পরাজয়ে ডরে বীর! by আসিফ নজরুল
উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপে আওয়ামী
লীগের বড় ধরনের পরাজয় ঘটেছিল। আওয়ামী লীগের নেতারা বলতে শুরু করেন যে
তাঁদের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়, এর প্রমাণ এসব নির্বাচনের ফলাফল।
একই
বক্তব্য আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির আগেও বিভিন্ন স্থানীয় সরকার
নির্বাচনে হারার পর দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের লক্ষ্য ছিল, ছোট বাজিতে হেরে বড়
বাজিতে বিএনপিকে খেলতে প্রলুব্ধ বা বাধ্য করা। তাদের সেই লক্ষ্য পূরণ হয়নি।
৫ জানুয়ারির আগে বিভিন্ন নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পরও জাতীয় সংসদ নির্বাচন
অনুষ্ঠান করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার নিরপেক্ষ থাকবে, এটি বিশ্বাস করেনি
দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজের বৃহত্তর অংশ এবং সাধারণ মানুষ।
৫ জানুয়ারি নির্বাচন তাই হয়েছে একতরফাভাবে এবং নজিরবিহীন বিভিন্ন অনিয়মের মধ্য দিয়ে। তবু এটি আওয়ামী লীগকে অন্তত কাগুজেভাবে হলেও পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার ম্যান্ডেট দিয়েছে। ক্ষমতায় থাকার লক্ষ্য পূরণ হওয়ার পর সুষ্ঠুভাবে উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠানের তেমন তাগিদ আওয়ামী লীগের মধ্যে থাকার কথা ছিল না। তার পরও আওয়ামী লীগ প্রথম ধাপে নির্বাচনে মোটামুটি সুষ্ঠুভাবে করতে দিয়েছে সম্ভবত এই নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার ভুল হিসাব থেকে। বিএনপি-জামায়াত এমন সর্বাত্মকভাবে নির্বাচনে অংশ নেবে, সেটিও হয়তো তারা বুঝতে পারেনি আগে। প্রথম ধাপে নির্বাচনে পরাজয়ের পর আওয়ামী লীগের এসব ভুল ভেঙেছে। দ্বিতীয় ধাপে তাই তাদের লোকজন কেন্দ্র দখল, ব্যালট বাক্স ছিনতাই এবং জাল ভোট দেওয়ার স্বেচ্ছাচার করেছেন অনেকগুলো এলাকায়। প্রথম ধাপে পরাজিত আওয়ামী লীগ মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে তুলনামূলক বেশি উপজেলা চেয়ারম্যান পদে জয়ীও হয়েছে। আমার ধারণা, আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিজয়ী করতে এই প্রবণতা আগামী ধাপের উপজেলা নির্বাচনগুলোতে আরও বাড়তে পারে।
২.
উপজেলা নির্বাচনে কারচুপি আওয়ামী লীগকে করতে হবে বিভিন্ন কারণে। ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত এবং একতরফা নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সাময়িকভাবে হলেও একটি বিজয়ী মনোভাব সৃষ্টি করতে পেরেছিল। ভোট পর্যবেক্ষণকারী দু-একটি আওয়ামীপন্থী সংগঠন নির্বাচনে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছে বলে জানায়, একশ্রেণীর গণমাধ্যম তা মাত্রাতিরিক্তভাবে প্রচার করে এবং আওয়ামী লীগের রোষের ভয়ে এসব দাবির বৈধতা চ্যালেঞ্জকারীদের কণ্ঠ দ্রুতই ম্নান হয়ে আসে। গত মাসে আকস্মিকভাবে একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান একটি জরিপ করে জানিয়ে দেয় যে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও আওয়ামী লীগ বেশি ভোট পেত। এই জরিপে পদ্ধতিগত মারাত্মক কিছু ত্রুটি (যেমন দৈবচয়ন না করে টার্গেটেড মানুষের মধ্যে জরিপ করা, টেলিফোনে প্রশ্ন করা এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের একটি আলাদা জনগোষ্ঠী ধরে নেওয়া) থাকা সত্ত্বেও এর ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বৃৃদ্ধি পেয়েছে—এমন একপেশে ব্যাখ্যা দেওয়া শুরু করেন বিভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্লেষক। বিজয় আবহ ধরে রাখার জন্য, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে জনসমর্থনের ফাঁকি আড়াল করার জন্য, বৈধতার বাতাবরণকে টিকিয়ে রাখার জন্য তাই আওয়ামী লীগকে উপজেলা নির্বাচনে কিছু কারচুপি করতে হবে। দ্বিতীয় ধাপের উপজেলা নির্বাচনে তা হয়েছে। নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম এবং উন্নয়ন-সহযোগীরা এর যথেষ্ট সমালোচনা না করলে এবং সরকার তাতে একেবারেই কান না দিলে আগামী ধাপগুলোতে কারচুপি আরও বাড়তে পারে।
উপজেলা নির্বাচনের ফলাফল বা এটি কীভাবে হচ্ছে, তা তারপরও খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না আগামী নির্বাচনকেন্দ্রিক বিতর্ক নিরসনে। কারচুপি হোক আর না হোক, এসব নির্বাচনে হারলে আওয়ামী লীগ বলবে দলীয় সরকারের অধীনে ৫ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের নৈতিক বৈধতা এবং তা বিএনপির বর্জন করার অযৌক্তিকতা এতে আরও প্রতিষ্ঠিত হলো। নির্বাচনগুলো জিতলে তারা বলবে যে তাদের ৫ জানুয়ারির বিজয়ের বিশ্বাসযোগ্যতা এতে শক্তিশালীভাবে প্রমাণিত হলো। যাঁরা মনে করেন এই নির্বাচনের প্রতিকূল ফলাফল হলে বা কারচুপি হলে তা আওয়ামী লীগকে দ্রুত একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন দিতে প্রণোদিত করবে, আমি তাঁদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছি। প্রবল ও ব্যাপক গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে বাধ্য করা না হলে আওয়ামী লীগ এমন নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহণ করবে না। এর কারণ খুবই সহজ। আওয়ামী লীগ কোনোভাবেই ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকি গ্রহণ করতে পারে না।
৩.
প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ে অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এই নির্বাচনের ফলাফলে বিস্ময়কর কিছু আসলে ছিল না। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে, বিশেষ করে ২০১৩ সালের স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগ এভাবেই পরাজিত হয়েছিল। এই নির্বাচনগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলো প্রকাশ্যে প্রার্থী মনোনয়ন, বিদ্রোহী প্রার্থীকে প্রত্যাহারের চেষ্টা এবং প্রচারণায় অংশ নিয়েছিল। ফলে এতে শুধু প্রার্থী নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিও জনগণের সমর্থন কতটুকু, তা পরীক্ষা করার একটি পরিষ্কার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছিল। এসব নির্বাচনে প্রায় একতরফাভাবে বিএনপি-জামায়াত বিজয়ী হয়েছিল। নির্বাচনের ফলাফল একই সময়ে পরিচালিত কিছু দেশি-বিদেশি জনমত জরিপের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। ফলে এটি ধরে নেওয়ার কারণ ছিল যে জাতীয় নির্বাচন নিরপেক্ষভাবে হলে এবং তাতে বিএনপি-জামায়াত অংশ নিলে, তারা সুস্পষ্ট ব্যবধানে বিজয়ী হতো। এমন সম্ভাবনাও ছিল যে নির্বাচনের পর সংবিধান পরিবর্তন করার মতো দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিএনপি ও তার জোট বিজয়ী হতো।
আমার ধারণা, এই আশঙ্কাই যেনতেনভাবে একটি একতরফা নির্বাচন করতে সরকারকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এ ছাড়া জাতীয় নির্বাচনে পরাজিত হলে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় সব নেতাকে সত্য-অসত্য বিভিন্ন মামলায় ভোগান্তির শিকার হতে হতো, কাউকে কাউকে গণরোষের মধ্যে পড়তে হতো এবং দ্বিতীয় সারির দক্ষ সংগঠকদের গুম বা ক্রসফায়ারের বলি হতে হতো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর পরিবারকে নানাভাবে হেনস্তার শিকার হতে হতো। বিডিআর হত্যাকাণ্ড, শেয়ারবাজার, হল-মার্ক ও পদ্মা সেতুর মতো বিভিন্ন কেলেঙ্কারির বিচারের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন হেইট ক্যাম্পেইনও চালানো হতো। কেন এসব হতো, তার কারণও পরিষ্কার। জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী দল পাঁচ বছরের জন্য নির্মম অত্যাচারী এবং পরাজিত দল চরম অত্যাচারিত হবে—১৯৯০ সালের পর ধাপে ধাপে এটি বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। নির্বাচনে জেতা মানে পাঁচ বছরের জন্য লুট আর যথেচ্ছাচার করা, পরাজয় মানে বৈধ সুযোগ, জীবিকা, সম্পদ এমনকি জীবন হারানো—এটি প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতা ক্রমেই তীব্রতর করে তুলেছে এই দুটো দল ও তাদের রাজনৈতিক মিত্ররা। জাতীয় নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার ঝুঁকি তাই কোনো শাসক দল এবং তাদের আমলে বিভিন্নভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত মহলের পক্ষে কোনোভাবেই এখন আর নেওয়া সম্ভব না। ইউক্রেন, নেপাল বা থাইল্যান্ডে তা সম্ভব হলে হতে পারে, বাংলাদেশে নয়।
৪.
আমি জানি না নির্বাচনের ফলাফলের এ ধরনের বিকৃত প্রয়োগ আদৌ বন্ধ করা সম্ভব কি না এই দেশে। উন্নত গণতন্ত্রে বিরোধী দল ছায়া সরকারের মর্যাদা ও সম্মান ভোগ করে, পার্লামেন্টের ফ্লোর ও কমিটিতে সরকারকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করতে পারে, সেখানে বিচার বিভাগ, বিভিন্ন কমিশন এবং গণমাধ্যম বিরোধী দলকে সরকারের যেকোনো হয়রানি ও অত্যাচার থেকে রক্ষা করে। সর্বোপরি সেখানে বিরোধী দলগুলো সুষ্ঠু নির্বাচনের সুদৃঢ় নিশ্চয়তায় আস্থাশীল থাকতে পারে। এসবের কিছুই এখন নেই আর বাংলাদেশে। এমন একটি সময়ে উপজেলা নির্বাচনের ফলাফলে কারও কোনো বোধোদয়ের সম্ভাবনা নেই। এই নির্বাচনের প্রকৃত ফলাফল প্রতিষ্ঠিত হতে দিতেও সরকারের আগ্রহ থাকার কথা নয়। উপজেলা নির্বাচন বড়জোর রাজধানীর বাইরে বিরোধী দলের আন্দোলনের সামর্থ্য বৃদ্ধি করতে পারে বা সরকারের ওপর নৈতিক চাপ বাড়াতে পারে। কিন্তু সেই আন্দোলনে সরকারকে সর্বতোভাবে কোণঠাসা না করতে পারলে অচিরে আরেকটি জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাবনা খুব কম।
আমরা এমন আপ্তবাক্য শুনে বড় হয়েছি যে, পরাজয়ে ডরে না বীর! কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন বীর আর নেই। যত প্রশ্নবিদ্ধভাবে হোক নির্বাচনে জিততেই হবে তাদের। আফসোস হচ্ছে এমন বীরদের বন্দনা করার লোকের অভাব নেই এখন এ দেশে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments