বিএনপি কি রাজনীতির মূল মঞ্চে ফিরতে পারবে? by এম. আবদুল হাফিজ
দেশের রাজনীতিতে এক সময়ের চমক সৃষ্টিকারী বিএনপি এখন আর তার আগের অবস্থানে নেই। দলটি এখন বড়জোর একটি বড় রাজনৈতিক সংগঠন। এখন তার আর অন্য কোনো পরিচিতি নেই- না সরকারে, না বিরোধী দলে। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, বিএনপি কি আবার জাতীয় রাজনীতিতে তার গৌরবের স্থানটি পুনরুদ্ধার করতে পারবে? অনেকে ঢালাওভাবে বলে থাকেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপির আজকের এ দুরবস্থা হতো না। কথাটি বিতর্ক সাপেক্ষ। ক্ষমতাসীনদের দুরভিসন্ধিমূলক নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপি হয়তো বেশ কিছু আসনে জয়লাভ করত। কিন্তু সরকার গঠনের মতো আসন সংখ্যা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটই পেত। কারণ আওয়ামী লীগকে জেতানোর পরিকল্পনা নিয়েই সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করা হয়েছিল। ক্ষমতাসীন সরকারের হাতে নির্বাচন পরিচালনার ক্ষমতা এবং একটি আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন গঠন- এসবই একটি পকিল্পিত ছকেই সম্পন্ন হয়েছিল। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, যার জন্য আওয়ামী এক সময় প্রাণপাত করেছিল, ইতিমধ্যেই তার অপমৃত্যু ঘটেছিল।
এ প্রেক্ষাপটে আপসহীন বলে পরিচিত বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া তার তত্ত্বাবধায়কের দাবিতে অনড় থেকে নির্বাচনে গেলেন না। গেলে কী হতো এবং না গিয়ে কী হয়েছে, সেসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে এবং তার নির্বাচনে না যাওয়ার কী খেসারত দিচ্ছে বিএনপি, তা তো দেশবাসীই দেখছে। মামলা-মোকদ্দমায় ফেঁসে থাকা দলের শত শত নেতাকর্মী গ্রেফতার ও নির্যাতনের ভয়ে যেখানে প্রকাশ্যেই আসতে পারছেন না, সেখানে আপসহীন নেত্রীর আন্দোলনের হুংকার হয়তো হাস্যকর মনে হবে। তবে আমার বিশ্বাস, গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেয়ার একটি অদৃশ্য চালিকাশক্তি আছে। তা না হলে আড়াই হাজার বছর ধরে নানা প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে লড়াই করে গণতন্ত্র কীভাবে আজও টিকে আছে? এই বাংলাদেশেই আগেও গণতন্ত্রে পচন ধরেছিল এবং জাতির জনককে তা পরিহার করে উদ্ভট মতবাদের এক একদলীয় বাকশাল প্রবর্তন করতে হয়েছিল। শাসন কাজে অনভিজ্ঞ বঙ্গবন্ধু কোনো কূলকিনারা না করতে পেরে ক্ষমতার কর্তৃত্বকে কুক্ষিগত করতেই বাকশালের পথে পা বাড়িয়েছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। তার পরিণতি আমরা সবাই জানি।
আজকের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী আওয়ামী লীগের অবস্থা পঁচাত্তরের ট্রাজেডির পর ছিল আরও করুণ। বঙ্গবন্ধুর জীবিত দুই কন্যা তখন ভারতের আশ্রয়ে। সত্তরের নির্বাচনে নির্বাচিত এবং তেহাত্তরের নির্বাচনে পুনর্নির্বাচিত অনেক জাঁদরেল নেতা তখন অবশিষ্ট থাকলেও পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের গোলকধাঁধা কেটে গেলে এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনর্বহাল হলে আলোচ্য আওয়ামী লীগ নেতারা পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে খাপ খাওয়াতে অক্ষমতা দেখিয়েছেন; উপরন্তু তখন তারা আন্তঃউপদলীয় কোন্দলে লিপ্ত। প্রায় আধা ডজন আওয়ামী লীগ নেতার নামের ব্র্যাকেটবন্দি উপদলগুলো রাজনীতি নয়, কাদা ছোড়াছুড়িতেই তখন ব্যস্ত।
নব্বইয়ের দশকে দেশ সামরিক শাসনমুক্ত হওয়ার পর ক্ষমতাসীন অধিক আÍবিশ্বাসী খালেদা জিয়া যখন রাজনীতির অঙ্গনে কিছু ভুল পদক্ষেপ নিতে শুরু করেন, শুধু তখনই ক্ষমতার দরদালান থেকে নির্বাসিত আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ২১ বছর পর প্রকাশ্য জনসভায় সদাচরণের কিরা-কসম খেয়ে এরশাদের ওপর ভর দিয়ে কোনোমতে ক্ষমতায় ফেরে।
পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার ঐতিহাসিক আনুগত্যের পর জিয়াউর রহমান যখন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন এবং সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহের লাগাম টেনে ধরেন, বঙ্গবন্ধুর প্রতাপশালী আওয়ামী লীগ তখন রাজনীতির এক প্রান্তিক অবস্থানে। এরপরই রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের গৌরবোজ্জ্বল আÍপ্রকাশ। বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা অক্ষুণ্ন রেখেই বলছি, জিয়ার মাত্র অল্প কবছরের নেতৃত্বে বাংলাদেশ তো বটেই, সারা মুসলিম বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে তাদের ভাগ্যাকাশে এক সোনালি অরুণোদয় দেখেছিল। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দৃশ্যপটে আবির্ভূত বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনের জনক এই নেতাকে আমি এর আগে আমার দুই দশকের চাকরি জীবনে দেখিনি। অথচ তিনি ছিলেন আমার নিজ জেলা বগুড়ার আমার গাবতলী থানারই সন্তান।
প্রশংসা ও প্রচারবিমুখ এ নেতাকে প্রথম দেখি যশোর সেনানিবাসে। সেনাসদরে এ স্পষ্টভাষী রাজনীতিবিমুখ মেজর জেনারেল জিয়া তখন তারই জুনিয়র মেজর জেনারেল শফিউল্লাহর অধীনে আর্মির ডেপুটি চিফ। সেনাবাহিনীর মূল স্রোত থেকে এ মেধাবী কর্মকর্তাকে সরিয়ে রাখতেই এ ব্যবস্থা। ডেপুটি চিফ হিসেবে তার দৃশ্যমান একটি কাজই দেখেছি- তা হল দেশের ক্যাডেট কলেজগুলোর তদারকি। সেই সুবাদেই তিনি তখন যশোর হয়ে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে যেতেন। ৫৫নং পদাতিক ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর আমি কখনও কখনও তাকে বিমানবন্দর থেকে সেনানিবাসে এনেছি।
একপর্যায়ে জিয়া যখন সেনাপ্রধান হলেন, দেশের ভবিষ্যৎ সেনাবাহিনীর রূপরেখা নিয়ে কম্বাইন্ড আর্মস স্কুলে (বর্তমানে বিলুপ্ত) তিনি একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। পাকিস্তানে বেশ কিছু জেনারেলের সান্নিধ্যে এসেছি, কিন্তু আমাকে স্বীকার করতেই হবে, জিয়া প্রদত্ত যশোরের ভাষণটি আমাকে মুগ্ধ করেছিল। তবু জিয়ার কঠোর প্রকৃতি, স্বল্পভাষী স্বভাব ও গাম্ভীর্য আমার কদাচিত ভালো লেগেছে। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তিনি আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে তার বৃহত্তর কর্মপরিসরে চলে গেলেন। মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক নেতৃত্ব না দিলেও তিনি আলবৎ জানতেন ভারতসহ প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কের স্পর্শকাতরতা, আন্তর্জাতিক রীতিনীতি এবং মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে আমাদের বিশেষ সম্পর্কের কথা।
সত্যি কথা বলতে কী, জিয়া শাসনের মেয়াদে একটি আধুনিক, সম্মুখ দৃষ্টি ও কর্মতৎপর বাংলাদেশের অবয়ব অস্তিত্বে আসতে থাকে। আওয়ামী লীগ তখনও রাজনৈতিকভাবে অগোছালো এবং পঁচাত্তরের জের ধরে বিমূঢ়। নানা স্তরে বিভক্ত জিয়া শাসনামলেই অস্তিত্বে এলো বিএনপি। অনেক আওয়ামী লীগ নেতা সে সময় বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন। আরও অধিক দলছুট আওয়ামীরা যোগ দিয়েছিলেন এরশাদের দলে। আমি নিশ্চিত, এ দেশে যদি আর নতুন কোনো ক্ষমতাসীন দলের উদ্ভব ঘটে, আওয়ামীরাই তার নেতানেত্রী ও কর্মীবাহিনীর জোগান দেবে।
রাজনীতিতে উত্থান-পতন আছে। এ দেশেও আমরা তা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সীমাবদ্ধ দেখেছি। আরেকটি অপ্রিয় সত্য এ দেশ সম্পর্কে প্রযোজ্য। ক্ষমতার পালাবদল এ দেশে কদাচিত মসৃণ হয়েছে। বৈধভাবে সাংবিধানিক পথেই ক্ষমতার মসনদে একবার আসীন হলে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার প্রতি আসক্তি এত বেড়ে যায় যে, তখন তাদের প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি ওঠে। এই ঝাঁকুনিটিই হল আন্দোলন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই সেটা করেছে। তবে এ কাজটিতে আওয়ামী লীগ অনেক বেশি পারদর্শী। ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর আমাদের অস্তিত্বের বেশির ভাগ সময় জুড়ে ছিল আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন, শিক্ষা-সংস্কৃতির আন্দোলন, ছয় দফার আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ। আন্দোলনের কলাকৌশল দলটির নখদর্পণে। অষ্টম সংসদের মেয়াদের গোটা সময় জুড়ে-এক-এগারো সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত- আওয়ামী আন্দোলনের মাঝে জীবনপণ আন্দোলনের নমুনা আমরা দেখেছি। তখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। এখন আওয়ামী লীগের মতো আন্দোলন গড়ে তোলা এবং তা প্রতিহত করার আওয়ামী শক্তির সামনে বিএনপির সরকার পতনের হুমকি একেবারেই শূন্যগর্ভ।
বিএনপি ও তার নেতৃত্বের রাজনীতি করার প্যাটার্ন সম্পূর্ণ আলাদা। আন্দোলন কোনো দিনই বিএনপির বৈশিষ্ট্যসূচক গুণ ছিল না, এখনও নেই। তাছাড়া অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের পর আওয়ামী লীগের শক্তি ও অভিজ্ঞতা বেড়েছে। তেমনিভাবে অনেক প্রতিকূলতা, দুর্বল নেতৃত্ব ও রাজশক্তির দাপটে বিএনপি আগের চেয়ে অনেক চুপসানো। তবে শেষমেশ এ দেশের রাজনীতিতে উভয় দলের টিকে থাকার স্বার্থে যৌক্তিক পথ অবলম্বন করতে হবে।
দুর্বলরা সব সময়ই অহেতুক উত্তেজনা ও আতংকে ভোগে। বিএনপিকে সেটা কাটিয়ে উঠতে অনেক কথাই বলতে হবে। কিন্তু উভয়ের মধ্যে সৃষ্ট সংকটের জট খোলার চাবিকাঠি আওয়ামী লীগের হাতে। একটি বিতর্কিত নির্বাচনে জিতে দলটির উচ্চাশা ও ক্ষমতার আসক্তি অনেক বেড়ে গেছে। তবে অগ্রজ রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে অবশ্যই বুঝতে হবে, এভাবে চিরদিন চলতে পারে না। এটা অবশ্যই গণতন্ত্র নয়। অথচ তার সাময়িক রাজনৈতিক বিপথগমন (Political aberration) বাদ দিলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আজীবন স্বপ্নই ছিল গণতন্ত্র। ভিন্নমত, ভিন্নপথ ও সেগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা তো গণতন্ত্রেরই দীক্ষা। তাই তার চর্চা এবং নির্বিঘ্ন ভোটাধিকার ক্ষমতাসীনদেরই নিশ্চিত করতে হবে।
আন্দোলন করে বিএনপি সরকারের পতন ঘটাবে এটি প্রলাপোক্তি। তাই বলে ক্ষমতাসীনরাও পরিতৃপ্ত হয়ে বসে থাকতে পারে না। রাজনৈতিক প্রলয় যদি একটা ঘটেই, উভয়ের কেউই তা থেকে অক্ষত থাকবে না।
এম আবদুল হাফিজ : রাজনীতি ও নিরাপত্তা বিশ্লষক
এ প্রেক্ষাপটে আপসহীন বলে পরিচিত বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া তার তত্ত্বাবধায়কের দাবিতে অনড় থেকে নির্বাচনে গেলেন না। গেলে কী হতো এবং না গিয়ে কী হয়েছে, সেসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে এবং তার নির্বাচনে না যাওয়ার কী খেসারত দিচ্ছে বিএনপি, তা তো দেশবাসীই দেখছে। মামলা-মোকদ্দমায় ফেঁসে থাকা দলের শত শত নেতাকর্মী গ্রেফতার ও নির্যাতনের ভয়ে যেখানে প্রকাশ্যেই আসতে পারছেন না, সেখানে আপসহীন নেত্রীর আন্দোলনের হুংকার হয়তো হাস্যকর মনে হবে। তবে আমার বিশ্বাস, গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেয়ার একটি অদৃশ্য চালিকাশক্তি আছে। তা না হলে আড়াই হাজার বছর ধরে নানা প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে লড়াই করে গণতন্ত্র কীভাবে আজও টিকে আছে? এই বাংলাদেশেই আগেও গণতন্ত্রে পচন ধরেছিল এবং জাতির জনককে তা পরিহার করে উদ্ভট মতবাদের এক একদলীয় বাকশাল প্রবর্তন করতে হয়েছিল। শাসন কাজে অনভিজ্ঞ বঙ্গবন্ধু কোনো কূলকিনারা না করতে পেরে ক্ষমতার কর্তৃত্বকে কুক্ষিগত করতেই বাকশালের পথে পা বাড়িয়েছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। তার পরিণতি আমরা সবাই জানি।
আজকের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী আওয়ামী লীগের অবস্থা পঁচাত্তরের ট্রাজেডির পর ছিল আরও করুণ। বঙ্গবন্ধুর জীবিত দুই কন্যা তখন ভারতের আশ্রয়ে। সত্তরের নির্বাচনে নির্বাচিত এবং তেহাত্তরের নির্বাচনে পুনর্নির্বাচিত অনেক জাঁদরেল নেতা তখন অবশিষ্ট থাকলেও পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের গোলকধাঁধা কেটে গেলে এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনর্বহাল হলে আলোচ্য আওয়ামী লীগ নেতারা পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে খাপ খাওয়াতে অক্ষমতা দেখিয়েছেন; উপরন্তু তখন তারা আন্তঃউপদলীয় কোন্দলে লিপ্ত। প্রায় আধা ডজন আওয়ামী লীগ নেতার নামের ব্র্যাকেটবন্দি উপদলগুলো রাজনীতি নয়, কাদা ছোড়াছুড়িতেই তখন ব্যস্ত।
নব্বইয়ের দশকে দেশ সামরিক শাসনমুক্ত হওয়ার পর ক্ষমতাসীন অধিক আÍবিশ্বাসী খালেদা জিয়া যখন রাজনীতির অঙ্গনে কিছু ভুল পদক্ষেপ নিতে শুরু করেন, শুধু তখনই ক্ষমতার দরদালান থেকে নির্বাসিত আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ২১ বছর পর প্রকাশ্য জনসভায় সদাচরণের কিরা-কসম খেয়ে এরশাদের ওপর ভর দিয়ে কোনোমতে ক্ষমতায় ফেরে।
পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার ঐতিহাসিক আনুগত্যের পর জিয়াউর রহমান যখন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন এবং সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহের লাগাম টেনে ধরেন, বঙ্গবন্ধুর প্রতাপশালী আওয়ামী লীগ তখন রাজনীতির এক প্রান্তিক অবস্থানে। এরপরই রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের গৌরবোজ্জ্বল আÍপ্রকাশ। বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা অক্ষুণ্ন রেখেই বলছি, জিয়ার মাত্র অল্প কবছরের নেতৃত্বে বাংলাদেশ তো বটেই, সারা মুসলিম বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে তাদের ভাগ্যাকাশে এক সোনালি অরুণোদয় দেখেছিল। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দৃশ্যপটে আবির্ভূত বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনের জনক এই নেতাকে আমি এর আগে আমার দুই দশকের চাকরি জীবনে দেখিনি। অথচ তিনি ছিলেন আমার নিজ জেলা বগুড়ার আমার গাবতলী থানারই সন্তান।
প্রশংসা ও প্রচারবিমুখ এ নেতাকে প্রথম দেখি যশোর সেনানিবাসে। সেনাসদরে এ স্পষ্টভাষী রাজনীতিবিমুখ মেজর জেনারেল জিয়া তখন তারই জুনিয়র মেজর জেনারেল শফিউল্লাহর অধীনে আর্মির ডেপুটি চিফ। সেনাবাহিনীর মূল স্রোত থেকে এ মেধাবী কর্মকর্তাকে সরিয়ে রাখতেই এ ব্যবস্থা। ডেপুটি চিফ হিসেবে তার দৃশ্যমান একটি কাজই দেখেছি- তা হল দেশের ক্যাডেট কলেজগুলোর তদারকি। সেই সুবাদেই তিনি তখন যশোর হয়ে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে যেতেন। ৫৫নং পদাতিক ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর আমি কখনও কখনও তাকে বিমানবন্দর থেকে সেনানিবাসে এনেছি।
একপর্যায়ে জিয়া যখন সেনাপ্রধান হলেন, দেশের ভবিষ্যৎ সেনাবাহিনীর রূপরেখা নিয়ে কম্বাইন্ড আর্মস স্কুলে (বর্তমানে বিলুপ্ত) তিনি একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। পাকিস্তানে বেশ কিছু জেনারেলের সান্নিধ্যে এসেছি, কিন্তু আমাকে স্বীকার করতেই হবে, জিয়া প্রদত্ত যশোরের ভাষণটি আমাকে মুগ্ধ করেছিল। তবু জিয়ার কঠোর প্রকৃতি, স্বল্পভাষী স্বভাব ও গাম্ভীর্য আমার কদাচিত ভালো লেগেছে। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তিনি আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে তার বৃহত্তর কর্মপরিসরে চলে গেলেন। মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক নেতৃত্ব না দিলেও তিনি আলবৎ জানতেন ভারতসহ প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কের স্পর্শকাতরতা, আন্তর্জাতিক রীতিনীতি এবং মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে আমাদের বিশেষ সম্পর্কের কথা।
সত্যি কথা বলতে কী, জিয়া শাসনের মেয়াদে একটি আধুনিক, সম্মুখ দৃষ্টি ও কর্মতৎপর বাংলাদেশের অবয়ব অস্তিত্বে আসতে থাকে। আওয়ামী লীগ তখনও রাজনৈতিকভাবে অগোছালো এবং পঁচাত্তরের জের ধরে বিমূঢ়। নানা স্তরে বিভক্ত জিয়া শাসনামলেই অস্তিত্বে এলো বিএনপি। অনেক আওয়ামী লীগ নেতা সে সময় বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন। আরও অধিক দলছুট আওয়ামীরা যোগ দিয়েছিলেন এরশাদের দলে। আমি নিশ্চিত, এ দেশে যদি আর নতুন কোনো ক্ষমতাসীন দলের উদ্ভব ঘটে, আওয়ামীরাই তার নেতানেত্রী ও কর্মীবাহিনীর জোগান দেবে।
রাজনীতিতে উত্থান-পতন আছে। এ দেশেও আমরা তা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সীমাবদ্ধ দেখেছি। আরেকটি অপ্রিয় সত্য এ দেশ সম্পর্কে প্রযোজ্য। ক্ষমতার পালাবদল এ দেশে কদাচিত মসৃণ হয়েছে। বৈধভাবে সাংবিধানিক পথেই ক্ষমতার মসনদে একবার আসীন হলে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার প্রতি আসক্তি এত বেড়ে যায় যে, তখন তাদের প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি ওঠে। এই ঝাঁকুনিটিই হল আন্দোলন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই সেটা করেছে। তবে এ কাজটিতে আওয়ামী লীগ অনেক বেশি পারদর্শী। ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর আমাদের অস্তিত্বের বেশির ভাগ সময় জুড়ে ছিল আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন, শিক্ষা-সংস্কৃতির আন্দোলন, ছয় দফার আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ। আন্দোলনের কলাকৌশল দলটির নখদর্পণে। অষ্টম সংসদের মেয়াদের গোটা সময় জুড়ে-এক-এগারো সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত- আওয়ামী আন্দোলনের মাঝে জীবনপণ আন্দোলনের নমুনা আমরা দেখেছি। তখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। এখন আওয়ামী লীগের মতো আন্দোলন গড়ে তোলা এবং তা প্রতিহত করার আওয়ামী শক্তির সামনে বিএনপির সরকার পতনের হুমকি একেবারেই শূন্যগর্ভ।
বিএনপি ও তার নেতৃত্বের রাজনীতি করার প্যাটার্ন সম্পূর্ণ আলাদা। আন্দোলন কোনো দিনই বিএনপির বৈশিষ্ট্যসূচক গুণ ছিল না, এখনও নেই। তাছাড়া অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের পর আওয়ামী লীগের শক্তি ও অভিজ্ঞতা বেড়েছে। তেমনিভাবে অনেক প্রতিকূলতা, দুর্বল নেতৃত্ব ও রাজশক্তির দাপটে বিএনপি আগের চেয়ে অনেক চুপসানো। তবে শেষমেশ এ দেশের রাজনীতিতে উভয় দলের টিকে থাকার স্বার্থে যৌক্তিক পথ অবলম্বন করতে হবে।
দুর্বলরা সব সময়ই অহেতুক উত্তেজনা ও আতংকে ভোগে। বিএনপিকে সেটা কাটিয়ে উঠতে অনেক কথাই বলতে হবে। কিন্তু উভয়ের মধ্যে সৃষ্ট সংকটের জট খোলার চাবিকাঠি আওয়ামী লীগের হাতে। একটি বিতর্কিত নির্বাচনে জিতে দলটির উচ্চাশা ও ক্ষমতার আসক্তি অনেক বেড়ে গেছে। তবে অগ্রজ রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে অবশ্যই বুঝতে হবে, এভাবে চিরদিন চলতে পারে না। এটা অবশ্যই গণতন্ত্র নয়। অথচ তার সাময়িক রাজনৈতিক বিপথগমন (Political aberration) বাদ দিলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আজীবন স্বপ্নই ছিল গণতন্ত্র। ভিন্নমত, ভিন্নপথ ও সেগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা তো গণতন্ত্রেরই দীক্ষা। তাই তার চর্চা এবং নির্বিঘ্ন ভোটাধিকার ক্ষমতাসীনদেরই নিশ্চিত করতে হবে।
আন্দোলন করে বিএনপি সরকারের পতন ঘটাবে এটি প্রলাপোক্তি। তাই বলে ক্ষমতাসীনরাও পরিতৃপ্ত হয়ে বসে থাকতে পারে না। রাজনৈতিক প্রলয় যদি একটা ঘটেই, উভয়ের কেউই তা থেকে অক্ষত থাকবে না।
এম আবদুল হাফিজ : রাজনীতি ও নিরাপত্তা বিশ্লষক
No comments