সাকিব, ক্রিকেট ও অন্যান্য
বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের অবস্থা বেশ ছন্নছাড়া। ২৬ ফেব্রুয়ারিতে যখন তারা নামছে ভারতের বিরুদ্ধে খেলতে, তখনই বিসিবির ট্রাইব্যুনাল রায় দিয়েছেন বিপিএলে ম্যাচ পাতানো বিষয়ে, যাঁর একজন অভিযুক্ত মোহাম্মদ আশরাফুল। এরই মধ্যে সাকিব আল হাসান ক্যামেরার সামনে অনভিপ্রেত আচরণ করে শাস্তি পেয়েছেন, তিন ম্যাচের জন্য তিনি খেলতে পারবেন না। জরিমানাও হয়েছে। তামিম ইকবালের ঘাড়ে ব্যথা। এশিয়া কাপের দল ঘোষণার আগে অধিনায়কের সঙ্গে কথা বলা হয়নি, এই অভিযোগ প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলনে তুলেছেন মুশফিকুর রহিম। সে জন্য তাঁকে জবাবদিহি করতে হয়েছে, সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে তাঁকে। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে টি-টোয়েন্টি ম্যাচে মাশরাফিকে অধিনায়ক করা নিয়ে বিতর্ক হয়েছে, এই নিয়ে মাশরাফি পর্যন্ত বিব্রত, সে খবর আমরা পড়েছি সংবাদপত্রে। তার পরও আমরা আশায় বুক বেঁধে আছি। ক্রিকেটের জয় আমাদের মরা গাঙে জোয়ার এনে দিতে পারে। পুরো জাতিকে জাগিয়ে তুলতে পারে। ভারতের বিরুদ্ধে খেলার দিনে সেই আশাতেই তাকিয়ে ছিলাম। বাংলাদেশ টসে জিতে ফিল্ডিং নিলে কী হতো, সেই হিসাব আমরা কষছি। হেরে গেলে সব সময়ই নানা কথা মনে হয়, ইশ্, একটুর জন্য, ওই ক্যাচটা যদি মিস না হতো, ওই মারটা যদি ছক্কা হয়ে যেত। কিন্তু খেলার ফল তাতে পাল্টায় না। ভারত হয়তো যোগ্যতর দল হিসেবেই জিতেছে, তবু আমরা বলব, আমাদের সাকিব-তামিম থাকলে দেখিয়ে দিতাম। বা শিশির যেহেতু বড় নিয়ামক হয়ে উঠেছিল, আগে ফিল্ডিং পেলেই জিতে যেতাম। আমরা যারা ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ নই, যাঁরা কেবলই সমর্থক, হয়তো অন্ধ সমর্থক এবং না-বুঝ ও নাছোড়-সমর্থক, তাঁরা তো কত কথাই বলব। এসবে তেমন গুরুত্ব না দিলেও চলবে। শুধু আমরা বলব, আমরা এই দেশটাকে ভালোবাসি, ভালোবাসি আমাদের ক্রিকেটারদের, ক্রিকেট দলকে। হারো আর জেতো, আমরা তোমাদের পাশে আছি, সঙ্গে আছি।
যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক, আমি তোমায় ছাড়ব না, মা। এখানেই হয়তো সাকিব আল হাসানদের কাছে আমরা আরেকটু সংযত আচরণ আশা করি। এখানেই হয়তো আশরাফুলদের কাছ থেকে আমরা এত বড় বিচ্যুতি আশা করি না। আমার নিজের ধারণা, আমরা বাংলাদেশের পুরুষেরা সাফল্য নিতে পারি না। আপনারা প্রায়ই ইস্পাতের বিজ্ঞাপনে শুনবেন একটা কথা, ‘বুয়েট পরীক্ষিত!’ ইস্পাতের দুই ধরনের পরীক্ষা করা হয়। একটা হলো, ইস্পাত টেনশন বা টান কতখানি সহ্য করতে পারে। আরেকটা হলো, স্ট্রেস বা চাপ কতখানি সইতে পারে। একটা পর্যায়ে গিয়ে লোহা ছিঁড়ে যায়, বা ভেঙে যায়। বাংলাদেশে সাফল্যের তেমন কোনো উদাহরণ নেই বললেই চলে। এই দেশে খুব কম মানুষই আছেন, যাঁদের স্বীকৃতি বা সাফল্য আন্তর্জাতিক মানের। কাজেই আমাদের মধ্যে কেউ একটু সফল হলেই হয় আমরা টেনশনে ছিঁড়ে যাই, নয়তো স্ট্রেসে ভেঙে পড়ি। পুরো জাতি উন্নত না হলে সেখান থেকে উন্নততর মানুষ কম পাওয়া যাবে। একটা বিশাল হিমালয় রেঞ্জ আছে বলেই একটা এভারেস্ট আছে। এভারেস্ট একা একা বড় হতে পারে না। সাকিব আল হাসানের কথা ধরুন। অল্প বয়স। মাগুরা থেকে এসেছেন। এই বয়সে কী খ্যাতি! কী টাকাপয়সা! তাঁকে যে কাউন্সেলিং করবে, কে আছে। আমাদের সিস্টেমেই তো কাউন্সেলিং ব্যাপারটা নেই। তাঁর ওপরে চাপটা কী ভাবুন। তিনি শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় এক দিনের খেলায় যেভাবে ব্যাটিং করছিলেন, বোঝাই যাচ্ছিল, তিনি চাপমুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছেন। ওইটা কাজে লেগে গেলেই হয়ে যেত। কোনো দিন হয়, কোনো দিন হয় না। আপনি ঠেকিয়ে খেলতে গিয়ে এলবিডব্লু হতে পারেন, স্লিপে ক্যাচ দিতে পারেন। তখন মনে হবে, মারলেই তো হতো। খেলাটা কঠিন। তার চেয়েও কঠিন মাথা ঠান্ডা রাখা।
আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরদেরও দেখি, মাথা আউলা হয়ে যায়। কী সব দুর্নীতি করেন। একটা কিছু সম্মান পেলেই নিজেকে দেশের চেয়েও বড় ভাবতে শুরু করি অনেক সময়। আর ওই অল্পবয়সী ছেলেগুলোর ওপরে কী চাপ! তবু সাকিব যা করেছেন, তা গ্রহণযোগ্য নয়, সেটা আমাদের স্বীকার করে নিতেই হবে। সাকিব আমাদের সবচেয়ে গৌরবের ধন বলেই তাঁর কাছে আমরা আদর্শ আচার-ব্যবহারও আশা করি। ভুলত্রুটি নিয়েই মানুষ। অমন যে মহাত্মা গান্ধী, তাঁর জীবনেও কত কাহিনি। মানুষি দুর্বলতা আমাদের সবার আছে। তবু ওটাও সত্য, ‘একটুখানি ভুলের তরে অনেক বিপদ ঘটে, ভুল করেছে যারা সবাই ভুক্তভোগী বটে।’ সাকিব নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন। ভুল স্বীকার করে নিয়েছেন। ফেসবুকে দেখলাম, তিনি তাঁর অগণিত ভক্তের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এশিয়া কাপে সাকিবের কথা আমাদের বারবার মনে পড়বে। তামিমের কথা মনে পড়বে। বিশেষ করে, গত এশিয়া কাপের ফাইনালে দুই রানে হেরে যাওয়ার পরে সাকিব আল হাসানের কাঁধে মুশফিকের মাথা, সাকিবের সিক্ত চোখ চিকচিক করছে, সেই দৃশ্য পুরো দেশকে আবেগাক্রান্ত করে তুলেছিল। দুই বছর আগে ১৬ মার্চ শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে সাকিব-তামিম-মুশফিক-নাসির টেন্ডুলকারের শততম শতকের দিনে বাংলাদেশের মানুষকে উদ্বেলিত করেছিলেন এক অনন্যসাধারণ বিজয় উপহার দিয়ে। আর ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে ১৭ মার্চ সাকিব-তামিম-মুশফিক ভারতের উৎসবের সাজানো বাসরে পানি ঢেলে দিয়েছিলেন। ক্রিকেট মানসিক খেলাও। জয়ই কেবল জয় এনে দেয়। আমরা একটুর জন্য জিততে জিততেও হেরে গেছি শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক ম্যাচগুলো। ভারতের বিরুদ্ধে তার পরও ছেলেরা মাথা উঁচু করে নেমেছিল,
এবং সমানে সমানে লড়ে গেছে। আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে খেলাটা নিয়ে কিন্তু ভয় আছে। বাংলাদেশ যেমন বড় টুর্নামেন্টে বড় দলকে হারিয়ে দিয়ে মাশরাফির বিখ্যাত সংলাপ ‘ধরায়া দিবানে’কে বাস্তবায়িত করে, তেমনি আয়ারল্যান্ড কিংবা আফগানিস্তানও তো বড় দলকে হারাতে পারে। কাজেই আমি বাংলাদেশের সমর্থকদের বলব, জয়-পরাজয়ে আমাদের মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে, দলের সঙ্গে থাকতে হবে। আর ক্রিকেটারদের বলব, জয়ের জন্যই নামতে হবে। এর নাম জিগীষা। জয়ের ক্ষুধা। কীভাবে খেলতে হবে না হবে, ব্যাট আগে করতে হবে নাকি বোলিং—এগুলো একেবারেই টিমের নিজস্ব ব্যাপার, এসব ব্যাপার নিয়ে আমরা কোনো কথাই বলব না। আমরা বলব, আমাদের ক্রিকেট দল খুব একটা খারাপ সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। কেবল জয়ই পারে দলটাকে আবার চাঙা করতে। অসুস্থতার কারণে সাকিব খেলতে পারেননি, সাকিবকে ছাড়াই নিউজিল্যান্ডকে বাংলাওয়াশ করা গিয়েছিল। তামিমও ওই সিরিজে শেষ ম্যাচটা খেলেননি। কাজেই আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের খেলোয়াড়েরা যেন তাঁদের স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে পারেন, এই হলো আমাদের প্রার্থনা। আমাদের তরুণ খেলোয়াড়েরা দারুণ খেলছেন; তাঁরা প্রমাণ করবেন, তাঁরাও পারেন। পরের খেলা থেকে সাকিব ফিরে আসবেন। তিনি জাত খেলোয়াড়, তিনি নিশ্চয়ই এই ছন্দচ্যুতিটা সামলে নিতে পারবেন। জয়টা আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে চাঙা করার জন্যও এই মুহূর্তে দরকার। নানা কারণে বর্তমান সময়টাকে বেশ একটা ধূসর বলে মনে হচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে গত একটা বছরে ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো হয়নি, পরিবহন খাতে অমেয় ক্ষতি হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল, বিদেশি ক্রেতারা এখনো আস্থা পাচ্ছে না এই দেশের ওপরে।
মানুষের মনে ফুর্তির ভাবটা নেই। ক্রিকেটের জয় কেবল ক্রিকেটকে উদ্বুদ্ধ করবে না, দেশের সব মানুষকেও পুনরুজ্জীবিত করতে পারে। সেটা আমাদের এখন ভীষণ দরকার। তাই বলে ক্রিকেটারদের ওপরে প্রত্যাশার বাড়তি কোনো চাপও দিতে চাই না। যে কাজ আমরা অন্য ক্ষেত্রে পারি না, রাজনীতিবিদেরা পারেন না সুন্দরতম সুশাসন দিতে, সমাজ বা রাষ্ট্র পারে না দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ দিতে, সর্বক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের এগিয়ে চলার পথটাকে নির্বিঘ্ন রাখতে, কেবল একটা ক্ষেত্র—ক্রিকেট—সেখানে আমরা সব সময় ভালো করব, তা-ও হয় না। আমাদের যদি ভালো করতে হয়, জাতীয় জীবনের সব দিক থেকেই ভালো করতে পারতে হবে। তবে এই জাতি নিয়ে আমাদের আশা মরে না। দেশের ৯৮ ভাগ ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়। ২০ বছর পরে এই দেশের প্রত্যেক কৃষক, প্রত্যেক শ্রমিক হবেন শিক্ষিত। এখনই প্রতিবছর ১০ লাখ মানুষ কাজের সন্ধানে বিদেশে যান, ২০ বছর পরে চার কোটি মানুষ বিদেশে থাকবেন এবং বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে দেশকে ভাসিয়ে দেবেন। পুঁজি তত দিনে গড়ে উঠে নিজের স্বার্থে নিজেকে পাহারা দেবে, আইনশৃঙ্খলা সুশাসন নিশ্চিত করতে চাইবে। সেই বাংলাদেশ হবে সব দিক থেকে একটা আলোকিত বাংলাদেশ। তখন আমরা সবকিছুতে ভালো করব, শিক্ষায়-দীক্ষায়, বিজ্ঞানে, কলায়, সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে ও নানা ধরনের খেলায়। এবং অবশ্যই ক্রিকেটে। ক্রিকেটই তো আমাদের বড় জয়ের আশায় উদ্বুদ্ধ করেছিল সবার আগে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments