আমাদের আসবাব ছিল রাশি রাশি বই by বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর
আমার
মধ্যবিত্ত শিক্ষক পিতা আমাদের জন্য উপহার দিয়েছিলেন রাশি রাশি বই।
আসবাবহীন গৃহে আমাদের আসবাব ছিল বই ও পত্রিকা। আমরা ভাইবোনেরা, বাইরে থেকে
গৃহে ফিরলে হুমড়ি খেয়ে পড়তাম বইয়ের ওপর। বইয়ের মধ্যে জীবন যাপন করার দরুন
বই-ই আমাদের সম্বল এই বোধ আমাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে। বই ছাড়া থাকতে পারি না,
বইহীন ঘরে ঢুকলে অস্বস্তি হয়। আমার ছাতাছত্র শেষ পর্যন্ত বই। বড় হয়েছি এমন
এক শহরে যা-কিনা গ্রামের মৌচাক। দুটো রাস্তা পার হলেই গ্রামের বসতে
পৌঁছানো যায়, আর বসতের চারপাশ ঘিরে একই নদীর তিন লহর ভূকৈলাশের রাজবাড়ির
দিকে নদীর নাম সুগন্ধা, স্টিমার স্টেশনের দিকে নাম বিষখালি, আর শহর ছাড়িয়ে
গ্রামের দিকে গেলে ধানসিঁড়ি। আমাদের সূর্যোদয় হতো নদীর মধ্যে রোদ দেখে, আর
সূর্যাস্ত হতো নদীর মধ্যে রঙের গুঞ্জরণ শুনে। বৃষ্টির দিন অফুরন্ত বৃষ্টির
মধ্যে নৌকাগুলো কোথায় কোথায় চলে যেত, আর শীতের দিন অবারিত কুয়াশার মধ্যে
স্টিমার আসার সিটি শুনে আমরা দৌঁড়াতাম জেটির দিকে। আমাদের ঝালকাঠি ছেড়ে
যাওয়ার কথা নয়, কিন্তু কোথাও যাওয়ার তাড়া আমাদের মধ্যে তাড়াহুড়োর তরপানি
তৈরি করত। যেন কোথাও যেতে হবে অফুরন্ত, অনন্ত, অকল্পনীয়র দিকে।
বই এবং নিসর্গ শাদা পিরহানের তরঙ্গের মতো আমাকে ডাক দিত, আমি বইয়ের মধ্যে পথ হারাতাম, আমি নিসর্গের মধ্যে পথ হারাতাম নিজের ঠিকানার খোঁজে। এভাবেই বইয়ের মধ্য দিয়ে নিসর্গে প্রবেশ করেছি আর নিসর্গের মধ্য দিয়ে বইয়ে ফিরে এসেছি। দুই ভুবন হাত ধরাধরি করে আমাদের ঘিরে রেখেছে। নিসর্গ কিংবা বই শেষ পর্যন্ত শান্তি নয়; এই বোধের ধাক্কা কয়েকটি ঘটনার দরুন নিদারুণভাবে আমাকে সজাগ করেছে।
আমার কৈশোর কেটেছে ১৯৪০ থেকে ১৯৪৭ সময়কালের মধ্যে। আমাদের বাড়িতে দুধ সরবরাহ যিনি করতেন তার পুত্র আজিজ ভাই শহরের ঈর্ষার পাত্র। দীর্ঘদেহী, উজ্জ্বল ছাত্র, পড়া ও ফুটবলে অগ্রগণ্য আজিজ ভাই ভোট শহরে পাঠাগার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। আর আমাকে করেছিলেন গ্রন্থাগারিক। দুটো কেরোসিন কাঠের শেলফ ভর্তি বই, একটি পড়ো টিনের বাড়ির পেছন দিকে। পড়োবাড়ির উঠোনে আমরা জাম্বুরা দিয়ে বল খেলতাম আর মধ্যে মধ্যে বই পড়তাম। সংগ্রহের মধ্যে গল্পের বই ছিল : রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎচন্দ্র, আর ছিল ছোট ছোট পুস্তিকা রাজনীতি ও অর্থনীতির। মধ্যে মধ্যে আজিজ ভাই আসতেন জেলা শহর বরিশাল থেকে, আমাদের ডেকে নিয়ে গল্প করতেন। জোর গলায় বলতেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের মৃত্যু হবে। ব্রিটিশরা আমাদের দেশকে শাসন ও শোষণ করেছে। আমাদের মান সম্মান নষ্ট করেছে। আমাদের তাই স্বাধীন হতে হবে এবং গড়তে হবে সমাজতন্ত্রী ভবিষ্যৎ। সমাজতন্ত্র শব্দটা বুঝতাম না, ছোটদের অর্থনীতির বই খুলে তিনি বোঝাতেন, আর বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতো, সন্ধ্যার অন্ধকারে হারিকেন লণ্ঠন জ্বেলে আমরা কয়েকজন আজিজ ভাইয়ের হাত ধরে ভবিষ্যৎ সমাজতন্ত্রের দিকে পা ফেলে ফেলে এগোতাম।
এর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, মহাযুদ্ধ, একপক্ষে ইংল্যান্ড, আমেরিকা, সোভিয়েত রাশিয়া, ফ্রান্স ও চীন, অন্যপক্ষে জার্মানি আর জাপান। জাপান নাকি সমুদ্র পেরিয়ে যে কোনো দিন বরিশাল মুলুকে এসে যাবে। তালগাছগুলোর আগা কেটে কেটে কামান বানানো হল। থানার সামনের মাঠে জেলেদের নৌকা ধরে ধরে এনে গেরেফতার করা হল হোগলা বন পর্যন্ত। জাপানিদের নৌকা ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। আজিজ ভাইয়ের সমাজতন্ত্র পাঠ আর মহাযুদ্ধের পদধ্বনির মধ্যে চালের দাম বাড়তে শুরু করে, বাজার থেকে উধাও হয়, আব্বা শূন্য হাতে চালের আড়ত থেকে একদিন ফিরে আসেন। আগামীকাল ভাত খাওয়া হবে না। এই অবস্থার মধ্যে আমাদের রক্ষা করেন আজিজ ভাইয়ের বাবা, দু’ডোলা চাল দিয়ে যান। এর মধ্যে একদিন সকালবেলা হৈ চৈ শুনে ঘুম ভাঙে, টিন ছাওয়া বারান্দায় এসে দেখি আজিজ ভাইকে কোমরে দড়ি বেঁধে থানায় নিয়ে যাচ্ছে। দৌড়ে আসি থানায়, লোকজনের ভিড়, আজিজ ভাই বিষণ্ন মুখে বসে আছেন দেয়ালে ঠেস দিয়ে। আমাকে দেখে হাসলেন। পরে আব্বার কাছে শুনি আজিজ ভাই সোসালিস্ট পার্টি করেন, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি কয়েক জনের সঙ্গে মিলে টেলিগ্রাফের তার কেটেছেন ইংরেজের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় বাধা দেয়ার জন্য। আজিজ ভাইকে জেলা শহরে চালান করা হয়। তার দুধওয়ালা বাবা, আব্বাকে ধরে কাঁদতে লাগলেন, ছেলেকে যেভাবেই হোক ছাড়িয়ে আনতে হবে মাস্টার সাব।
এক সপ্তা পরে জেলা সদর থেকে এক লোক এলেন গোয়েন্দা বিভাগ থেকে। তার মুখটা আমার পছন্দ হল না। তিনি আমাকে জেরা শুরু করলেন পাঠাগার আন্দোলন সম্বন্ধে। পাঠাগারের সদস্যদের তালিকা আমার কাছ থেকে নিলেন। সদস্যদের বয়স জিজ্ঞেস করলেন, বাবাদের জীবিকা জানতে চাইলেন। তিনি আমার সঙ্গে পাঠাগারে এসে বাক্সবন্দি করলেন বইগুলো আর জেলা সদরে চালান দিলেন। লাইব্রেরি বন্ধ হল। আমাদের ‘বাজে’ বইপড়া শেষ হল। স্কুল বন্ধ, কাগজের অভাব; আমার দিন কাটে হোগলার বনে ঘুরে, লাশকাটা সড়কে ঝাউগাছের শনশন শুনে, আর রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্র পড়ে। ছিন্নপত্রের নদী বিদীর্ণ করে, হোগলার বনের মধ্যে সূর্যাস্তের রক্তিম আভা বিদীর্ণ করে, সুগন্ধা-বিষখালি-ধানসিঁড়ির লহর বিদীর্ণ করে আজিজ ভাইয়ের মুখটা মনে হয়, লাশকাটা ঘরে শুয়ে। চারদিকে ঝাউ আর ধান ক্ষেতের শনশন। আর কিছু নেই, কোথাও কিছু নেই।
আস্তে আস্তে টের পাই ছোট্ট এই শহরটার সাধারণ মানুষ মুসলিম লীগ, কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা এবং সোসালিস্ট পার্টির মধ্যে বিভক্ত। অধিকাংশ মুসলমান মুসলিম লীগে, অধিকাংশ হিন্দু হিন্দু মহাসভায়, অধিকাংশ হিন্দু এবং ছিটেফোঁটা মুসলমান কংগ্রেসে এবং জনাদুই হিন্দু মুসলমান সোসালিস্ট পার্টির অনুরক্ত। চাপা একটা রেষারেষি আছে, মধ্যে মধ্যে উত্তেজনা বাড়ে। দেশটার ভবিষ্যৎ কোথায় বুঝি না। বুঝি কোনো একদিন দেশটা স্বাধীন হবে। স্বাধীন হলে আমি কোথায় যুক্ত হব, এই চিন্তাটা কুয়াশার মতো কখনও কখনও দেখা দেয়, যাদের বই পড়ি রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, প্রমথ চৌধুরী তাদের বইয়ের মানুষগুলো সংসারে আছে বুঝি, কিন্তু হাত দিয়ে ছুঁতে পারি না, দূরেই থেকে যায়। এর মধ্যে একদিন একটা বই হাতে এলো, মলাট ছেঁড়া, লেখকের নাম নেই, কেবল বইটার নাম আছে পদ্মা নদীর মাঝি। বইটা পড়ে আচ্ছন্ন হই, কদিন নদীর পাড়ে পাড়ে ঘুরি। যুদ্ধের তাণ্ডবে নৌকা উধাও, নৌকাহীন নদীতে আমি খুঁজি ইলিশ মাছধরা জেলেদের। মানচিত্রে পদ্মা খুঁজে পাই, ঝালকাঠি থেকে পদ্মা বহুদূর। একটা জীবনের মধ্যে প্রবেশ করি, যে জীবনটা মনে হয় চেনাজানা। রবীন্দ্রনাথ পড়তে ভালো লাগে, কিন্তু বইয়ের রবীন্দ্রনাথের আবহাওয়া আমার চারপাশে টের পাই না। তবু জেদি মাছির মতো রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, প্রমথ চৌধুরীর শব্দের মধ্যে ঘুরতে থাকি। শব্দের সঙ্গে শব্দ মিলে শব্দের যে বুনন হয় তার তুলনা হয় না। আমার খিদে বাড়ে, শব্দের খিদে।
মানুষ কিভাবে মুসলমান হয়? কিংবা হিন্দু? মানুষ কিভাবে মুসলিম লীগার হয়? কিংবা কংগ্রেসী হয়? কিংবা সোসালিস্ট হয়? মানুষ এসব হওয়ার মধ্য দিয়ে কিভাবে পরস্পরকে ভালোবাসে? কিংবা ঘৃণা করে? কিংবা পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধ করে? এসব প্রশ্নের মধ্যে আমি যখন রক্তাক্ত হচ্ছি, মহাযুদ্ধ থেকে উত্থিত রক্তের গন্ধে যখন চারপাশ সমাচ্ছন্ন, তখন স্কুল লাইব্রেরি থেকে আব্বার সৌজন্য একটা বই হাতে আসে। মোটাসোটা বই, টলস্টয়ের যুদ্ধ ও শান্তি, বাংলা বইয়ের পাশাপাশি, এই বইটি আমি এক মাস ধরে পড়ি। অসংখ্য চরিত্রের মধ্য দিয়ে কাহিনীর বুনন, একটা অপ্রতিরোধ্য গতিতে চরিত্রগুলো পরস্পরের সঙ্গে আবর্তিত, প্রতিটি চরিত্রের একটা প্রতি-চরিত্র আছে, ভালো ও মন্দের সঙ্গে, শুভ ও অশুভের সঙ্গে সবাই লিপ্ত, আমিও লিপ্ত হই অর্থের নিয়তির মধ্যে। আমি বুঝতে শুরু করি সাহিত্য মানে অর্থের মধ্যে প্রবেশ করা। এই ঘোরের মধ্যে যখন আমার বসবাস শুরু তখন, হঠাৎ একদিন, ঠিক করি; আমি লেখক হব। ছোট শহরটা একটা মহাদেশ হয়, সপ্ত সিন্ধু দশ দিগন্ত হয়, আমি তার মধ্যে হাঁটতে শুরু করি। ধুলাবালির মধ্যে, কাদামাটির মধ্যে আমি হাঁটতে থাকি, সে হাঁটার শেষ নেই। আমি সাহিত্যের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে হাঁটছি, কোথাও পৌঁছব বলে।
বই এবং নিসর্গ শাদা পিরহানের তরঙ্গের মতো আমাকে ডাক দিত, আমি বইয়ের মধ্যে পথ হারাতাম, আমি নিসর্গের মধ্যে পথ হারাতাম নিজের ঠিকানার খোঁজে। এভাবেই বইয়ের মধ্য দিয়ে নিসর্গে প্রবেশ করেছি আর নিসর্গের মধ্য দিয়ে বইয়ে ফিরে এসেছি। দুই ভুবন হাত ধরাধরি করে আমাদের ঘিরে রেখেছে। নিসর্গ কিংবা বই শেষ পর্যন্ত শান্তি নয়; এই বোধের ধাক্কা কয়েকটি ঘটনার দরুন নিদারুণভাবে আমাকে সজাগ করেছে।
আমার কৈশোর কেটেছে ১৯৪০ থেকে ১৯৪৭ সময়কালের মধ্যে। আমাদের বাড়িতে দুধ সরবরাহ যিনি করতেন তার পুত্র আজিজ ভাই শহরের ঈর্ষার পাত্র। দীর্ঘদেহী, উজ্জ্বল ছাত্র, পড়া ও ফুটবলে অগ্রগণ্য আজিজ ভাই ভোট শহরে পাঠাগার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। আর আমাকে করেছিলেন গ্রন্থাগারিক। দুটো কেরোসিন কাঠের শেলফ ভর্তি বই, একটি পড়ো টিনের বাড়ির পেছন দিকে। পড়োবাড়ির উঠোনে আমরা জাম্বুরা দিয়ে বল খেলতাম আর মধ্যে মধ্যে বই পড়তাম। সংগ্রহের মধ্যে গল্পের বই ছিল : রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎচন্দ্র, আর ছিল ছোট ছোট পুস্তিকা রাজনীতি ও অর্থনীতির। মধ্যে মধ্যে আজিজ ভাই আসতেন জেলা শহর বরিশাল থেকে, আমাদের ডেকে নিয়ে গল্প করতেন। জোর গলায় বলতেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের মৃত্যু হবে। ব্রিটিশরা আমাদের দেশকে শাসন ও শোষণ করেছে। আমাদের মান সম্মান নষ্ট করেছে। আমাদের তাই স্বাধীন হতে হবে এবং গড়তে হবে সমাজতন্ত্রী ভবিষ্যৎ। সমাজতন্ত্র শব্দটা বুঝতাম না, ছোটদের অর্থনীতির বই খুলে তিনি বোঝাতেন, আর বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতো, সন্ধ্যার অন্ধকারে হারিকেন লণ্ঠন জ্বেলে আমরা কয়েকজন আজিজ ভাইয়ের হাত ধরে ভবিষ্যৎ সমাজতন্ত্রের দিকে পা ফেলে ফেলে এগোতাম।
এর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, মহাযুদ্ধ, একপক্ষে ইংল্যান্ড, আমেরিকা, সোভিয়েত রাশিয়া, ফ্রান্স ও চীন, অন্যপক্ষে জার্মানি আর জাপান। জাপান নাকি সমুদ্র পেরিয়ে যে কোনো দিন বরিশাল মুলুকে এসে যাবে। তালগাছগুলোর আগা কেটে কেটে কামান বানানো হল। থানার সামনের মাঠে জেলেদের নৌকা ধরে ধরে এনে গেরেফতার করা হল হোগলা বন পর্যন্ত। জাপানিদের নৌকা ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। আজিজ ভাইয়ের সমাজতন্ত্র পাঠ আর মহাযুদ্ধের পদধ্বনির মধ্যে চালের দাম বাড়তে শুরু করে, বাজার থেকে উধাও হয়, আব্বা শূন্য হাতে চালের আড়ত থেকে একদিন ফিরে আসেন। আগামীকাল ভাত খাওয়া হবে না। এই অবস্থার মধ্যে আমাদের রক্ষা করেন আজিজ ভাইয়ের বাবা, দু’ডোলা চাল দিয়ে যান। এর মধ্যে একদিন সকালবেলা হৈ চৈ শুনে ঘুম ভাঙে, টিন ছাওয়া বারান্দায় এসে দেখি আজিজ ভাইকে কোমরে দড়ি বেঁধে থানায় নিয়ে যাচ্ছে। দৌড়ে আসি থানায়, লোকজনের ভিড়, আজিজ ভাই বিষণ্ন মুখে বসে আছেন দেয়ালে ঠেস দিয়ে। আমাকে দেখে হাসলেন। পরে আব্বার কাছে শুনি আজিজ ভাই সোসালিস্ট পার্টি করেন, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি কয়েক জনের সঙ্গে মিলে টেলিগ্রাফের তার কেটেছেন ইংরেজের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় বাধা দেয়ার জন্য। আজিজ ভাইকে জেলা শহরে চালান করা হয়। তার দুধওয়ালা বাবা, আব্বাকে ধরে কাঁদতে লাগলেন, ছেলেকে যেভাবেই হোক ছাড়িয়ে আনতে হবে মাস্টার সাব।
এক সপ্তা পরে জেলা সদর থেকে এক লোক এলেন গোয়েন্দা বিভাগ থেকে। তার মুখটা আমার পছন্দ হল না। তিনি আমাকে জেরা শুরু করলেন পাঠাগার আন্দোলন সম্বন্ধে। পাঠাগারের সদস্যদের তালিকা আমার কাছ থেকে নিলেন। সদস্যদের বয়স জিজ্ঞেস করলেন, বাবাদের জীবিকা জানতে চাইলেন। তিনি আমার সঙ্গে পাঠাগারে এসে বাক্সবন্দি করলেন বইগুলো আর জেলা সদরে চালান দিলেন। লাইব্রেরি বন্ধ হল। আমাদের ‘বাজে’ বইপড়া শেষ হল। স্কুল বন্ধ, কাগজের অভাব; আমার দিন কাটে হোগলার বনে ঘুরে, লাশকাটা সড়কে ঝাউগাছের শনশন শুনে, আর রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্র পড়ে। ছিন্নপত্রের নদী বিদীর্ণ করে, হোগলার বনের মধ্যে সূর্যাস্তের রক্তিম আভা বিদীর্ণ করে, সুগন্ধা-বিষখালি-ধানসিঁড়ির লহর বিদীর্ণ করে আজিজ ভাইয়ের মুখটা মনে হয়, লাশকাটা ঘরে শুয়ে। চারদিকে ঝাউ আর ধান ক্ষেতের শনশন। আর কিছু নেই, কোথাও কিছু নেই।
আস্তে আস্তে টের পাই ছোট্ট এই শহরটার সাধারণ মানুষ মুসলিম লীগ, কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা এবং সোসালিস্ট পার্টির মধ্যে বিভক্ত। অধিকাংশ মুসলমান মুসলিম লীগে, অধিকাংশ হিন্দু হিন্দু মহাসভায়, অধিকাংশ হিন্দু এবং ছিটেফোঁটা মুসলমান কংগ্রেসে এবং জনাদুই হিন্দু মুসলমান সোসালিস্ট পার্টির অনুরক্ত। চাপা একটা রেষারেষি আছে, মধ্যে মধ্যে উত্তেজনা বাড়ে। দেশটার ভবিষ্যৎ কোথায় বুঝি না। বুঝি কোনো একদিন দেশটা স্বাধীন হবে। স্বাধীন হলে আমি কোথায় যুক্ত হব, এই চিন্তাটা কুয়াশার মতো কখনও কখনও দেখা দেয়, যাদের বই পড়ি রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, প্রমথ চৌধুরী তাদের বইয়ের মানুষগুলো সংসারে আছে বুঝি, কিন্তু হাত দিয়ে ছুঁতে পারি না, দূরেই থেকে যায়। এর মধ্যে একদিন একটা বই হাতে এলো, মলাট ছেঁড়া, লেখকের নাম নেই, কেবল বইটার নাম আছে পদ্মা নদীর মাঝি। বইটা পড়ে আচ্ছন্ন হই, কদিন নদীর পাড়ে পাড়ে ঘুরি। যুদ্ধের তাণ্ডবে নৌকা উধাও, নৌকাহীন নদীতে আমি খুঁজি ইলিশ মাছধরা জেলেদের। মানচিত্রে পদ্মা খুঁজে পাই, ঝালকাঠি থেকে পদ্মা বহুদূর। একটা জীবনের মধ্যে প্রবেশ করি, যে জীবনটা মনে হয় চেনাজানা। রবীন্দ্রনাথ পড়তে ভালো লাগে, কিন্তু বইয়ের রবীন্দ্রনাথের আবহাওয়া আমার চারপাশে টের পাই না। তবু জেদি মাছির মতো রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, প্রমথ চৌধুরীর শব্দের মধ্যে ঘুরতে থাকি। শব্দের সঙ্গে শব্দ মিলে শব্দের যে বুনন হয় তার তুলনা হয় না। আমার খিদে বাড়ে, শব্দের খিদে।
মানুষ কিভাবে মুসলমান হয়? কিংবা হিন্দু? মানুষ কিভাবে মুসলিম লীগার হয়? কিংবা কংগ্রেসী হয়? কিংবা সোসালিস্ট হয়? মানুষ এসব হওয়ার মধ্য দিয়ে কিভাবে পরস্পরকে ভালোবাসে? কিংবা ঘৃণা করে? কিংবা পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধ করে? এসব প্রশ্নের মধ্যে আমি যখন রক্তাক্ত হচ্ছি, মহাযুদ্ধ থেকে উত্থিত রক্তের গন্ধে যখন চারপাশ সমাচ্ছন্ন, তখন স্কুল লাইব্রেরি থেকে আব্বার সৌজন্য একটা বই হাতে আসে। মোটাসোটা বই, টলস্টয়ের যুদ্ধ ও শান্তি, বাংলা বইয়ের পাশাপাশি, এই বইটি আমি এক মাস ধরে পড়ি। অসংখ্য চরিত্রের মধ্য দিয়ে কাহিনীর বুনন, একটা অপ্রতিরোধ্য গতিতে চরিত্রগুলো পরস্পরের সঙ্গে আবর্তিত, প্রতিটি চরিত্রের একটা প্রতি-চরিত্র আছে, ভালো ও মন্দের সঙ্গে, শুভ ও অশুভের সঙ্গে সবাই লিপ্ত, আমিও লিপ্ত হই অর্থের নিয়তির মধ্যে। আমি বুঝতে শুরু করি সাহিত্য মানে অর্থের মধ্যে প্রবেশ করা। এই ঘোরের মধ্যে যখন আমার বসবাস শুরু তখন, হঠাৎ একদিন, ঠিক করি; আমি লেখক হব। ছোট শহরটা একটা মহাদেশ হয়, সপ্ত সিন্ধু দশ দিগন্ত হয়, আমি তার মধ্যে হাঁটতে শুরু করি। ধুলাবালির মধ্যে, কাদামাটির মধ্যে আমি হাঁটতে থাকি, সে হাঁটার শেষ নেই। আমি সাহিত্যের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে হাঁটছি, কোথাও পৌঁছব বলে।
No comments