ঢাকার ৬৫ শতাংশ ভূখণ্ড তপ্ত by ইফতেখার মাহমুদ
ভবনের ভেতরে ভাপসা গরম। বাইরে যেন আগুনের
হলকা। আর গণপরিবহনগুলো অগ্নিচুল্লির মতো। সূর্য ডোবার পর সন্ধ্যা নামলেও
গরম কমছে না। রাজধানীর পুরোটাই দিনে দিনে ‘তপ্ত ভূখণ্ড’ হয়ে উঠছে। পুরান
ঢাকা থেকে উত্তরা, মোহাম্মদপুর থেকে মিরপুর, বাড্ডা থেকে বাসাবো, গাবতলী
থেকে গুলশান—যেখানেই যান, অসহনীয় দাবদাহ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের
(বুয়েট) গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, রাজধানীর আটটি অঞ্চলের ২৫টি এলাকা এরই
মধ্যে তপ্ত ভূখণ্ড হয়ে উঠেছে। এখানকার গড় তাপমাত্রা অন্য এলাকার চেয়ে ৩
থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি।
>>সূত্র: বুয়েটের অধ্যাপক মাফেজুর রহমানের গবেষণা
কৃত্রিম
উপগ্রহ থেকে নেওয়া ছবি আর তাপমাত্রা পরিমাপ করে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগ
ঢাকার তপ্ত এলাকা বৃদ্ধির পরিমাণ নির্ণয় করেছে। তাতে দেখা যায়, ১৯৮৯ সালে
ঢাকার ৩০ শতাংশ এলাকা তপ্ত ছিল। ২০১৪ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৬৫ শতাংশ। এসব
এলাকা আবাসিক-বাণিজ্যিক ও ঘনবসতিপূর্ণ। এখানে রাজধানীর ৮০ শতাংশ মানুষ
বসবাস করে।
২০০২ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড এনার্জি স্টাডিজ প্রোগ্রাম ঢাকার অঞ্চলভেদে তাপমাত্রার কমবেশি বা হেরফের নিয়ে প্রথম গবেষণা করে। তাতে দেখা গিয়েছিল, ঢাকার চারটি এলাকা তপ্ত হয়ে উঠেছে। আর অন্য এলাকার সঙ্গে তপ্ত এলাকার তাপমাত্রার পার্থক্য ২ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
গত বছর বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের করা আরেক গবেষণায় দেখা যায়, দুই যুগে রাজধানীর আটটি অঞ্চলের ২৫টি এলাকা তপ্ত হয়ে উঠেছে। আর অন্য এলাকার সঙ্গে তপ্ত এলাকার তাপমাত্রার পার্থক্য ৩ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
ঢাকার তপ্ত ভূখণ্ডের বিস্তৃতি নিয়ে বুয়েটের করা ২০১৩ সালের গবেষণা বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে দ্রুত তপ্ত হয়ে উঠেছে মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকা। এখানকার তাপমাত্রা দুই যুগে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এর কারণ প্রকৃতি নয়, মানুষ। এলাকাটি ছিল নিচু ভূমি ও জলাশয়। দ্রুতই তা আবাসিক এলাকায় পরিণত হলেও রাখা হয়নি জলাশয়, উন্মুক্ত স্থান ও বৃক্ষরাজি।
আবহাওয়ার বৈরী আচরণ ছাড়া এই তীব্র খরতাপের আর কী কারণ থাকতে পারে, তা জানতে কথা হয় বুয়েটের পুরকৌশল, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা এবং স্থাপত্য বিভাগের সাতজন শিক্ষকের সঙ্গে। তাঁরা সবাই ঢাকার ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ে গবেষণা করেছেন। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আশঙ্কাজনক হারে ‘তপ্ত ভূখণ্ড’ সৃষ্টি হওয়ার কথা উল্লেখ করে তাঁরা এর কারণ হিসেবে নগর পরিকল্পনার সমস্যা ও অপরিকল্পিত আবাসনকেই দায়ী করেছেন। একই সঙ্গে জনসংখ্যা, ভবন ও যানবাহনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়াও এর জন্য দায়ী।
বুয়েটের অঞ্চল ও নগর পরিকল্পনা বিভাগ থেকে ঢাকার তপ্ত ভূখণ্ড নিয়ে করা গবেষণায় দেখা গেছে, নতুন আবাসিক এলাকায় এ ধরনের ভূখণ্ড সৃষ্টি হচ্ছে বেশি। মোহাম্মদপুর, আদাবর, উত্তরায় দ্রুত তাপমাত্রা বাড়ছে।
বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর ভবনগুলো চারপাশ বন্ধ একেকটি খাঁচার মতো করে নির্মিত হচ্ছে। সেখানে বাতাস খেলা করার মতো জায়গা থাকছে না। আর দিনের বেলায় যে পরিমাণ সূর্যের আলো আসছে, তা ভবনের গায়ে, ছাদে, পার্শ্ববর্তী রাস্তায় জমে থাকে। সূর্য ডুবে গেলে ওই জমে থাকা তাপ অল্প অল্প করে ছাড়ছে। ফলে ঘরের বাইরে ও ভেতরে সমান গরম অনুভূত হয়। সন্ধ্যার পর ভাপসা গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে নাগরিক জীবন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, প্রায় দেড় কোটি মানুষের এই শহরে এখন প্রায় আট লাখ যানবাহন চলে। এর মধ্যে ৩০ হাজারই বাস ও মিনিবাস। কংক্রিটের তৈরি সড়ক আর বাস তাপমাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়।
নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক রোখসানা হাফিজ প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার নীলক্ষেত থেকে আজিমপুর হয়ে বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করা মাত্রই সেখানকার তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি কমে যায়। গত শুক্রবার যখন আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে বলা হয়েছিল, ঢাকার গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তখন বুয়েটের তাপমাত্রা মেপে দেখা গেছে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত শীতল এলাকা বুয়েটের তাপমাত্রাই ঢাকার গড় তাপমাত্রার চেয়ে ২ ডিগ্রি বেশি। তাহলে তপ্ত ভূখণ্ডের তাপমাত্রা গড় তাপমাত্রার চেয়ে অন্তত ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি হবে।
বুয়েটের ওই গবেষণায় দেখা গেছে, গত শতকের সত্তরের দশকে ঢাকা শহরের প্রথম তপ্ত ভূখণ্ড সৃষ্টি হয় পুরান ঢাকা ও মতিঝিল এলাকায়। এরপর পর্যায়ক্রমে শ্যামপুর, পোস্তগোলা, সায়েদাবাদ, ফার্মগেট ও কারওয়ান বাজার এলাকা তপ্ত হয়ে ওঠে। এরপর একে একে মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, বাসাবো, রামপুরা, হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীরচর, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর, শেরেবাংলা নগর, গাবতলী ও গুলশানের একাংশ।
এই এলাকাগুলোর মধ্যে অল্প সময়ে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা বেড়েছে মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকায়। ১৯৯০ সালে এ দুই এলাকার বেশির ভাগই ছিল জলা ও নিম্নভূমি। আবাসন প্রকল্পের কারণে এখানে দ্রুত ইমারত ও সড়ক নির্মিত হয়েছে। মধ্য ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত জীবনের অনুষঙ্গ হিসেবে গাড়ি, গণপরিবহন, শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র তাপ বাড়াতে ভূমিকা রাখছে। ১৯৯০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে এ এলাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি ও সর্বনিম্ন ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। অন্য এলাকাগুলোর গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ২ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, গত ১০০ বছরে দেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর রাজধানীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দেশের উত্তরাঞ্চল, রাঙামাটি ও শ্রীমঙ্গল এলাকায় ভৌগোলিক কারণে তাপমাত্রা বেশি। কিন্তু ঢাকা শহরে মানুষের সৃষ্ট কারণেই তাপমাত্রা বাড়ছে।
বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক খন্দকার সাব্বির আহমেদ। তিনি গবেষণার আলোকে সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ থেকে জানান, তপ্ত ভূখণ্ড এলাকায় শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ও বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ছে। এতে ভবনের ভেতরে ঠান্ডা অনুভূতির বিনিময়ে ভবনের বাইরের মানুষ আরও বেশি তাপের কষ্ট অনুভব করছে।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের ‘ঢাকা শহরের ভূমি ব্যবহারের কারণে তাপমাত্রার পার্থক্য এবং তপ্ত ভূখণ্ড সৃষ্টি’ শীর্ষক এক গবেষণায় ঢাকা শহরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে অপরিকল্পিত নগরায়ণকেই দায়ী করা হয়েছে। কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে নেওয়া ছবি বিশ্লেষণ করে ওই গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৮৯ সালে রাজধানীর ২৬ শতাংশ এলাকা ছিল উন্মুক্ত স্থান, ৪৬ শতাংশ এলাকা বৃক্ষরাজি দিয়ে আচ্ছাদিত আর বসতি ছিল ২৩ শতাংশ এলাকায়। ২০১০ সালে এসে দেখা যায়, রাজধানীর মাত্র ৮ শতাংশ এলাকা উন্মুক্ত আর ৩১ শতাংশ এলাকায় গাছ আছে। পক্ষান্তরে ৫৭ শতাংশ এলাকা বসতি ও অবকাঠামোয় পরিপূর্ণ। জলাশয় রয়েছে মাত্র ৪ শতাংশ এলাকায়।
বুয়েটের এই গবেষণায় নেতৃত্বদানকারী অধ্যাপক মাফিজুর রহমান বলেন, ‘গাছ তাপ শুষে নিয়ে অক্সিজেন ও ঠান্ডা বাতাস ছাড়ে। জলাশয়ও তাপ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। অথচ আমরা এ দুটিকেই ক্রমাগত মেরে ফেলে নিজেদের শহরটাকে বসবাসের অযোগ্য করে ফেলছি।’
* ১০০ বছরে সারা দেশে গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস
* রাজধানীতে বেড়েছে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস
* রাজধানীর আটটি অঞ্চলের ২৫টি এলাকার ভূখণ্ড তপ্ত হয়ে উঠেছে। এখানকার গড় তাপমাত্রা অন্য এলাকার চেয়ে বেশি ৩—৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
২০০২ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড এনার্জি স্টাডিজ প্রোগ্রাম ঢাকার অঞ্চলভেদে তাপমাত্রার কমবেশি বা হেরফের নিয়ে প্রথম গবেষণা করে। তাতে দেখা গিয়েছিল, ঢাকার চারটি এলাকা তপ্ত হয়ে উঠেছে। আর অন্য এলাকার সঙ্গে তপ্ত এলাকার তাপমাত্রার পার্থক্য ২ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
গত বছর বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের করা আরেক গবেষণায় দেখা যায়, দুই যুগে রাজধানীর আটটি অঞ্চলের ২৫টি এলাকা তপ্ত হয়ে উঠেছে। আর অন্য এলাকার সঙ্গে তপ্ত এলাকার তাপমাত্রার পার্থক্য ৩ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
ঢাকার তপ্ত ভূখণ্ডের বিস্তৃতি নিয়ে বুয়েটের করা ২০১৩ সালের গবেষণা বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে দ্রুত তপ্ত হয়ে উঠেছে মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকা। এখানকার তাপমাত্রা দুই যুগে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এর কারণ প্রকৃতি নয়, মানুষ। এলাকাটি ছিল নিচু ভূমি ও জলাশয়। দ্রুতই তা আবাসিক এলাকায় পরিণত হলেও রাখা হয়নি জলাশয়, উন্মুক্ত স্থান ও বৃক্ষরাজি।
আবহাওয়ার বৈরী আচরণ ছাড়া এই তীব্র খরতাপের আর কী কারণ থাকতে পারে, তা জানতে কথা হয় বুয়েটের পুরকৌশল, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা এবং স্থাপত্য বিভাগের সাতজন শিক্ষকের সঙ্গে। তাঁরা সবাই ঢাকার ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ে গবেষণা করেছেন। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আশঙ্কাজনক হারে ‘তপ্ত ভূখণ্ড’ সৃষ্টি হওয়ার কথা উল্লেখ করে তাঁরা এর কারণ হিসেবে নগর পরিকল্পনার সমস্যা ও অপরিকল্পিত আবাসনকেই দায়ী করেছেন। একই সঙ্গে জনসংখ্যা, ভবন ও যানবাহনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়াও এর জন্য দায়ী।
বুয়েটের অঞ্চল ও নগর পরিকল্পনা বিভাগ থেকে ঢাকার তপ্ত ভূখণ্ড নিয়ে করা গবেষণায় দেখা গেছে, নতুন আবাসিক এলাকায় এ ধরনের ভূখণ্ড সৃষ্টি হচ্ছে বেশি। মোহাম্মদপুর, আদাবর, উত্তরায় দ্রুত তাপমাত্রা বাড়ছে।
বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর ভবনগুলো চারপাশ বন্ধ একেকটি খাঁচার মতো করে নির্মিত হচ্ছে। সেখানে বাতাস খেলা করার মতো জায়গা থাকছে না। আর দিনের বেলায় যে পরিমাণ সূর্যের আলো আসছে, তা ভবনের গায়ে, ছাদে, পার্শ্ববর্তী রাস্তায় জমে থাকে। সূর্য ডুবে গেলে ওই জমে থাকা তাপ অল্প অল্প করে ছাড়ছে। ফলে ঘরের বাইরে ও ভেতরে সমান গরম অনুভূত হয়। সন্ধ্যার পর ভাপসা গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে নাগরিক জীবন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, প্রায় দেড় কোটি মানুষের এই শহরে এখন প্রায় আট লাখ যানবাহন চলে। এর মধ্যে ৩০ হাজারই বাস ও মিনিবাস। কংক্রিটের তৈরি সড়ক আর বাস তাপমাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়।
নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক রোখসানা হাফিজ প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার নীলক্ষেত থেকে আজিমপুর হয়ে বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করা মাত্রই সেখানকার তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি কমে যায়। গত শুক্রবার যখন আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে বলা হয়েছিল, ঢাকার গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তখন বুয়েটের তাপমাত্রা মেপে দেখা গেছে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত শীতল এলাকা বুয়েটের তাপমাত্রাই ঢাকার গড় তাপমাত্রার চেয়ে ২ ডিগ্রি বেশি। তাহলে তপ্ত ভূখণ্ডের তাপমাত্রা গড় তাপমাত্রার চেয়ে অন্তত ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি হবে।
বুয়েটের ওই গবেষণায় দেখা গেছে, গত শতকের সত্তরের দশকে ঢাকা শহরের প্রথম তপ্ত ভূখণ্ড সৃষ্টি হয় পুরান ঢাকা ও মতিঝিল এলাকায়। এরপর পর্যায়ক্রমে শ্যামপুর, পোস্তগোলা, সায়েদাবাদ, ফার্মগেট ও কারওয়ান বাজার এলাকা তপ্ত হয়ে ওঠে। এরপর একে একে মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, বাসাবো, রামপুরা, হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীরচর, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর, শেরেবাংলা নগর, গাবতলী ও গুলশানের একাংশ।
এই এলাকাগুলোর মধ্যে অল্প সময়ে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা বেড়েছে মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকায়। ১৯৯০ সালে এ দুই এলাকার বেশির ভাগই ছিল জলা ও নিম্নভূমি। আবাসন প্রকল্পের কারণে এখানে দ্রুত ইমারত ও সড়ক নির্মিত হয়েছে। মধ্য ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত জীবনের অনুষঙ্গ হিসেবে গাড়ি, গণপরিবহন, শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র তাপ বাড়াতে ভূমিকা রাখছে। ১৯৯০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে এ এলাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি ও সর্বনিম্ন ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। অন্য এলাকাগুলোর গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ২ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, গত ১০০ বছরে দেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর রাজধানীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দেশের উত্তরাঞ্চল, রাঙামাটি ও শ্রীমঙ্গল এলাকায় ভৌগোলিক কারণে তাপমাত্রা বেশি। কিন্তু ঢাকা শহরে মানুষের সৃষ্ট কারণেই তাপমাত্রা বাড়ছে।
বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক খন্দকার সাব্বির আহমেদ। তিনি গবেষণার আলোকে সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ থেকে জানান, তপ্ত ভূখণ্ড এলাকায় শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ও বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ছে। এতে ভবনের ভেতরে ঠান্ডা অনুভূতির বিনিময়ে ভবনের বাইরের মানুষ আরও বেশি তাপের কষ্ট অনুভব করছে।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের ‘ঢাকা শহরের ভূমি ব্যবহারের কারণে তাপমাত্রার পার্থক্য এবং তপ্ত ভূখণ্ড সৃষ্টি’ শীর্ষক এক গবেষণায় ঢাকা শহরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে অপরিকল্পিত নগরায়ণকেই দায়ী করা হয়েছে। কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে নেওয়া ছবি বিশ্লেষণ করে ওই গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৮৯ সালে রাজধানীর ২৬ শতাংশ এলাকা ছিল উন্মুক্ত স্থান, ৪৬ শতাংশ এলাকা বৃক্ষরাজি দিয়ে আচ্ছাদিত আর বসতি ছিল ২৩ শতাংশ এলাকায়। ২০১০ সালে এসে দেখা যায়, রাজধানীর মাত্র ৮ শতাংশ এলাকা উন্মুক্ত আর ৩১ শতাংশ এলাকায় গাছ আছে। পক্ষান্তরে ৫৭ শতাংশ এলাকা বসতি ও অবকাঠামোয় পরিপূর্ণ। জলাশয় রয়েছে মাত্র ৪ শতাংশ এলাকায়।
বুয়েটের এই গবেষণায় নেতৃত্বদানকারী অধ্যাপক মাফিজুর রহমান বলেন, ‘গাছ তাপ শুষে নিয়ে অক্সিজেন ও ঠান্ডা বাতাস ছাড়ে। জলাশয়ও তাপ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। অথচ আমরা এ দুটিকেই ক্রমাগত মেরে ফেলে নিজেদের শহরটাকে বসবাসের অযোগ্য করে ফেলছি।’
* ১০০ বছরে সারা দেশে গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস
* রাজধানীতে বেড়েছে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস
* রাজধানীর আটটি অঞ্চলের ২৫টি এলাকার ভূখণ্ড তপ্ত হয়ে উঠেছে। এখানকার গড় তাপমাত্রা অন্য এলাকার চেয়ে বেশি ৩—৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
No comments