শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় আচ্ছাদন কেন? by কাবেরী গায়েন
প্রথম আলোর সাংবাদিক শরিফুজ্জামানকে ধন্যবাদ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও
পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) অধীনে সাধারণ শিক্ষার মূল পাঠ্যবইগুলোকে
‘মাদ্রাসা শিক্ষার উপযোগী’ করে তুলতে গিয়ে বইগুলোর আঙ্গিক ও আদর্শিক যে
পরিবর্তন হতে চলেছে, সেই ধরনটি তুলে ধরার জন্য (১০ এপ্রিল, ২০১৪)।
প্রতিবেদনটি পড়ে খানিকক্ষণ বিমূঢ় হয়ে ছিলাম। দেশটি বাংলাদেশ, পঞ্চাশের
দশকের পাকিস্তান নয় যে ভাষা সংস্কার কমিটি যা কিছু আছে ‘হিন্দুয়ানি’ ভাষার
মধ্যে, তা কাটছাঁট করে ঝেঁটিয়ে বিদায় দেবে। পরিহাস আরও বড় যে শুধু ভাষা নয়,
চিহ্নায়নের সব স্তরে ‘অমুসলিম’ বলে যা কিছু বিবেচিত হয়েছে বিশেষজ্ঞ কমিটির
কাছে, তার সবকিছুই ঝেড়ে পবিত্র করা হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার বইগুলোকে
মাদ্রাসা উপযোগী করার জন্য!
অষ্টম শ্রেণীর বাংলা বইয়ে লালন শাহের কবিতা ‘মানবধর্ম’। কবিতাটি নির্বাচনের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ‘...ধর্ম বা সম্প্রদায়গত পরিচিতির চেয়ে মানুষ হিসেবে পরিচয়ই বড়। শিক্ষার্থীরা জাতপাত বা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি বা মিথ্যে গর্ব করা থেকে বিরত থাকবে।’ কবিতাটি প্রতিস্থাপিত হচ্ছে কবি ফররুখ আহমদের ‘মেঘ বৃষ্টি আলোর দেশে’ কবিতা দিয়ে। ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা জর্জ হ্যারিসনের ছবিসহ ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ লেখাটি পড়ে, কিন্তু পরিমার্জন কমিটি লেখাটি বাদ দিতে চাইলে স্টিয়ারিং কমিটি আপস করেছে এইভাবে যে, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা লেখাটি পড়লেও গিটার বাজিয়ে গান গাওয়া ঝাঁকড়া চুলের জর্জ হ্যারিসনের ছবিটি সেখানে থাকবে না।
অষ্টম শ্রেণীর বাংলা বইয়ে বিপ্রদাশ বড়ুয়ার গদ্য ‘মংডুর পথে’ প্রতিস্থাপিত হচ্ছে মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর ‘মদিনার পথে’ লেখাটি দিয়ে। দশম শ্রেণীতে জ্ঞানদাশের কবিতা ‘সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু’ প্রতিস্থাপিত হচ্ছে মুহাম্মদ সগীরের লেখা ‘বন্দনা’ কবিতা দিয়ে। শুধু ভাষায় নয়, চিহ্নায়নের নানা স্তরেও পরিবর্তন। তৃতীয় শ্রেণীর ‘আমার বাংলা’ বই-এর প্রচ্ছদে হাফপ্যান্ট পরা যে বালকটি নৌকা বাইছে এবং যে বালিকাটি শাপলা ফুল তুলছে নৌকায় বসে, সেখানে প্রচ্ছদ পরিবর্তন করে বালকটিকে পায়জামা পরানো হবে এবং কিশোরীর মাথায় দেওয়া হবে হিজাব। পঞ্চম শ্রেণীর ইংরেজি বইয়ের প্রচ্ছদে ফুল, পাখি, প্রজাপতি ও কাশবনের মধ্যে নৌকা বাইছে এক কিশোর আর নৌকার অন্য প্রান্তে বসা এক ফ্রক পরা কিশোরী, সেটিও পাল্টে মাদ্রাসা শিক্ষার ‘উপযোগী’ করা হবে। পঞ্চম শ্রেণীর বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদে নদীর দিকে মুখ করে দাঁড়ানো নারীর ঘাড়ের পাশ দিয়ে সামান্য যে পিঠ দেখা যায়, শিল্পীর আঁকা সেই পিঠও দেওয়া হবে ঢেকে। তবে সবকিছুকে বোধ হয় ছাড়িয়ে গেছে অষ্টম শ্রেণীর বাংলা বইয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তৈলচিত্রের ভূত’ গদ্যটির শিরোনাম পরিবর্তনের সুপারিশ করে ‘তৈলচিত্রের আছর’ নামকরণের প্রস্তাব করার মধ্য দিয়ে। এসবের তুলনায় ব্রতচারী নৃত্য তুলে দেওয়া, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা বাদ দেওয়া বা অন্যান্য পরিবর্তনের তালিকা আর না বাড়াই।
চাকরিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা যেন পিছিয়ে না পড়ে এই উদ্দেশ্যে বাংলা ও ইংরেজিসহ সাধারণ শিক্ষার মূল বইগুলো মাদ্রাসা শিক্ষার মূল বই করার মাধ্যমে এই দুই শিক্ষা বোর্ডের পার্থক্য কমিয়ে আনার জন্য যে উদ্যোগ, তাকে সাধুবাদ দিতেই হয়। কিন্তু সাধারণ শিক্ষার বইগুলোকে ‘মাদ্রাসা উপযোগী’ করাই যদি পদ্ধতি হয়, তবে আর মাদ্রাসার জন্য সাধারণ শিক্ষার বই প্রতিস্থাপনের কথা বলে কী লাভ? সাধারণ শিক্ষার যে উদার মানবতাবাদী অসাম্প্রদায়িক চরিত্র রয়েছে, সেটিই যদি বইগুলোর মাদ্রাসাকরণের জন্য বাদ দিতে হয়, তবে মাদ্রাসা শিক্ষার বইগুলোকে আলাদা রাখাই ভালো। না হলে একই ক্লাসের শিশু-কিশোরদের একই বইয়ের দুই ধরনের নৈতিকতার মানদণ্ড জারি রাখা হয়, যা বিপজ্জনক।
দুই ধারার শিক্ষাব্যবস্থার একই শ্রেণীর জন্য সংকলিত একই বইকে যদি ভিন্ন দুই নৈতিকতার মানদণ্ডে বিন্যস্ত করা হয়, তবে কোন ধারাটি গ্রহণযোগ্য এবং কোনটি বর্জনীয় সমাজে, সে বিষয়ে এই শিশু-কিশোরেরা কোন সিদ্ধান্তে আসবে? লালনের ‘মানবধর্ম’ কবিতাটি কি তবে অনৈতিক? অনৈতিক কি জর্জ হ্যারিসনের ছবি, বিপ্রদাশ বড়ুয়ার ভ্রমণকাহিনি, ফুল-পাখি-প্রজাপতি-কাশবনের ভেতরে বালকের হাফপ্যান্ট? শিল্পীর আঁকা গ্রামীণ নারীর ঘোমটার ফাঁক দিয়ে পিঠের যে সামান্য আভাস দেখা যায়, তা নয় নৈতিক? নৈতিক ড্রেস তবে বালিকার হিজাব, তার ফ্রক অনৈতিক?
আর যে পরিমার্জন কমিটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তৈলচিত্রের ভূত’ শিরোনাম পাল্টে ‘তৈলচিত্রের আছর’ নামকরণের সুপারিশ করতে পারে, তারা কীভাবে শিশুদের জীবন-মনন গঠনের জন্য যে বই পড়ানো হবে, সেই বই-নির্বাচন কমিটির সদস্য হতে পারে? ব্যাপারটি গোলমেলে মনে হওয়াতে প্রতিবেদনটি ফের পড়লাম। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে প্রতিবেদক জানিয়েছেন, সাধারণ শিক্ষার বইগুলো মাদ্রাসা শিক্ষার ‘উপযোগী’ করার কাজ করেছে মূলত স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এনসিটিবি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড। তারা এমন করবে সেটি হয়তো স্বাভাবিক। পরিমার্জন-প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মাদ্রাসাশিক্ষকদের সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদাররেছিনের মহাসচিব শাব্বির আহমেদ মোমতাজি যথার্থই বলেছেন, ‘সাধারণ শিক্ষা জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার জন্য; কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষা শুধু মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য। তাই যেসব বিষয় মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করতে পারে, সেগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে।’
কিন্তু যথার্থ নয় সরকারি অবস্থান। মনে পড়ছে, ২০০৮ সালের নারীনীতি থেকে পবিত্র কোরআন ও সুন্নার বিপরীতে কিছু আছে কি না তা পরীক্ষণের জন্য যাঁদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা বলাই বাহুল্য ছিলেন ধর্মীয় নেতা, যাঁরা নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত কোনো অপরাধের বিরুদ্ধে একটি কথাও কোনো দিন বলেননি বরং নারীর অগ্রায়ণকে বাধাগ্রস্তই করেছেন নানাভাবে এবং তাঁরা এমন সব পরিবর্তনের সুপারিশ করেছিলেন, যেসব সুপারিশের পরে আর যা-ই হোক, নারীনীতির কোনো উপযোগিতা থাকে না।
২০১১ সালের নারীনীতির পরেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন পবিত্র কোরআন ও সুন্নার বিপরীতে যায় এমন কোনো নীতি তিনি করবেন না। তিনি কথা রেখেছেন। ১৯৯৭ সালে তাঁরই প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বের কালে ঘোষিত নারীনীতি এবং ২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে ১৯৯৭ সালের নারীনীতিকেই পুনর্বহালের ঘোষণা থাকা সত্ত্বেও উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীর সমানাধিকারসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি থেকে পিছিয়ে আসেন।
উদাহরণটি দেওয়া হলো কেবল একটি বিষয়েই আলোকপাত করার জন্য যে এ-জাতীয় আপসের ফলাফল নেতিবাচকই হয়ে থাকে। মাদ্রাসার জন্য সাধারণ শিক্ষার বইয়ে পরিবর্তন এনে কিন্তু সরকার পক্ষান্তরে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার দাবিকেই সঠিক বলে স্বীকৃতি দিল। ফলে যদি কখনো একই শক্তির কাছ থেকে দাবি ওঠে যে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার সবকিছুই মাদ্রাসা শিক্ষার নৈতিকতার মানদণ্ড পার হয়ে আসতে হবে, তখন সরকার নিজেকে কীভাবে রক্ষা করব জানি না।
কারণ, আগে মাদ্রাসা শিক্ষা এবং সাধারণ শিক্ষার পার্থক্য ছিল স্পষ্ট। একটি ঘোষিত বিশ্বাসনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা, অন্যটি বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসামূলক অসাম্প্রদায়িক সর্বজনীন সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা। কাজের ধরনও তাঁদের অর্জিত শিক্ষার অনুগামী হবে, সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু সমস্যা বেড়ে যায় তথাকথিত ‘পরিমার্জনা’র কারণে। কারণ, সাধারণ শিক্ষার বই যখন একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের আচ্ছাদনে মুড়ে দেওয়া হয়, তখন সেসব বই না বহন করে সাধারণ শিক্ষার স্পিরিট, না বহন করে মাদ্রাসার ধারা। হয়ে যায় ‘হাঁসজারু’। এই হাঁসজারুত্বের সমস্যা এ কারণেও যে চাকরি-বাকরিতে ব্যবধান যাবে কমে, যা খুব ইতিবাচক অথচ যে ব্যবস্থার ওপর দাঁড়িয়ে এই ব্যবধান ঘুচবে তা সমস্যাজনক।
অসাম্প্রদায়িক, সর্বজনীন চরিত্র থেকে সরে আসা এসব বই পড়ে মনন রয়ে যাবে মাদ্রাসার, যা মূলত ধর্মীয় বিশ্বাসনির্ভর অথচ প্রজাতন্ত্রের সব ধরনের ইহজাগতিক চাকরিতেই তাঁরা বহাল হবেন। প্রজাতন্ত্রের চরিত্র তখন কোন দিকে ঝুঁকবে, নীতিনির্ধারকেরা ভেবেছেন কি? প্রজাতন্ত্রের চরিত্র অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের রাখতে চাইলে সবার জন্য একমুখী, বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থা চালু করতে না পারলেও এসব ‘আছর’ থেকে বের হয়ে সাধারণ শিক্ষার নির্বাচিত বইগুলো অবিকলভাবেই পড়ানো হোক মাদ্রাসায়, নয়তো একবারেই বাদ দেওয়া হোক। শিশু-কিশোরদের মুক্তি দেওয়া হোক একই বইয়ের দুই নৈতিক মানদণ্ডের দোদুল্যমানতা থেকে।
ড. কাবেরী গায়েন, অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments