ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখানো মানুষটি
‘ভালো ছিলাম। প্রেসক্লাবে আড্ডা দিতাম। ঘুরে বেড়াতাম। মাঝেমধ্যে প্রথম আলোয় কলাম লিখতাম। সকাল থেকেই ফোনে লোকজন বলত, চমৎকার লেখা হয়েছে। আমরা তো এ রকম লেখাই চাই। সরকারের সমালোচনা করলে ফোন বেশি আসত। সেটা খালেদার সরকার হোক কিংবা হাসিনার।’ শেখ হাসিনার প্রথম সংবাদ সম্মেলনে একটি প্রশ্ন করেছিলেন মূসা ভাই। এর পর থেকে মোসাহেবরা তাঁর বিরুদ্ধে কান ভারী করতে থাকল। এটাও সমস্যা নয়। সমস্যা নাকি শুরু হলো টক শোর কারণে। এ জন্য অনেকখানি আমি দায়ী। আমি নাকি সর্বনাশ করেছি। গভীর রাতে চ্যানেল আইয়ের শোতে এসে মূসা ভাই প্রথমেই বলতেন, ‘আজ কী জিজ্ঞেস করবি? তোর এখানে এলেই কী যেন হয়ে যায়। সব সত্য কথা, শক্ত কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়।’ এভাবে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বলতেন প্রতিদিন। অসংখ্য স্মৃতি মূসা ভাইয়ের সঙ্গে। কেউ কেউ বলেন, টেলিভিশন লাইসেন্স পাননি বলে তিনি সরকারের কড়া সমালোচনা করেন। নিশ্চিত করে বলতে পারি, এটা সত্য নয়। অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি।
তাঁর সাফ জবাব, রাত জেগে যাঁরা অনুষ্ঠান দেখতে টিভির সামনে বসেন, তাঁরা দলনিরপেক্ষ আলোচনা চান। আমি কী পেলাম বা পেলাম না তাতে কী যায়-আসে। তা ছাড়া আমার কোনো আফসোস নেই। বঙ্গবন্ধুকন্যা যেহেতু আমার ওপর আস্থা রাখতে পারেননি, তখন আমি কী করব। আমি তো বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য ছিলাম। টক শোতে সরাসরি বলতেন তিনি আওয়ামী লীগের এমপি ছিলেন। আলোচনায় কখনো মনে হতো না তিনি কোন দলভুক্ত। অথবা কোনো দুর্বলতা রয়েছে বিশেষ দলের প্রতি। মূসা ভাই আসলে এক জীবন্ত ডিকশনারি। ৫০ বছর আগের কোনো ঘটনা বা কোনো ব্যক্তির নাম ভুল হতো না তাঁর আলোচনায়। শরীরটা ভালো নেই। আমার ওপর রাগ দেখিয়ে আলোচনার টেবিলে বসে যখন ঘটনার বিবরণ দিতেন, তখন মনে হতো তরতাজা কোনো ঘটনার বিবরণ দিচ্ছেন। হাজার শরীর খারাপ হলেও মধ্যরাতের টক শো মিস করতেন না। মূসা ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক প্রায় ৪২ বছর। সব সময় তাঁর কাছ থেকে আদর-ভালোবাসা পেয়েছি। ভালো রিপোর্ট ছাপা হলে প্রশংসা করতেও কুণ্ঠাবোধ করতেন না। ইদানীং এটা অনুপস্থিত। সবাই রক্ত পরীক্ষা করে দেখতে চান রক্তের গ্রুপ ‘এ’ না ‘বি’। কিন্তু মূসা ভাই খারাপ হলে মুখের ওপর বলে দিতেন বা দেন। বিশ্বকাপ ফুটবল কভার করে ঢাকায় ফিরেছি। প্রেসক্লাবে দেখা। প্রথম বাক্য, ‘ওয়েলডান। তুই তো স্পোর্টস রিপোর্টার না। তুই কেন ইতালি গেলি?’ আবার নিজেই বললেন, ‘ইত্তেফাকে খেলা যেখানে সিঙ্গেল কলাম ছাপা হতো এই এক মাস দেখলাম প্রধান শিরোনাম। সারওয়ার আছে তো (বার্তা সম্পাদক গোলাম সারওয়ার) এ জন্যই বোধ করি। ভালো হয়েছে।’ কোক খাচ্ছিলেন। আমাকেও খেতে বললেন। মূসা ভাইয়ের মুখে শোনা একটি ঘটনা উল্লেখ করে লেখাটির যবনিকা টানব। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলন নিয়ে তুমুল বিতর্ক। অবরোধ আর হরতালে কাবু ৫৪ হাজার বর্গমাইল। কোনো সমঝোতা হচ্ছে না সরকার ও বিরোধীপক্ষের মধ্যে। ভারত-মার্কিন কূটনৈতিক যুদ্ধও হয়ে গেল বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে। ভারত সংবিধান রক্ষার পক্ষে মরিয়া। যুক্তরাষ্ট্র চায় সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন। সমঝোতা হলো না। শেষ পর্যন্ত যা হওয়ার তা-ই হলো। একপেশে নির্বাচন পেলাম আমরা। বিএনপির গায়ে কলঙ্ক লেগেছিল ১৫ ফেব্রুয়ারির তামাশার নির্বাচন করে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন করে আওয়ামী লীগও কলঙ্কিত হলো। আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন মূসা ভাইয়ের কাছে একটি প্রস্তাব এল। প্রস্তাবটি নিয়ে এসে একজন মন্ত্রী বললেন, ‘মূসা ভাই, আপনি তো সর্বজন শ্রদ্ধেয়। সবাই আপনাকে মান্য করে। আপনার কথার মূল্য দেয়। এক কাজ করেন না, আপনি সমঝোতার একটি উদ্যোগ নেন না।’ মূসা ভাই হতবাক। কী বলছেন মন্ত্রী। যে সরকারের লোকজন তাঁর ওপর বিরক্ত। প্রকাশ্যে বক্তৃতা-বিবৃতিতে কড়া সমালোচনা করছেন। এর মধ্যে দূতিয়ালির প্রস্তাব। মন্ত্রী বললেন, ‘আমরা কয়েকজন বসেছিলাম।
প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে একটি সমঝোতা করা যায় কি না। তখনই আপনার নাম এসেছে।’ মূসা ভাই প্রশ্ন করলেন, ‘ঠিক করে বলছিস তো? উদ্যোগ নিলাম। পরে দেখা গেল কেউ শুনল না, তখন আমি ফালতু বনে যাব।’ মন্ত্রী বললেন, ‘না, সবই ঠিক আছে।’ মূসা ভাই প্রেসিডেন্ট দপ্তরে ফোন করে সময় নিলেন। এক শনিবারে দেখা করলেন প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদের সঙ্গে। প্রেসিডেন্ট খালেদা জিয়াকে ডাকতে রাজি হলেন বঙ্গভবনে। বঙ্গভবন থেকে বের হয়ে মূসা ভাই মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে এই উদ্যোগের কথা বললেন। মির্জা রাজি। খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা বলে জানাবেন। দুই ঘণ্টার মধ্যে জানালেন। তাঁদের আপত্তি নেই। খালেদা জিয়া ১৮-দলীয় জোট নেতাদের নিয়ে গেলেন বঙ্গভবনে। প্রধানমন্ত্রীও সৈয়দ আশরাফকে নিয়ে প্রেসিডেন্টের চা-চক্রে যোগ দিয়েছিলেন। বরফ কিছু গলেনি। সে অন্য এক বিতর্ক। কেন সমঝোতা হয়নি, এ নিয়ে নানা কথাই চাউর হয়ে গেছে। যেভাবে জাতিসংঘ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর দূতিয়ালি ব্যর্থ হয়েছিল, প্রেসিডেন্টের উদ্যোগও সেভাবেই ব্যর্থ হয়ে যায়। মূসা ভাই আমাকে অফিসে এসে এ ঘটনা বলেছিলেন। মূসা ভাই এখন টক শোতে আসেন না। শরীরটা বড্ড খারাপ। হাসপাতালে শুয়ে আছেন। দেখা করতে গিয়েছিলাম। শুরুতেই একহাত নিলেন। বললেন, ‘তুই এখনো টক শোতে যাচ্ছিস দেখে অবাক হই। এখন তো টক শোর আবেদন কমে গেছে।’ আবার নিজেই বললেন, ‘কিরে, কারে কারে নিষিদ্ধ করলি। আমি কী করি, সেটা আমি জানি। তোকে বললাম আর কি। আমার মনে হয় আর টক শোতে যাওয়া হবে না।’ তাঁর চোখ ছলছল করছে। বললাম, ‘অবশ্যই যাবেন।’ তিনি বললেন, ‘সান্ত্বনা দিচ্ছিস। আমার জন্য দোয়া করিস।’ নীরবে বসে আছি কয়েক মিনিট। মূসা ভাইয়ের শেষ কথা, ‘সত্য না বলতে পারলে টক শোতে যাবি না।’ যা-ই হোক, মূসা ভাইয়ের জন্মদিনে অনেক অনেক শুভেচ্ছা। সেই সঙ্গে কামনা করছি তিনি আবার ফিরে আসবেন টিভির পর্দায়। শোনাবেন তাঁর জীবনের অনেক অজানা কাহিনি। স্বপ্ন দেখাবেন ভবিষ্যতের।
মতিউর রহমান চৌধুরী: সম্পাদক, দৈনিক মানবজমিন।
মতিউর রহমান চৌধুরী: সম্পাদক, দৈনিক মানবজমিন।
No comments