ফজল আমার আত্মার আত্মীয় by আল মাহমুদ
ফজলের মৃত্যু আমার বুকে একটি আঘাতজনিত
ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। আমি খুবই কষ্ট পেয়েছি। মনে হচ্ছে আমার বুকের পাঁজর
ভেঙে গেছে। আমি বেদনাহত ভারাক্রান্ত। তার সঙ্গে কত স্মৃতি। আমরা কাছাকাছি
বয়সের। আমাদের চেয়ে একটু বড় ছিলেন শামসুর রাহমান, তারপর ফজল, আমি ও শহীদ
কাদরী। আমাদের আড্ডা হতো বিউটি বোর্ডিংয়ে। সেখানে কবিরা আসতেন। আসতেন
সাংস্কৃতিক জগতের মানুষেরা। আসতেন লেখক এবং বোদ্ধা পাঠকেরা। আড্ডা চলত
দীর্ঘ সময় ধরে। ফজল ছিলেন সে আড্ডার প্রাণ।
ফজল যখন পোস্ট অফিসে চাকরি করতেন তখনও সে অফিসে আমাদের আড্ডা হতো। দৈনিক বাংলার উল্টোদিকে হারুন এন্টারপ্রাইজ তো ছিল আমাদের প্রাণভূমি। প্রায় দুপুরে আমাদের খাওয়া হতো। ফজলই ডাক পাঠাতেন। ফজল নেই সেসব স্মৃতি এখন চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে। আমাদের সবাইকে এক দিন চলে যেতে হবে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু ফজলের এই চলে যাওয়াটাকে আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। তিনি আমার চেয়ে সবল ছিলেন। তার বড় কোনো অসুখের কথা কখনও শুনিনি। হঠাৎ ব্রেনস্ট্রোক তারপর অল্পদিনের মধ্যেই মৃত্যু- এ সত্যিই যেন এক অসম্ভব ঘটনা, যা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।
ফজল ছিল আমাদের আত্মার আত্মীয়। তার মৃত্যু আমাকে আত্মাহীন আত্মীয়হীন করেছে। অনেক দিন হৃদয়ে এমন তীব্র বেদনাবোধ করিনি। ফজলের লিরিকধর্মী কবিতার বই হে নীল সমুদ্র হে বৃক্ষ সবুজ-এর শেষে বইটি নিয়ে আমার একটি ছোট্ট লেখা ছাপা হয়েছিল। লেখাটিতে আমি লিখেছিলাম-
একজন কবি নিজেকে আবিষ্কার করেন অকস্মাৎ দৈবভাবে। বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে ফেটে বেরোয় এমন একটা আঙ্গিকরীতি, যাতে হৃদয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। ফজল শাহাবুদ্দীনের বর্তমান ক্ষুদ্র কবিতার বই হে নীল সমুদ্র হে বক্ষ সবুজ পাঠ করে আমার মনে হল এ এক আশ্চর্য স্ফুরণ, কবি হৃদয়ের এক সময়োচিত আবিষ্কার কিংবা আন্তরিক উৎসার। ফজলের কবিতা যে এমন আধ্যাত্মিক বিষয়ের সঙ্গে লগ্ন হবে তা কবিতার পাঠক হিসেবে আমার ধারণার বাইরে ছিল। আমি ফজল শাহাবুদ্দীনকে এক নির্বিরোধ গভীর প্রেমের কবি হিসেবেই জেনে এসেছি এমনকি প্রকৃতির কবি হিসেবেও। এখন দেখছি তার কবিতায় আছে অন্য এক গূঢ় রহস্য, যা আমাদের কবিতার জন্য একান্ত দরকার। আকস্মিক চিত্রকল্প বা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনুভব যে এমন দীর্ঘস্থায়ী কল্পনাসঞ্চারী হতে পারে কবির এই টুকরো কবিতাগুলো আস্বাদন না করলে আমি হয়তো সে সম্বন্ধে অজ্ঞই থেকে যেতাম। এ দিক দিয়ে কবি ফজল শাহাবুদ্দীন অনেকেরই চোখ খুলে দিতে পেরেছেন বলে আমি মনে করি।
তার এই ক্ষুদ্র কবিতাগুলোতে রয়েছে এক ধরনের গভীর ভাবব্যঞ্জনা, যা পাঠককে একজন দ্রষ্টার দার্শনিক উপলব্ধির কাছে নিয়ে যায়। যেন কাম প্রেম ও প্রকৃতির পর্দাকে ভেদ করতে গিয়ে কবি অন্য এক সত্যকে উদঘাটন করে দিচ্ছেন। যার নাম দিতে পারি আমরা আস্থা বা বিশ্বাস।
ফজলের কবিতার এই মোড় পরিবর্তন সামগ্রিক বিচারে আধুনিক বাংলা কবিতারই অনাস্বাদিত এক দিগন্তে উপনীত হওয়া। এ অভিজ্ঞতা সমকালীন কবি মাত্রকেই প্রভাবিত করবে। অন্তত আমি তো অভিভূত হয়েছি।
আমার স্মৃতি আর আগের মতো কাজ করে না। আমি ফজলের কবিতা নিয়ে অনেক কিছু লিখতে পারতাম কিন্তু বয়স আমাকে নিরুৎসাহিত করল তাই বাধ্য হয়ে পুরনো লেখার উদ্ধৃতি দিতে হল।
কবি খ্যাতি নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব আমাদের মধ্যে ছিল না, তবে একটু প্রতিযোগিতা একটু ঈর্ষা তো ছিলই কিন্তু তা কখনও আমাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরাতে পারেনি। মাঝে মধ্যে মান-অভিমান হতো তবে তা সাময়িক। ক্ষণিক পরেই সে মেঘ কেটে যেত। ফজলের মতো বন্ধু বৎসল মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। আমি নিজেও আড্ডা পছন্দ করি কিন্তু ফজলের মতো আড্ডাপ্রিয় মানুষ এ সমাজে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আমি ফজলকে ভালোবাসতাম তার হৃদয় খোলা আচরণের জন্য। তার পছন্দ অপছন্দকে সে ঢেকে রাখতে পারত না এতে করে অনেকেই তার ওপর রাগ হতো কিন্তু আমরা যারা তাকে চিনেছি তারা তার হৃদয়কে বুঝতাম আর বুঝতাম বলেই তার কথায় কখনও কিছু মনে করতাম না।
ফজলের এবারের অসুস্থতার সংবাদটি আমি জানতে পারি কবি শাহীন রেজার কাছ থেকে। সে আমার এবং ফজলের দুজনেরই খুব প্রিয় পাত্র। শুনে খুব খারাপ লেগেছিল। শাহীনকে বলেছিলাম আমি ফজলকে দেখতে যাব। কিন্তু আমিওতো শারীরিকভাবে সুস্থ নই, তাই যেতে পারিনি। ৪ ফেব্র“য়ারি ফজলের জন্মদিনে শাহীন এসেছিল সঙ্গে কামরুজ্জামান, কিন্তু সেদিন আমার শরীর ছিল ভয়ানক রকম খারাপ। বিছানা থেকেই উঠতে পারছিলাম না। ওরা আমার অবস্থা দেখে আমাকে না নিয়েই ফিরে গেল। আজ খুব আফসোস হচ্ছে। যদি সেদিন শরীরটা বেশি রকম খারাপ না হতো তাহলে ফজলকে অন্তত শেষ দেখাটা দেখতে পারতাম।
আগেই বলেছি ফজল চলে গিয়ে আমাকে আরও একা করে দিয়ে গেলেন। ফজলের মৃত্যুতে শুধু আমারই ক্ষতি হল না, ক্ষতি হল বাংলার কবিতারও। ফজল তার লেখার মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকুন অনন্তকাল।
ফজল যখন পোস্ট অফিসে চাকরি করতেন তখনও সে অফিসে আমাদের আড্ডা হতো। দৈনিক বাংলার উল্টোদিকে হারুন এন্টারপ্রাইজ তো ছিল আমাদের প্রাণভূমি। প্রায় দুপুরে আমাদের খাওয়া হতো। ফজলই ডাক পাঠাতেন। ফজল নেই সেসব স্মৃতি এখন চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে। আমাদের সবাইকে এক দিন চলে যেতে হবে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু ফজলের এই চলে যাওয়াটাকে আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। তিনি আমার চেয়ে সবল ছিলেন। তার বড় কোনো অসুখের কথা কখনও শুনিনি। হঠাৎ ব্রেনস্ট্রোক তারপর অল্পদিনের মধ্যেই মৃত্যু- এ সত্যিই যেন এক অসম্ভব ঘটনা, যা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।
ফজল ছিল আমাদের আত্মার আত্মীয়। তার মৃত্যু আমাকে আত্মাহীন আত্মীয়হীন করেছে। অনেক দিন হৃদয়ে এমন তীব্র বেদনাবোধ করিনি। ফজলের লিরিকধর্মী কবিতার বই হে নীল সমুদ্র হে বৃক্ষ সবুজ-এর শেষে বইটি নিয়ে আমার একটি ছোট্ট লেখা ছাপা হয়েছিল। লেখাটিতে আমি লিখেছিলাম-
একজন কবি নিজেকে আবিষ্কার করেন অকস্মাৎ দৈবভাবে। বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে ফেটে বেরোয় এমন একটা আঙ্গিকরীতি, যাতে হৃদয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। ফজল শাহাবুদ্দীনের বর্তমান ক্ষুদ্র কবিতার বই হে নীল সমুদ্র হে বক্ষ সবুজ পাঠ করে আমার মনে হল এ এক আশ্চর্য স্ফুরণ, কবি হৃদয়ের এক সময়োচিত আবিষ্কার কিংবা আন্তরিক উৎসার। ফজলের কবিতা যে এমন আধ্যাত্মিক বিষয়ের সঙ্গে লগ্ন হবে তা কবিতার পাঠক হিসেবে আমার ধারণার বাইরে ছিল। আমি ফজল শাহাবুদ্দীনকে এক নির্বিরোধ গভীর প্রেমের কবি হিসেবেই জেনে এসেছি এমনকি প্রকৃতির কবি হিসেবেও। এখন দেখছি তার কবিতায় আছে অন্য এক গূঢ় রহস্য, যা আমাদের কবিতার জন্য একান্ত দরকার। আকস্মিক চিত্রকল্প বা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনুভব যে এমন দীর্ঘস্থায়ী কল্পনাসঞ্চারী হতে পারে কবির এই টুকরো কবিতাগুলো আস্বাদন না করলে আমি হয়তো সে সম্বন্ধে অজ্ঞই থেকে যেতাম। এ দিক দিয়ে কবি ফজল শাহাবুদ্দীন অনেকেরই চোখ খুলে দিতে পেরেছেন বলে আমি মনে করি।
তার এই ক্ষুদ্র কবিতাগুলোতে রয়েছে এক ধরনের গভীর ভাবব্যঞ্জনা, যা পাঠককে একজন দ্রষ্টার দার্শনিক উপলব্ধির কাছে নিয়ে যায়। যেন কাম প্রেম ও প্রকৃতির পর্দাকে ভেদ করতে গিয়ে কবি অন্য এক সত্যকে উদঘাটন করে দিচ্ছেন। যার নাম দিতে পারি আমরা আস্থা বা বিশ্বাস।
ফজলের কবিতার এই মোড় পরিবর্তন সামগ্রিক বিচারে আধুনিক বাংলা কবিতারই অনাস্বাদিত এক দিগন্তে উপনীত হওয়া। এ অভিজ্ঞতা সমকালীন কবি মাত্রকেই প্রভাবিত করবে। অন্তত আমি তো অভিভূত হয়েছি।
আমার স্মৃতি আর আগের মতো কাজ করে না। আমি ফজলের কবিতা নিয়ে অনেক কিছু লিখতে পারতাম কিন্তু বয়স আমাকে নিরুৎসাহিত করল তাই বাধ্য হয়ে পুরনো লেখার উদ্ধৃতি দিতে হল।
কবি খ্যাতি নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব আমাদের মধ্যে ছিল না, তবে একটু প্রতিযোগিতা একটু ঈর্ষা তো ছিলই কিন্তু তা কখনও আমাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরাতে পারেনি। মাঝে মধ্যে মান-অভিমান হতো তবে তা সাময়িক। ক্ষণিক পরেই সে মেঘ কেটে যেত। ফজলের মতো বন্ধু বৎসল মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। আমি নিজেও আড্ডা পছন্দ করি কিন্তু ফজলের মতো আড্ডাপ্রিয় মানুষ এ সমাজে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আমি ফজলকে ভালোবাসতাম তার হৃদয় খোলা আচরণের জন্য। তার পছন্দ অপছন্দকে সে ঢেকে রাখতে পারত না এতে করে অনেকেই তার ওপর রাগ হতো কিন্তু আমরা যারা তাকে চিনেছি তারা তার হৃদয়কে বুঝতাম আর বুঝতাম বলেই তার কথায় কখনও কিছু মনে করতাম না।
ফজলের এবারের অসুস্থতার সংবাদটি আমি জানতে পারি কবি শাহীন রেজার কাছ থেকে। সে আমার এবং ফজলের দুজনেরই খুব প্রিয় পাত্র। শুনে খুব খারাপ লেগেছিল। শাহীনকে বলেছিলাম আমি ফজলকে দেখতে যাব। কিন্তু আমিওতো শারীরিকভাবে সুস্থ নই, তাই যেতে পারিনি। ৪ ফেব্র“য়ারি ফজলের জন্মদিনে শাহীন এসেছিল সঙ্গে কামরুজ্জামান, কিন্তু সেদিন আমার শরীর ছিল ভয়ানক রকম খারাপ। বিছানা থেকেই উঠতে পারছিলাম না। ওরা আমার অবস্থা দেখে আমাকে না নিয়েই ফিরে গেল। আজ খুব আফসোস হচ্ছে। যদি সেদিন শরীরটা বেশি রকম খারাপ না হতো তাহলে ফজলকে অন্তত শেষ দেখাটা দেখতে পারতাম।
আগেই বলেছি ফজল চলে গিয়ে আমাকে আরও একা করে দিয়ে গেলেন। ফজলের মৃত্যুতে শুধু আমারই ক্ষতি হল না, ক্ষতি হল বাংলার কবিতারও। ফজল তার লেখার মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকুন অনন্তকাল।
No comments