পোশাক-বাণিজ্যে পরিবর্তনের হাওয়া?
২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে লন্ডনে যত ধরনের অনুষ্ঠান হয়েছে, সম্ভবত ঢাকার পর বিশ্বের অন্য আর কোনো শহরে এত আয়োজন হয়নি। এ রকম একটি আয়োজন ছিল বাংলা টাউনের র্যাগ ফ্যাক্টরিতে, যার আয়োজক ছিল ওয়ার্ল্ড ফেয়ার ট্রেড ফাউন্ডেশন। পুরোনো একটা গুদামঘরে অনুষ্ঠিত সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন শ দুয়েক শ্রোতা। তাঁদের সবাই এসেছিলেন ১০ পাউন্ড মূল্যের টিকিট কেটে। শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং বাঁচার মতো মজুরি নিশ্চিত করার বিষয়ে বৈশ্বিক ব্র্যান্ডের মালিক কোম্পানিগুলোকে আইনগতভাবে বাধ্য করার উপায় নিয়ে একপর্যায়ে সেখানে শুরু হলো প্রশ্নোত্তর পর্ব। দর্শকদের সারি থেকে একজন যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি গ্যাপের পণ্য বর্জনের আহ্বান জানালে দেখা গেল মিলনায়তনের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তাতে হাত তুলে সম্মতি জানালেন। তাঁদের ক্ষোভের কারণ, রানা প্লাজা ধসের হতাহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসন তহবিলে অংশ নিতে গ্যাপের অস্বীকৃতি। সেদিন লন্ডনের তিনটি আয়োজনে আমি উপস্থিত হতে পারলেও অন্তত আরও ছয়টি অনুষ্ঠানে যেতে পারিনি। এগুলোর মধ্যে ছিল সমারসেট হাউস এবং ব্রিকলেনে দুটো আলাদা সেমিনার, ওয়েস্টমিনস্টার ইউনিভার্সিটিতে একটি নতুন তথ্যচিত্রের প্রদর্শনী, কভেন্ট গার্ডেনে ফ্যাশনের নৈতিকতাবিষয়ক প্রদর্শনী। ধারণা করি, এসব আয়োজনে আরও কয়েক শ লোক অংশ নিয়েছেন। সকালের দিকে অক্সফোর্ড স্ট্রিটের ইউনাইটেড কালার্স অব বেনিট্টন ব্র্যান্ডের এক শোরুমে দুজন বিক্ষোভকারী দরজার সঙ্গে নিজের গলায় তালা লাগিয়ে বসে পড়ে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করায় শেষ পর্যন্ত দোকানটি সেদিনের জন্য বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিল কোম্পানির কর্তৃপক্ষ। অক্সফোর্ড স্ট্রিট ছাড়াও লন্ডনে আরও অনেক জায়গায় দিনভর এ ধরনের নানা প্রতিবাদ সংঘটিত হয়। বাইরে কেমব্রিজেও প্রতিবাদকারীদের কারণে গ্যাপের একটি দোকান বন্ধ হয়ে যায়। ফ্যাশন বিপ্লব দিবস নামে আরেক দল প্রতিবাদকারী কাপড় উল্টো করে পরে এক অভিনব প্রচারণায় শামিল হন। ‘কে বানিয়েছে আপনার কাপড়?’ এই প্রশ্নের জবাব জেনে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ক্রেতা ও ভোক্তাদের উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে এই ফ্যাশন বিপ্লব দিবস পালিত হয় বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশে। নৈতিক বাণিজ্যের প্রবক্তা, মানবাধিকার সংগঠন, ফ্যাশন তারকা, ছাত্রছাত্রী ও ভোক্তাদের পাশাপাশি রাজনীতিকেরাও এই প্রচারণায় অংশ নেন। তাঁদের প্রচারণার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এঁরা কেউই বাংলাদেশকে বয়কটের কথা বলেননি, বরং বহুজাতিক ব্র্যান্ডগুলো যেখান থেকেই পোশাক আনুক, সেখানে কাজের নিরাপদ পরিবেশ এবং বাঁচার মতো মজুরি নিশ্চিত করার কথা বলেছেন।
রানা প্লাজার দুর্ঘটনায় পাশ্চাত্যের নাগরিকসমাজের মধ্যে এই প্রতিক্রিয়া রাজনীতিকদের পক্ষে উপেক্ষা করা অসম্ভব বলেই এসব দেশের মন্ত্রী এবং এমপিদের অনেককেই এখন এসব কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হতে দেখা যাচ্ছে। ব্রিটিশ আন্তর্জাতিক উন্নয়নমন্ত্রী জাস্টিন গ্রিনিং এবং তাঁর ডেপুটি অ্যালান ডানকান বিবৃতি দিয়ে বাংলাদেশের পোশাক খাতের সংস্কার এবং হতাহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনে কী কী করছেন, তার বিশদ বিবরণ তুলে ধরেন। বিরোধী দলের নেতাদের মধ্যে ছায়া মন্ত্রিসভার সদস্য জিম মারফি এবং রুশনারা আলী এসব প্রচারাভিযানের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন। ‘ফ্যাশনের জন্য আর কোনো প্রাণহানি নয়’ (নো মোর ফ্যাশন ভিকটিমস) স্লোগান লেখা টি-শার্ট পরা ছবি তুলে তা প্রচারের ব্যবস্থা করেছেন। এই প্রচারাভিযানের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো এটি মূলত সংগঠিত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক এবং টুইটারের মাধ্যমে। ফলে, রাস্তাঘাটে প্রতিবাদকারীদের সশরীরী উপস্থিতি যতটা দেখা গেছে, সাইবারজগতে তাদের অশরীরী উপস্থিতি ছিল তার চেয়েও অনেক গুণ বেশি। বিপরীতে, বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন, বিজিএমইএর সভাপতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আগাম প্রচার করলেন যে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্টের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বিশ্বের নানা প্রান্তে কাপড় উল্টো করে পরার কর্মসূচি পালন করা হবে বলে তাঁরা জানতে পেরেছেন। তিনি বলেন, তারা বলবে ‘ডোন্ট বাই বাংলাদেশ গার্মেন্ট’ (প্রথম আলো অনলাইন, ২৩ এপ্রিল, ২০১৪)। বাংলাদেশের রাজনীতিকদের একটা বড় অংশ সুশীল সমাজের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপবাদ দিয়ে যেমন অভ্যস্ত, এটা ব্যবসায়ীদের মধ্যে সেই বদভ্যাসের সংক্রমণ কি না জানি না। তবে, তেমনটি ঘটলে তা বড়ই দুশ্চিন্তার বিষয়। বিশেষ করে, বিদেশের সুশীল সমাজের বিরুদ্ধে এ ধরনের অপপ্রচার কতটা বিবেচনাপ্রসূত কাজ হয়েছে সেটা কী তাঁরা ভেবে দেখবেন? তাঁদের উচিত হবে ওই বিবৃতি প্রত্যাহার।
No comments