবহারের বিষয়টি প্রকাশ
হয়ে পড়েছে। ২০১৩ সালের ওপর প্রণীত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের করাপশন
পারসেপশন্স ইনডেক্সে ১৭৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৬তম। ২০১২
সালে ছিল ১৪৪তম অবস্থানে। ২০১১ সালে ছিল ১২০তম অবস্থানে। ২০১৪ সালের ওপর
বিশ্ব ব্যাংক ‘ইজি অব ডুইং বিজনেস’ সার্ভেতে দেখা যায় ১৮৯টি দেশের মধ্যে
বাংলাদেশের অবস্থান ১৩০তম। আগের দু’বছর থেকে এ পরিবর্তন সামান্যই। আগের
দু’বছরে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৩২ ও ১২৯। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে
যুক্তরাজ্যের ব্যবসায়ীদের সতর্ক করা হয়েছে। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়,
বাংলাদেশে অন্যান্য ঝুঁকির সঙ্গে রয়েছে সন্ত্রাস, যদিও ২০০৫ সাল থেকে
উল্লেখ করার মতো কোন সন্ত্রাসী হামলা হয়নি। সন্ত্রাসীদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র
দল ও গোষ্ঠী দেশের ভিতরে তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। অভিবাসী ও বিদেশীরা যেসব
স্থানে চলাফেরা করেন সেখানে হামলা হতে পারে। তাই সতর্কতার পরামর্শ দেয়া
হয়েছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য বাংলাদেশ। ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল
প্রপার্টি অর্গানাইজেশনেরও (আইপিআর) সদস্য এ দেশ। একই সঙ্গে প্যারিস
কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী। তবে আইপিআর বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ সরকার সম্পদ
বরাদ্দ করেছে নামমাত্র এবং আইন বাস্তবায়নের সক্ষমতা খুবই দুর্বল। বই,
শিক্ষাবোর্ডের বইপত্র ব্যাপকভাবে নকল করা হয় ও তা নির্ধারিত দামে বিক্রি
করা হয়। স্বত্ব আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে তাই বৃটিশ প্রকাশকদের ঝুঁকির বিষয়ে
সতর্ক হতে হবে। ওদিকে বিদেশী ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোতে সংগঠিত অপরাধের
প্রভাব বা জড়িত হওয়ার প্রমাণ পায়নি যুক্তরাজ্য। বলা হয়েছে, অনেক দেশ ও
উন্নয়নশীল বিশ্বের বড় বড় শহরের তুলনায় বাংলাদেশের রাজধানী দ্রুত বর্ধনশীল।
ওই সব দেশ ও শহরের চেয়ে এই ঢাকা নিরাপদ। বেশির ভাগ অপরাধ হয় সম্পত্তি নিয়ে,
সুবিধা পাওয়া নিয়ে। এগুলো প্রতিরোধ করা যায় শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন পদক্ষেপের
মাধ্যমে। এছাড়া রয়েছে চুরি, ডাকাতির মতো ঘটনা। গুলশান, বনানী এলাকায় রয়েছে
চুরি ডাকাতির ঘটনা। এই এলাকাগুলোতে থাকেন বিদেশীরা। আছেন বাংলাদেশীরাও।
মাঝে মাঝেই এখানে ছিনতাই হয়। তাই কোন বৃটিশের উচিত হবে না বেশি অর্থ সঙ্গে
রাখা অথবা স্বর্ণালঙ্কার প্রদর্শন করা। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক
বিমানবন্দর থেকে তাদের উচিত সিএনজিচালিত বেবিট্যাক্সি, বেসরকারি ট্যাক্সিতে
নিরাপদে সফর করতে। এছাড়া যে হোটেলে উঠবেন সে হোটেলের পরিবহন ব্যবস্থা
ব্যবহার করা উচিত।
No comments